ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি

ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি প্রসঙ্গে জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগ, নেহেরু পরবর্তী উদ্যোগ, উদারীকরণ নীতির সংজ্ঞা, উদারীকরণ নীতি গ্রহণের কারণ, ভারতের উদারীকরণ কর্মসূচি, ভারতের উদারীকরণে সাফল্য ও তা চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব সম্পর্কে জানবো।

ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি

ঐতিহাসিক ঘটনাভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি
সময়কাল১৯৯১ খ্রি
প্রধানমন্ত্রীপি ভি নরসিমা রাও
অর্থমন্ত্রীমনমোহন সিং
জি ডি পি বৃদ্ধি৯ শতাংশ
ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি

ভূমিকা :- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর ছিলেন। সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ চালু করতে গিয়ে সরকারকে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনুদার নীতি ও ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে অনেকে লাইসেন্স রাজ’ বলে উপহাস করতেন।

নেহুরুর উদ্যোগ

স্বাধীন ভারত-এর প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এইসব পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম ছিল জাতীয়করণ ধনীদের আয় ও সম্পদের উপর কর আরোপ প্রভৃতি।

জওহরলাল নেহেরু পরবর্তী উদ্যোগ

১৯৭০-এর দশকের শেষদিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই (১৯৭৭-১৯৭৯ খ্রি.) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল পণ্যমূল্য হ্রাস, ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসারে উদ্যোগ প্রভৃতি। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে রাজীব গান্ধি (১৯৮৪-১৯৮৯ খ্রি.) প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভারতের অর্থনীতিতে কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে শেষপর্যন্ত তাকে এই সংস্কার কর্মসূচি থেকে পিছিয়ে আসতে হয়।

উদারীকরণ নীতির সংজ্ঞা

১৯৯০-এর দশকে ভারতে কংগ্রেস সরকারের শাসনকালে দেশের অর্থনীতি প্রবল সংকটের মুখে পড়ে। এই সংকটকালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি.ভি. নরসিমা রাও (১৯৯১-১৯৯৬ খ্রি.) এবং অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহ ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এই কর্মসূচি সাধারণভাবে অর্থনৈতিক উদারীকরণ’ নামে পরিচিত।

সরকারের উদারীকরণ নীতি গ্রহণের কারণ

ভারত সরকারের উদারীকরণ নীতি গ্রহণের কারণ গুলি হল –

(১) অর্থনীতিতে আঘাত

১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ-সহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক ঘটনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকেই কমবেশি আঘাত করে। ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের ফলে পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। এই আঘাতে ভারতের অর্থনীতি সংকটে পড়ে।

(২) ভারত সরকারের ঋণ গ্রহণ

প্রসঙ্গত ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে নরসিমা রাও সরকার আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল।

(৩) বাণিজ্য ঘাটতি

১৯৯০-৯১ সালে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৬০০ কোটি ডলার। এই আঘাতে বোধ হয় সবচেয়ে বেশি সংকটজনক অবস্থার সম্মুখীন হয় ভারতের অর্থনীতি।

(৪) ১৯৯০ এর সংকটজনক পরিস্থিতি

উপসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধজনিত কারণে সেখানে কর্মরত প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার ভারতীয় শ্রমিককে ভারত সরকার নিজের অর্থব্যয়ে দেশে ফিরিয়ে আনে। এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকদের মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ ভারতে আসত তা বন্ধ হয়ে যায়। এই সংকট জনক পরিস্থিতিতে ১৯৯০-এ ভারতের অর্থনীতি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

(৫) দেউলিয়া রাষ্ট্র

অবশেষে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ভারতকে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে দেউলিয়া রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করে। তাই ভারত সরকার দেশের অর্থনৈতিক সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক উদারীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে।

