ফ্রান্সের সংবিধান সভার কার্যাবলী প্রসঙ্গে সংবিধান সভা গঠন, সংবিধান সভার বৈশিষ্ট্য, চারধরনের কার্যাবলী, সংবিধান সভার শাসনতান্ত্রিক সংস্কার হিসেবে রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা, আইন সভা, প্রাদেশিক শাসন, অর্থনৈতিক সংস্কার, বিচারবিভাগীয় সংস্কার, গির্জার পুনর্গঠন, সংবিধান সভার কৃতিত্ব, সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানবো।
ফ্রান্সের সংবিধান সভার কার্যাবলি প্রসঙ্গে অভিজাত, বিশপ ও নিম্ন যাজকদের সভায় অংশগ্রহণ, কৃষক ও সাধারণ মানুষের কাছে ভূমিকা, জাতীয় সভা সংবিধান সভায় রূপান্তর, ফ্রান্সের সংবিধান সভার বৈশিষ্ট্য, ফ্রান্সের সংবিধান সভার কার্যাবলি, সংবিধান সভার শাসনতান্ত্রিক সংস্কার, সংবিধান সভার অর্থনৈতিক সংস্কার, সংবিধান সভার বিচারবিভাগীয় সংস্কার, ফ্রান্সের সংবিধান সভার কৃতিত্ব, ফ্রান্সের সংবিধান সভার সীমাবদ্ধতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানব।
ফ্রান্সের বা ফরাসি সংবিধান সভার কার্যাবলী
ঐতিহাসিক ঘটনা | ফ্রান্সের সংবিধান সভার কার্যাবলী |
সংবিধান সভা গঠন | ৯ জুলাই, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ |
সংবিধান রচনাকাল | ১৭৮৯-১৭৯১ খ্রিস্টাব্দ |
রচয়িতাগণ | মুনিয়ের, মিরাবো, আবেসিয়েস, রোবসপিয়ার |
গির্জার ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত | ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দ |
অ্যাসাইনেট | কাগজের নোট |
ভূমিকা:- ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জুন স্টেটস্ জেনারেলের অধিবেশনে তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা নিজেদের সভাকে ‘জাতীয় সভা’ বলে ঘোষণা করেন। ২০শে জুন ‘টেনিস কোর্টের শপথ‘-এর মাধ্যমে এই সভা ফ্রান্স-এর জন্য একটি সংবিধান রচনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
ফ্রান্সের বা ফরাসি সংবিধান সভার গঠন
২৭শে জুন থেকে তিনটি শ্রেণির যৌথ অধিবেশন বসে এবং ৯ই জুলাই থেকে ‘জাতীয় সভা’ ‘সংবিধান সভা’-য় রূপান্তরিত হয়। এই সংবিধান সভার কাজ হয় ফ্রান্সের জন্য একটি সংবিধান তৈরি করা। এইভাবে ফরাসি বিপ্লব -এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা হয়।
ফ্রান্সের বা ফরাসি সংবিধান সভার বৈশিষ্ট্য
সংবিধান সভার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন –
- (১) এই সভার সদস্যদের অধিকাংশই ছিলেন বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি—আইনজীবী, ব্যবসায়ী, পূর্বতন সরকারি কর্মচারীরাই ছিলেন এই সভার মূল চালিকা শক্তি। শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ছিলেন সংখ্যালঘু।
- (২) অধ্যাপক কোবান প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সভায় আইনজীবীদের সংখ্যা ছিল ২০%, চাকুরিজীবী ৫%, বণিক ও শিল্পপতি ১৩% এবং কৃষক প্রতিনিধি ছিল ৭-৯%।
- (৩) এই সভায় ৫০ জন প্রগতিশীল সদস্য, ৪৪ জন বিশপ এবং ২০০ জন নিম্ন যাজক ছিলেন। বুর্জোয়া সম্প্রদায়ই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং তাদের স্বার্থেই এই সভার পরিচালিত হয়।
- (৪) সভার সদস্যরা যথেষ্ট শিক্ষিত ও দার্শনিকদের রচনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিলেন। এই কারণে এই সভার কাজকর্মে দার্শনিক তত্ত্বের যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়।
