মুঘল সম্রাট শাহজাহানের কান্দাহার নীতি প্রসঙ্গে কান্দাহার হাত ছাড়া, পারস্যে বিরোধ, পারস্যের শাহের কান্দাহার জয়, ব্যর্থ অবরোধ অবরোধ পরিত্যাগ, দুর্গ অবরোধে ব্যর্থতা, ঔরঙ্গজেবের সুযোগ ভিক্ষা, দারাশিকোকে কান্দাহার অভিযানের দায়িত্ব প্রদান, দারাশিকোর ব্যর্থতা, কান্দাহার অভিযানের পরাজয়ের কারণ ও কান্দাহার নীতির ফলাফল সম্পর্কে জানবো।
মুঘল সম্রাট শাহজাহানের কান্দাহার নীতি
ঐতিহাসিক ঘটনা | শাহজাহানের কান্দাহার নীতি |
সম্রাট | শাহজাহান |
পারস্যের শাহ | দ্বিতীয় আব্বাস |
প্রথম অভিযান | ঔরঙ্গজেব |
দ্বিতীয় অভিযান | ঔরঙ্গজেব |
তৃতীয় অভিযান | দারাশিকো |
ফলাফল | ব্যর্থতা |
ভূমিকা :- কান্দাহার ছিল ভারত-এর উত্তর পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ভারত ও ইরাণের মধ্যে একটি সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ভারতের আত্মরক্ষার জন্য কান্দাহার হাতে রাখার প্রয়োজনীয়তা মুঘল সম্রাটরা বুঝতেন। পারস্যের শাহও কান্দাহার দখলে রাখার জন্যে চেষ্টা চালাতেন।
মোঘলদের কান্দাহার হাতছাড়া
মুঘল যুগে সম্রাট জাহাঙ্গীর-এর রাজত্বকালে কান্দাহার মুঘলদের হাতছাড়া হয়।
শাহজাহানের কান্দাহার অভিযানের সময় পারস্যে বিরোধ
মোঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল-এ কান্দাহারের পারসিক শাসনকর্তা আলি মর্দান খাঁর সঙ্গে পারস্যের দ্বিতীয় শাহ আব্বাসের বিরোধ দেখা দেয়। আলি মর্দান ছিলেন প্রয়াত শাহের পক্ষভুক্ত লোক। এজন্য নতুন শাহ তাকে সন্দেহ করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেন।
শাহজাহানের কান্দাহার দখল
পারস্যে বিরোধের সুযোগে শাহজাহান অর্থ দ্বারা আলি মর্দানকে নিজ পক্ষে এনে কান্দাহার অধিকার করেন। আলি মর্দানকে মুঘল সরকারের অধীনে উচ্চপদ দেওয়া হয়।
পারস্যের শাহের কান্দাহার জয়
শাহ দ্বিতীয় আব্বাস কান্দাহার হাত ছাড়া করতে প্রস্তুত ছিলেন না। ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে পারসিক বাহিনী কান্দাহার দুর্গ অবরোধ করলে অবরুদ্ধ মুঘল সেনা ৫৭ দিন আত্মরক্ষার পর আত্মসমর্পন করে। এর ফলে কান্দাহার শাহের অধিকারে চলে যায়।
কান্দাহারে ঔরঙ্গজেবের ব্যর্থ অবরোধ
সম্রাট শাহজাহান কান্দাহার পুনর্দখল করার উদ্দেশ্যে ঔরঙ্গজেব ও শাদুল্লা খাঁর নেতৃত্বে এক বাহিনী পাঠান। স্বয়ং শাহজাহান কাবুল থেকে অভিযান পরিচালনার ব্যবস্থা করেন। মুঘল বাহিনী ৩ মাস ২০ দিন কান্দাহার দুর্গ অবরোধ করে। কিন্তু পারসীক গোলন্দাজরা মুঘলের দুর্গ অধিকারের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।
ঔরঙ্গজেবের কান্দাহার দুর্গ অবরোধ পরিত্যাগ
আপাতত শীত এসে পড়ায় অবরোধ পরিত্যাগ করা হয়। এই বিফলতার ফলে ঔরঙ্গজেবের সামরিক খ্যাতি কিছুটা স্নান হয়।
কান্দাহার দুর্গ অবরোধে ঔরঙ্গজেবের ব্যর্থতা
শীতের পরে নতুন কামান বাহিনী নিয়ে ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে নতুন উদ্যমে ঔরঙ্গজেব কান্দাহারে দ্বিতীয় আক্রমণ ও অবরোধ চালান। কিন্তু মুঘল গোলন্দাজদের অপদার্থতার জন্য দুর্গের প্রাচীরে ফাটল তৈরি করা যায় নি। অপরদিকে পারসিকরা বৃষ্টির ধারার মত কামানের গোলা ছুঁড়তে থাকে। সাদুল্লা খাঁ সম্রাটকে জানান যে, এই আক্রমণের সফলতার সম্ভাবনা নেই।
ঔরঙ্গজেবের সুযোগ ভিক্ষা
এরপর ঔরঙ্গজেব পিতার কাছে কিছু সময় ভিক্ষা করেন এবং দরবারে তাঁর সামরিক মর্যাদা পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য আর একবার সুযোগ দিতে বলেন।
ঔরঙ্গজেবের উপর সম্রাটের আস্থা নষ্ট
পুত্র ঔরঙ্গজেবের যোগ্যতার ওপর সম্রাটের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। সম্রাট তাকে জানান যে, “আমি যদি বিশ্বাস করতে পারতাম যে তুমি কান্দাহার অধিকারে সক্ষম তবে তোমায় ফিরে আসার আদেশ দিতাম না। যারা জ্ঞানী তারা কারও পরামর্শের অপেক্ষা করে না।”
