ব্রিটিশ ভারতে পুলিশি ব্যবস্থা প্রসঙ্গে ব্রিটিশ মোগল পুলিশি ব্যবস্থার ভাঙ্গন, কোম্পানির সুসংবদ্ধ পুলিশি ব্যবস্থা, পুলিশি ব্যবস্থা গঠনে ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যোগ, কর্ণওয়ালিশের উদ্যোগ কালেক্টরদের দায়িত্ব প্রদান, সিন্ধু অঞ্চলে পুলিশি ব্যবস্থা, মহাবিদ্রোহের পরবর্তী পদক্ষেপ, ভারতীয়দের প্রতি বঞ্চনা ও পুলিশি ব্যবস্থার গুরুত্ব সম্পর্কে জানব।
ব্রিটিশ ভারতে পুলিশি ব্যবস্থা
ঐতিহাসিক ঘটনা | ব্রিটিশ ভারতের পুলিশি ব্যবস্থা |
দেওয়ানি লাভ | ১৭৬৫ খ্রি |
নিয়মিত পুলিশ বাহিনী | ১৭৮৭ খ্রি |
দারোগা ব্যবস্থা | লর্ড কর্ণওয়ালিশ |
দারোগা ব্যবস্থা বাতিল | ১৮১২ খ্রি |
মহাবিদ্রোহ | ১৮৫৭ খ্রি |
পুলিশ কমিশনার নিয়োগ | ১৮৬০ খ্রি |
ভূমিকা :- বাংলায় ব্রিটিশদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে মোগল আমলের ফৌজদারি ব্যবস্থা বাংলা-সহ সমগ্র ভারত-এ বলবৎ ছিল। তখন কোতোয়ালরা শহরগুলির এবং চৌকিদাররা গ্রামগুলির নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করত।
মোগল পুলিশি ব্যবস্থার ভাঙন
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি বা রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করার সময় মোগল পুলিশি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।
ব্রিটিশ কোম্পানির সুসংবদ্ধ পুলিশি ব্যবস্থা
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্যোগ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, আইন শৃঙ্খলার অবনতির পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ কোম্পানি এদেশে এক সুসংবদ্ধ পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
পুলিশি ব্যবস্থা গঠনে ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যোগ
ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যোগে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে এদেশে নিয়মিত পুলিশবাহিনী গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে তার পদক্ষেপ গুলি হল –
- (১) হেস্টিংস বাংলা ও বিহারকে যথাক্রমে দশটি ও আটটি ফৌজদারি জেলায় বিভক্ত করেন।
- (২) প্রতিটি জেলায় একটি করে ফৌজদারি থানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই থানাগুলিতে একজন করে দেশীয় ফৌজদার নিযুক্ত হন।
- (৩) ফৌজদার ছিলেন জেলার প্রধান পুলিশ কর্মচারী। তাঁর হাতে জেলার শান্তি রক্ষার সকল দায়িত্ব দেওয়া হয়।
- (৪) প্রতিটি থানার সঙ্গে একটি করে জেলখানা স্থাপিত হয়।
- (৫) ফৌজদারকে সাহায্য করার জন্য ৩৪ জন কর্মচারী ছিল যার মধ্যে ২০ জন ছিল সিপাই।
- (৬) ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ফৌজদারের পদ বিলুপ্ত করা হয়। কোম্পানির দেওয়ানি আদালতের বিচারকরা ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা পেয়ে পুলিশ বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
- (৭) কোতোয়ালের হাতে শহরের শান্তি রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পুলিশি ব্যবস্থা গঠনে কর্নওয়ালিশের উদ্যোগ
লর্ড কর্নওয়ালিশ ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় নতুন পুলিশি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এক্ষেত্রে তার পদক্ষেপ গুলি হল –
- (১) কর্নওয়ালিশ ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে জমিদারদের আরক্ষাবিষয়ক দায়িত্ব সম্পূর্ণ কেড়ে নেন এবং জেলাগুলিকে বিভিন্ন থানার অধীনে বিভক্ত করেন। এক একটি থানার অধীনে প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা থাকত।
- (২) একজন দারোগার হাতে থানার দায়িত্বভার দেওয়া হয়। দারোগার অধীনে ২০ থেকে ৩০ জন কনস্টেবল থাকত।
- (৩) ম্যাজিস্ট্রেটরা দারোগাকে নিয়োগ ও তাঁর কাজের তদারকি করতেন।
- (৪) প্রতিটি গ্রামে একজন করে চৌকিদার থাকত। তিনি গ্রামের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে দারোগাকে অবহিত করতেন।
- (৫) কলকাতা শহরে একজন সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ এর পদ সৃষ্টি করা হয়। অন্যান্য শহরের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ‘কোতোয়াল’ নিযুক্ত হন।
- (৬) ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে দারোগা ব্যবস্থা চালু হয়। এই ব্যবস্থা ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-এর অন্যত্রও চালু করা হয়।