- (৫) সভার সদস্যরা ছিলেন সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। সভাপতির নির্দেশ পালন করে সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করার শিক্ষা তাদের ছিল না। সদস্যদের পারস্পরিক বিবাদ, ঈর্ষা, দলগত দ্বন্দ্ব শুরু থেকেই সংবিধান সভাকে একটি বিশৃঙ্খল জনসভায় পরিণত করে।
ফ্রান্সের বা ফরাসি সংবিধান সভার কার্যাবলী
ফ্রান্সের সংবিধান সভার কার্যাবলীকে চারভাগে ভাগ করা যায়। যথা –
- (ক) শাসনতান্ত্রিক সংস্কার,
- (খ) অর্থনৈতিক সংস্কার,
- (গ) বিচারবিভাগীয় সংস্কার এবং
- (ঘ) গির্জার পুনর্গঠন।
(ক) শাসনতান্ত্রিক সংস্কার
সংবিধান সভার শাসনতান্ত্রিক সংস্কার গুলি ছিল নিম্নরূপ-
(১) রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা
- (i) মন্তেস্কুর ক্ষমতা-বিভাজন নীতি অনুসারে শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ পৃথক করা হয়। ফ্রান্সে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজতন্ত্র অক্ষুণ্ণ রাখা হলেও রাজা ছিলেন ক্ষমতাহীন।
- (ii) শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে রাজার সর্বোচ্চ ক্ষমতা স্বীকৃত হলেও তাঁর ক্ষমতা বহুলাংশে খর্ব করা হয়। তাঁর দৈব অধিকারের দাবি নাকচ করা হয়। পূর্বে তাঁর উপাধি ছিল ‘ফরাসি দেশের রাজা’। নতুন সংবিধান অনুসারে তাঁর উপাধি হয় ‘ফরাসি জাতির রাজা”।
- (iii) তিনি আইন রচনা, আইনসভার উপর নিয়ন্ত্রণ, রাজ্যের কর্মচারী ও বিচারকদের নিয়োগ এবং ইচ্ছামতো রাজকোষ ব্যবহারের অধিকার হারান। তাঁর সমস্ত ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাজপরিবারের ব্যয় নির্বাহের জন্য একটি তালিকা (civil list) প্রস্তুত করা হয়।
- (iv) স্থলবাহিনী ও নৌবাহিনীর দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হলেও, বৈদেশিত নীতি নির্ধারণে তাঁর ক্ষমতা খর্ব করা হয়। আইনসভার অনুমতি ব্যতীত তিনি যুদ্ধ ঘোষণা বা শান্তি স্থাপন করতে পারবেন না বলে স্থির হয়।
(২) আইনসভা
- (i) ৭৪৫ জন সদস্য নিয়ে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার হাতে আইন প্রণয়ন, বিদেশ নীতি নির্ধারণ, অর্থ বরাদ্দকরণ প্রভৃতির দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। আইনসভা ছিল প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এর সদস্যরা দু’বছরের জন্য নির্বাচিত হতেন। তাঁরা পুনর্নির্বাচিত হতে পারতেন না।
- (ii) সম্পত্তির ভিত্তিতে জনগণকে’সক্রিয়’ ও ‘নিষ্ক্রিয়’—এই দু’ভাগে বিভক্ত করে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তির অধিকারী অন্যূন পঁচিশ বছরের ‘সক্রিয়’ নাগরিকদেরই ভোটাধিকার দেওয়া হয়।
- (iii) ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে ফ্রান্সের প্রায় ২ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষের মধ্যে মাত্র ৪ লক্ষ মানুষ ‘সক্রিয়’ নাগরিক বলে চিহ্নিত হয়। ভোটাধিকার পান মাত্র ৫০ হাজার।
- (iv) রাজা কখনোই আইনসভা ভেঙে দিতে বা আইনসভা প্রণীত কোনও আইন বাতিল করতে পারতেন না— ‘ভেটো’ প্রয়োগ করে কিছু সময়ের জন্য তিনি কোনও আইনের প্রয়োগ স্থগিত রাখতে পারতেন মাত্র। কোনও আইন পর পর তিনবার আইনসভায় পাস হয়ে গেলে রাজার সম্মতি ছাড়াই তা আইনে পরিণত হত।
(৩) প্রাদেশিক শাসন
