রামতনু লাহিড়ী

উনবিংশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন রামতনু লাহিড়ী (১৮১৩-১৮৯৮)। তিনি ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহকর্মী ও ব্রাহ্ম সমাজের সক্রিয় সদস্য হিসেবে শিক্ষার প্রসার, কুসংস্কার দূরীকরণ এবং নারী শিক্ষা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রামতনু লাহিড়ী ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক এবং তাঁর চিন্তাধারা তরুণ প্রজন্মকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি পরিহার করে যুক্তিবাদী ও আধুনিক মনোভাব প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

রামতনু লাহিড়ী

ঐতিহাসিক চরিত্ররামতনু লাহিড়ী
জন্ম১৮১৩ খ্রি
জন্মস্থানকৃষ্ণনগর, বাংলা, ব্রিটিশ ভারত
পেশাশিক্ষক, সমাজ সংস্কারক
অবদানশিক্ষার প্রসার, ব্রাহ্ম সমাজে সক্রিয়তা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি দূরীকরণ
সহযোগিতাঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ব্রাহ্ম সমাজ
বিশেষ উপাধিবাংলার নবজাগরণ-এর অন্যতম পথিকৃৎ
মৃত্যু১৮৯৮ খ্রি

রামতনু লাহিড়ী

ভূমিকা :- বঙ্গদেশের নতুন যুগের অন্যতম অগ্রনায়ক ডিরোজিওর অনুগামী ইয়ং বেঙ্গল দলের অন্যতম ও প্রথম যুগের কৃতকর্মা শিক্ষাবিদ, মুক্তবুদ্ধি সমাজকর্মী রামতনু লাহিড়ী। তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত লাহিড়ী পরিবাবের সন্তান। সেইকালে নানা সংকর্ম ও সদাশয়তার জন্য এই বংশের সুখ্যাতি ছিল।

রামতনু লাহিড়ীর জন্ম

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে নদীয়া জেলার বারাইহুদা গ্রামে মাতুলালয়ে রামতনুর জন্ম। তাঁর পিতা রামকৃষ্ণ লাহিড়ী ছিলেন ধর্মপরায়ণ ও পরোপকারী মানুষ। রামতনুর মাতা জগদ্ধাত্রী দেবী ছিলেন সাধ্বী স্বাধীনচেতা মহিলা।

শিক্ষাবিদ রামতনু লাহিড়ীর পরিবার

  • (১) পিতা রামকৃষ্ণ লাহিড়ী কাজ করতেন নবদ্বীপের রাজসরকারে লালাবাবুদের অধীনে। এতবড় এস্টেটের ম্যানেজারের পদে থাকলেও কখনো অসৎ পথ অবলম্বন করেন নি তিনি। তাই সামান্য উপার্জনের দ্বারাই তাঁকে কায়ক্লেশে সংসারযাত্রা নির্বাহ করতে হত।
  • (২) তার মা জগদ্ধাত্রী দেবী সত্যপরায়ণ স্বামীর মর্যাদা সম্পর্কে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দেওয়ান রাধাকান্ত রায় মহাশয়ের কন্যা। ধনী ঘরের মেয়ে হয়েও, তিনি স্বামীর সংসারের দারিদ্র্য ও অসচ্ছলতা হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছিলেন। পরিবারের এই পরিমন্ডলেই বড় হয়ে উঠেছেন রামতনু। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।

রামতনু লাহিড়ীর শিক্ষা

পিতা রামকৃষ্ণ তাঁর ছেলেদের লেখাপড়ার বিষয়ে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। পাঁচবছর বয়সেই হাতেখড়ি দিয়েছিলেন রামতনুর। তাঁর তত্ত্বাবধানেই রামতনুর ফারসী ও ইংরাজী শিক্ষা চলত। কৃষ্ণনগরে থাকতেই ফারসীর সঙ্গে ইংরাজি কিছুটা পড়তে ও লিখতে শিখেছিলেন রামতনু। দাদার কাছে পড়াশোনা করে তাঁর ইংরাজী জ্ঞান ও হাতের লেখা অনেকটা সড়গড় হয়েছিল।

শিশু রামতনু লাহিড়ীর ঘোড়ায় চড়ার নেশা

বালক রামতনু ছিলেন দুরন্ত প্রকৃতির। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে জুটিয়ে প্রায়ই নানা দুষ্টমীতে মেতে উঠতেন। সেইকালে কৃষ্ণনগরে নানা কাজেই দূর দূর অঞ্চল থেকে লোকে ঘোড়ায় চড়ে বা ঘোড়ার গাড়িতে চেপে আসত। সেই সব ঘোড়া মাঠে চরত। রামতনু সঙ্গীদের নিয়ে সুযোগ পেলেই ঘোড়ার পিঠে চাপবার চেষ্টা করতেন। এই ভাবে ঘোড়ায় চড়ার নেশায় মেতে পড়াশুনাতেও তিনি যথেষ্ট অমনোযোগী হয়ে পড়েছিলেন। তাছাড়া ওই বয়সেই নানা শ্রেণীর লোকের সঙ্গে মিশে তাঁর মন বহির্মুখী হয়ে উঠছিল।

কলকাতায় রামতনু লাহিড়ী

ছেলের মতিগতি পিতা রামকৃষ্ণের দৃষ্টি এড়াল না। তিনি রামতনুকে কৃষ্ণনগরে না রেখে কলকাতায় চেতলায় তাঁর বড় ছেলে কেশবচন্দ্রের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কাজ করার সুবাদে কেশবচন্দ্রকে কলকাতায় একাই থাকতে হত। কাজেই তিনি কাজে বেরিয়ে গেলে সারা দিন রামতনু বাসায় একাই থাকতেন। দাদার তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া চললেও তাঁর অবর্তমানে রামতনু স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরার সুযোগ পেতেন।

