পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩–১৯৩১) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি সংস্কৃত পণ্ডিত, ইতিহাসবিদ, এবং গবেষক। তিনি চর্যাপদ আবিষ্কারের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত, যা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। বাংলা সাহিত্যের আদি ইতিহাস অনুসন্ধানে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। শাস্ত্রী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন এবং প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির গবেষণায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

ঐতিহাসিক চরিত্রহরপ্রসাদ শাস্ত্রী
জন্ম৬ ডিসেম্বর, ১৮৫৩ খ্রি
জন্মস্থানখুলনা, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ)
পেশাসংস্কৃত পণ্ডিত, ইতিহাসবিদ, গবেষক
প্রধান আবিষ্কারচর্যাপদ, বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন
গবেষণা ক্ষেত্রপ্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
খ্যাতিচর্যাপদের আবিষ্কর্তা এবং বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যিক নিদর্শনের সন্ধানী
মৃত্যু১৭ নভেম্বর, ১৯৩১ খ্রি
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

ভূমিকা :- বাংলার সারস্বত সমাজের অন্যতম পুরোধা পুরুষ হলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জন্ম

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জন্ম চব্বিশ পরগনার নৈহাটির প্রসিদ্ধ ভট্টাচার্য বংশে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর। তাঁর পিতা রামকমল ন্যায়রত্ন পাণ্ডিত্য ও বিদ্যাচর্চার জন্য এতদঞ্চলে সুপরিচিত ছিলেন।

গবেষক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বংশ পরিচয়

নিজের বংশ পরিচয় সম্পর্কে হরপ্রসাদ লিখেছেন, “আমার পূর্বপুরুষেরা যশোর জেলা ত্যাগ করিয়া নৈহাটিতে আসিয়া বসতি করেন। সেখানে ন্যায়শাস্ত্রের টোল খুলিয়া অধ্যাপনা শুরু করেন। একশত বৎসর ধরিয়া এই অঞ্চলের নৈয়ায়িকেরা আমাদের বাড়ির পাঠ স্বীকার করিয়া আসিয়াছেন। অনেকেই নৈহাটিতে পাঠ স্বীকার করিয়া তথা হইতে উপাধি লইয়া গিয়াছেন।”

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বাল্য শিক্ষা

নৈহাটিতে সেই সময় অপরাপর টোলের মধ্যে ভট্টাচার্য পরিবারের টোল ছিল শীর্ষ স্থানীয়। বিদ্যাচর্চার এই পরিবেশের মধ্যেই হরপ্রসাদের বাল্যকালের শিক্ষা সমাপ্ত হয়।

পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দাদা নন্দকুমার

হরপ্রসাদের বড় দাদা নন্দকুমার অল্প বয়সেই ন্যায়শাস্ত্রে সুপন্ডিত হয়েছিলেন। তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করতেন। পরে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যোগাযোগে মুর্শিদাবাদ জেলার পাইকপাড়ার রাজাদের কান্দী স্কুলে হেড পণ্ডিতের পদ লাভ করেন।

