বৌদ্ধ ধর্মের দুটি শাখা মহাযান ও হীনযান প্রসঙ্গে মহাযানবাদ, বুদ্ধযান, হীনযান, পারমিতা তত্ত্ব, বোধিসত্ত্ব, হীনযান মতের লক্ষ্য, কয়েকজন বোধিসত্ত্ব, পারমিতার অধিকারী, মহাযানবাদের জনপ্রিয়তা, মহাযান ধর্মের প্রসার ও হীনযান ধর্মের প্রসার সম্পর্কে জানবো।
বৌদ্ধ ধর্মের দুটি শাখা মহাযান ও হীনযান
ঐতিহাসিক ঘটনা | বৌদ্ধ ধর্ম -এ মহাযান ও হীনযান |
প্রবর্তক | গৌতম বুদ্ধ |
ধর্মগ্ৰন্থ | ত্রিপিটক |
সমকালের অন্য ধর্ম | জৈন ধর্ম |
পূর্ববর্তী ধর্ম | ব্রাহ্মণ্যধর্ম |
ভূমিকা :- গৌতম বুদ্ধ প্রচারিত বৌদ্ধ ধর্ম ভারত ও ভারতের বাইরে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। বৌদ্ধ ধর্মের দুটি বিভাগ হল মহাযান ও হীনযান। চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতিতে এই দুটি মতবাদ গড়ে ওঠে।
মহাযানবাদ
- (১) চতুর্থ বৌদ্ধ সঙ্গীতিতে সর্বাস্তিবাদিদের মধ্যে মতভেদ দূর করা হয়। এই অধিবেশনের ফলে সর্বাস্তিবাদীদের মতভেদ দূর হয়ে যে ধর্মমত গড়ে ওঠে তার নাম হয় মহাযান। সর্বাস্তিবাদের মতে বুদ্ধের আদি ধর্মমতের মধ্যেই মহাযানবাদের বীজ ছিল।
- (২) গবেষক এ কে ওয়ার্ডারের মতে, প্রথম উঠাতে দক্ষিণ ভারতে সর্বপ্রথম মহাযানবাদের উত্তর হয়। মহাযানবাদের প্রধান ব্যাখ্যাকারদের জন্ম হয় দক্ষিণ ভারতে। এঁদের মধ্যে নাগার্জুনের নাম করা যায়।
বুদ্ধযান
বুদ্ধ বলেছিলেন যে, নিজের মুক্তির কথা না ভেবে আগে অপরের মুক্তির চিন্তা করা উচিত। একে তিনি বলেন বুদ্ধযান। এই মতকে সার করে যে ধর্মমত গড়ে ওঠে তার নাম হয় মহাযান।
হীনযান
যারা আদি বৌদ্ধধর্ম বা থেরবাদকে আঁকতে থাকেন তাদের ধর্মের নাম হয় হীনযান। হীনযানবাদীরা অষ্টমার্গের সাধনাকেই মুক্তির একমাত্র পথ মনে করতেন। হীনযানবাদীরা নৈতিক আচরণকে শ্রেয় মনে করতেন।
মহাযান ধর্মে পারমিতাতত্ত্ব
বৌদ্ধ ধর্মের মহাযানবাদে বুদ্ধকে দেবতার আসনে বসান হয়। বুদ্ধের মূর্তি পুজো আরম্ভ হয়। বোধিসত্ববাদ অর্থাৎ বুদ্ধের পূর্ববর্তী জন্মকেও মূল্য দেওয়া হয়। এর ওপরে নির্ভর করে পারমিতাতত্ত্ব রচিত হয়। মহাযানবাদীরা বুদ্ধ মূর্তির পুজো ও ভক্তিকেই মুক্তির পথ ভাবতে থাকেন। মহাযানীরা তন্ত্রে-মন্ত্রে বিশ্বাস করতেন।
মহাযান ধর্মে বোধিসত্ত্ব
- (১) মহাযানবাদীরা ভক্তিকেই শ্রেয় মনে করতেন। মহাযানবাদের কয়েকটি বিশেষ দিক লক্ষ্য করা যায়। বোধিসত্ত্বের কল্পনা এই ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যার বোধি চিত্তের বিকাশ হয় তিনিই বোধিসত্ত্ব, তিনি বোধি লাভ করে বুদ্ধ হন।