দাদা কেশবচন্দ্রের আশঙ্কা

সেইকালের কলকাতায় চেতলা হাট চালের কারবারের জন্য বিখ্যাত ছিল। দূর দূর অঞ্চল থেকে টালিনালা পথে অসংখ্য নৌকা বোঝাই হয়ে সেখানে মাল আসত। ফলে নানা শ্রেণীর লোকের সমাবেশ চেতলায় লেগেই থাকত। তাদের সংস্রবে এসে পাছে ছোট ভাইটি বিপথগামী হয়ে পড়ে, সেই আশঙ্কাতেই কেশবচন্দ্রকে সর্বদা শঙ্কিত থাকতে হত। শেষ পর্যন্ত তিনি রামতনুকে অন্যত্র রেখে ইংরাজি স্কুলে পড়াবার চেষ্টা করতে লাগলেন।

হেয়ার সাহেবের স্কুলে রামতনু লাহিড়ী

  • (১) বাংলায় ইংরাজি শিক্ষা প্রবর্তনের অন্যতম পথিকৃত সমাজসেবী ডেভিড হেয়ার সাহেব সেই সময় নিজেই স্কুল খুলে ছেলেদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে বিনা বেতনেও অনেক ছাত্র পড়ালেখার সুযোগ পেত। কেশবচন্দ্র হেয়ার সাহেবের স্কুলেই ছোট ভাইকে ভর্তি করাবার মনস্থ করলেন।
  • (২) সুযোগ একটা জুটেও গেল কিছুদিনের মধ্যে। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার মহাশয় সেই সময়ে হাতিবাগানে থাকতেন। হেয়ার সাহেবের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা ছিল। তাঁকে ধরেই রামতনুকে একদিন হেয়ার সাহেবের কাছে পাঠানো হল।
  • (৩) গৌরমোহন অবৈতনিক ছাত্র হিসাবে রামতনুকে তাঁর স্কুলে নেবার জন্য হেয়ার সাহেবকে অনুরোধ করলেন। কিন্তু সেই সময় ছাত্র ভর্তির এমনই চাপ ছিল যে সাহেবের পক্ষে তাঁর অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব হল না। সেই সময় ছেলেদের তাঁর স্কুলে নেবার জন্য বহু লোকই হেয়ার সাহেবকে নানাভাবে পীড়াপীড়ি করত।
  • (৪) সুস্থ ভাবে তাঁর পথ চলারও উপায় ছিল না অভিভাবকরা কিংবা ছেলেরা তাঁর পাল্কীর সঙ্গে চলতে চলতে ক্রমাগত কাকুতি মিনতি করতে থাকত। অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হলেও গৌরমোহন কিন্তু নিরাশ হলেন না।
  • (৫) তিনি কেশবচন্দ্রকে পরামর্শ দিলেন, রামতনুকে অন্য অনেক বালক যেমন করে থাকে, তেমনি হেয়ার সাহেবের পাল্কির পাশে পাশে ছুটতে হবে। তাতে সাহেবের মন নরম হবে, তিনি যে করে হোক একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।
  • (৬) এই ব্যবস্থা অনুযায়ী বালক রামতনু একদিন চেতলা থেকে হাতিবাগানে গৌরমোহনের বাসায় চলে গেলেন। সেখান থেকে তিনি প্রতিদিন হেয়ার সাহেবের পাড়ির পাশে পাশে ছুটে তাঁকে স্কুলে ভর্তি করবার জন্য অনুনয় করতে লাগলেন।
  • (৭) পরিবেশ পরিস্থিতি দেখেশুনে ততদিনে রামতনুরও ঝোঁক চেপে গেছে। যে করে হোক হেয়ার সাহেবের স্কুলে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শেখার সুযোগ করে নিতে হবে এই সঙ্কল্পে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। হেয়ার সাহেবের পাল্কি ধরার জন্য তিনি প্রতিদিনই সকালে বাড়ি থেকে বার হতে লাগলেন। এই করতে গিয়ে প্রায় দিনই তাঁকে অনাহারে কাটাতে হত।
  • (৮) নানা কাজে হেয়ার সাহেব শহরের বিভিন্ন স্থানে যেতেন। দুপুরে বাসায় ফিরে আসতেন। বাসায় ফিরে একদিন পাল্কি থেকে নেমেই দেখেন সামনে দাঁড়ানো রামতনু। পাল্কির সঙ্গে ছুটে ছুটে ক্লান্ত শ্রান্ত অবস্থা। মলিন মুখ দেখেই তিনি বুঝলেন ক্ষুধাতৃষ্ণায় বালক রামতনু খুবই কাতর হয়ে পড়েছেন।
  • (৯) সেদিন রামতনুকে ডেকে সাহেব বাড়ির পাশের মিষ্টির দোকান থেকে পেট ভরে তাঁকে খাইয়ে দিয়েছিলেন। এই ভাবে একদিন দুদিন নয় টানা দুমাস পাল্কির সঙ্গে ছোটার পর রামতনুর বিদ্যাশিক্ষার আগ্রহ দেখে হেয়ার সাহেব আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি তাঁকে তাঁর কলুটোলা ব্রাঞ্চস্কুলে অবৈতনিক ছাত্র হিসাবে ভর্তি করে নিলেন।

