সুলতানি যুগের রাজস্ব ব্যবস্থা

সুলতানি যুগের রাজস্ব ব্যবস্থা প্রসঙ্গে পাঁচ ধরনের কর, বাণিজ্য শুল্ক, খালিসা জমি, জমি জরিপ, খুৎ ও মুকাদ্দম, খলজি যুগে খালিসা জমির রাজস্ব, গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের ভূমি রাজস্ব নীতি, মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজস্ব নীতি, ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজস্ব নীতি, সুলতানি ভূমি-রাজস্ব নীতির সমালোচনা, ভূমি স্বত্ব ও ইক্তা প্রথা সম্পর্কে জানবো।

সুলতানি যুগের রাজস্ব ব্যবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনাসুলতানি যুগের রাজস্ব ব্যবস্থা
কর সংখ্যাপাঁচটি
জিজিয়াধর্মকর
খামসলুন্ঠিত দ্রব্যের কর
ইক্তা প্রচলনইলতুৎমিস
সুলতানি যুগের রাজস্ব ব্যবস্থা

ভূমিকা :- সুন্নী ধর্মশাস্ত্রে হানাফি নামে একটি বিশেষ মতবাদ আছে। সুলতানি শাসন ও রাজস্বনীতি এই হানাফি মত অনুসারে পরিচালিত হত।

সুলতানি যুগে পাঁচ ধরনের কর

শরিয়ত অনুসারে সুলতান সাধারণত ৫ রকমের কর আদায় করতেন। যথা –

(১) উসর

উসর বা মুসলিমদের প্রদত্ত ভূমি কর। স্বাভাবিকভাবে সেচযুক্ত জমিতে এই করের হার ছিল ফসলের ১/১০ ভাগ।

(২) খরাজ

খরাজ বা অ-মুসলিমদের প্রদেয় ভূমি-রাজস্ব। ইসলামীয় আইন অনুসারে ১/১০ থেকে ১/২ পর্যন্ত ভূমিকর সুলতান আদায় করতে পারতেন। মুসলিম আইনে খরাজ কেবলমাত্র অমুসলিমদের প্রদেয় হলেও দিল্লী সুলতানির আমলে মুসলিম, অমুসলিম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই এই কর দিত। আইনত খরাজের হার ফসলের ১/১০ ভাগ হলেও তা ১/২ ভাগ পর্যন্ত আদায় করা হত।

(৩) জিজিয়া

জিজিয়া ছিল অ-মুসলিমদের প্রদেয় কর। জিজিয়াকে কোনো কোনো ঐতিহাসিক অ-মুসলিমদের ওপর বৈষম্যমূলক কর রূপে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু সাধারণত অ-মুসলিমদের সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি ও অন্যান্য অধিকার ভোগের জন্য এই জিজিয়া কর ধার্য করা হত। জিজিয়ার হার ছিল ধনীদের ক্ষেত্রে মাথা পিছু ৪৮ দিরহাম, মধ্যবিত্তদের জন্য মাথাপিছু ২৪ দিরহাম, দরিদ্রশ্রেণীর জন্য ১২ দিরহাম। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, নিরক্ষর, উন্মাদ, ক্রীতদাস ও সম্পত্তিহীন লোকেরা জিজিয়া মুক্ত ছিল।

(৪) জাকাৎ

জাকাৎ ছিল মুসলিমদের প্রদেয় ধর্মকর। সাধারণত আয়ের আড়াই ভাগ জাকাত হিসেবে দিতে হত। জাকাৎ ছিল স্বেচ্ছা কর। এই কর বলপূর্বক আদায় ছিল অবৈধ।

(৫) খামস

খামস ছিল যুদ্ধের সময় লুঠ করা সম্পত্তির ভাগ। আইনত রাষ্ট্র এর ১/৫ ভাগ পেত। আলাউদ্দিন খলজিমহম্মদ বিন তুঘলক অবশ্য খামসের ৩/৪ ভাগ রাজস্ব হিসেবে নিতেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক শরিয়ত সম্মতভাবে খামসের ভাগ নিতেন।

সুলতানি যুগে বাণিজ্য শুল্ক

দিল্লী সুলতানরা সাধারণত এই পাঁচ রকম কর আদায় করলেও, এছাড়া বাণিজ্য শুল্ক হিন্দুদের কাছ থেকে শতকরা ৫ ভাগ এবং মুসলিমদের কাছ থেকে শতকরা আড়াই ভাগ আদায় করতেন। শরিয়তী নির্দিষ্ট পাঁচটি করের মধ্যে খরাজ বা ভূমি করই ছিল প্রধান।

দিল্লির সুলতানি যুগে খালিসা জমি

সুলতানি রাজস্ব বিভাগে ছিল খালিসা জমি বা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে খাস জমি। এই জমির বন্দোবস্ত সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের উজীরের দপ্তর থেকে করা হত।

