১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে সংঘটিত জুলাই বিপ্লব প্রসঙ্গে বিপ্লবের নামকরণ, সার্থক প্রতিবাদ, জুলাই বিপ্লবের কারণ হিসেবে বুরবোঁ রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, শ্বেত সন্ত্রাস, মধ্যপন্থা নীতি বাতিল, ধর্মীয় উদ্যোগ, ক্ষতিপূরণ, জুলাই অর্ডিন্যান্স, ফরাসি বিপ্লবের পরিণতি, জুলাই বিপ্লবের ফলাফল হিসেবে স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস, ফরাসি বিপ্লবের পরিপূরক, বুর্জোয়াদের আধিপত্য, বুরবোঁ রাজবংশের পতন, ন্যায্য অধিকার নীতির অসারতা ও চিন্তার জগতে জাগরণ সম্পর্কে জানবো।
জুলাই বিপ্লব
ঐতিহাসিক ঘটনা | জুলাই বিপ্লব |
সময়কাল | ২৭-২৯ জুলাই ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ |
অন্য নাম | দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব |
স্থান | ফ্রান্স |
রাজা | দশম চার্লস |
ফলাফল | জুলাই রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা |
ভূমিকা:- ১৮৩০ সালে ফ্রান্স-এ সংঘটিত হয় জুলাই বিপ্লব। এই বিপ্লব ১৮৩০ সালের ২৭শে জুলাই থেকে ২৯শে জুলাই পর্যন্ত ৪ দিন স্থায়ী ছিল। এটি ১৮৩০ সালের ফরাসি বিপ্লব বা দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব নামেও পরিচিত।
জুলাই বিপ্লবের নামকরণ
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৭-২৯ জুলাই ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়। অর্থাৎ জুলাই মাসে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল বলে একে জুলাই বিপ্লব বলা হয়।
সার্থক প্রতিবাদ জুলাই বিপ্লব
ভিয়েনা সম্মেলন ও পরর্বতীকালে ইউরোপীয় শক্তি সমবায় ১৮১৫ থেকে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত যে সকল জাতীয়তা বিরোধী ও গণতন্ত্রবিরোধী নীতি গ্রহণ করেছিল জুলাই বিপ্লব ছিল সেগুলির বিরুদ্ধে প্রথম সার্থক প্রতিবাদ।
জুলাই বিপ্লবের কারণ
১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সম্রাট অষ্টাদশ লুইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই সম্রাট দশম চার্লস ( ১৮২৪-৩০ খ্রিঃ) ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন। তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল দশম চার্লসের বিরুদ্ধে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জুলাই বিপ্লব ঘটে। এই বিপ্লবের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন –
(১) স্বৈরাচারী বুরবোঁ রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা
ভিয়েনা ব্যবস্থায় গৃহীত ন্যায্য অধিকার নীতি অনুযায়ী ফ্রান্সের সিংহাসনে বুরবোঁ রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটে। অষ্টাদশ লুই সিংহাসনে বসলে (১৮১৪-২৪ খ্রি.) ফ্রান্স থেকে নির্বাসিত যাজক ও অভিজাতরা পুনরায় ফ্রান্সে ফিরে এসে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সাহায্য নিয়ে তাদের হারানাে সম্পত্তি ও অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য সচেষ্টা হয়ে ওঠে। এতে ফ্রান্সের অধিবাসীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রজাতন্ত্রীদের নেতৃত্বে তারা সংঘবদ্ধ হয়। ফলে পুনরায় বিপ্লবের পরিস্থিতি তৈরি হয়।
(২) শ্বেতসন্ত্রাস
উগ্র রাজতন্ত্রীরা নির্বাচনে জিতে আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তারা অষ্টাদশ লুইয়ের সমন্বয়ী নীতির তীব্র বিরােধিতা শুরু করে এবং শ্বেত সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিপ্লবী ভাবাদর্শে আস্থাশীল উদারপন্থীদের বিরুদ্ধে ত্রাস সৃষ্টি করে। ঐতিহাসিক জ্যাক ডুজের মতে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সমগ্র ফ্রান্স শ্বেত সন্ত্রাসের কাছে মাথা নত করে।
(৩) মধ্যপন্থা নীতি বাতিল
পূর্ববর্তী সম্রাট অষ্টাদশ লুইয়ের মধ্যপন্থা নীতি বাতিল করে দশম চার্লস ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও ক্যাথলিক গির্জার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করেন। বহু সাংবাদিককে কারারুদ্ধ করা হয়।
