প্রথম সার্বভৌম নরপতি হিসাবে কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রভু ও ভৃত্য, নির্ভীকতা, সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা, শাসন সংস্কার, শিশু সুলতানির রক্ষা, সার্বভৌম মর্যাদা ও তার শাসন প্রকৃতি সম্পর্কে জানবো।
প্রথম সার্বভৌম নরপতি হিসাবে কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা
ঐতিহাসিক ঘটনা | প্রথম সার্বভৌম নরপতি হিসাবে কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা |
সুলতান | কুতুবউদ্দিন আইবক |
রাজধানী | দিল্লী |
রাজত্ব | ১২০৬-১২১০ খ্রি: |
উত্তরসূরি | আরাম শাহ |
ভূমিকা :- মধ্যযুগের তুর্কি নরপতিদের মধ্যে কুতুবউদ্দিন আইবক সুদক্ষ যোদ্ধা হিসাবে অগ্রগণ্য ছিলেন। নির্ভীকতা ও সাহসিকতাই তাঁকে দারিদ্র্য ও অন্ধকারময় জীবন থেকে ক্ষমতা ও মর্যাদার চরম শিখরে আরোহণ করতে সাহায্য করেছিল। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন আজন্ম সৈনিক।
প্রভু ও ভৃত্য
মহম্মদ ঘুরি ও কুতুবউদ্দিন আইবক দুজনেই দুজনের উপর অগাধ বিশ্বাস রেখেছিলেন। এই বিশ্বাসই তাঁদের উভয়ের উদ্দেশ্য, অর্থাৎ, তুর্কি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথকে সহজ করেছে। প্রভু ও ভৃত্যের পরস্পরের প্রতি এরূপ বিশ্বাস, ইতিহাসে একান্তই বিরল ঘটনা। প্রভুও ভৃত্যের সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে গেছেন। কুতুবউদ্দিন আইবক সেই বিশ্বাস ও আস্থার পুরস্কারস্বরূপ পেয়েছিলেন ভারতবর্ষের অধিকার।
কুতুবউদ্দিন আইবকের নির্ভিকতা
মিনহাজ-উস-সিরাজ কুতুবউদ্দিন আইবক সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “A high spirited and open hearted monarch.” তাঁর চরিত্রে তুর্কি জাতির নির্ভীকতা এবং পার্সিয়ান জাতির সুকুমার প্রকৃতির ও ঔদার্যের সমন্বয় ঘটেছিল। সমস্ত লেখকগণই তাঁর দানশীলতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং তাঁকে ‘Lakh bakhs’ বা ‘লক্ষ- দাতা’ আখ্যায় বিভূষিত করেছেন।
নিজামির মন্তব্য
হাসান নিজামি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ তাজ-উল-মাসির- এ কুতুবউদ্দিনের প্রশংসা করে বলেছেন, “He dispensed even handed justice to the people, and exerted himself to promote the peace and prosperity of the realm.” তিনি ছিলেন জনসাধারণের প্রতি ন্যায়বিচারকারী এবং সাম্রাজ্যের শান্তি ও সমৃদ্ধির সমুন্নতিতে নিজে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
মিনহাজের মন্তব্য
মিনহাজ বলেছেন, “Hindustan became full of friends and empty of cnemies.” কুতুবউদ্দিন আইবকের উদারনীতির জন্যই ভারতবর্ষ বন্ধুপূর্ণ এবং শত্রুশূন্য হয়েছিল।
সুলতানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা
আমাদের দেশ ভারতবর্ষ -এ সুলতানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কুতুবউদ্দিনের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর সাহায্য ছাড়া মহম্মদ ঘুরির পক্ষে উত্তর ভারত -এর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সুলতানি প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করা কখনোই সম্ভব হত না।
ইসলামের প্রতি কুতুবউদ্দিন আইবকের অনুরাগ
- (১) ইসলামের প্রতি তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। হাসান নিজামি তাই মন্তব্য করেছেন, “By his orders the precepts of Islam received great promulgation and Sun of righteousness cast its shadow on the countries of Hind from the heaven of God’s assistance.” তাঁর আদেশে ইসলাম ধর্ম এক মহান প্রচার প্রাপ্ত হয় এবং ভগবানের সদিচ্ছায় স্বর্গ থেকে ধর্মপ্রাণতার সূর্য হিন্দের দেশগুলির উপর তার ছায়া ফেলে।