পড়াশোনায় মনোযোগী রামতনু লাহিড়ী

এই ঘটনা বালক রামতনুর জীবনে এক স্থায়ী ছাপ এঁকে দিয়েছিল। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ভাল কিছু অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। নিরন্তর চেষ্টা কখনো বিফল হয় না।বলাবাহুল্য সেই ঘটনার পর থেকেই দুরন্ত-স্বভাব বালক রামতনুর জীবনের ধ্যানধারণা ভবিষ্যতের উজ্জ্বল পথ খুঁজে পেল। তিনি পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠলেন।

বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ রামতনু লাহিড়ী

  • (১) রামতনু লাহিড়ী কলুটোলা স্কুল থেকে রামতনু দু’বছর পর বৃত্তি পেয়ে হিন্দু কলেজের চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। পড়াশুনার কৃতিত্ব ও চরিত্রগুণে রামতনু হেয়ার সাহেবের স্নেহদৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। একবার তিনি ওলাওঠা রোগে আক্রান্ত হলে হেয়ার সাহেবই তাঁর চিকিৎসার ভার নেন।
  • (২) ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে রামতনু হিন্দু কলেজে ছাত্র বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ষোল টাকা বৃত্তি পেলেন। বিদ্যাশিক্ষায় উৎসাহ দানের জন্য সেইকালে কৃতী ছাত্রদের বৃত্তি দেওয়া হত। বৃত্তির টাকাতেই সারা বছর তাদের শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ হত। ষোলটাকা বৃত্তি পেয়ে রামতনু স্বভাবতই পরিবারের প্রতি কর্তব্য সচেতন হয়ে উঠলেন।

দারিদ্র্যের সঙ্গে রামতনু লাহিড়ীর কঠোর সংগ্রাম

  • (১) তিনি ছোট দুই ভাই রাধাবিলাস ও কালীচরণকে লেখাপড়া শেখাবার জন্য কলকাতায় নিজের কাছে নিয়ে এলেন। তিন জনের খাইখরচ ও ঘরভাড়া ওই বৃত্তির টাকাতেই কষ্টেসৃষ্টে সঙ্কুলান করতে হত। ফলে রান্না খাওয়ার সব কাজই নিজেদের হাতে সারতে হত। দু’বেলা খাবার ছাড়া অন্য কিছু জুটত না।
  • (২) অনেক সময়ই পাল্টাপাল্টি করে তিন ভাইকে পোশাক পরতে হত। পায়ে জুতো ছিল না কারোরই। কিন্তু তাতেও সব দিক সামাল দেওয়া যেত না। বাধ্য হয়ে তখন বন্ধুদের কাছে কিংবা হেয়ার সাহেবের কাছে ধারের জন্য রামতনুকে হাত পাততে হত। এইভাবে দারিদ্র্যের সঙ্গে কঠোর সংগ্রাম অব্যাহত রেখেই রামতনু বঙ্গভারতীর কৃপালাভের সাধনা করেছেন।

ডিরোজিওর সংস্পর্শে রামতনু লাহিড়ী

  • (১) ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার হিন্দু কলেজে শিক্ষকপদে বৃত হয়েছিলেন তরুণ ডিরোজিও। তিনি পড়াতেন ইতিহাস ও ইংরাজি সাহিত্য। অল্পদিনের মধ্যেই ছাত্রদের হৃদয় জয় করে তাদের প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকরূপে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন।
  • (২) সংস্কারমুক্ত যুক্তিবাদী এই মহান শিক্ষকের শিক্ষা ও সাহচর্যে বেড়ে ওঠা ছাত্ররাই পরবর্তীকালে বাংলা তথা ভারতের প্রগতিমূলক আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। শিক্ষাগুরু ডিরোজিও ছিলেন নব্য বঙ্গের দীক্ষাগুরু।
  • (৩) তিনি ক্লাশে বিখ্যাত মনীষীদের রাজনৈতিক দর্শনের প্রচার ও ব্যাখ্যা করে ছাত্রদের জ্ঞান যুক্তি ও স্বাধীন চিন্তার ভিত্তি গড়ে দিতেন। হিন্দুস্কুলে পড়ার সময় রামতনু মহাত্মা ডিরোজিওর সংস্রবে আসেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ডিরোজিওর অনুগামী ছাত্রদের অন্যতম হয়ে উঠলেন।

অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনে রামতনু লাহিড়ী

  • (১) ডিরোজিও তাঁর শিষ্য-ছাত্র রামগোপাল ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ শিকদার, প্যারীচাঁদ মিত্র, শিবচন্দ্র দেব, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও রামতনু লাহিড়ী প্রমুখ ও অন্যান্য ছাত্রদের নিয়ে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামে বিতর্কসভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
  • (২) এই সভায় জাতিভেদ, পৌত্তলিকতা, অদৃষ্টবাদ, নাস্তিকতা, আস্তিকতা, সাহিত্য, স্বদেশপ্রেম প্রভৃতি তৎকালীন প্রধান সামাজিক নৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা ও মত বিনিময় হত। এটিই ছিল আমাদের দেশে ছাত্রদের প্রথম আলোচনা সভা বা ছাত্র সংগঠন।
  • (৩) হেয়ার সাহেব ছাড়াও দেশের জ্ঞানী গুণী বিখ্যাত ব্যক্তিরা সুযোগ মতো উপস্থিত থেকে ছাত্র-শিক্ষকের আলোচনায় যোগ দিতেন। তাঁদের উপস্থিতি ছাত্রদের জ্ঞান ও চিন্তার ক্ষেত্র প্রসারে সহায়তা করত।
  • (৪) ডিরোজিওর উপযুক্ত শিক্ষায় রামতনুর স্বাধীন চিন্তাশক্তির বিকাশ ও সংস্কারমুক্ত চেতনার উন্মেষ হয়। তিনি ডিরোজিওর অনুগামী ইয়ং বেঙ্গল দলের অন্যতম রূপে পরিচিত হলেন।

