স্মৃতিকথা প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ব্যক্তি, স্মৃতিকথার সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, উদাহরণ, গুরুত্ব ও সমালোচনা সম্পর্কে জানবো।
স্মৃতিকথা
ঐতিহাসিক বিষয় | স্মৃতিকথা |
জীবনের জলসাঘরে | মান্না দে |
আমি নেতাজিকে দেখেছি | নারায়ণ সান্যাল |
সেদিনের কথা | মণিকুন্তলা সেন |
যতদূর মনে পড়ে | জ্যোতি বসু |
একাত্তরের বাইরে | সুফিয়া কামাল |
ভূমিকা :- ইতিহাসের একটি অন্যতম মৌখিক উপাদান হল স্মৃতিকথা। অতীতের কোনো ব্যক্তি, পরিবার বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে অনেক তথ্য কোনো মানুষের কাছে থাকতে পারে যিনি সেই ঘটনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষী। সেই ঘটনা অতীত হয়ে গেলেও ঘটনার বিবরণটি সেই ব্যক্তির স্মৃতিতে থেকে যায়। তিনি এই ঘটনাগুলি পরবর্তীকালে স্মরণে এনে প্রকাশ করতে পারেন।
ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ব্যক্তি
এমন হতে পারে যে, কোনো ব্যক্তি কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অথবা সেই ঘটনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষী ছিলেন। অতীতের ঘটনায় অংশগ্রহণকারী বা ঘটনার সাক্ষী সেই ব্যক্তি তাঁর অতীত স্মৃতি থেকে তৎকালীন ঘটনার বিবরণ দেন। এরূপ ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে সেই ব্যক্তির দেওয়া স্মৃতিকথায় উল্লিখিত তথ্যগুলি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে।
স্মৃতিকথার সংজ্ঞা
আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের প্রধান বিভাগ হল স্মৃতিকথা। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে স্মৃতিকথার সংজ্ঞা দেওয়া যায়। যেমন –
(১) বাস্তব ঘটনার বিবরণ
অতীতের কোনো ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত কোনো ব্যক্তি পরবর্তীকালে তার স্মৃতি থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন অতীত ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে প্রকাশ করতে পারেন। এরূপ কাহিনি সাধারণভাবে ‘স্মৃতিকথা’ নামে পরিচিত।
(২) স্মৃতিচারণ
স্মৃতিকথা হল এক ধরনের সাহিত্য যেখানে লেখক তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া বা জীবনে প্রত্যক্ষ করা বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ স্মৃতি থেকে এনে তুলে ধরেন। অর্থাৎ স্মৃতিকথাগুলি হল এক ধরনের অতীতের স্মৃতিচারণ।
(৩) ঐতিহাসিক ঘটনা
স্মৃতিকথা হল লেখকের এক ধরনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণ যেখানে লেখক তাঁর নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে অতীতের কোনো ঘটনার বিবরণ দেন।
স্মৃতিকথার বৈশিষ্ট্য
স্মৃতিকথার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
(১) ঘটনার সত্যতা
স্মৃতিকথা কোনো কাল্পনিক উপন্যাস নয়। এর একটি বাস্তব ভিত্তি আছে। স্মৃতিকথার কাহিনি কোনো ব্যক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল। লেখক সাধারণত প্রকৃত ঘটনাই তার স্মৃতিকথায় তুলে ধরেন বলে মনে করা হয়। তাই স্মৃতিকথার বিষয়বস্তুতে সত্যতা থাকে এবং এর ঐতিহাসিক ভিত্তিও শক্তিশালী হয়।
(২) বিশেষ ঘটনার উপস্থাপন
স্মৃতিকথায় লেখকের সমগ্র জীবনের আলোচনা করা হয় না। বরং লেখকের জীবনকালে সংঘটিত সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনার ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে স্মৃতিকথা লেখা হয়। তাই অধিকাংশ স্মৃতিকথার শিরোনামে উক্ত ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন – দেশভাগের পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ-এর উদ্বাস্তু কমিশনার শ্রীহিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ‘উদ্বাস্তু’ নামে একটি গ্রন্থ লেখেন যেটি প্রকৃতপক্ষে একটি স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে লেখকের জীবনের সময় আলোচনা স্থান পায় নি, পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের জীবন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা স্থান পেয়েছে।