গবেষক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর শিক্ষাজীবন

  • (১) ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে রামকমলের মৃত্যু হয়। তখন নন্দকুমার নৈহাটি থেকে ছোট ভাইদের নিয়ে কান্দী স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানে বাংলা ও সংস্কৃতের সঙ্গে ইংরাজি ভাষাও শিক্ষা দেওয়া হত। হরপ্রসাদের ইংরাজি শিক্ষা এখানেই শুরু হয়। স্কুলে হরপ্রাসাদের নাম ছিল শরৎনাথ ভট্টাচার্য। যথারীতি এই নামেই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন।
  • (২) রামকমলের মৃত্যুর কিছুকাল পরেই নন্দকুমারও পরলোকে গমন করেন। ফলে পরিবারে অর্থাভাব দেখা দেয়। পরিণতিতে হরপ্রসাদের লেখাপড়াতেও বিঘ্ন ঘটে। তাঁকে কিছুদিন কাঁচড়াপাডাব টোলে ও পরে নৈহাটির স্থানীয় স্কুলে পড়াশুনা করতে হয়।
  • (৩) সেই সময়ে দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছাত্রদের জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়িতে একটি ছাত্রাবাস ছিল। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে সেই ছাত্রাবাসে আশ্রয়লাভ করে হরপ্রসাদ সংস্কৃত কলেজে পড়াশুনা শুরু করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ কিছুদিন পরেই আশ্রয়চ্যুত হতে হয় তাঁকে, ছাত্রাবাসটি উঠে যায়।
  • (৪) এরপর তিনি বউবাজারে নেবুতলা অঞ্চলে গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশ্রয় লাভ করেন। বিনিময়ে তাঁকে বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়াতে হত। এই সময় দারিদ্র্যের মধ্যে থেকে তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করে পড়ালেখা করতে হয়েছে। আশ্রয়দাতার ছেলেমেয়েদের পড়ানো, নিজে হাতে রান্নাবান্না- এত সব করে যেটুকু সময় পাওয়া যেত তার সদ্ব্যবহার করতে ত্রুটি করতেন না তিনি।
  • (৫) সংস্কৃত কলেজে সেই সময় রঘুবংশ পড়াতেন রামনারায়ণ তর্করত্ব। সমগ্র রঘুবংশটি হরপ্রসাদের কণ্ঠস্থ হয়ে যায়। অসাধারণ মেধা, আগ্রহ ও যত্নের বলে ক্লাসে বরাবরই ভাল ফল করতেন তিনি। শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পর পর দুবার ডবল প্রমোশন পেয়েছিলেন এবং পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করায় আট টাকা বৃত্তি পান।
  • (৬) নানাপ্রকার প্রতিকূলতার মধ্যেই ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রাস, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে এফ.এ এবং ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে অষ্টম স্থান অধিকার করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি. এ পাস করেন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে এম-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর সংস্কৃত কলেজ থেকে শাস্ত্রী উপাধি পান।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নাম পরিবর্তন

এক ঘটনার মাধ্যমে তাঁর নামের পরিবর্তন ঘটাতে হল। একবার কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হল হরপ্রসাদ। জীবনের আশা প্রায় ছেড়েই দিতে হয়েছিল। তখন শিবের কাছে মানত করলে তিনি আরোগ্য লাভ করেন। হরপ্রসাদ শিবের প্রসাদে নবজীবন লাভ করেছিলেন বলে শরৎনাথ নামের পরিবর্তে তাঁর হরপ্রসাদ নামকরণ হয় এবং পরবর্তীকালে এই নামেই তিনি দেশবিখ্যাত হন।

শিক্ষক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

বি.এ. ক্লাসে পড়াকালীনই হরপ্রসাদ ‘ভারত মহিলা’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করে হোলকার পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এম-এ পাস করার পর হেয়ার স্কুলে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা হয়। এখানে শিক্ষকতা করার সময়েই ১৮৭৮ খ্রিঃ তিনি বিবাহ করেন। তাঁর পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা জন্মগ্রহণ করে।

পুঁথি অনুবাদের কাজে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

সেই সময়ে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন। তাঁর মাধ্যমে হরপ্রসাদের যোগাযোগ হয় রাজেন্দ্রলাল মিত্রর সঙ্গে। এশিয়াটিক সোসাইটির সহযোগিতায় রাজেন্দ্রলাল তখন কিছু প্রাচীন বৌদ্ধ পুঁথির তালিকা তৈরির কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। এই পুঁথিগুলি সংগৃহীত হয়েছিল নেপাল রাজদরবার থেকে। রাজেন্দ্রলাল এই সব পুঁথির ইংরাজিতে অনুবাদ করার দায়িত্ব দিলেন হরপ্রসাদকে।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়িতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

