ইঙ্গ-শিখ সম্পর্ক প্রসঙ্গে রণজিৎ সিংহ, অমৃতসরের সন্ধি, শিখ রাষ্ট্রে ভাঙন, প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ, শিখদের পরাজয়, লাহোরের সন্ধি, লাহোরের দ্বিতীয় সন্ধি, দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ, শিখদের পরাজয় ও যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে জানবো।
ইঙ্গ-শিখ সম্পর্ক
ঐতিহাসিক ঘটনা | ইঙ্গ-শিখ সম্পর্ক |
দশম শিখ গুরু | গুরু গোবিন্দ সিংহ |
পাঞ্জাব কেশরী | রণজিৎ সিংহ |
অমৃতসরের সন্ধি | ১৮০৯ খ্রি: |
প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ | ১৮৪৫-৪৬ খ্রি: |
লাহোরের সন্ধি | ১৮৪৬ খ্রি: |
দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ | ১৮৪৮-৪৯ খ্রি: |
ভূমিকা :- গুরু গোবিন্দ সিংহ-এর মৃত্যুর পর শিখদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা দানা বাঁধে। রণজিৎ সিংহ (১৭৮০-১৮৩৯ খ্রিঃ) বিবাদমান শিখ মিশল গুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে অখণ্ড শিখ রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী হন।
ইংরেজদের কাছে রণজিৎ সিংহের নতি স্বীকার
কিন্তু শিখ মিশলগুলি ইংরেজের সাহায্যপ্রার্থী হলে ইংরেজরা শিখদের বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ পায়। ইংরেজের চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হন রণজিৎ সিংহ।
ইঙ্গ-শিখ সম্পর্কে অমৃতসরের সন্ধি
এরপর রণজিৎ সিংহ ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজের সাথে অমৃতসরের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধিতে –
- (১) শতদ্রু নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত রণজিৎ সিংহের রাষ্ট্রসীমা নির্দিষ্ট করা হয়।
- (২) পূর্ব তীরের মিশলগুলির ওপর তিনি দাবি ত্যাগ করেন।
ইঙ্গ-শিখ সম্পর্কে অমৃতসরের সন্ধির তাৎপর্য
এই চুক্তি ইংরেজদের কূটনৈতিক সাফল্য ও রণজিৎ সিংহের চরম ব্যর্থতার অন্যতম নিদর্শন।
অমৃতসরের সন্ধি সম্পর্কে নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের মন্তব্য
ড. নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ এই চুক্তিকে শিখ সামরিক জাতীয়তাবাদের বিয়োগান্তক পরিণতি তথা গুরু গোবিন্দ সিংহের আদর্শবাদের অবসান বলে বর্ণনা করেছেন।
শিখ রাষ্ট্রে ভাঙন
রণজিৎ সিংহের মৃত্যুর পর শিখ রাষ্ট্রে ভাঙন দেখা দেয়। চক্রান্ত ও দুর্ঘটনায় তাঁর দুই পুত্র ও এক পৌত্র অকালে মারা গেলে সিংহাসনে বসেন তাঁর নাবালক পুত্র দলীপ সিংহ এবং তাঁর পরিচালিকা নিযুক্ত হন রানিমাতা ঝিন্দন।
ইঙ্গ-শিখ সম্পর্কে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ
খালসাবাহিনী অমৃতসরের সন্ধি ভঙ্গ করে শতদ্রু নদী অতিক্রম করলে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ শুরু হয় (১৮৪৫-৪৬ খ্রিঃ)। কিন্তু শিখনেতা লালসিংহ ও তেজসিংহের অযোগ্যতা ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য খালসাবাহিনী বিপর্যস্ত হয়।
প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে শিখদের পরাজয়
পর পর মুদকী, ফিরোজশা, আলিওয়াল ও স্রোব্রাওঁ-এর যুদ্ধে শিখরা পরাজিত ও বিধ্বস্ত হয়। ইংরেজবাহিনী শতদ্রু অতিক্রম করে রাজধানী লাহোর দখল করলে শিখরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
ইঙ্গ-শিখ সম্পর্কে লাহোরের সন্ধি
শেষ পর্যন্ত ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে লাহোরের সন্ধি দ্বারা যুদ্ধের অবসান ঘটে।
লাহোরের সন্ধির শর্ত
এই সন্ধির শর্ত অনুসারে –
- (১) বিপাশা ও শতদ্রু নদীর মধ্যবর্তী জলন্ধর-দোয়াব এবং শতদ্রু নদীর দক্ষিণস্থ সকল ভূভাগ ইংরেজদের হাতে সমর্পিত হয়।
- (২) ক্ষতিপূরণ হিসেবে শিখদের দেড় কোটি টাকা দিতে হয়। কিন্তু তাদের এত টাকা দেবার সামর্থ্য না থাকায় তারা কাশ্মীর রাজ্যটি ইংরেজদের ছেড়ে দেয়।