- (i) শাসনকাজের সুবিধার জন্য ফ্রান্সের পুরোনো কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীভূত করা হয়। পুরোনো প্রদেশসমূহ বাতিল করে সমগ্র ফ্রান্সকে ৮৩টি ‘ডিপার্টমেন্ট’ বা প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি ‘ডিপার্টমেন্ট’ আবার কয়েকটি ‘জেলা’, ‘ক্যান্টন’ ও ‘কমিউন’-এ বিভক্ত হয়।
- (ii) ৮৩টি ডিপার্টমেন্টকে ৫৪৭টি ক্যান্টনে এবং ক্যান্টনগুলিকে ৪৪০০০ কমিউনে বিভক্ত করা হয়। প্যারিসের পৌর-প্রশাসন ঢেলে সাজানো হয়। এই শহরের পৌর-প্রশাসনকে ৪৮টি ‘সেকশনে’ বিভক্ত করা হয়।
- (iii) প্রদেশ শাসনে পূর্বতন ‘ইনটেনডেন্ট’ পদের বিলুপ্তি ঘটানো হয়। প্রাদেশিক শাসক, বিচারক, জুরি ও অন্যান্য পদস্থ কর্মচারীদের ‘সক্রিয়’ নাগরিকদের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
(খ) অর্থনৈতিক সংস্কার
ফরাসি বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল সরকারের প্রবল অর্থসংকট। বিপ্লবকালে এই সংকট তীব্রতর হয়ে ওঠে। এই সংকট মোকাবিলার জন্য জনগণের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায় নি। এই অবস্থায় সংবিধান সভা কতকগুলি ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যেমন –
- (১) সংবিধান সভা ফ্রান্সের গির্জার সকল ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে (১৭৯০ খ্রিঃ) এবং তা আমানত রেখে তার পরিবর্তে ‘অ্যাসাইনেট’ (Assignat) নামে এক ধরনের কাগজের নোট প্রচলন করে।
- (২) সারা দেশে একই ধরনের ওজন ও মাপ চালু করা হয়।
- (৩) জমি ও অস্থাবর সম্পত্তির উপর কর ধার্য করা হয়।
- (৪) বাণিজ্য, শিল্প ও ব্যক্তিগত আয়ের উপর আয়কর বসানো হয়।
- (৫) সকল প্রকার পরোক্ষ কর তুলে দেওয়া হয়।
- (৬) শিল্পসংঘ ও উৎপন্ন পণ্যাদির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং বহু একচেটিয়া ব্যবসা লুপ্ত করা হয়।
- (৭) অবাধ শস্য-চলাচল স্বীকৃত হয় ও অভ্যন্তরীণ শুল্কপ্রাচীর তুলে দেওয়া হয়।
- (৮) শ্রমিকদের ধর্মঘট ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার রদ করা হয়।
(গ) বিচার বিভাগীয় সংস্কার
- (১) বিচার বিভাগেও এক বিরাট পরিবর্তন আসে। সামন্তপ্রভুদের বিচারালয়গুলির বিলোপসাধন করে বিচার বিভাগকে পুনর্গঠন করা হয়। ‘আইনের চোখে সব নাগরিক সমান’—এই নীতি প্রবর্তিত হয়।
- (২) বিচার বিভাগকে আইন ও শাসন বিভাগের এক্তিয়ার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার দেওয়া হয়। জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত বিচারক নিয়োগ ও ফৌজদারি মামলায় জুরি প্রথা প্রবর্তিত হয়।
- (৩) বিচারকদের নিয়মিত বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় এবং বিচার প্রার্থীদের কাছ থেকে কোনও ফি বা উৎকোচ গ্রহণ নিষিদ্ধ হয়। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অধিকার স্বীকৃত হয়। বিনা বিচারে কোনও ব্যক্তিকে আটক রাখা আইন-বিরুদ্ধ বলে ঘোষিত হয়।
(ঘ) গির্জার পুনর্গঠন
গির্জার পুনর্গঠনের জন্য দুটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যথা –
- (১) আর্থিক সংকট মোচনের জন্য গির্জার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং ওই সম্পত্তির ভিত্তিতে ‘অ্যাসাইনেট’ নামক কাগজি মুদ্রা প্রচলিত হয়।
- (২) ‘সিভিল কনস্টিটিউশন অব দি ক্লার্জি ‘(১৭৯১ খ্রি) বা ‘ধর্মযাজকদের সংবিধান’ নামক দলিল দ্বারা গির্জার উপর থেকে পোপের সব কর্তৃত্বের অবসান ঘটানো হয় এবং গির্জা রাষ্ট্রের একটি দপ্তরে পরিণত হয়। ফরাসি গির্জা ‘গ্যালিকান গির্জা’ নামে পরিচিত হয়। ধর্মযাজকেরা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হতেন এবং তাঁরা রাষ্ট্রের বেতনভুক কর্মচারীতে পরিণত হন।