কিছুকাল কাজ করার পর ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ কলকাতা ছেড়ে লখনউ ক্যানিং কলেজে সংস্কৃত অধ্যাপকের কাজে যোগ দেন। লখনউ যাওয়ার পথে তিনি কার্মাটাড়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সেখানে রাত্রিবাস করেছিলেন। এই সময়ের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ পরে লিখেছেন,

“১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে কার্মাটাড়ে স্টেশনের কাছে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এক বাংলো ছিল। কলকাতায় প্রায় আমার ম্যালেরিয়া জ্বর হত, সেইজন্য বছরখানেক বিনা বেতনে ছুটি লইয়া লখনউ ক্যানিং কলেজের প্রফেসর রাজকুমার সর্বাধিকারীর একটিনি করতে গিয়েছিলাম। আমরা কার্মাটাড়ে পৌঁছাইয়া আমাদের মালপত্র স্টেশন মাস্টারের জিম্মা করিয়া দিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাংলোয় গেলাম। তিনি আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির খবর লইলেন আমি সংস্কৃত পড়াইতে যাইতেছি, এম.এ ক্লাসেও পড়াইতে হইবে, বিশেষ হর্ষচরিতখানা পুরা পড়াইতে হইবে-শুনিয়া তিনি একটু ভাবিত হইলেন। বলিলেন, বইটা বড় কঠিন। তবে তিনি আমাকে হর্ষচরিত ও অন্যান্য বই পড়াইবার কিছু কিছু কৌশল বলিয়া দিলেন।”

সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

লখনউ থেকে ফিরে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ প্রেসিডেন্সি কলেজে সংস্কৃতের প্রধান অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন। তাঁর অধ্যাপনাকালেই তাঁর বিশেষ উদ্যোগে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজে সংস্কৃতে এম-এ পড়াবার ব্যবস্থা হয়। কয়েক বছর চাকরির পর তৎকালীন জনশিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর আলেকজান্ডার সেভলরে সাহেবের সুপারিশে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়। এখানে কর্মরত অবস্থাতেই ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি সরকারের কাছ থেকে মহামহোপাধ্যায় উপাধি লাভ করেন।

প্রাচীন বাংলা পুঁথি সংগ্রহের কাজে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

সংস্কৃত কলেজে যোগ্যতা ও সুনামের সঙ্গে আট বছর কাজ করার পর তিনি অবসর গ্রহণ করলেন। কিন্তু সরকার বাহাদুর এর পরেও হরপ্রসাদকে অন্য কাজে নিযুক্ত করলেন। ভারতবর্ষ ও বঙ্গদেশের প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতি বিষয়ে তথ্যাদি সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। এই সঙ্গে এশিয়াটিক সোসাইটির পুঁথি সংগ্রহ সম্পাদনা ও তালিকা প্রণয়ন এবং পুরাতাত্ত্বিক গবেষণার কাজও যুক্ত হল। এই সময় থেকে আমৃত্যুকাল তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ১০০ টাকা করে বৃত্তি পেয়েছেন। এই সোসাইটির কাজের সূত্রেই প্রাচীন বাংলা পুঁথি সংগ্রহের জন্য হরপ্রসাদের মধ্যে গভীর আগ্রহ জন্মেছিল।

বেঙ্গল লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

এক সময়ে কর্মসূত্রে হরপ্রসাদ বেঙ্গল লাইব্রেরির সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। ফলে সেখানে সংরক্ষিত প্রাচীন বাংলা পুঁথি দেখার সুযোগ হয়েছিল। তিনি লিখেছেন,