- (২) মহাযানীদের মতে অর্হত্ব পদপ্রাপ্তি অপেক্ষা বোধিসত্ব পদপ্রাপ্তি একটি মহত্বর প্রাপ্তি। আদি মহাযানসূত্রের নাম রত্নকূট সূত্র। এর থেকে জানা যায় যে বোধিসত্বের চিন্তাধারা বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে উদ্ভূত হয়।
- (৩) জরাথুষ্ট ধর্মমতের প্রভাবে বুদ্ধকে ত্রাণকর্তা বলে মনে করা আরম্ভ হয়। ক্রমে এই বিশ্বাস বলবতী হয় যে, বুদ্ধ শাক্যকুলে বুদ্ধ হিসেবে জন্মাবার আগে অনেক বার বোধিসত্ব হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। বুদ্ধের মৃত্যুর পর বোধিসত্বের কল্পনা দ্রুত প্রসার লাভ করে।
- (৪) মহাযানীরা বিশ্বাস করতেন যে, জগতের সকল প্রাণীকে জন্মান্তর ও কর্মফলের হাত থেকে মুক্ত না করে বোধিসত্ব নিজে মুক্তি লাভ করবেন না বা নির্বাণ লাভ করবেন না। ক্ষুদ্রতম জীবেরও মুক্তি না হলে তিনি অপেক্ষা করবেন।
হীনযান মতের লক্ষ্য
হীনযানীদের মত অর্হত্ব লাভ তার লক্ষ্য নয়। তার লক্ষ্য হল বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি। হীনযানে বুদ্ধ নৈতিক নিয়ম পালন করলে নির্বাণ লাভের পথ দেখান। হীনযানে তিনি এক প্রচারক মাত্র।
চারটি গুণ
বোধি চিত্ত লাভের জন্যে চারটি গুণের অণুশীলন করা দরকার। যথা অনিমিত্ততা বা বৈশিষ্ট্য অর্জনের চেষ্টা না করা, অপ্রনিহিতা বা কোনো কিছুতে আসক্তি না রাখা, বিমোক্ষ বা মুক্তি ও শূন্যতা।
মহাযান মতে প্রাপ্ত কয়েকজন বোধিসত্ত্ব
বোধিসত্ব করুণা ও দুঃখের প্রতিমূর্তি। সকলের পাপের জন্যে তিনি প্রায়শ্চিত্ত করেন। মহাযানে কয়েকজন বোধিসত্বের কথা জানা যায়। যথা – মঞ্জুশ্রী, অবলোকিতেশ্বর, বজ্রপানি, মৈত্রেয় প্রমুখ। অবলোকিতেশ্বর হলেন করুণার প্রতিমূর্তি, মঞ্জুশ্রী জ্ঞানের, তিনি চিরনবীন, বজ্রপানি নির্মম, অন্যায় ও পাপের দণ্ডদাতা।
পারমিতার অধিকারী
কোনো গৃহী বা সন্ন্যাসী যদি বোধিসত্ব গুণের অধিকারী হন তাকে বুদ্ধত্ব পেতে হলে দশটি গুণ বা পারমিতার অধিকারী হতে হবে। এই দশটি গুণ হল দান, শীল, বীর্য, ক্ষান্তি, ধ্যান, প্রজ্ঞা, উপায়, কৌশল্যা, প্রণিধান, বল ও জ্ঞান। এর ওপর মহাযানবাদীরা বুদ্ধের দেবত্ব আরোপ করে বুদ্ধ মূর্তির পুজোর প্রবর্তন করেন।
মহাযানবাদের জনপ্রিয়তা
নাগার্জুন, বসুবন্ধু, আসঙ্গ প্রভৃতির প্রচারের ফলে মহাযানবাদ জনপ্রিয়তা পায়।
মহাযান মত অনুসারে দেবতার আসনে বুদ্ধ
মহাযানবাদে বৌদ্ধধর্ম প্রায় একটি নতুন রূপ লাভ করে। মহাযানে বুদ্ধ দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত। তিনি মানুষকে ত্রাণ করতে সক্ষম এবং তার প্রার্থনা পূরণে সক্ষম।
মহাযান মতে সমষ্টির মুক্তি