জুনিয়র শিক্ষক রামতনু লাহিড়ী

১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে রামতনুর কলেজের শিক্ষা সমাপ্ত হল। সঙ্গে সঙ্গেই কর্মজীবনে প্রবেশেরও সুযোগ পেয়ে গেলেন। হিন্দু কলেজেরই জুনিয়র শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হলেন তিনি।

রামতনু লাহিড়ীর জীবনে শোক

  • (১) হেয়ার সাহেবের সাহায্য সহযোগিতাতেই লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন রামতনু। পেয়েছিলেন মাতৃস্নেহের স্পর্শ। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে এই পরহিতব্রতী মহাত্মার মৃত্যু হলে আপনজন হারানোর শোক পেলেন তিনি। অল্প সময়ের ব্যবধানেই পর পর কয়েকটি শোকাবহ ঘটনা এই সময়ে তাঁর জীবনে ঘটে যায়।
  • (২) কনিষ্ঠ ভ্রাতা রাধাবিলাস অকালে আগেই গত হয়েছিলেন। বড় ভাই কেশবচন্দ্রও ইহধাম ত্যাগ করলেন। সম্মুখ কর্তব্য দায়িত্বের আহ্বানে সমস্ত শোকই তিনি প্রবল মানসিক দৃঢ়তার সঙ্গে সামলে উঠতে সক্ষম হলেন।
  • (৩) সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এবার তাঁকেই তুলে নিতে হল। কৃষ্ণনগরে বৃদ্ধা মাতার অসুখে বিসুখে ভাল চিকিৎসা হচ্ছিল না। মাকে সুস্থ করে তুলবার জন্য কলকাতায় নিজের কাছে নিয়ে এলেন এবং তাঁর উপযুক্ত সেবাযত্নে নিযুক্ত হলেন।

সমাজসংস্কারক রামতনু লাহিড়ীর বিবাহ

  • (১) সাংসারিক জীবনেও রামতনুকে অনেক ঝড়ঝাপটা সইতে হয়েছে। সেইকালের রীতি অনুযারী হিন্দু কলেজের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়েই তাঁকে বিয়ে করতে হয়েছিল। বছর কয়েক পরে সেই পত্নী মারা যান। তাঁর দ্বিতীয় বিবাহও সুখের ছিল না। তীব্র মানসিক অশান্তি সেই সময় তাঁকে ভোগ করতে হয়েছিল।
  • (২) বাধ্য হয়ে রামতনুকে তৃতীয়বার দারপরিগ্রহ করতে হয়েছিল। এই বালিকা বধূকে নিয়েই তিনি কলকাতায় সংসার পেতেছিলেন। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে হয়েও সাধ্বী মাতাকে সারাজীবন দারিদ্র্যের যন্ত্রণা সইতে দেখেছেন রামতনু। দরিদ্র স্বামীর মর্যাদা রক্ষার জন্য কোনও অবস্থাতেই কোনও দিন তিনি পিতৃগৃহের মুখাপেক্ষী হন নি।

রামতনু লাহিড়ীর মায়ের মৃত্যু

স্বামীভক্তি, সততা, তেজস্বিতা ও স্নেহের প্রতিমূর্তি মাতাকে রামতনু সর্বদাই দেবীজ্ঞানে শ্রদ্ধাভক্তি করেছেন। তাই অসুস্থা জননীকে নিজের কাছে এনে মাতৃসেবার কোনও প্রকার ত্রুটি রাখেন নি। কলেজের কাজের সময়টুকুর বাইরে সকল সময়েই তিনি মাতার সেবাশুশ্রষায় নিযুক্ত থাকতেন। নিষ্ঠা সেবা ও ভক্তিতে তাঁর বালিকা স্ত্রীও ছিলেন তাঁর যোগ্য সহধর্মিণী। তাঁদের প্রাণপাত সেবাযত্নের পরেও জননীর রোগ ভাল হল না। কিছুকাল রোগভোগের পর কলকাতাতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