- (২) এই উদ্দেশ্যে দিল্লিতে ও আজমিরে তিনি একটি করে মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি শিল্প ও সাহিত্যেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। হাসান নিজামি ও অন্যান্য পণ্ডিত তাঁর রাজসভা অলঙ্কৃত করেছিলেন। তাঁদের লিখিত গ্রন্থ তাঁরা কুতুবউদ্দিনকে উৎসর্গ করেছিলেন।
কুতুবউদ্দিন আইবকের শাসন সংস্কার
- (১) শাসন-সংস্কারে তিনি তেমন দক্ষতার পরিচয় দিতে না পারলেও তাঁর সাম্রাজ্যের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তিনি কিছু সংস্কার করেছিলেন। সংস্কারগুলির প্রকৃতি ছিল সম্পূর্ণ সামরিক। শাসনব্যবস্থার দায়িত্ব ছিল সেনাদের হাতে।
- (২) রাজস্বব্যবস্থা পূর্বের ন্যায় অক্ষুণ্ণ ছিল। প্রাদেশিক রাজধানী নগরগুলিতে মুসলমান উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, সেনাধ্যক্ষ ও কাজির সাহায্যে প্রদেশের শাসনকার্য চালাতেন। কুতুবউদ্দিন আইবকের শাসনব্যবস্থা ছিল নিঃসন্দেহে একটি জরুরিকালীন ব্যবস্থা।
শিশু সুলতানির রক্ষায় কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা
- (১) কুতুবউদ্দিনই ভারতবর্ষে সুলতানি শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেন। তাই ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ মন্তব্য করেছেন, “His ranks among the great pioneers of Muslim conquest in India.” ভারতবর্ষে মুসলিম অভিযানের মহান অগ্রদূতগণের মধ্যে তাঁর স্থান ছিল অন্যতম।
- (২) একদিকে তিনি তাঁর অধিকৃত অঞ্চলে বিদ্রোহ যাতে মাথাচাড়া না দেয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেছেন; আবার, অপরদিকে তিনি ভারতে ও ভারতের বাইরে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার চেষ্টা করেছেন।
- (৩) যাতে কোনোরকম বিদ্রোহ হয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য খণ্ড-বিখণ্ড না হয়ে যায়, সেদিকে তাঁর তীক্ষ্ণদৃষ্টি ছিল। এদিক দিয়ে বিচার করলে, তিনি দিল্লির শিশু সুলতানি সাম্রাজ্যকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তাকে রক্ষা করেছিলেন।
কুতুবউদ্দিন আইবকের সার্বভৌম মর্যাদা
- (১) অবশ্য ভারতবর্ষে কুতুবউদ্দিনকে সার্বভৌম নরপতির মর্যাদা দেওয়া যায় কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। যেমন –
- (১) ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেছেন, “Qutubuddin became the ruler of Hindustan and founded a dynasty of Kings, which is called after his name.” কুতুবউদ্দিন হিন্দুস্তানের শাসক হয়েছিলেন এবং একটি রাজবেশের প্রতিষ্ঠা করেন যা তাঁর নামে অভিহিত।
- (২) ড. কালীকিঙ্কর দত্ত কুতুবউদ্দিনকে বর্ণনা করেছেন, ‘The Indian Sultan’ বা ভারতীয় সুলতান বলে। কিন্তু অপরদিকে ড. শ্রীবাস্তব জোর দিয়ে বলেছেন, “He was the real founder of Turkish dominion in India and the first de-facto Sultan of the almost entire Hindustan.” তিনিই ভারতবর্ষে প্রথম তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং প্রায় সমগ্র হিন্দুস্তানের তিনিই ছিলেন প্রথম কার্যত সুলতান।
- (৩) আবার ড. ত্রিপাঠী বলেছেন, “It is however not correct to regard Qutubuddin as the sovereign ruler of Muslim India, or Delhi, as yet, the capital of the Indian Empire.” এটি যাইহোক, দিল্লি ভারতীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী হওয়া সত্ত্বেও কুতুবউদ্দিনকে মুসলিম-ভারতের সার্বভৌম শাসক বলে অভিহিত করা ঠিক হবে না।
- (৪) ড. হবিবুল্লাহর মতে, “Aibak was responsible for detailed planning and initiation of the Delhi State.” দিল্লি রাজ্যের বিস্তারিত পরিকল্পনা ও সূচনার জন্য আইবকই দায়ী ছিলেন।