সুলতানি যুগে জমি জরিপ

দিল্লির সুলতানি আমলে ভূমিস্বত্ব করা হত না। যদিও জরিপ দ্বারা ফসলের উৎপাদন জেনে নিয়ে, সেইমত ফসলের ভাগ সরকারের প্রাপ্য ছিল। কিন্তু এত বড় সাম্রাজ্যে জরিপ সম্ভব ছিল না। এজন্য কৃষকের কাছ থেকে থোকে অর্থ রাজস্ব হিসেবে সাধারণত আদায় করা হত।

দিল্লির সুলতানি যুগে খুৎ ও মুকাদ্দম

খুৎ, মুকাদ্দমরা যে রাজস্ব আদায় করত তার থেকে তাদের নানকর বা কমিশন নিয়ে তারা বাকি অর্থ সরকারে জমা দিতে বাধ্য ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে খুৎ ও মুকাদ্দমরা আদায়ীকৃত রাজস্বের বেশীর ভাগ হাতে রাখত।

সুলতানি যুগে আমির

আমিল নামে কর্মচারীরা খুৎ, মুকাদ্দমদের কাছ থেকে রাজস্বের হিসেব নিত এবং রাজস্ব আদায় করত। অনেক সময় খালিসা জমি খু্ৎ, মুকাদ্দমদের থেকে রাজস্বের পরিবর্তে ইজারা বন্দোবস্ত দেওয়া হত।

খলজি যুগে খালিসা জমির রাজস্ব

  • (১) খালিসা জমি থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হারে রাজস্ব আদায় করা হত। শরিয়তী আইন অনুসারে ফসলের ১/১০ থেকে ১/২ ভাগ পর্যন্ত সরকার দাবী করতে পারত। কার্যত ১/৫ থেকে ১/৩ ভাগ আদায় হত।
  • (২) আলাউদ্দিন সিংহাসনে বসার পর ভূমি-রাজস্বের হার বাড়িয়ে ১/২ ভাগ করে দেন। তিনি ভূমি কর ছাড়া চরাই বা গোচারণ কর, ঘর বা গৃহকর আদায় করতেন। তিনি জমি জরিপ করে ফসলের পরিমাণের ওপর জমি অনুপাতে কর ধার্যের নিয়ম করেন। আলাউদ্দিনের আদেশ অত্যন্ত কঠোরভাবে প্রযুক্ত হয়। কারণ তাঁর লক্ষ্য ছিল খুৎ বা মুকাদ্দমদের হাতে বাড়তি অর্থ জমা না রাখা।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের ভূমি রাজস্ব নীতি

সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক, আলাউদ্দিনের কঠোর রাজস্ব নীতিকে কিছুটা নমনীয় করেন। তিনি খুৎ, মুকাদ্দম প্রমুখকে ভূমি কর ও অন্যান্য কর প্রদান থেকে অব্যাহতি দেন। তিনি জমি জরিপের নীতি ত্যাগ করে অনুমানের ভিত্তিতে রাজস্ব ধার্য করার ব্যবস্থা করেন।

মহম্মদ বিন তুঘলকের ভূমি রাজস্ব নীতি

সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক দোয়াব অঞ্চলে ৫-২০ গুণ রাজস্ব বাড়াবার চেষ্টা করেন। কিন্তু দোয়াবে দুর্ভিক্ষের দরুন তাঁর প্রচেষ্টা সফল হয় নি। তবে তাঁর আমল পর্যন্ত ১/২ ভাগ ভূমি-রাজস্বের হার চালু থাকে। তিনি কৃষির উন্নতির জন্য আমীর-ই-কোহি নামে দপ্তর স্থাপন করেন।

ফিরোজ তুঘলকের রাজস্ব নীতি

ফিরোজ শাহ তুঘলক সিংহাসনে বসার পর খালিসা জমিতে ভূমিকরের পরিমাণ হ্রাস করেন। তিনি চব্বিশ রকম কর লোপ করেন। এছাড়া কৃষকদের প্রদত্ত তাকাভি ঋণ তিনি মুকুব করেন। তিনি পাঁচটি প্রধান সেচ খাল খনন করে সেচের উন্নতি করেন। বহু ফলের বাগান স্থাপন করেন। কৃষকদেরও উন্নতভাবে কৃষিকার্য করার জন্য তিনি উৎসাহ দেন। তিনি সেচের জন্য সেচকর ফসলের ১/১০ অংশ আদায় করতেন।

সুলতানি ভূমি-রাজস্ব নীতির সমালোচনা

এই ভাবে দিল্লী সুলতানরা খালিসা জমি থেকে তাদের ভূমি-রাজস্ব বা খরাজ ও উসর আদায় করতেন। খালিসা জমিতে সুলতানদের রাজস্ব নীতির কয়েকটি ত্রুটি ছিল‌। যেমন –

