নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা প্রসঙ্গে নদীমাতৃক সভ্যতা, নদী সভ্যতার বিকাশ, উদাহরণ, নদীমাতৃক সভ্যতার গড়ে ওঠার কারণ হিসেবে উর্বর কৃষি জমি, জল সেচের সুবিধা, পশুপালনের সুবিধা, পণ্য পরিবহণ ও যাতায়াতের সুবিধা, মাছ শিকার, অনুকুল আবহাওয়া, পানীয় জলের সুবিধা, অধিক নিরাপত্তা ও নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসের সুবিধা সম্পর্কে জানবো।
নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা
ঐতিহাসিক ঘটনা | নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা |
হরপ্পা সভ্যতা | সিন্ধু |
মিশরীয় সভ্যতা | নীলনদ |
মেসোপটেমিয়া সভ্যতা | ইউফ্রেটিস ও টাইগ্ৰিস |
ইজিয়ান সভ্যতা | ভূমধ্যসাগর |
চৈনিক সভ্যতা | হোয়াংহো ও ইয়াং সি কিয়াং |
ভূমিকা :- প্রথমদিকে আদিম মানুষ প্রকৃতির কোলে খোলা প্রান্তরে, বনেজঙ্গলে বাস করত। পরে ঝড়বৃষ্টি, তুষারপাত, শীত প্রভৃতির প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তারা পাহাড়ের গুহায়, গাছের কোটরে প্রভৃতি স্থানে আশ্রয় নেয়। এর বহুকাল পর তারা পশুপালন ও চাষবাস শেখে। এই সময় তারা যাযাবর জীবন ত্যাগ করে চাষবাস ও পশুপালনের সুবিধাযুক্ত অঞ্চলে ঘরবাড়ি তৈরি করে সেখানে জনবসতি গড়ে তোলে।
নদীমাতৃক সভ্যতা
আদিম মানুষ লক্ষ্য করেছিল যে, নদীর তীরে বসবাস করা তুলনামূলকভাবে বেশি সুবিধাজনক। এজন্য প্রাচীনকালে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে জনবসতির প্রসার ঘটে। পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের উদ্ভব ঘটেছিল জলে, আবার প্রাচীন সভ্যতাগুলিরও বিকাশ ঘটেছিল জলের কাছে অর্থাৎ নদী উপত্যকায়। নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা প্রাচীন সভ্যতাগুলিকে বলা হয় ‘নদীমাতৃক সভ্যতা’।
নদীমাতৃক সভ্যতার বিকাশ
আজ থেকে অন্তত ৭০০০ বছর পূর্বে নদীমাতৃক সভ্যতাগুলির বিকাশ শুরু হয়েছিল।
নদীমাতৃক সভ্যতার উদাহরণ
প্রাচীন বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সভ্যতাগুলির অধিকাংশ বিভিন্ন নদী অববাহিকা অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল। এগুলির মধ্যে সিন্ধুনদের তীরে হরপ্পা সভ্যতা, নীল নদের তীরে মিশরীয় সভ্যতা, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর তীরে মেসোপটেমীয় বা সুমেরীয় সভ্যতা ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, ভূমধ্যসাগরের তীরে ইজিয়ান সভ্যতা, ইয়াং-সি কিয়াং ও হোয়াংহো নদী তীরে চৈনিক সভ্যতা প্রভৃতি অন্যতম।
নদীমাতৃক সভ্যতা গড়ে ওঠার কারণ
প্রাচীন কালে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় নদীমাতৃক সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন –
(১) উর্বর কৃষিজমি
আদিম মানুষ লক্ষ্য করেছিল যে, নদীতে প্লাবনের ফলে নদীর দুকূল ছাপিয়ে যখন বন্যার জল উপত্যকা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তখন উপকূল অঞ্চলে নদীর পলিমাটি সঞ্চিত হয়। এই পলিমাটি সমৃদ্ধ জমি খুবই উর্বর এবং এই জমিতে তুলনামূলকভাবে বেশি ফসল উৎপাদিত হয়।
(২) জলসেচের সুবিধা
নদীর উপকূল অঞ্চলে চাষবাস করলে জলসেচের সুবিধা পাওয়া যায়। নদীতে বাঁধ দিয়ে এবং সেখান থেকে খাল কেটে কৃষিজমিতে জলসেচ করা সম্ভব হয়। জলসেচের ফলে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। কৃষি উৎপাদনের সুবিধার্থে আদিম মানুষ দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন নদীর উপত্যকা অঞ্চলে বসতি গড়ে তুলেছিল।
(৩) পশুপালনের সুবিধা
নদী, হ্রদ বা দীঘির তীরবর্তী অঞ্চল যথেষ্ট উর্বর হওয়ায় এবং সেখানে জলের সরবরাহ থাকায় জলাশয় সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তৃণভূমির প্রসার ঘটত। এই তৃণভূমি আদিম মানুষের পশুপালনের পক্ষে বিশেষ সহায়ক হত। কারণ, মানুষের গৃহপালিত পশুর অধিকাংশই হত তৃণভোজী। মানুষ নদী উপতাকা বা হ্রদের নিকটবর্তী বিস্তৃত তৃণভূমি অঞ্চলে পশুচারণ করতে পারত। পশুপালনের ক্ষেত্রে নদী বা হ্রদের তীরে বসবাস করাই আদিম মানুষের পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক ছিল।
