অটোমান সাম্রাজ্যের পতন প্রসঙ্গে বিভিন্ন কারণ হিসেবে স্থানীয় শাসকদের উত্থান, ঐক্যের অভাব, গতিহীন অবস্থা, নিপীড়ন, রাজ পরিবারের ত্রুটি, অর্থনৈতিক দুর্বলতা, সামরিক ত্রুটি ও সুলতানদের অযোগ্যতা সম্পর্কে জানবো।
মধ্যযুগের পৃথিবীর ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী অটোমান সাম্রাজ্যের পতন প্রসঙ্গে অটোমান সাম্রাজ্যে স্থানীয় শাসকদের উত্থান, অটোমান সাম্রাজ্যে শাসকদের ঐক্যের অভাব, অটোমান সাম্রাজ্যের গতিহীন অবস্থা, অটোমান সাম্রাজ্যে রাজ পরিবারের ত্রুটি, অটোমান সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও অটোমান সাম্রাজ্যের সামরিক ত্রুটি সম্পর্কে জানব।
অটোমান সাম্রাজ্যের পতন
ঐতিহাসিক ঘটনা | অটোমান সাম্রাজ্যের পতন |
সময়কাল | ১৯২২ খ্রি |
স্থায়ীত্বকাল | ১২৯৯-১৯২২ খ্রি |
সামন্তপ্রথার প্রচলন | সুলেমান |
প্রাদেশিক শাসক | পাশা |
ভিয়েনা জয়ে ব্যর্থ | ১৬৮৩ খ্রি |
ভূমিকা :- অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্য ছিল মধ্যযুগের পৃথিবীর ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য। সপ্তদশ শতকে এই সাম্রাজ্যের মর্যাদা চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছোয়, আবার এই সময় থেকেই অটোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতাগুলি প্রকট হয়ে ওঠে। ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা জয়ের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে অটোমান সাম্রাজ্য ক্রমে দুর্বল হতে থাকে। অষ্টাদশ শতকে এই দুর্বলতা চরমে পৌঁছোয়।
অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ
মধ্যযুগের পৃথিবীর ইতিহাসের সর্ববৃহৎ অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন –
(ক) স্থানীয় শাসকদের উত্থান
- (১) অটোমান তুর্কি শাসকরা সামরিক শক্তির জোরে বৃহৎ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় তুর্কি নাগরিকরা মোটেই যোগ্য ছিলেন না। ফলে অটোমান সুলতানরা দেশের শাসনকার্য পরিচালনায় নব বিজিত স্থানের স্থানীয় মানুষদের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
- (২) এই সুযোগে দুর্বল সুলতানদের আমলে বিভিন্ন কর্মচারী নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীনভাবে প্রশাসন পরিচালনা করতে থাকেন। সুলেমান অটোমান সাম্রাজ্যে সামন্তপ্রথার প্রচলন করেন। পরবর্তীকালে এই সব সামন্তপ্রভু এবং ‘পাশা’ নামে পরিচিত প্রাদেশিক শাসকরা নিজ নিজ অঞ্চলে স্বাধীন শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
(খ) ঐক্যের অভাব
অটোমান সাম্রাজ্য বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায় ও ভাষাভাষীর মানুষদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল। ফলে এই সাম্রাজ্যে কোনো ধরনের শাসনতান্ত্রিক, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে ওঠে নি। বৃহত্তর এই সাম্রাজ্যে একসময় তুর্কি জাতির লোকই সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে নিজ দেশে বিদেশিদের মতো বসবাস করতে বাধ্য হয়। আর অন্যান্য জাতিগুলিও তুরস্ক-এর প্রতি কোনো ধরনের ঐক্যের তাগিদ অনুভব করে নি।
(গ) গতিহীন ব্যবস্থা
অটোমান সাম্রাজ্য বহুদূর বিস্তৃত হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সাম্রাজ্যের শাসন, সমাজ ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো অগ্রগতি হয় নি। ফলে প্রতিবেশী ইউরোপীয় দেশগুলি থেকে অটোমান সাম্রাজ্য সবদিক থেকেই পিছিয়ে পড়ে। এদিকে অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন রাজ্যগুলিতে প্রতিবেশী ইউরোপ-এর অগ্রগতির ধারা যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়। অটোমানদের এই গতিহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা সাম্রাজ্যের পতনকে অনিবার্য করে তোলে।