- (৩) শিখ সৈন্যের সংখ্যা হ্রাস করা হয় এবং
- (৪) লাহোরে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি (রেসিডেন্ট) রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
ইংরেজ কর্তৃক কাশ্মীর রাজ্য বিক্রি
পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে কাশ্মীর রাজ্যটি জম্মুর ডোগরা সর্দার ও লাহোর দরবারের অন্যতম প্রধান সদস্য গোলাব সিংহকে বিক্রি করে। এই ঘটনায় লাহোর দরবারে তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
ইংরেজদের সম্পর্কে কানিংহামের মন্তব্য
ইংরেজ ঐতিহাসিক কানিংহাম-এর মতে এই ব্যবস্থা ইংরেজদের সুনাম ও মহত্ত্বের সঙ্গে একান্ত সামঞ্জস্যহীন।
ইঙ্গ-শিখ সম্পর্কে লাহোরের দ্বিতীয় সন্ধি
১৮৪৬-এ শিখ নেতাদের সঙ্গে ইংরেজের আরো একটি চুক্তি হয়। এটির নাম ভৈরওয়াল-এর চুক্তি। এটি লাহোরের দ্বিতীয় সন্ধি নামেই পরিচিত।
লাহোরের দ্বিতীয় সন্ধির শর্ত
এই সন্ধির শর্তানুসারে,
- (১) ব্রিটিশ রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণাধীনে আটজন শিখ নেতাকে নিয়ে গঠিত একটি পরিষদের (Council of Regency) হাতে শিখরাজ্যের শাসনভার অর্পিত হয়।
- (২) লাহোরে একদল ইংরেজ সেনা রাখার ব্যবস্থা হয় এবং তার ব্যয়-নির্বাহের জন্য শিখ সরকার বার্ষিক ২২ লক্ষ টাকা দিতে সম্মত হন।
পাঞ্জাবে ব্রিটিশ শাসনের নামান্তর
বলা বাহুল্য, এর ফলে শিখরাজ্যে কার্যত ব্রিটিশ শাসনই প্রবর্তিত হয় এবং ইংরেজ রেসিডেন্ট স্যার হেনরি লরেন্স-ই রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতার নিয়ামকে পরিণত হন।
শিখ জাতির ক্ষোভ বৃদ্ধি
লাহোর ও ভৈরওয়াল-এর সন্ধির অপমানকর শর্ত ক্রমেই শিখদের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ রেসিডেন্ট হেনরি লরেন্স-এর ঔদ্ধত্য শিখজাতির মনে ক্ষোভ বৃদ্ধি করতে থাকে।
খালসা বাহিনী ভঙ্গ
খালসাবাহিনী ভেঙে দেবার ফলে যে শিখরা চাকরি হারায়, তারাও ইংরেজের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ খুঁজতে থাকে।
ইংরেজ কর্তৃক রানি ঝিন্দনের নির্বাসন
এমন সময়ে ইংরেজ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে ইংরেজগণ রানি ঝিন্দনকে চুনার দুর্গে নির্বাসিত করলে শিখরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ
প্রথমে মুলতান ও পরে হাজারার শাসকগণ ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। আফগানরা শিখদের সাথে যোগ দেয়। এইভাবে দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ (১৮৪৮-৪৯ খ্রিঃ) শুরু হয়।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে শিখদের চূড়ান্ত পরাজয়
দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য শিখরা মরিয়া হয়ে লড়াই করে। রামনগর ও চিলিয়ানওয়ালা নামক স্থানের যুদ্ধে শিখরা তুমুল লড়াই করে। কিন্তু ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের যুদ্ধে শিখবাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত পাঞ্জাব
গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি ২৯ মার্চ, ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে এক ঘোষণাপত্র জারি করে সমগ্র পাঞ্জাবকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেন।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের ফলাফল
এই যুদ্ধের ফলে-
- (১) সমগ্র পাঞ্জাব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং রণজিৎ সিংহের প্রতিষ্ঠিত শিখরাজ্যের পতন ঘটে।
- (২) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন আফগানিস্তান-এর সীমানা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়।
- (৩) দলীপ সিংহ সিংহাসনচ্যুত হন এবং ইংরেজদের বৃত্তিভোগী হয়ে লণ্ডনে নির্বাসিত হন।