আদর্শ শিক্ষক রামতনু লাহিড়ী

  • (১) ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে রামতনুর কর্মস্থলের পরিবর্তন ঘটল। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে দ্বিতীয় শিক্ষকের পদে যোগ দিলেন তিনি। উদারহৃদয় ছাত্রদরদী হেয়ার সাহেবের স্নেহধন্য এবং ডিরোজিওর মতো ছাত্রবৎসল আদর্শ শিক্ষকের সুযোগ্য ছাত্র রামতনু। শিক্ষাগুরুর আদর্শেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন নিজেকে।
  • (২) শিক্ষাদানে ও ব্যবহারে ডিরোজিওকেই অনুসরণ করবার চেষ্টা করতেন সর্বদা। যথাযথ শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে রামতনু ছাত্রদের পড়াতেন প্রাণমন ঢেলে। তাদের সঙ্গে মিশতেন বন্ধুর মতো। কলেজের মাঠে খেলায় সঙ্গ দিতেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক।
  • (৩) কেবল ছাত্রদের শিক্ষাদানের মধ্যেই একজন আদর্শ শিক্ষকের কর্তব্য শেষ হয় না। শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রমাধুর্য তাঁর শিক্ষাদানব্রতের অনুসারী হয়ে যখন ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানস্পৃহা জাগানোর সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রগঠন ও নীতি উন্নত করার সহায়ক হয়ে ওঠে তখনই তাঁকে আদর্শ শিক্ষক অভিধায় ভূষিত করা চলে।
  • (৪) রামতনু ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। সততা, তেজস্বিতা ও সত্যনিষ্ঠা ছিল তাঁর চরিত্রের ভূষণ। শিক্ষাগুরুর আসনে থাকলেও তিনি ছাত্রদের সঙ্গে সহজ ভাবে মিশতেন, তাদের মধ্যে বিচারবোধ উন্নত করার উদ্দেশ্যে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ দিতেন।
  • (৫) ক্লাশে পাঠ্য বিষয়ের সূত্র অনুসরণ করে তিনি পাঠ্য বিষয়ের বাইরের অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। তাতে ছাত্ররা পাঠ্যবিষয়ের সঙ্গে অন্যান্য অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় সম্পর্কেও আগ্রহী হয়ে উঠত। রামতনু সমস্ত বিষয়ই এমন বিস্তারিত ভাবে ছাত্রদের বুঝিয়ে দিতেন যে তাদের অমনোযোগী হবার সুযোগ থাকত না।
  • (৬) স্বদেশের প্রচলিত রীতিনীতি, কুসংস্কার, জাতিভেদ, ধর্ম বিষয়ে অজ্ঞতা ও অহেতুক বাড়াবাড়ি ইত্যাদি বিষয়েও ছাত্রদের মধ্যে বিচারবোধ ও স্বাধীন চিন্তা জাগিয়ে তুলবার চেষ্টা করতেন রামতনু। আন্তরিক ভাবেই তিনি মানুষ গড়ার দায়িত্ব প্রতিপালন করতেন। শিক্ষাগুণে ও ব্যক্তিত্ব প্রভাবে অল্পদিনের মধ্যেই ছাত্ররা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অনুরক্ত হয়ে পড়ত।

বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলন

সেই সময় কলকাতায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবা বিবাহ আন্দোলন তুমুল আলোড়ন তুলেছে। তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের নানা প্রান্তে। সংস্কারবাদী নব্য সম্প্রদায় ও সমাজের রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্যবাদী দল তীব্র বাদানুবাদে লিপ্ত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঐকান্তিক চেষ্টায় ও কঠোর শ্রমে বিধবা বিবাহের শাস্ত্রানুমোদন স্বীকৃত হয়েছে।

কৃষ্ণনগর ছাড়লেন রামতনু লাহিড়ী

  • (১) একসময় কৃষ্ণনগরেও বিধবা বিবাহ নিয়ে আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠল। শহরের প্রগতিপন্থীরা এই সময়ে কলেজ প্রাঙ্গণে একটি সভার আয়োজন করে জানালেন, বিধবা বিবাহ প্রচলনে তাঁরা সকল প্রকার সাহায্য দানের জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।
  • (২) রক্ষণশীল সম্প্রদায় এই সুযোগে রটনা করল যে ধর্মবিরোধী নব্য দল সভাসমাবেশের নাম করে নিষিদ্ধ মাংস ও সুরা পানের আয়োজন করেছে। এই অপপ্রচারের ফলে চাবদিকে ক্ষোভের সৃষ্টি হল। কলেজের অধ্যক্ষকে সভা করার অনুমতি দেবার জন্য সমাজপতিদের ধিক্কার শুনতে হল।
  • (৩) প্রগতিপন্থী রামতনুও এই দুঃখজনক ঘটনার আঁচ থেকে রক্ষা পেলেন না। আত্মীয়-স্বজনের তিরস্কার ও সামাজিক নির্যাতন তাঁকে যারপর নাই বিরত করে তুলল এবং শেষ পর্যন্ত তিনি বাধ্য হলেন কৃষ্ণনগরের বাস উঠিয়ে দিতে।

দিশাহারা রামতনু লাহিড়ী

এই সময়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও একটি শোকাবহ ঘটনা ঘটে। তাঁর প্রথম শিশু সন্তানটি খাট থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছিল। মাথার আঘাত গুরুতর হওয়ায়, তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় নি। একদিকে ব্যক্তিগত শোকতাপের আঘাত অপরদিকে সামাজিক নির্যাতন, এই দুয়ের মধ্যে পড়ে রামতনু দিশাহারা হয়ে পড়লেন।

বর্ধমানে রামতনু লাহিড়ী

শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা চরিত্রের পর তিনি বর্ধমান কলেজে বদলির ব্যবস্থা করলেন। এ বিষয়ে তিনি সে সময় বাল্যবন্ধু বর্ধমান-এর ডেপুটি কালেকটর রসিকলাল মল্লিকের কাছ থেকে সহৃদয় সহযোগিতা পেয়েছিলেন। রামতনু বর্ধমান-এ কাজে যোগ দিলেন ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে। আর সেই বছরেই এমন একটি ঘটনা তাঁর জীবনে ঘটল যার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।