(৩) উত্তম পুরুষে লেখা
স্মৃতিকথা সাধারণত লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়। রচনার উপস্থাপনা করা হয় উত্তম পুরুষে। অর্থাৎ বক্তা বা লেখক নিজে কাহিনির কথক বলে স্মৃতিকথার কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যান।
(৪) নিজস্ব অনুভূতির প্রকাশ
কথক বা লেখক তাঁর স্মৃতিকথায় যে কাহিনি বা ঘটনার বিবরণ দেন তা ঘটনার সমসাময়িককালে তাঁর মনে কীরূপ প্রভাব ফেলেছিল, তিনি কীরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন বা সেই ঘটনার সমসাময়িক পরিস্থিতি কীভাবে পালটে যেতে দেখেছেন তা তাঁর স্মৃতিকথার আলোচনায় উঠে আসে।
স্মৃতিকথার উদাহরণ
স্মৃতিকথার বিভিন্ন উদাহরণ রয়েছে। যেমন –
(১) মণিকুন্তলা সেনের স্মৃতিকথা
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট কলকাতায় মুসলিম লীগ-এর উদ্যোগে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রসঙ্গে মণিকুন্তলা সেন তাঁর স্মৃতিকথা ‘সেদিনের কথা’য় লিখেছেন, “মুসলিম লিগ একটা মিছিলে যোগ দিতে আহ্বান জানাল মুসলিম জনতাকে। এই মিছিল থেকে যে একটা কিছু ঘটবে এটা সবাই অনুমান করছিল।… মিছিল যত এগোয় মারামারি ও লুঠপাট ততই চলতে থাকে।” তাঁর স্মৃতিকথার এই তথ্য ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট কলকাতায় শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হতে পারে।
(২) আশালতা সরকারের স্মৃতিকথা
বিপ্লবী আশালতা সরকারের লেখা ‘আমি সূর্য সেনের শিষ্যা’ একটি স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তাঁর ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের মানসিকতা গড়ে ওঠা, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নায়ক মাষ্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী দলে যোগদানের আগ্রহ, সূর্য সেনের সাক্ষাৎ লাভ, লড়াইয়ের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ, সশস্ত্র লড়াই, জেলযাত্রা প্রভৃতি ঘটনার বিবরণ রয়েছে।
(৩) নারায়ণ সান্যালের স্মৃতিকথা
সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যালের লেখা ‘আমি নেতাজীকে দেখেছি’ একটি স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন ঘটনা প্রকাশ করেছেন। এই স্মৃতিকথা থেকে সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে সমসাময়িক বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া সম্ভব।
(৪) সুফিয়া কামালের স্মৃতিকথা
বাংলাদেশ-এর সাহিত্যিক সুফিয়া কামালের লেখা ‘একাত্তরের ডাইরী’ একটি মূল্যবান স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তান-এর বর্বরতার নানা টুকরো ঘটনা, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের বিভিন্ন টুকরো ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এই স্মৃতিকথার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
(৫) মান্না দে -র স্মৃতিকথা
প্রয়াত সঙ্গীত শিল্পী মান্না দের বাংলায় লেখা আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি পরে ইংরেজিতে ‘মেমরিজ কাম অ্যালাইভ’, হিন্দিতে ‘ইয়াদেন জি উঠি’ নামে প্রকাশিত হয়। স্মৃতিকথাটি মারাঠি ও অন্যান্য ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। মান্না দে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে আমৃত্যু হিন্দি ও বাংলা সংগীতের জনপ্রিয় শিল্পী হিসেবে বিচরণ করেছেন। এই সময়কালে মুম্বই ও কলকাতার বিভিন্ন শিল্পী, সংগীতচর্চার ইতিহাস লিখতে গেলে মান্না দে রচিত স্মৃতিকথা ‘জীবনের জলসাঘরে’ নিঃসন্দেহে একটি মূল্যবান ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে।
(৬) জ্যোতি বসু-র স্মৃতিকথা
পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু-র স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ ‘যতদূর মনে পড়ে’ থেকে তাঁর সমসাময়িক ইংরেজ শাসন এবং স্বাধীন ভারত-এর রাজনৈতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে বহু ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া সম্ভব।
(৭) দক্ষিণারঞ্জন বসুর স্মৃতিকথা
দক্ষিণারঞ্জন বসু সম্পাদিত ‘ছেড়ে আসা গ্রাম‘ নামে গ্রন্থটিতে উল্লিখিত বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিকথা থেকে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে বহু ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া সম্ভব ।
স্মৃতিকথার গুরুত্ব
স্মৃতিকথামূলক বিবরণগুলির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। যেমন –
(১) গুণীজনদের বিবরণ
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্মৃতিকথাগুলি গুণী ব্যক্তিরা রচনা করেন। ফলে তাতে অবান্তর, পক্ষপাতমূলক ও অতিরঞ্জিত ঘটনার প্রবেশ হ্রাস পায় এবং এগুলি থেকে অতীতের বিভিন্ন বাস্তব ঘটনার তথ্য ও বিবরণ পাওয়া যায়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার দাঙ্গার ঘটনাবলি বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়।
(২) প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ
বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ঘটনার বিবরণ তাঁদের স্মৃতিকথাগুলিতে আলোচনা করেন। ফলে উক্ত বিবরণে ঐতিহাসিক তথ্যের সত্যতা অনেক বেশি থাকে।
(৩) ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব
বিভিন্ন স্মৃতিকথা বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার মূল্যবান উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর পাক বাহিনী পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের ওপর যে বর্বর-নৃশংস অত্যাচার ও হত্যালীলা চালিয়েছিল তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হল স্মৃতিকথাগুলি। কেননা, পাক সামরিক বাহিনী তখন পূর্ববাংলার সমস্ত সংবাদ গোটা বিশ্ব থেকে আড়াল করেছিল।
সমালোচনা
কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, স্মৃতিকথা থেকে সঠিক ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া সম্ভব হয় না। এর কারণ হল,
- (১) কোনো বিশেষ মতাদর্শের প্রতি নিজের সমর্থন জানাতে গিয়ে কোনো কোনো ব্যক্তি নিজেদের স্মৃতিকথায় অতীতের প্রকৃত ঘটনাকে বহুক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত করেন।
- (২) স্বল্পশিক্ষিত ব্যক্তিরা অনেক সময় তাদের স্মৃতিকথায় সঠিকভাবে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারেন না।
- (৩) একই ঘটনা বহুকাল পর বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিকথায় বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়। ফলে সঠিক ঘটনা জানা মুশকিল হয়ে পড়ে।
উপসংহার :- কিছু কিছু স্মৃতি মনের মধ্যে আজও ভোরের কোকিলের মত ডেকে ওঠে। ফেলে আসা গ্রামের স্মৃতি, বিকেলের ঢলে পড়া হলুদ সূর্যের আলোর মত ডাক পাঠায়। মাঝে মাঝে বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে ওঠে। মাথার ভেতরটা টনটন করে ওঠে। মনে হয় ফিরে যায় সেই শৈশবে, মনে হয় ফিরে যাই সেই স্মৃতির সমুদ্রে। তাই এই স্মৃতিকথা গুলি অন্যতম নস্টালজিক বই হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
স্মৃতিকথা টপিকের প্রথম অংশ নিয়ে আলোচনা
(FAQ) স্মৃতিকথা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
স্মৃতিকথা হল এক ধরনের সাহিত্য যেখানে লেখক তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া বা জীবনে প্রত্যক্ষ করা বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ স্মৃতি থেকে এনে তুলে ধরেন।
সেদিনের কথা।
আমি সূর্য সেনের শিষ্যা।
আমি নেতাজিকে দেখেছি।
জীবনের জলসাঘরে।