“বেঙ্গল লাইব্রেরিতে আসিয়া দেখিলাম বৈষ্ণবদের অনেক বই ছাপা হইতেছে। শুধু গানের বই নয়, সংকীর্তনের বই নয়, অনেক জীবনচরিত ও ইতিহাসের বইও ছাপা হইতেছে। বাংলা দেশে এত কবি, এত পদ্য ও এত বই ছিল কেহ বিশ্বাস করিতে পারিতেন না। একবার কম্বুলেটোলার লাইব্রেরির বাৎসরিক উৎসব-এর সময় একটি প্রবন্ধ পড়ি। ঐ প্রবন্ধে প্রায় ১০০ জন কবির নাম ও তাঁদের জীবনচরিত গ্রন্থের কিছু কিছু সমালোচনা কবি। সভায় গিয়া দেখি আমি যেমন বাঙ্গালা সাহিত্যে এত কবি আছে ও তাঁদের জীবনচরিতের ইতিহাস জানিতাম না তেমনি লক্ষ্য করিলাম অধিকাংশ লোকই সেইরূপ। বাঙ্গালায় এত বই আছে শুনিয়া সকলে আশ্চর্য হইয়া গেলেন। বহু ব্যক্তি সমালোচনায় উৎসাহিত হইয়া পত্র লিখিয়াছিলেন। অনেকে উক্তি করেন, ‘তাহারা একটা নূতন জগতে প্রবেশ করিয়াছে’। এইসকল সমালোচনায় উৎসাহিত হইয়া ভাবিলাম যদি ছাপা পুঁথির উপর প্রবন্ধেই এত খবর পাওয়া গেল, হাতের লেখা পুঁথি খুঁজিতে পারিলে না জানি কত কি নূতন খবর সংগ্রহ করিতে পারিব আর তাদের বক্তব্য জানিতে পারিব। তাই বাঙ্গালা পুঁথি খোঁজার একটা উৎকট আগ্রহ জন্মাইল”।

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

প্রবল আগ্রহ নিয়েই হরপ্রসাদ ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে পুঁথি সন্ধানের কাজে ব্রতী হন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদের সঙ্গে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তিনি পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে হরপ্রসাদের পুঁথি অনুসন্ধান ও তার সুফল ইত্যাদি বিষয়ের বিবরণ সাহিত্য পরিষদই প্রথম প্রবন্ধের আকারে প্রকাশ করে।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য

রবীন্দ্রনাথ-এর লেখা থেকে জানতে পারি, “আমাদের সৌভাগ্যক্রমে সাহিত্য পরিষদে হরপ্রসাদ অনেকদিন ধরে আপন বহুদর্শী শক্তির প্রভাব প্রয়োগ করবার উপযুক্ত ক্ষেত্র পেয়েছিলেন। রাজেন্দ্রলালের সহযেগিতায় এশিয়াটিক সোসাইটির বিদ্যা ভান্ডারে নিজের বংশগত পান্ডিত্যের অধিকার নিয়ে তরুণ বয়সে তিনি যে অক্লান্ত তপস্যা করেছিলেন, সাহিত্য পরিষদকে তারই পরিণত ফল দিয়ে সতেজ করে রেখেছিলেন।”

বঙ্কিমচন্দ্রের সান্নিধ্য লাভে সক্ষম হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