দারাশিকোর কান্দাহার অভিযানের দায়িত্ব প্রার্থনা
ঔরঙ্গজেবকে যথেষ্ট অপমানের মধ্যে কান্দাহার ছাড়তে হয়। দারাশিকো এই সময় তাঁর ভ্রাতা ঔরঙ্গজেবকে অপদস্থ করার জন্য সম্রাটকে কান্দাহার অভিযানের দায়িত্ব তার হাতে দিতে বলেন। দারা দেখাতে চান যে, ঔরঙ্গজেব যা পারেন না, তিনি তা করতে সক্ষম। এমন কি তিনি মুর্খের ন্যায় গর্ব করে বলেন যে এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি কান্দাহার জয় সম্পন্ন করবেন।
দারাশিকোকে কান্দাহার অভিযানের দায়িত্ব প্রদান
শাহজাহান নামার লেখক ইনায়েত খাঁর মতে, দারার প্রতি স্নেহে অন্ধ শাহজাহান শুধুমাত্র তাকে তৃতীয় কান্দাহার অভিযানের নেতৃত্ব দেন নি। তাঁর সাহায্যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সেনাদল, কামান ও সরঞ্জাম দেওয়া হয়। কোনো কিছুর অভাব রাখা হয় নি। খরচার জন্যে নগদ এক কোটি টাকা বরাদ্ধ করা হয়। তার সাহায্যের জন্য সুযোগ্য সেনাপতিদেরও নিয়োগ করা হয়।
কান্দাহারে দারাশিকোর ব্যর্থতা
দারা ৫ বার কান্দাহার দুর্গ আক্রমণ করে, পারসীক গোলার ঘায়ে পিছু হঠে আসেন। দরবারে আরাম ও অলসতায় অভ্যস্ত দারার পক্ষে এই কঠিন কাজ করা আদপেই সম্ভব ছিল না। ৭ মাস অজস্র অর্থ ও লোকবল ক্ষয় করে দারা রাজধানীতে ফিরে এলে পুত্র স্নেহে অন্ধ সম্রাট তাকে ভর্ৎসনা করতে ভুলে যান।
শাহজাহানের কান্দাহার অভিযানের ফলাফল
- (১) এর পর শাহজাহান কান্দাহার উদ্ধারের আশা পাকাপাকিভাবে ত্যাগ করেন। কান্দাহার দখলের জন্য তিনটি অভিযানে রাজকোষের মোট ১২ কোটি টাকা ব্যয় হয়, অসংখ্য সেনা, ঘোড়া ও সরঞ্জামের ক্ষয়ক্ষতি হয়।
- (২) মুঘল সম্রাটের সামরিক মর্যাদা নষ্ট হয়। যে মুঘল শক্তি বাবর ও আকবরের আমলে প্রতিবেশী দেশে ত্রাস ও সম্ভ্রম সৃষ্টি করেছিল তার মর্যাদা নষ্ট হয়ে যায়।
কান্দাহার ব্যর্থতার ফলে পারসিক আক্রমণের আতঙ্ক
মোঘলদের কান্দাহার হাতছাড়া হলে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত উন্মুক্ত হয়। এই পথে যে কোনো সময় বিদেশী আক্রমণকারী ভারতে ঢুকে পড়তে পারত। পারস্যের দিক থেকে এই পথে আক্রমণের আতঙ্ক এখন থেকে মুঘল শক্তিকে ব্যস্ত করে। ঔরঙ্গজেব এজন্য তাঁর গোটা রাজত্বকাল পারসিক আক্রমণের আতঙ্কে ভুগতেন।
কান্দাহার ব্যর্থতার ফলে সেনাপতিদের মনোবল নষ্ট
এই কান্দাহারে পরাজয়ের পর মুঘল সেনাপতিদের মনোবল এত ভেঙে যায় যে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব কোনো সেনাপতি সহসা নিতে চাইতেন না।
কান্দাহারে শাহজাহানের পরাজয়ের কারণ
কান্দাহার অভিযানে শাহজাহানের পরাজয়ের কারণগুলির মধ্যে ছিল –
- (১) পারসিক গোলন্দাজ বাহিনী ও কামানের শ্রেষ্ঠত্ব। তুলনামূলকভাবে মুঘল কামানগুলি ছিল সেকেলে ও অকেজো।
- (২) পারসিকরা কান্দাহার দুর্গকে তাদের আত্মরক্ষার কাজে সফলভাবে ব্যবহার করে। মুঘল সেনাকে খোলা জমিনে দাড়িয়ে পারসিক গোলা বৃষ্টির বিরুদ্ধে লড়তে হয়।
- (৩) মুঘল সেনার রসদ সুদূর কাবুল থেকে আনতে বহু কষ্ট করতে হত।
- (৪) মুঘল সম্রাট কান্দাহারে বিশাল সেনাদল না পাঠিয়ে ভাল গোলা-বারুদ ও গোলন্দাজ পাঠালে ভাল ফল পেতেন। কান্দাহারে এই বিশাল সেনার রসদ যোগাড় করা কঠিন ছিল।
উপসংহার :- ঔরঙ্গজেব দ্বিতীয় বার পরাজয়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কান্দাহারে তৃতীয় আক্রমণ হানতে চেয়েছিলেন। সম্রাট তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে অপদার্থ দারাকে পাঠিয়ে ভুল করেন।
(FAQ) মুঘল সম্রাট শাহজাহানের কান্দাহার নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ঔরঙ্গজেব ও শাদুল্লা খাঁ।
দারাশিকো।
ঔরঙ্গজেব।
দ্বিতীয় আব্বাস।