রামতনু লাহিড়ীর উপবীত পরিত্যাগ

  • (১) মানবতাবাদী রামতনু কোনও প্রকার আনুষ্ঠানিক ধর্মাচরণে বিশেষ করে মূর্তিপূজা ইত্যাদিতে আস্থাশীল ছিলেন না। লোকহিতৈষণা ও মানবকল্যাণের কর্মকেই তিনি প্রকৃষ্ট ধর্মাচরণ বলে বিশ্বাস করতেন। অথচ নিজে ছিলেন ধর্মপরায়ণ রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান। সেই হিসাবে, মূর্তিপূজা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বর্জন করলেও ব্রাহ্মণের পরিচয় বাহক যজ্ঞোপবীত পরিত্যাগ করেন নি।
  • (২) কৃষ্ণনগরে থাকার সময়েই তাঁর মাতৃবিয়োগ ঘটেছিল। একবার মায়ের বাৎসারকি শ্রাদ্ধক্রিয়ায় তিনি বসেছেন, সেই সময় এক কিশোর তাঁর উদ্দেশ্যে মন্তব্য করে বলেছিল, “এদিকে তো বলা হয় কিছুই মানি না, ওদিকে শ্রাদ্ধ কর্তে বসা হয়েছে, পৈতাটি বেশ ঝুলছে, বামনাই দেখান হচ্ছে।”
  • (৩) কথাগুলো কানে যেতে রামতনু খুবই বিব্রত ও লজ্জাবোধ করলেন। সেই সময় থেকেই তিনি উপবীত পরিত্যাগের বিষয়ে কৃতসঙ্কল্প হন। বর্ধমানে আসার পরে কার্যকারণে তাঁর উপবীত বর্জনের সংকল্প কার্যকরী হয়।
  • (৪) ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে পুজোর ছুটিতে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে তিনি গাজিপুরে যাচ্ছিলেন। পথে রান্নাবান্নার দায়িত্ব মাঝিমাল্লাদের হাতেই দেওয়া হয়েছিল। একদিন যখন রান্নাবান্নার কাজ চলছে, বন্ধুদের একজন রসিকতা করে বলল, “এদিকে তো মাল্লাদের হাতে খাচ্ছি, অথচ পৈতেটা রেখে বামনাই দেখাচ্ছি, কি ভন্ডামিই করছি।”
  • (৫) রঙ্গচ্ছলে বলা হলেও কথাগুলির গূঢ়ার্থ রামতনুর মনে গভীর রেখাপাত করল। তাঁর মনে পড়ল কৃষ্ণনগরের কথা-কিশোরের মন্তব্য। নিঃশব্দে তিনি গলা থেকে পৈতাটি খুলে নৌকার ছইয়ে ঝুলিয়ে দিলেন। এই ভাবেই তাঁর উপীবত ত্যাগের সংঙ্কল্প সিদ্ধ হয়েছিল।
  • (৬) ব্রাহ্মণ হয়ে পৈতা পরিত্যাগ করে ইতিপূর্বে অনেক ইয়ংবেঙ্গল সদস্যই সমাজে আলোড়ন ঘটিয়েছিলেন। সমাজের চোখে নিন্দনীয় এই কর্মটি প্রগতিপন্থীরা করেছেন, যতকিছু গোঁড়ামী ও রক্ষণশীলতার প্রতিবাদ হিসেবে। রামতনুর পৈতাত্যাগের ঘটনাটিও চারদিকে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল।

একঘরে রামতনু লাহিড়ী

  • (১) সবে তিনি বর্ধমানে কাজে যোগ দিয়েছেন, তার মধ্যেই প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণ করে একেবারে ঝড়ের মুখে পড়ে গেলেন। হিন্দু সমাজের সমাজপতিরা তাঁকে অচিরেই একঘরে ঘোষণা করল। ফলে ধোপা, নাপিত, বাড়ির কাজের লোক সকলেই তাঁকে পরিত্যাগ করল।
  • (২) ঘরে বালিকা বধূ, প্রথম পক্ষের দুগ্ধপোষ্য পুত্র। রামতনু একেবারে অথৈ জলে পড়লেন। ঘর-গৃহস্থালীর কাজ কর্ম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। কিন্তু হাসিমুখেই তিনি এই দুঃসময়কে বরণ করে নিলেন।
  • (৩) অক্লান্ত পরিশ্রমে, সংসারের জলতোলা বাসনমাজা থেকে শুরু করে দাসদাসীদের কৃত্য সকল কাজই তিনি নিজ হাতে সমাধা করতে লাগলেন। দুঃখের কথা এই যে, সহযোগিতা তো দূরের কথা আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকেও এই সময় বিদ্রূপ আর অবজ্ঞা ছাড়া কিছু পান নি।

প্রধান শিক্ষক রামতনু লাহিড়ী

এই পরিস্থিতির মধ্যে সুস্থির হয়ে কাজ করা বেশি দিন সম্ভব হল না। একবছর থাকার পর ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের পরেই চলে এলেন উত্তর পাড়ার ইংরাজি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ নিয়ে।

বিদ্যাসাগরের সাথে রামতনু লাহিড়ীর সাক্ষাৎ

  • (১) সেই সময় অদূরেই কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠেছে ইংরাজি শিক্ষা ও স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। বিদ্যাসাগর মহাশয় এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। তাঁর সঙ্গে রামতনুর এই সময়েই চাক্ষুষ পরিচয় ঘটে। বিদ্যাসাগর মহাশয় রামতনুর প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি তাঁকে বন্ধু হিসাবে নানা ভাবে সাহায্য করতেন।
  • (২) পৈতা ত্যাগের নির্যাতন রামতনুকে ভোগ করতেই হচ্ছিল। তাঁর অসুবিধাদি লাঘব করার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় গৃহস্থালীর দ্রব্যসামগ্রী কলকাতা থেকে কিনে পাঠিয়ে দিতেন। উত্তর পাড়ায় রামতনু শিক্ষক হিসাবে অল্প সময়ের মধ্যে অতিশয় জনপ্রিয় হয়েছিলেন। এখানে তাঁর কার্যকাল স্থায়ী হয়েছিল মাত্র দেড় বছর। দুই কন্যা লীলাবতী ও ইন্দুমতীর জন্মও হয়েছিল এখানেই।