  • (১) হরপ্রসাদের ভারত মহিলা প্রবন্ধটি বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সূত্রে বঙ্কিমচন্দ্র-এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা জন্মেছিল। কী করে তিনি প্রথম বঙ্কিমচন্দ্রের সান্নিধ্য লাভ করেন সে সম্পর্কে একটি সুন্দর গল্প আছে। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত বঙ্গদর্শন কাগজে যখন প্রবন্ধটি ছাপা হয় তখন হরপ্রসাদ বি.এ. ক্লাশের ছাত্র।
  • (২) তিনি লিখেছেন, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক মহাশয়েরা আমার রচনা ভাল বলিয়াছিলেন এবং বাংলার তৎকালীন গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল পুরস্কার স্বরূপ আমার হাতে একখানি চেক তুলিয়া দিলেন আর কতকগুলি বেশ মিষ্ট কণাও বলিলেন। এরপর আমার মনে এক নূতন ভাবের সৃষ্টি হইল। ভাবিলাম, এই লেখা ছাপাইয়া একজন গ্রন্থকার হওয়া যায়।
  • (৩) কিন্তু এই পাওয়া টাকাগুলি বই ছাপিয়া উড়াইয়া দিবার পর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করিয়া সাময়িক উত্তেজনা হইতে বিরত হইলাম। অতঃপর শ্রীযুক্তবাবু যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাভূষণের নিকট গেলাম। তিনি সংস্কৃত কলেজের এম. এ আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। তাঁর এক মাসিক পত্র আর্য্য দর্শনে আমার লেখাটি ছাপাইয়া দিবার জন্য দেখাইলাম।
  • (৪) তিনি বেশ গম্ভীরভাবে মুরুব্বিয়ানা চালে বলিলেন, তুমি আমাদের কলেজের ছাত্র, রচনা লিখিয়া পুরস্কার পাইয়াছ। আমার কাগজে ছাপানো উচিত। তবে তুমি যে সকল মন্তব্য করিয়াছ, তাহা বাপু পরিবর্তন না করিলে আমার কাগজে উহা স্থান দিতে পারিব না। আমি বলিলাম, আমার তো মহাশয় নিজের কোনও ভিউ নাই। পূরাণ-পুঁথিতে যা পাইয়াছি, তাহাই সংগ্রহ করিয়া লিখিয়াছি। যাহা হউক তিনি ছাপাইতে রাজি হইলেন না।
  • (৫) অবশেষে একদিন হঠাৎ গোলদিঘীর ধারে বাবু রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের সহিত দেখা। তিনিও তাঁর দাদা বাবু রাধিকাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় আমাদের বেশ জানিতেন ও স্নেহ করিতেন। তিনি সত্বর তাঁহাদের বাড়িতে যাইতে আদেশ করিলেন। কথা প্রসঙ্গে এই লেখার কথা উঠিতে তিনি বলিলেন, তুমি যদি ইচ্ছা কর ‘আমি উহা বঙ্গদর্শনে ছাপাইয়া দিতে পারি।
  • (৬) আমি বলিলাম, আর্য্যদর্শনে যাহা লয় নাই, বঙ্গদর্শনে তাহা লইবে এ আমার বিশ্বাস হয় না। রাজকৃষ্ণবাবু বলিলেন, সে ভাবনা আমার, তোমার নয়। তুমি রবিবারের দিন নৈহাটি স্টেশনে অপেক্ষা করিও। সেই সময় আমি পৌঁছিব। যথাসময়ে নৈহাটি স্টেশন হইতে রেল লাইনের ভিতর দিয়া আমি বঙ্কিমচন্দ্রের কাঁঠালপাড়ার বাড়িতে রাজকৃষ্ণবাবুর সহিত ঢুকিলাম।