(৪) ধর্মীয় উদ্যোগ
দশম চার্লস ‘ধর্মবিরোধী আইন’ পাস করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর গির্জার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন। গির্জার বিরুদ্ধে সমালোচনার অধিকার কেড়ে নেন। জেসুইট নামক নির্বাসিত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেদের দেশে ফিরিয়ে এনে উচ্চ রাজপদে নিয়োগ করেন।
(৫) ক্ষতিপূরণ
বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের দেশত্যাগী অভিজাতদের জমি বাজেয়াপ্ত করে তা কৃষকদের বিতরণ করা হয়েছিল। দশম চার্লস ‘অ্যাক্ট অব জাস্টিস’ নামে এক আইন পাশ করে সেই বাজেয়াপ্ত জমি অভিজাতদের ফিরিয়ে দেবার উদ্যোগ গ্ৰহণ করেন।
(৬) জুলাই অর্ডিন্যান্স
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই দশম চার্লস জুলাই অর্ডিন্যান্স জারি করে নির্বাচিত আইনসভা ভেঙে দেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করেন, বুর্জোয়া শ্রেণির ভোটাধিকার কেড়ে নেন এবং অষ্টাদশ লুইয়ের আমলের সনদ বাতিল করেন।
জুলাই বিপ্লবের সূত্রপাত
দশম চার্লসের এই অর্ডিন্যান্স ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের সূত্রপাত হয়।
ফরাসি বিপ্লবের পরিণতি জুলাই বিপ্লব
নেপোলিয়ন -এর পতনের পরেও বিপ্লবের ভাবধারা ফ্রান্সে ছিল। শুধু মাত্র অনুকূল পরিবেশের জন্য অপেক্ষা করেছিল। ১৮৩০ সালে জুলাই বিপ্লব ছিল এক অর্থে ফরাসি বিপ্লব -এর পরিণতি মাত্র।
জুলাই বিপ্লবের ফলাফল
বিপ্লবের ব্যাপকতায় সম্রাট দশম চার্লসের পতন ঘটে এবং অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপ ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন। ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
(১) স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস
ঐতিহাসিক গর্ডন ক্রেইগ বলেছেন যে, দশম চার্লসের আমলে দেশে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা চালানো হয়েছিল তা জুলাই বিপ্লব ধ্বংস করে দেয়।
(২) ফরাসি বিপ্লবের পরিপুরক
জুলাই বিপ্লব অভিজাততন্ত্র, যাজকতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্র ধ্বংস করে ফ্রান্সে সাম্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রভৃতি গণতান্ত্রিক নীতিগুলি স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করে।
(৩) বুর্জোয়াদের আধিপত্য
জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে যাজক ও অভিজাতদের আধিপত্য ধ্বংস হলে বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁদের আমলে ফ্রান্সে শিল্প বিপ্লব-এর সূচনা হয়।
(৪) বুরবোঁ বংশের পতন
ফ্রান্সে স্বৈরাচারী বুরবোঁ বংশের শাসনের অবসান ঘটে এবং অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপ ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন। এই বংশের অধীনে ফ্রান্সে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
(৫) ন্যায্য অধিকার নীতির অসারতা
জুলাই বিপ্লব প্রমাণ করে যে, ন্যায্য অধিকারের ভিত্তিতে নয় , জনগণের প্রতিনিধি হিসেবেই রাজা সিংহাসন লাভের অধিকারী।
(৬) চিন্তাজগতে জাগরণ
জুলাই বিপ্লব একদিকে যেমন ফ্রান্সের শ্রমিক শ্রেণির চিন্তার জাগরণ ঘটায়, অন্যদিকে তেমনি ভিক্টর হুগো, জর্জ স্যান্ড, সাঁ সিমোঁ প্রমুখ তাদের রচনায় দেশের বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের দুর্দশার কাহিনি ফুটিয়ে তোলেন।
উপসংহার:- ঐতিহাসিক লিপসনের মতে, “জুলাই বিপ্লব ফ্রান্সের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করে।” এই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সের রাজবংশের পরিবর্তন ঘটে, জনসাধারণের লুপ্ত অধিকার ফিরে আসে। জুলাই বিপ্লব ফ্রান্সে এক নতুন ঊষার সূচনা করে।
(FAQ) জুলাই বিপ্লব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে।
দশম চার্লস।
অর্লিয়েন্স বংশের লুই ফিলিপ।
জুলাই বিপ্লব।