- (৪) খালসা বাহিনী ভেঙ্গে দেওয়া হয়।
ইঙ্গ-শিখ সম্পর্কে ইংরেজদের সমালোচনা
- (১) বিদ্রোহের অজুহাতে দলীপ সিংহের পদচ্যুতি ও ইংরেজদের পাঞ্জাব অধিকার নৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে কোনওক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়।
- (২) মূলরাজের বিদ্রোহ ও তার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দলীপ সিংহ কোনওক্রমেই দায়ী ছিলেন না, কারণ পাঞ্জাব প্রশাসনের সকল দায়িত্বই তখন ইংরেজ রেসিডেন্টের ওপর ন্যস্ত ছিল।
- (৩) দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের জন্য লর্ড ডালহৌসি শিখদের দায়ী করলেও জেমস মিল, কানিংহাম প্রমুখ ঐতিহাসিকরা এই যুদ্ধের জন্য কোম্পানির আগ্রাসী নীতিকেই দায়ী করেছেন।
- (৪) ট্রট্রার (Trotter)-এর মতে পাঞ্জাব জয়ের ক্ষেত্রে “ডালহৌসির নীতিই ছিল নীতিবর্জিত ও অযৌক্তিক।” বেল (Bell)-এর মতে পাঞ্জাব দখল হল ‘চরম বিশ্বাসঘাতকতা’ (‘a violent breach of trust”)।
- (৫) এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, পাঞ্জাব জয়ের ফলে কোম্পানির সাম্রাজ্যের সীমা আফগানিস্তানকে স্পর্শ করে এবং এর ফলে কোম্পানি আফগান সমস্যার সম্মুখীন হয়। পাঞ্জাব দখল না করলে আফগানিস্তান নিয়ে ইংরেজদের এতটা বিব্রত হতে হত না।
ইঙ্গ-শিখ সম্পর্কে শিখ শক্তির পতনের কারণ
শিখদের পতনের পশ্চাতে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল। যেমন –
- (১) শিখ শক্তির পতনের জন্য মহারাজা রণজিৎ সিংহের দায়িত্ব অস্বীকার করা যায় না। তিনি রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা ছিলেন এবং সব ক্ষমতাই তাঁর কুক্ষিগত ছিল। বলা হয়, তিনি নিজেই ছিলেন তাঁর রাষ্ট্র (‘state in person’)। তাঁর মৃত্যুর পর দুর্বল উত্তরাধি কারীদের আমলে এক বিরাট শূন্যতা দেখা দেয় এবং এর ফলে পুরো শাসনযন্ত্র ভেঙে পড়ে।
- (২) রণজিৎ সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর সেনাবাহিনীতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সেনাবাহিনী উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে এবং দরবারের রাজনীতিতে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করতে থাকে। এর ফলাফল রাষ্ট্রের পক্ষে ভালো হয় নি।
- (৩) রণজিৎ সিংহের রাজ্যের আয় অপেক্ষা তাঁর সেনাবাহিনীর ব্যয় ছিল বেশি। এ জন্য তিনি বেতনের পরিবর্তে সৈনাদের জায়গির দিতে শুরু করেন। জায়গির পেয়ে সেনাদল রাষ্ট্রের স্বার্থ উপেক্ষা করে জায়গিরের দিকেই বেশি নজর দিতে শুরু করে, যা রাষ্ট্রের পক্ষে ক্ষতিকারক ছিল।
- (৪) যুদ্ধে শিখ সেনাপতিদের অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ ও বিশ্বাসঘাতকতা শিখদের পতনের অন্যতম কারণ। প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে লাল সিংহ ও তেজ সিংহ ইংরেজদের অনেক গোপন তথ্য সরবরাহ করেন।
- (৫) এই সময় ভারত-এ শিখদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল প্রবল পরাক্রান্ত ইংরেজরা। দুর্বল, অন্তর্দ্বন্দ্বে বিভক্ত শিখরা কখনোই ইংরেজদের রণকৌশল, উন্নত মানের কামান এবং দক্ষ সেনাপতিদের সমকক্ষ ছিল না। তাই ইংরেজ শক্তির জয় ও শিখদের পতন এক রকম সুনিশ্চিত ছিল।
উপসংহার :- রাজ্যচ্যুত দলীপ সিংহকে ইংল্যান্ডে নির্বাসিত করা হয়। এইভাবে রণজিৎ সিংহের মৃত্যুর মাত্র দশ বছরের মধ্যে স্বাধীন শিখ রাজ্যের অবলুপ্তি ঘটে।
(FAQ) ইঙ্গ-শিখ সম্পর্ক সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
রণজিৎ সিংহ।
১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে।
১৮৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দ।
১৮৪৬ খ্রি:।
১৮৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দ।