  • (৭) সেই সময় বঙ্কিমবাবু শ্যামাচরণবাবুর বাড়িতে অন্যান্য ভাইদের সহিত গল্প করিতেছেন। রাজকৃষ্ণবাবুকে খুব আদর অভ্যর্থনা করিয়া বসাইলেন। আমিও বসিলাম। এই আমার প্রথম সাক্ষাৎ বঙ্কিমচন্দ্রের সহিত। আমার দিকে নজর পড়িতে বঙ্কিমচন্দ্র রাজকৃষ্ণবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, এই ছেলেটি কে?
  • (৮) বঙ্কিমচন্দ্র জানিলেন আমি ব্রাহ্মণ। নৈহাটিতে থাকি। সংস্কৃত কলেজে পড়িয়া এইবার বি. এ. পাশ করিয়াছি। বলিলেন, আমাদের এখানে আস না কেন? আমি মৃদুস্বরে বলিলাম, সঞ্জীববাবুর ভয়ে। তাঁহারা হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। সঞ্জীববাবু বলিলেন, আমার ভয়ে? কেন?
  • (৯) ‘শুনিয়াছি কামিনী ফুল ছিঁড়িলে আপনি নাকি মারেন।’ হাসির মাত্রা বাড়িয়া গেল। বাবার নাম জানাইতে বঙ্কিমবাবু আশ্চর্য হইলেন। আমার দাদার সমবয়সী বঙ্কিমবাবু। ভারী ভাব ছিল। দাদার সম্বন্ধে অনেক কথা বলিলেন। দাদার উপর তাঁহার বেশ শ্রদ্ধা ছিল।
  • (১০) কথার ফাঁকে রাজকৃষ্ণবাবু বলেন, হরপ্রসাদ আপনার নিকট আসিয়াছে একটি পুরস্কার পাওয়া রচনা বঙ্গদর্শনে ছাপাইয়া দিবার জন্য। সংস্কৃত কলেজে এক প্রতিযোগিতায় এই পুরস্কার পাইয়াছে। আপনাকে ছাপাইয়া দিতে হইবে।
  • (১১) বঙ্কিমবাবু বলিলেন, বাংলা লেখা বড় কঠিন ব্যাপার। বিশেষ করে যারা সংস্কৃতওয়ালা। তারা তো নিশ্চয়ই নদনদী পর্বত কন্দর লিখিয়া বসিবে। শেষে বঙ্কিমচন্দ্র বলিলেন, ‘নন্দের ভাই বাংলা লিখিয়াছে, রাজকৃষ্ণ সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে, যাহাই হউক আমাকে উহা ছাপাইতে হইবে।’
  • (১২) এই চিত্তাকর্ষক ঘটনার পরে হরপ্রসাদের লেখাটি বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হল এবং এভাবেই উভয় সারস্বত পুরুষের দীর্ঘ সম্পর্কের সূত্রপাত। এরপর থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের উৎসাহে হরপ্রসাদ প্রতি মাসে বঙ্গদর্শনের জন্য লেখা পাঠাতেন। বলা চলে এই ভাবে হরপ্রসাদের সাহিত্যজীবন পুষ্টি ও সমৃদ্ধি লাভ করেছিল।
  • (১৩) পরবর্তীকালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে বঙ্কিমচন্দ্রের মর্মরমূর্তি প্রতিষ্ঠাকালে হরপ্রসাদ সভাপতি হিসেবে যে বক্তৃতা করেছিলেন, তাতে তিনি নিজেকে বঙ্কিমচন্দ্রের শিষ্যরূপে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘তিনি আমার জীবনের Friend, Philosopher and guide ছিলেন।’

পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ

বিভিন্ন সময়ে হরপ্রসাদ ভারতের বিভিন্ন সংস্কৃতিবান বিদগ্ধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এবং আজীবন পুঁথি সংগ্রহের কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। এজন্য তাঁকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করতে হয়েছে, নানা বিদ্যাকেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হয়েছে।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর চর্যাপদ আবিষ্কার

এরপর পুরাতন পুঁথি সংগ্রহের জন্য নেপাল তিব্বত প্রভৃতি রাজ্যেও তাঁকে একাধিকবার পরিভ্রমণ করতে হয়েছে। নেপাল থেকেই ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাচর্যবিনিশ্চয় উদ্ধার করেন। এছাড়া সরোহূবজ্র রচিত দোহাকোষ, কাহ্নপাদ রচিত দোহাকোষ ও সংস্কৃতে রচিত ডাকার্ণব-এই কয়খানি গ্রন্থও তিনি সেখানেই পেয়েছিলেন এবং পরে ‘হাজার বছরের পুরান বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’ নামে তাঁর সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি চর্যাপদ নামেই সমধিক পরিচিত।

পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর খ্যাতি

ঐতিহাসিক গবেষণা-সংক্রান্ত কাজের জন্য দেশে বিদেশে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন হরপ্রসাদ। তিনি লন্ডনের রয়‍্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির অনারারি সদস্য ছিলেন। খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠায় গৌরবান্বিত ছিল তাঁর জীবন।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর গ্রন্থ

গবেষণামূলক তত্ত্বানুসন্ধান ও প্রবন্ধ রচনা ছাড়াও সাহিত্য সমাজতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং শাসনতন্ত্র বিষয়েও মননশীল প্রবন্ধ রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন হরপ্রসাদ। তাঁর রচিত ৫২টি নিবন্ধের মধ্যে ঐতিহাসিক নিবন্ধের সংখ্যাই অধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল বাল্মীকির জয়, মেঘদূত ব্যাখ্যা, কাঞ্চনমালা (উপন্যাস), বেনের মেয়ে (উপন্যাস), সচিত্র রামায়ণ, প্রাচীন বাংলার গৌরব, বৌদ্ধ ধর্ম প্রভৃতি। ইংরেজী নিবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল Magadhan Literature, San- skrit Culture in Modern India, Discovery of Living Buddhisın in Bengal প্রভৃতি। এছাড়াও একাধিক গ্রন্থ তিনি সম্পাদনা করেছেন।

পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মৃত্যু

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর এই গৌরবোজ্জ্বল জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

উপসংহার :- রবীন্দ্রনাথ হরপ্রসাদ সম্পর্কে এক জায়গায় উক্তি করেছেন, “অনেক পন্ডিত আছেন তাঁরা কেবল সংগ্রহ করতেই জানেন, কিন্তু আয়ত্ত করতে পারেন না। তাঁরা খনি থেকে তোলা ধাতু পিন্ডটার সোনা এবং খাদ অংশটাকে পৃথক করতে শেখেননি বলেই উভয়কেই সমান মূল্য দিয়ে কেবল বোঝা ভারী করেন। হরপ্রসাদ যে যুগে জ্ঞানের তপস্যায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, সে যুগে বৈজ্ঞানিক বিচার-বুদ্ধির প্রভাবে সংস্কারমুক্ত জ্ঞানের উপাদানগুলি শোধন করে নিতে শিখেছিলেন। তাই স্কুল পান্ডিত্য নিয়ে বাঁধামত আবৃত্তি করা তাঁর পক্ষে কোনদিন সম্ভবপর ছিল না। বুদ্ধি আছে কিন্তু সাধনা নেই, এইটেই আমাদের দেশে সাধারণতঃ দেখতে পাই। অধিকাংশ স্কুলেই আমরা কম শিক্ষায় বেশি মার্কস পাবার অভিলাষী। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছিলেন সাধকের দলে এবং তাঁর ছিল দর্শনশক্তি।”

(FAQ) পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কে ছিলেন?

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একজন বিখ্যাত বাঙালি সংস্কৃত পণ্ডিত, ইতিহাসবিদ ও গবেষক ছিলেন, যিনি চর্যাপদ আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শনকে উন্মোচন করেন।

২. হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রধান অবদান কী?

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রধান অবদান হলো চর্যাপদ আবিষ্কার, যা বাংলা সাহিত্যের প্রথম রচনা হিসেবে বিবেচিত হয় এবং বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যিক নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত।

৩. চর্যাপদ কী?

চর্যাপদ হলো বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের রচিত প্রাচীন বাঙালি পদাবলি, যা প্রায় ১০০০ বছরের পুরনো। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন বলে মনে করা হয়।

৪. হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর গবেষণার ক্ষেত্র কী ছিল?

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বাংলা সাহিত্যের আদি ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন।

৫. হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যে কী প্রভাব ফেলেছে?

চর্যাপদ আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলা ভাষার আদি ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া যায়, যা বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ও ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে এবং তার গবেষণা বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শনকে তুলে ধরতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

Leave a Comment