ফ্রান্সের বা ফরাসি সংবিধান সভার কৃতিত্ব
ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে সংবিধান সভার গুরুত্ব অপরিসীম। এর বিভিন্ন কৃতিত্ব গুলি হল –
- (১) ‘ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার’-সংক্রান্ত দলিলে সংবিধান সভা যে সাম্যের নীতি ঘোষণা করেছিল,তা কেবলমাত্র ফ্রান্সকে নয়, সারা ইউরোপকে প্রেরণা যোগায়।
- (২) কার্লটন হেজ (C. Hayes) বলেন যে, দীর্ঘ দু’বছরের চেষ্টায় সংবিধান সভা যে সংবিধান রচনা করে তা ছিল ইউরোপের প্রধান প্রধান দেশগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান।
- (৩) ঐতিহাসিক কার্লটন হেজ (C. Hayes) বলেন যে, সংবিধান সভার উল্লেখযোগ্য কাজ হল অভূতপূর্ব ধ্বংসসাধন। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে আর কোনও আইনসভা এত ব্যাপক ধ্বংসসাধন করতে পারে নি।
- (৪) পুরোনো ধরনের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও ধর্মব্যবস্থা – অর্থাৎ স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, সামন্তপ্রথা, অভিজাত শ্রেণির বিশেষ অধিকার ও ক্যাথলিক গির্জার একাধিপত্যের মূলে কুঠারাঘাত হেনে সংবিধান সভা ফ্রান্সের ইতিহাসে এক নব যুগ ও নব চেতনার সঞ্চার করেছিল।
- (৫) রুদে বলেন যে, সংবিধান সভার সংস্কারগুলি ফরাসি জাতিকে এক নতুন মর্যাদায় ভূষিত করে। মধ্যযুগীয় মতাদর্শের অবসান ঘটিয়ে দেশবাসীকে নতুন চেতনায় উদ্দীপিত করার কাজে এই সভার ভূমিকা ছিলযথেষ্ট প্রশংসনীয়।
- (৬) রবার্টস-এর মতে, এই সংবিধান ফ্রান্সে নতুন রাজনৈতিক জীবনের জন্ম দেয়। হ্যাম্পসন এই সভার আইন-বিষয়ক সংস্কারগুলিকে ‘গৌরবজনক’ বলে অভিহিত করেছেন।
ফ্রান্সের বা ফরাসি সংবিধান সভার সীমাবদ্ধতা
ঐতিহাসিক রাইকার বলেন, “সংবিধান সভা ধ্বংসের কাজে তৎপরতা দেখালেও গঠনের কাজে তার শৈথিল্য ছিল।” এর নানা ত্রুটি ছিল। যেমন –
- (১) মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও সাম্যের ঘোষণা করা সত্ত্বেও সংবিধান রচনার প্রতি পদে সেই আদর্শলঙ্ঘিত হয়। সম্পত্তির পরিমাণের ভিত্তিতে নাগরিকদের ‘সক্রিয়’ও ‘নিষ্ক্রিয়’—এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা গণতন্ত্র, সাম্য এবং ‘ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারপত্রে’ ঘোষিত আদর্শের পরিপন্থী। এই ব্যবস্থায় ফ্রান্সে বুর্জোয়া শ্রেণির আধিপত প্রতিষ্ঠিত হয়।
- (২) ডেভিড টমসন বলেন যে, এই সংবিধান যাজক, অভিজাত ও সাধারণ লোকের পরিবর্তে পাউন্ড, শিলিং ও পেনির ভিত্তিতে নতুন শ্রেণি গঠন করে।
- (৩) এই সংবিধান দ্বারা রাজা, যাজক ও অভিজাতদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তা বুর্জোয়াদের উপর অর্পিত হয়। কৃষক ও সাঁকুলোৎ সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করে বুর্জোয়ারা সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে।
- (৪) লেফেভর প্রমুখ ঐতিহাসিক বলেন যে, সংবিধান সভা ফ্রান্সে অর্থনৈতিক সমতার দিকে নজর না দিয়ে পুঁজিবাদী বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
- (৫) ক্ষমতা বিভাজন নীতির ফলে রাজা ও মন্ত্রিপরিষদ শাসনকাজ পরিচালনার দায়িত্ব পান, কিন্তু আইন প্রবর্তন বা পরিবর্তনের কোনও ক্ষমতা তাঁদের ছিল না।