  • (১) আলাউদ্দিন ও মহম্মদ ছাড়া অপর কোন সুলতান জমি জরিপ করে রাজস্ব ধার্য করার চেষ্টা করেন নি। এর ফলে সরকারের আয় কম হত।
  • (২) জমি খুৎ, মুকাদ্দম প্রমুখকে ইজারা দেওয়ার ফলে সরকারের আয় কমে যেত। জমি থেকে যা আদায় হত তার সামান্য অংশ সরকার পেত।
  • (৩) আলাউদ্দিন ও মহম্মদ ছাড়া অন্য সুলতানরা কর্মচারীদের নগদ বেতনের পরিবর্তে খালিসা জমি জাগীর হিসেবে দিতেন। এর ফলে খালিসা জমির পরিমাণ কমে যায়। জাগীরগুলি বংশানুক্রমিক হলে খালিসা জমি স্থায়ীভাবে হাত ছাড়া হয়। লোদী শাসনের সময় খালিসা জমির প্রায় কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।

সুলতানি যুগে ভূমিস্বত্ব

  • (১) এর পর সুলতানি আমলে ভূমি স্বত্বের কথা আলোচ্য। ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, “সুলতানি যুগে সামন্ততান্ত্রিক প্রথার কারণে কৃষি জমিকে সুলতানের নিজস্ব খালিসা জমি বলে গণ্য করা হত”।
  • (২) ডঃ পি. শরণ স্মিথের এই মত খণ্ডন করেছেন। তিনি বলেন যে, সুলতান তত্ত্বগতভাবে সমগ্ৰ ভূসম্পত্তির অধিপতি হলেও, তার প্রাপ্য ভূমি কর প্রদান করে কৃষক জমিতে কৃষি স্বত্ব পেত। কৃষককে জমি থেকে উচ্ছেদের কথা ভাবা হত না।
  • (৩) তবে কৃষক জমির উচ্চ সত্ত্বেও একাংশ সুলতানকে দিতে বাধ্য ছিল। কোনো খালিসা জমি জাগীর বা ওয়াকফ হিসেবে দেওয়া হলেও কৃষককে সেই জমি থেকে জাগীরদার উচ্ছেদ করতে পারত না।

দিল্লির সুলতানি যুগে ইক্তা প্রথা

সুলতানি রাজস্বের অপর সূত্র ছিল ইক্তা হতে আয়। মাকতি নামে কর্মচারীরা ছিল ইক্তার শাসনকর্তা। ইক্তার খরচপত্র মিটিয়ে যে উদ্বৃত্ত থাকত তা মাকতি কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিত।

ইক্তা প্রথার ত্রুটি

ইক্তার রাজস্ব আদায়ের হার ও দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে মাকতির হাতে থাকত। এর ফলে মাকতি সাধারণতঃষ রাজস্ব আদায় ঘাটতি দেখাতে চেষ্টা করত। এজন্য খোওজা নামক কর্মচারী নিয়োগ করে ইক্তার হিসেবপত্র পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। যাতে খোওজা ও মাকতি জোটবদ্ধ হয়ে দুর্নীতি না করে এজন্য গোয়েন্দাদের সাহায্য নেওয়া হত।

সুলতানি যুগে পেশকাশী রাজাদের কর

হিন্দু রাজাদের দ্বারা শাসিত রাজ্য হতেও সুলতান কিছু রাজস্ব পেতেন। এই সকল রাজা বা জমিদার স্বায়ত্ত শাসন ভোগ করত। এর বিনিময়ে তারা প্রতি বছর সুলতানকে নিয়মিত কর বা নজরানা দিতে বাধ্য থাকত।

সুলতানি যুগে ইনামী ও ওয়াকফ জমি

যে সকল খালিসা জমি মুসলিম উলেমা বা মালিকদের ইনাম বা ওয়াকফ হিসেবে দেওয়া হত, তার আয় সুলতান সাধারণত পেতেন না। কিন্তু আলাউদ্দিন খলজি এই সকল ইনাম বা ওয়াকফের জমি বাজেয়াপ্ত করে খালিসা জমিতে পরিণত করে রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি করেন।

উপসংহার :- সুলতানি সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল যুদ্ধের মাধ্যমে এবং তার স্থায়িত্ব নির্ভরশীল ছিল সামরিক ভূমিকার উপর। তাই সুলতানি আমলে প্রশাসনের প্রচুর অর্থ ব্যবহৃত হতো। স্বভাবতই সুলতানি পর্বে সরকারি আয়ের মূল উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব ও ব্যক্তিগত কিছু কর।

(FAQ) সুলতানি যুগের রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. শরিয়ত অনুসারে সুলতান কয় প্রকার কর আদায় করতেন?

পাঁচ ধরনের কর।

২. অমুসলিমদের প্রদত্ত ভূমি রাজস্ব কর কি নামে পরিচিত?

খরাজ।

৩. মুসলিমদের প্রদত্ত ভূমি রাজস্ব কি নামে পরিচিত?

উসর।

৪. ইক্তা প্রথা চালু করেন কে?

ইলতুৎমিস।

Leave a Comment