মহাযানে সমষ্টির মুক্তির কথা চিন্তা করা হয়। মহাযানে বোধিসত্ব অপরের পাপের ভার বইতেন ও তার মুক্তির ব্যবস্থা করতেন। মহাযান আশাবাদী।
হীনযান মত দুঃখবাদী
হীনযানে ব্যক্তির মুক্তির কথা বলা হয়েছে। হীনযান আত্মপর, মহাযান পরার্থপর। হীনযানে নিজের মুক্তি নিজেকে অর্জন করতে হয়। “আত্মদীপ” হতে হয়। হীনযান দুঃখবাদী।
মহাযান ও হীনযান মতে শূন্যতার ব্যাখ্যা
হীনযানীরা ‘শূন্যতা’র যে ব্যাখ্যা করেন, মহাযানীরা তা অপেক্ষা ব্যাপক অর্থে শূন্যতার ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা বলেন যে, অপবিত্রতার আবরণকে শূন্য করা এবং সত্যের আচ্ছাদনকে শূন্য করাই হল প্রকৃত শূন্যতা। তাদের কাছে অষ্টমার্গ একটি আচরণ বিধিমাত্র। ভেলার দ্বারা জলাশয় পার হয়ে যেমন লোকে ভেলা ছেড়ে দেয়, তেমন মুক্ত হলে অষ্টপথের আর দাম থাকে না। তা শূন্য হয়ে যায়।
মহাযান ও হীনযান মতের ক্ষেত্রে বুদ্ধ
হীনযানীদের কাছে বুদ্ধ ছিলেন এক সর্বজ্ঞ পুরুষ। মহাযানীদের কাছে তিনি ছিলেন শাশ্বত, চিরন্তন, সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, হীন, অনাদি, অনন্ত। তিনি অবর্ণনীয়, সত্য। তিনি ত্রিকায় – ধর্মকায়, সম্ভোগকায় এবং নির্মাণকায়। তাঁর আবির্ভাব নেই, তিরোভাব নেই। তিনি অমিতাভ। তিনি মানুষকে ত্রাণের জন্যে পৃথিবীতে আসেন।
মহাযান ধর্মের প্রসার
মহাযানবাদ সম্পর্কে বলা যায় যে, এই ধর্মমত বিশেষ জনপ্রিয় হয় এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ও ভারতের বাইরে প্রসার লাভ করে। দক্ষিণে অন্ধ্রদেশ ছিল মহাযান ধর্মের প্রধান কেন্দ্র।
মহাযান ধর্মের সমালোচনা
মহাযানবাদের বিরুদ্ধে বলা হয় যে, গৌতম বুদ্ধ এই ধর্মমত প্রচার করেন নি এবং মহাযানে প্রত্যেক বুদ্ধযানকে কার্যকরী করা সম্ভবপর নয়। মহাযানী লেখকরা এই সমালোচনা খণ্ডন করেছেন।
মহাযান দর্শনের প্রবক্তা
নাগার্জুন ও আসঙ্গ ছিলেন মহাযান দর্শনের প্রধান প্রবক্তা। যোগাচার দর্শন, মাধ্যমিক দর্শন, সংশয়বাদ, শূন্যতাবাদ তারাই প্রচার করেন। সুত্রালঙ্কার যোগাচার দর্শনের বিখ্যাত গ্রন্থ।
হীনযান ধর্মের প্রসার
অশোক -এর আমলে হীনযানবাদের বিশেষ প্রসার ঘটেছিল। ভারতের বাইরে সিংহল ও ব্রহ্মদেশে অশোকের আমলে এই ধর্ম প্রচারিত হয়।
উপসংহার :- কণিষ্ক -এর আমলে মহাযানবাদ মধ্য এশিয়া, চীন, তিব্বতে প্রচারিত হয়। মহাযানবাদের বিখ্যাত প্রবক্তা হিসেবে নাগার্জুন পঞ্চবিংশতি সহস্রিকা প্রজ্ঞা পারমিতা রচনা করেন।
(FAQ) বৌদ্ধ ধর্মের দুটি শাখা মহাযান ও হীনযান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
গৌতম বুদ্ধ।
ত্রিপিটক।
চারটি।
রাজগৃহে।
প্রাকৃত ভাষা।
হীনযান ও মহাযান।
মহাযান।