পুলিশি ব্যবস্থায় কালেক্টরদের দায়িত্ব প্রদান
- (১) কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ধরা পড়ায় ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে তহশিলদারদের হাত থেকে পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে দারোগা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এরপর পুলিশি ব্যবস্থার দায়িত্ব দেওয়া হয় কালেক্টরদের হাতে।
- (২) এর ফলে কালেক্টরদের অধীনস্থ রাজস্ব বিভাগের অধস্তন কর্মচারীরা গ্রাম-গঞ্জে পুলিশি ব্যবস্থা দেখাশোনা করতে থাকে। তাদের উদ্যোগে পুলিশি জুলুমবাজি ব্যাপক বৃদ্ধি পায়।
সিন্ধু অঞ্চলে পুলিশি ব্যবস্থা
স্যার নাপিয়ের ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু অঞ্চল জয় করার পর সেখানে রাজকীয় আইরিশ পুলিশ বাহিনীর আদলে একটি পৃথক পুলিশি দফতর খোলেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
- (১) সমগ্র সিন্ধু অঞ্চলকে একজন ইনস্পেকটর জেনারেল-এর তত্ত্বাবধানে আনা হয়।
- (২) প্রতিটি জেলায় একজন করে ডিস্ট্রিক্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ (ডি. এস. পি.) নিয়োগ করা হয়। তিনি নিজের কাজের জন্য ইনস্পেকটর-জেনারেল ও জেলা কালেক্টরের কাছে দায়বদ্ধ থাকতেন।
- (৩) সিন্ধু অঞ্চলের পুলিশি ব্যবস্থা ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে চালু করা হয়। পরবর্তীকালে এই ব্যবস্থা ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ে এবং ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে চালু করা হয়।
পুলিশি ব্যবস্থা গঠনে মহাবিদ্রোহের পরবর্তী পদক্ষেপ
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের ফলে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কেঁপে ওঠে এর ফলে ব্রিটিশ সরকার পুলিশি ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়। এক্ষেত্রে তাদের বিভিন্ন উদ্যোগ গুলি হল –
- (১) ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ কমিশনার নিয়োগ করা হয়।
- (২) ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে একটি সুনির্দিষ্ট পুলিশি প্রতিষ্ঠানের কাঠামো গড়ে তোলা হয়। অসামরিক কর্তাদের নিয়ন্ত্রণে ভারতের পুলিশ বাহিনীকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
- (৩) এই কাঠামোয় গ্রাম ও শহরের পুলিশ বাহিনী ডিস্ট্রিক্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ (ডি এস. পি.)-র কাছে, ডিস্ট্রিক্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ আবার ইনস্পেকটর-জেনারেল ও জেলা কালেক্টরের কাছে এবং জেলা কালেক্টররা প্রাদেশিক সরকারের কাছে দায়বদ্ধ থাকত।
- (৪) ইনস্পেকটর-জেনারেলরা সামান্য রদবদল ঘটালেও এই কাঠামোটি পরবর্তী এক শতাব্দীকাল মোটামুটি অপরিবর্তিত থাকে।
পুলিশি ব্যবস্থা গঠনে ভারতীয়দের প্রতি বঞ্চনা
ভারতে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগের সুযোগ ছিল না। তবে নিম্নপদগুলিতে ভারতীয়রা নিযুক্ত হত। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ কমিশন পুলিশ বাহিনীর আধিকারিক পদে শিক্ষিত ভারতীয়দের নিয়োগের ব্যবস্থা করলেও ‘পদমর্যাদায় ইওরোপীয়রা যেখানে শুরু করতেন, ভারতীয়দের চাকরি জীবন শেষ হত সেখানে।
ব্রিটিশ পুলিশি ব্যবস্থা সম্পর্কে আর্নল্ডের মন্তব্য
ডেভিড আর্নল্ড মনে করেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় পর্যন্ত ভারতে একটি ‘পুলিশ রাজ’ ক্রমে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
ব্রিটিশ পুলিশি ব্যবস্থার গুরুত্ব
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, খুন-রাহাজানি-ডাকাতি দমন করা প্রভৃতি দায়িত্ব পুলিশ বাহিনী পালন করত। বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহ ও অন্যান্য আন্দোলনে ভারতে ব্রিটিশ সরকার যখন সংকটের সম্মুখীন হত তখনই পুলিশ বাহিনীর সহায়তায় বিদ্রোহ দমন করে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অস্তিত্বকে সুনিশ্চিত করত।
উপসংহার :- ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিল পুলিশ বাহিনী। পুলিশ বাহিনী সেনাবাহিনীর সহায়ক হিসেবে কাজ করত।
(FAQ) ব্রিটিশ ভারতে পুলিশি ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে, ওয়ারেন হেস্টিংস।
১৮০২ খ্রিস্টাব্দে।
১৮১২ খ্রিস্টাব্দে।
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে।
স্যার নাপিয়ের।