- (৫) যদিও কুতুবউদ্দিন আইবক কোনো মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন কিনা, তা আজও প্রমাণিত হয়নি। এটাও সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়নি যে, সমস্ত মুসলমান উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী তাঁর প্রভুত্ব স্বীকার করেছিলেন কিনা।
- (৬) উপরন্তু, ইবন বতুতা তাঁকে দিল্লির প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম নরপতি হিসাবে স্বীকার করেননি। এমনকি, ফিরোজ শাহ তুঘলক শুক্রবারের “খুৎবায় দিল্লির পূর্ববর্তী সুলতানদের নাম উচ্চারণের যে তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন, তাতে কুতুবউদ্দিনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
- (৭) এই সমস্ত দিক থেকে বিচার করে Dr. R. P. Tripathy Some Aspects of Muslim Administration গ্রন্থে বলেছেন ভারতে দিল্লি সুলতানির সার্বভৌমত্বের ইতিহাস শুরু হয়েছে ইলতুৎমিস-এর সময় থেকে, কুতুবউদ্দিন আইবকের শাসনকাল থেকে তা শুরু হয়নি।
সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের শাসন প্রকৃতি
- (১) এই প্রসঙ্গে কুতুবউদ্দিনের শাসনকালের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন । বিশেষ করে, কুতুবউদ্দিনের শাসনকালে ভারতবর্ষে সুলতানি শাসনের প্রকৃতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই গজনির সার্বভৌম শাসক তাজউদ্দিন বারংবার ভারতের উপর প্রভুত্বের দাবি করে গেছেন।
- (২) স্বভাবতই এই প্রশ্ন উঠতে পারে, উত্তর ভারত তখন কি তুর্কি সার্বভৌমত্বের অধীনস্থ একটি মধ্য এশীয় সাম্রাজ্যের উপনিবেশমাত্র, নাকি স্বতন্ত্র সার্বভৌমত্বের অধীনস্থ হয়েছিল? কুতুবউদ্দিন আইবক কোনো স্বতন্ত্র শাসন-ব্যবস্থার কাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হননি। এটাই বাস্তব ঘটনা।
- (৩) তখন ভারতের রাজধানী একটিমাত্র ছিল না লাহোর এবং দিল্লি – দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সদর দপ্তর ছিল। কিন্তু আমাদের স্মরণে রাখতে হবে যে তাঁর স্বল্পকাল শাসনকালে এত কাজ করার মতো সময় তাঁর ছিল না।
কুতুবউদ্দিন আইবকের কৃতিত্ব
- (১) উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ থাকলেও, কুতুবউদ্দিন আইবকের শাসনকালকে ঐতিহাসিক দিক থেকে লঘু করে দেখা ঠিক নয়। ভারতবর্ষে দিল্লির শিশু সুলতানির প্রভুত্বকে বিস্তার করার জন্য তিনি সব সময় অকৃত্রিম সাহায্য করে গেছেন। ভারতবর্ষে সুলতানি আধিপত্যের ইতিহাসে, গজনির প্রভুত্ব থেকে ভারতবর্ষকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রতা দান করাই ছিল তাঁর মহান অবদান, যা আরও দুই শতাব্দী কাল টিকে ছিল।
- (২) তাঁর সবথেকে বড়ো কৃতিত্ব দিল্লিকে ভারতের প্রথম রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করা এবং ভারতবর্ষ থেকে বিদেশে অর্থ-নির্গমনের পথকে রুদ্ধ করে দিল্লির সুলতানি শাসনকে সার্বভৌম ক্ষমতা দান করে স্বাধীনভাবে চলার পথ উন্মুক্ত করা। তিনিই সর্বপ্রথম গজনির কর্তৃত্ব অস্বীকার করে দিল্লির স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
উপসংহার :- সমস্ত দিক বিচার-বিবেচনা করে ড. আর. পি. ত্রিপাঠী যথার্থই বলেছেন, “He paved the way for an independent Sultanate in India free from an outside interference.” বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত করে তিনি ভারতবর্ষে স্বাধীন সুলতানির এক নতুন পথ নির্মাণ করেছিলেন।
(FAQ) প্রথম সার্বভৌম নরপতি হিসাবে কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
কুতুবউদ্দিন আইবক।
কুতুবউদ্দিন আইবক।
কুতুবউদ্দিন আইবক।