বারাসাত স্কুলে রামতনু লাহিড়ী

  • (১) বদলি হয়ে রামতনু চলে এলেন বারাসাত স্কুলে। স্থানটি কলকাতার অদূরবর্তী হওয়ায় কলকাতার বন্ধুদের সঙ্গে রামতনুর নতুন করে যোগাযোগ স্থাপিত হল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে যোগাযোগও বৃদ্ধি পেল। বারাসাতেও ছাত্রদের শ্রদ্ধা ভালবাসা অল্পদিনেই অর্জন করলেন রামতনু।
  • (২) লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্রদের চরিত্র গঠনের ওপরেও বরাবরই সমান গুরুত্ব দিতেন তিনি। নানা সৎ উপদেশ ও দেশ বিদেশের মনীষীদের জীবনী আলোচনার মাধ্যমে দৃষ্টান্ত উপাস্থাপনার দ্বারা চেতনা সঞ্চার করতেন।
  • (৩) জ্ঞান অর্জন ও চরিত্র গঠনের অঙ্গ হিসেবে ছাত্রদের তিনি শ্রমশীল হওয়ার শিক্ষাও দিতেন। অবসর সময়ে ছাত্রদের নিয়ে তিনি স্কুলসীমার অন্তর্বর্তী বিস্তীর্ণ জমিতে চাষাবাদের কাজেও নিযুক্ত হতেন।

রামতনু লাহিড়ীর অবসর গ্রহণ

বদলির চাকরিতে বেশিদিন এক জায়গায় থিতু হওয়ার উপায় ছিল না। তাই বারাসাতের পরে তৎকালীন পূর্ব্বঙ্গে বরিশাল জেলাস্কুলেও কিছুকাল তাঁকে প্রধান শিক্ষকের কাজ করতে হয়। সর্বশেষ এলেন কৃষ্ণনগর কলেজে এবং এখান থেকেই ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারী চাকরি থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

Arnald of Bengal রামতনু লাহিড়ী

সরকারী কর্ম থেকে যখন রামতনু অবসর গ্রহণ করেন, ততদিনে তাঁর সাধুতা কর্তব্যপরায়ণতা ও সমাজ হিতৈষণার খ্যাতি দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। আপামর সাধারণের শ্রদ্ধাভাজন হিসেবে স্বয়ং বিদ্যাসাগরের পরেই তাঁর নাম উচ্চারিত হত। একজন কৃতকর্মা শিক্ষাব্রতী হিসেবেও তিনি চিহ্নিত হয়েছিলেন। সেকালে মহাজ্ঞানী আর্নল্ডের সঙ্গে তুলনা করে তাঁকে বলা হত Arnald of Bengal.

অভিভাবক রামতনু লাহিড়ী

চব্বিশ (উত্তর) পরগনার গোবরডাঙ্গা অঞ্চলের প্রসিদ্ধ মুখোপাধ্যায় জমিদার, পরিবারে নাবালক ছেলেদের অভিভাবক নিয়োগের প্রশ্নে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। একজন সজ্জন, কর্তব্যপরায়ণ ও সাধুচরিত্রের খ্যাতিমান মানুষের সন্ধান করা হচ্ছিল। সরকার বাহাদুরের পরামর্শে সেই সময় রামতনুকেই মুখোপাধ্যায় পরিবারে অভিভাবকত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

কুসংস্কারের বিরোধী রামতনু লাহিড়ী

আজীবন তিনি ছিলেন কুসংস্কারের বিরোধী। জাতিভেদও মানতেন না। গোবরডাঙ্গায় থাকাকালীন তিনি উদারভাবে সকল শ্রেণীর মানুষের সঙ্গেই মেলামেশা করতেন। কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি আস্থা না থাকলেও তাঁর ধর্ম ভাবনা ছিল কেশব সেনের প্রভাবপুষ্ট। নবীন ব্রাহ্মদের বাড়িতে নানা অনুষ্ঠানে ও উপাসনাতেও তিনি নিয়মিত যোগদান করতেন। তাঁর চরিত্রগুণে ও পবিত্র সান্নিধ্যে সকলের মধ্যেই সদভাব জাগরিত হত।

নারীমুক্তি আন্দোলনে রামতনু লাহিড়ী

  • (১) ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিধবা বিবাহের পক্ষে প্রবল সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্ত্রী স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত হন। নারীমুক্তি আন্দোলনের পক্ষাবলম্বীরা স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিল হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ে প্রথম ছাত্রী হিসাবে রামতনু তাঁর কন্যা ইন্দুমতীকে পাঠিয়েছিলেন।
  • (২) ব্রাহ্মনেতা প্রখ্যাত কেশব সেনের বক্তৃতা শুনতে গেলে টাউন হলের সভায় তিনি নিজ ভ্রাতুষ্পুত্রীদেরও প্রকাশ্য স্থানে বসিয়ে দিতেন। নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ও তাদের মনে জ্ঞান স্পৃহা জাগাবার জন্য রামতনু সর্বদা ব্যগ্র ছিলেন।
  • (৩) তিনি কলকাতায় এসে এক একটি পরিবারের মধ্যে কিছুদিন বাস করতেন এবং মেয়েদের একত্র করে নানা বিষয়ে উপদেশ দিতেন। মেয়েদের দিয়েও গ্রন্থাদি পাঠ করাতেন। তাঁর সান্নিধ্যে অতি অল্পসময়ের মধ্যেই বাড়িব সাংস্কৃতিক আবহাওয়া ও রুচির পরিবর্তন ঘটে যেত।