ভারতের উদারীকরণ কর্মসূচি

স্বাধীন ভারতের অর্থনীতির এই সংকটকালে প্রধানমন্ত্রী পি.ভি. নরসিমা রাও (শাসনকাল ১৯৯১-১৯৯৬ খ্রি.) এবং অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহ ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে ড. মনমোহন সিংহ ভারতের প্রধানমন্ত্রী (শাসনকাল ২০০৪-২০১৪ খ্রি.) হিসেবেও এই সংস্কার কর্মসূচি চালিয়ে যান। এই কর্মসূচির মাধ্যমে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যেমন –

  • (১) শুল্ক এবং সুদের হার হ্রাস করা হয়।
  • (২) বিভিন্ন একচেটিয়া সরকারি অর্থনৈতিক কাজকর্মের অবসান ঘটানো হয়।
  • (৩) ভারতীয় অর্থনীতিতে সরাসরি আন্তর্জাতিক পুঁজি ও বিনিয়োগের বাজারকে খুলে দেওয়া হয়।
  • (৪) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করা হয় এবং বৃহৎ ভোগ্যপণ্য শিল্পে লাইসেন্স প্রথার বিলোপ।
  • (৫) অর্থনীতিতে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ দেওয়া হয়, এবং বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রির অনুমতি দান।
  • (৬) করব্যবস্থায় সংস্কার সাধন করা হয়।
  • (৭) মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
  • (৮) আণবিক ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ক্ষেত্র ব্যতীত অন্যান্য সব উৎপাদনেই বিদেশি পুঁজির অবাধ বিনিয়োগের সুযোগ সুবিধা প্রদান।

ভারতের উদারীকরণ কর্মসূচির সাফল্য

১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করার ফলে দেশের ওপর এর সদর্থক প্রভাব পড়ে। যেমন  –

(১) বাজার অর্থনীতি

উদারীকরণের ফলে ভারতে মুক্ত বাজার অর্থনীতি গড়ে ওঠে।

(২) জি ডি পি বৃদ্ধি

অর্থনীতিতে উদারীকরণের সুফল উপলব্ধি করা যায় সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ জিডিপি হার বৃদ্ধিতে।

(৩) দারিদ্র্য হ্রাস

দেশের দারিদ্র্যের হার যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পায়। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের হিসেব অনুসারে, ভারতের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ অতি দারিদ্র্য অবস্থার কবল থেকে মুক্ত হয়।

(৪) জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন

নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটে, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পায় এবং খাদ্য সুরক্ষা অর্জিত হয়। অবশ্য এই উদারীকরণের ফলে গ্রামীণ বাসিন্দাদের তুলনায় শহরের বাসিন্দারা বেশি উপকৃত হয়

(৫) অর্থনৈতিক বৃদ্ধি

দ্রুততর অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারে বিশ্বে চিন প্রথম এবং ভারত দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।

উদারীকরণ চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব

অর্থনৈতিক উদারীকরণের সুফল পাওয়ার পর ভারত সরকার ও সরকারের সহযোগীরা এই উদারনীতি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করেন।

ম্যাককিনসের মন্তব্য

বিশেষজ্ঞ ম্যাককিনসের মতে, ভারতীয় অর্থনীতির প্রধান বাধাগুলি দূর করা সম্ভব হলে চিন-এর মতো ভারতের অর্থনীতিও বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

উপসংহার :- প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির প্রভাব ও অন্যান্য কারণে মার্কিন ডলারের তুলনায় ভারতের টাকার মূল্য অনেকটাই হ্রাস পায়। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে, একবিংশ শতকের মধ্যে ভারত বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক মহাশক্তিতে পরিণত হবে এবং বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

(FAQ) ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভারতের কোন প্রধানমন্ত্রীর আমলে অর্থনীতিতে উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করা হয়?

পি ভি নরসিমা রাও।

২. ভারতের কোন অর্থমন্ত্রী উদারীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করেন?

ডক্টর মনমোহন সিং।

৩. ভারতীয় উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করা হয় কখন?

১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে।

৪. ভারতে অর্থনৈতিক উদারীকরণের ফলে জিডিপির হার কত বৃদ্ধি পায়?

৯ শতাংশ।

Leave a Comment