- (৬) আইনসভার সদস্যদের কোনও দায়িত্ব না থাকলেও তাঁরা আইন প্রবর্তন এবং রাজা ও মন্ত্রীদের সমালোচনা করার অধিকারী ছিলেন। এর ফলে প্রশাসন পঙ্গু ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে এবং রাজা ও আইনসভার বিরোধের পথ প্রশস্ত হয়।
- (৭) প্রাদেশিক শাসক, বিচারক, জুরি ও প্রশাসনের সর্বস্তরে নির্বাচনের মাধ্যমে নিযুক্তির ফলে বহু অযোগ্য লোক এইসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হত। এর ফলে শাসনব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা যায়।
- (৮) প্রদেশ, জেলা ও কমিউনগুলির শাসনভার ছিল নির্বাচিত শাসক ও নির্বাচিত সভার হাতে। সুতরাং, রাজার প্রতি তারা যথার্থ আনুগত্য দেখাত না এবং নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীনভাবে শাসনকাজ পরিচালনা করত। এর ফলে দেশের ঐক্য বিপন্ন হয়ে পড়ে। মিরাবো তাই বলেন, “দেশকে ভেঙে ফেলার জন্য এর চেয়ে আর কোনও ভালো ব্যবস্থা হতে পারে না।”
- (৯) বিচারকরা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ায় তাঁদের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না।
- (১০) নিয়ম ছিল যে, সংবিধান সভার কোনও সদস্যই আর পরবর্তী আইনসভায় নির্বাচিত হতে পারবেন না। এর ফলে আইনসভা সংবিধান সভার অভিজ্ঞ সদস্যদের পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হয়।
- (১১) গির্জাকে রাষ্ট্রের অধীনে আনায় বহু ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান বিপ্লব থেকে সরে যান এবং তারা বিপ্লবের শত্রুতে পরিণত হন। নিম্নশ্রেণির যাজকদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল।
- (১২) গির্জার ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ‘অ্যাসাইনেট’ নামে যে কাগজি মুদ্রা বের করা হয় তার দ্বারা দেশের আর্থিক সংকট মেটেনি। ক্রমশ এই মুদ্রার মূল্য এত কমে আসে যে, জনগণ তা নিতে অস্বীকার করে।
- (১৩) সংবিধান সভা দরিদ্র কৃষক, দিনমজুর, শ্রমজীবী প্রভৃতির অবস্থার উন্নতি ঘটাতে ব্যর্থ হয়। ঐতিহাসিক হ্যাম্পসন বলেন যে, সামন্তপ্রথা লোপ করা হলেও সামন্তদের সব অধিকার লোপ করা হয় নি।
- (১৪) লেফেভর তাই বলেন যে, নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের কথা বললেও সংবিধান সভা আসলে বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্র স্থাপন করে এবং তা ছিল অতি দুর্বল।
মূল্যায়ণ
এইসব ত্রুটি সত্ত্বেও সংবিধান সভার কৃতিত্বকে কোনওভাবেই খর্ব করা যায় না। এই সংবিধান ‘পুরোনো ব্যবস্থা” ধ্বংস করে রাজার স্বৈরক্ষমতা, শ্রেণিবৈষম্য ও সামন্তপ্রথার অবলুপ্তি ঘটায় এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা, সাম্য ও ধর্মাচরণেরঅধিকারকে স্বীকৃতি দান করে।
উপসংহার:- সংবিধান সভার কৃতিত্ব ও ত্রুটিগুলিকে একীভূত করেই ঐতিহাসিক মাদেলা বলেন, “এই ব্যাপক সংস্কারাবলী ইতিহাসে অদ্বিতীয় হলেও আসলে ছিল জীর্ণ ও ভঙ্গুর। ”এজন্য সংবিধান সভার স্থায়িত্ব ছিল স্বল্পকালের।
(FAQ) ফ্রান্সের বা ফরাসি সংবিধান সভার কার্যাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
৯ জুলাই, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ।
১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে।
ফরাসি সংবিধান সভা গির্জার ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে যে কাগজের নোট প্রচলন করেছিল তা অ্যাসাইনেট নামে পরিচিত।
৮৩ টি।