(৪) পণ্য পরিবহণ ও যাতায়াতের সুবিধা
প্রাচীন কালে স্থলপথে দূরদূরান্তে যাতায়াত বা পণ্য পরিবহণের বিশেষ সুযোগসুবিধা ছিল না। নদীর তীরে বসবাস করলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহণের বিশেষ সুবিধা হয়। এই বিষয়টি আদিম মানুষ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিল। কৃষিকাজ শুরু করার পর উৎপাদিত শস্য ও অন্যান্য পণ্য দূরাদূরান্তে পাঠানোর জন্য নদীপথই ছিল সবচেয়ে উপযোগী।
(৫) মাছ শিকার
আদিম মানুষ যখন যাযাবর জীবন ছেড়ে কৃষিকাজে নিযুক্ত হল তখন শিকার করে মাংস সংগ্রহের পরিমাণ কমতে শুরু করল। কিন্তু নদীর তীরে বসবাস করে মানুষ তা পুষিয়ে নিতে পারল মাছ ধরে। নদী ও হ্রদে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। মানুষ তখনকার অনুন্নত হাতিয়ার ব্যবহার করেই নদী থেকে প্রচুর মাছ ধরত। উৎপাদিত খাদ্যশস্য এবং নদীর মাছ ধরার ফলে তখনকার মানুষের খাদ্যের কোনো অভাব হত না।
(৬) অধিক নিরাপত্তা
আদিম যুগে শিকার, সম্পদ সংগ্রহ ও অন্যান্য কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ বাধত। তাই প্রতিটি জনগোষ্ঠীর কাছে নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মানুষ উপলব্ধি করেছিল যে, জলভাগহীন বিস্তীর্ণ স্থলভাগে বসবাস করলে যখন তখন অন্য গোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু নদীর জলরাশি অতিক্রম করে সহসা এরূপ আক্রমণ সম্ভব নয়। তাই প্রাকৃতিক নিরাপত্তার কারণেও মানুষ নদীর তীরে বসবাস করত।
(৭) অনুকূল আবহাওয়া
নদী বা বড়ো জলাশয়ের ধারে আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে আরামদায়ক হয়। জলরাশি থেকে দূরবর্তী স্থানে গ্রীষ্মকালে বেশি গরম এবং শীতকালে বেশি শীত অনুভূত হয়। কিন্তু জলাশয়ের নিকটবর্তী অঞ্চলে আবহাওয়া সেই তুলনায় নাতিশীতোয় হয়। এজন্য নদী বা বড়ো হ্রদের উপকূলে প্রাচীন মানুষ তাদের বসতি গড়ে তুলতে চাইত।
(৮) পানীয় জলের সুবিধা
আদিম মানুষের কাছে পানীয় জলের একমাত্র উৎস ছিল নদীনালা বা হ্রদের জল। পানীয় জল প্রাপ্তির সুবিধার কারণে আদিম মানুষ নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে।
নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসের সুবিধা
আদিম মানুষ নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করার ফলে বিভিন্ন সুবিধা লাভ করেছিল। যেমন –
(১) অবসর যাপন
নদী উপত্যকার উর্বর জমিতে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হওয়ায় মানুষের খাদ্যের অনিশ্চয়তা দূর হয়েছিল। বরং নদী-উপত্যকায় উদ্বৃত্ত ফসল উৎপাদন সম্ভব হয়েছিল। এর ফলে মানুষ খাদ্যসংগ্রহের জন্য অধিকাংশ সময় ব্যয় করার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে অবসর যাপনের সুযোগ পায়।
(২) শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ
এই অবসরকালে আদিম মানুষ বিভিন্ন শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে পেরেছিল। এর ফলে মৃৎশিল্প, বয়নশিল্প, দারুশিল্প, হাতিয়ার তৈরির প্রযুক্তি প্রভৃতির বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। এই সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে মানবসমাজে স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সংগীতচর্চা, নৃত্যচর্চা, ধাতুবিদ্যা, বিজ্ঞান, খেলাধূলো, শরীরচর্চা প্রভৃতির বিকাশ ঘটেছিল।
উপসংহার :- নব্য প্রস্তর যুগ-এ কৃষি কাজ শুরু হলে মানুষ স্থায়ী বসতি স্থাপনের চাহিদা অনুভব করে। আর নদী তীরবর্তী অঞ্চল ছিল স্থায়ী বসতির গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
(FAQ) নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
৭০০০ বছর পূর্বে।
মেহেরগড় সভ্যতা।
সিন্ধু।
ইউফ্রেটিস ও টাইগ্ৰিস।