ভারতাশ্রমে রামতনু লাহিড়ী

  • (১) জাতীয় সমস্যা সমাধান ও ব্রাহ্ম বিবাহের সুবিধার জন্য ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারতাশ্রম নামে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে অন্যান্য পরিবারের সঙ্গে রামতনুও নিজের আত্মীয়দের নিয়ে বাস করেন। এখানে বাসকালে একবার তিনি তাঁর এক মৃত্যুপথযাত্রী অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে যান।
  • (২) সেই বন্ধুটি এককালে সরকারী চাকরি করতেন। চরিত্রের নানা দোষ ত্রুটির জন্য নিন্দাভাজন ব্যক্তিটির নাম শুনে আশ্রমবাসীদের মধ্যে এক মহিলা বলে উঠলেন, “ওমা, এমন মানুষকেও আপনি দেখতে যান? সে যে লক্ষ্মীছাড়া লোক।”
  • (৩) রামতনু তাঁর বন্ধুটির অখ্যাতির বিষয়ে সম্যক অবগত ছিলেন। এ-ও জানতেন অবসর গ্রহণের পর বন্ধুটি ধর্মকার্যে লিপ্ত থেকে নিজ স্বভাব চরিত্রের পরিবর্তন সাধন করেছেন। আন্তরিক ধর্মাচরণ, সহৃদয়তা ও কর্তব্যপরায়ণতা গুণে তিনি যৌবনের সকল দোষ ত্রুটি বর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রামতনু ছিলেন তাঁর গুণগ্রাহী বন্ধু।
  • (৪) মহিলার মুখে বন্ধু সম্পর্কে নিন্দাসূচক মন্তব্য শুনে রামতনু মনে ব্যথা পেলেন। তিনি মহিলাকে বললেন, “ঠাকরুণ, আমি জানি কেন আপনি তাকে লক্ষ্মীছাড়া বলছেন। এখন সে অন্য মানুষ, ধর্মকর্ম নিয়েই থাকে। চিরকালই মানুষ মন্দ থাকে না।”
  • (৫) এর পর তিনি বন্ধুটির নানা গুণ ও কর্মকৃতিত্বের কথা একে একে প্রকাশ করে প্রশ্নের ছলে বললেন, “এতসব কি আপনি করতে পারতেন?” ভদ্রমহিলা অকপটে স্বীকার করলেন, এত কাজ তাঁর পক্ষে করা সম্ভব হত না।

রামতনু লাহিড়ীর মহৎ হৃদয়

কথাচ্ছলে নানা দৃষ্টান্ত উত্থাপন করে রামতনু এর পর যা বললেন, তাতেই প্রকাশ পায় তাঁর সত্যকার মহৎ হৃদয়ের পরিচয়। তিনি বললেন, ‘আমরা মানুষের মন্দটাই দেখি, ভালটা দেখি না। মন্দ মানুষের ভালটা দেখতে হয়। ঈশ্বর যদি আমাদের মন্দটাই ধরেন তাহলে কি আমরা পার পাই?”

জ্ঞান-তাপস রামতনু লাহিড়ী

রামতনু ছিলেন জ্ঞান-তাপস। জ্ঞানান্বেষণে তিনি সারা জীবন ব্যয় করেছেন। শিক্ষাগুরু হিসেবে ছাত্রদেরও তিনি সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছেন।

ন্যাশনাল কনফারেন্সের সভাপতি রামতনু লাহিড়ী

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রথম সভায় রামতনু সভাপতিত্ব করেন।

শয্যাশায়ী রামতনু লাহিড়ী

জীবনের শেষ বয়সে নানা শোকতাপে খুবই অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে খাট থেকে পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভেঙ্গে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তারপর আর সুস্থ হতে পারেন নি।

রামতনু লাহিড়ী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মন্তব্য

মৃত্যুশয্যায় তাঁকে দেখতে এসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বলেন, “স্বর্গে দেবগণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন, তোমাকে তাঁরা সাদরে গ্রহণ করবেন।”

শিক্ষাবিদ রামতনু লাহিড়ীর মৃত্যু

১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ২৩ আগস্ট, সাধু রামতনু ইহলোক ত্যাগ করেন।

উপসংহার :- রামতনু লাহিড়ী ছিলেন বাংলার নবজাগরণ-এর অন্যতম পথিকৃৎ, যিনি আধুনিক শিক্ষার প্রসার, যুক্তিবাদী চিন্তাধারা প্রচার এবং সমাজ সংস্কারে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের মাধ্যমে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে সমাজে পরিবর্তনের বাতাস বইয়ে দেন। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরসহ সমসাময়িক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে মিলে তিনি নারী শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। রামতনু লাহিড়ীর জীবন আমাদের শিক্ষা দেয় যে যুক্তিবাদ, সততা, এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তাঁর অবদান আজও প্রাসঙ্গিক এবং অনুপ্রেরণার উৎস।

(FAQ) মানবতাবাদী রামতনু লাহিড়ী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১। রামতনু লাহিড়ী কে ছিলেন?

রামতনু লাহিড়ী উনবিংশ শতকের বাংলার একজন বিশিষ্ট শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক এবং ব্রাহ্ম সমাজের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

২। রামতনু লাহিড়ীর শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান কী ছিল?

তিনি শিক্ষার প্রসার, নারী শিক্ষা উন্নয়ন, এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে যুক্তিবাদী মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য কাজ করেছেন।

৩। রামতনু লাহিড়ী কোন সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

রামতনু লাহিড়ী ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দূরীকরণের জন্য কাজ করেছেন।

৪। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রামতনু লাহিড়ীর সম্পর্ক কী?

ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রামতনু লাহিড়ী ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন এবং দুজনেই বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে এবং সমাজ সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

৫। রামতনু লাহিড়ী বাংলার নবজাগরণে কেন গুরুত্বপূর্ণ?

রামতনু লাহিড়ী আধুনিক শিক্ষার প্রসার, যুক্তিবাদী চিন্তাধারা প্রচার এবং সমাজ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় বাংলার নবজাগরণে অনন্য অবদান রেখেছেন।

Leave a Comment