(ঘ) নিপীড়ন
অটোমান তুর্কি শাসকরা মূলত সামরিক শক্তির জোরে সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে সর্বদা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর অটোমান সেনা ও প্রশাসনের অত্যাচার চলত। প্রশাসনের সর্বস্তরে অন্যায় ও দুর্নীতি ছেয়ে গেলেও সাধারণ মানুষ অন্যায়ের কোনো প্রতিকার পেত না। ফলে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছিল।
(ঙ) রাজপরিবারের ত্রুটি
তুর্কি রাজপরিবার অটোমান সাম্রাজ্যকে নিজেদের পারিবারিক সম্পত্তি বলে মনে করত। এর ফলে তারা সাম্রাজ্যের কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করার প্রয়োজন বোধ করত না। তা ছাড়া রাজপরিবারের মধ্যে সর্বদা বিবাদ ও ষড়যন্ত্র অটোমান প্রশাসনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল।
(চ) অর্থনৈতিক দুর্বলতা
অটোমান সাম্রাজ্যে শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হয় নি। শিল্প-বাণিজ্য সবই চলে গিয়েছিল ইউরোপীয়দের হাতে। ফলে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক দুর্বলতার ফলে অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষাত্রশক্তি নষ্ট হয় এবং সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।
(ছ) সামরিক ত্রুটি
অর্থনৈতিক দুর্বলতা অটোমান সাম্রাজ্যের সামরিক ক্ষেত্রকেও প্রভাবিত করেছিল। একদা যে জানিসারি বাহিনী সাম্রাজ্যে একের পর এক সাফল্য এনে দিয়েছিল পরবর্তীকালে তারা বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। তা ছাড়া এই বাহিনী সাম্রাজ্যে নানা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। ইউরোপের সামরিক বাহিনীতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধরীতির প্রচলন ঘটলেও অটোমান সম্রাটরা সামরিক বাহিনীতে তা প্রবেশের চেষ্টা না করায় সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি ক্রমে হ্রাস পায়।
(জ) সুলতানদের অযোগ্যতা
অটোমান সাম্রাজ্য সুলতানদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও সামরিক শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যে কোনো ধর্মীয় বা শাসন বিষয়ক ঐক্য গড়ে ওঠে নি। এজন্য রাষ্ট্রের প্রতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আনুগত্যের অভাব ছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে পরবর্তীকালে একের পর এক দুর্বল ও অযোগ্য শাসক অটোমান সিংহাসন দখল করলে সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।
অটোমান সাম্রাজ্যের পতন
এরূপ অবস্থায় খ্রিস্টান ইউরোপ, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের আক্রমণ অটোমান সাম্রাজ্যের পতনকে অনিবার্য করে তোলে। শেষপর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-এর পর তুরস্কের জাতীয়তাবাদী নেতা কামাল আতাতুর্ক বা কামাল পাশা সর্বশেষ অটোমান সুলতান ষষ্ঠ মহম্মদকে (১৯১৮-১৯২২ খ্রি.) সিংহাসনচ্যুত করে (১লা নভেম্বর, ১৯২২ খ্রি.) তুরস্কে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন। এভাবে দীর্ঘ ৬২৩ বছরের (১২৯৯-১৯২২ খ্রি.) প্রাচীন তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
উপসংহার :- সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সুলতান সুলেমানের রাজত্বকালে অটোমান সাম্রাজ্য সুবর্ণ যুগে প্রবেশ করেছিল। তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর একসময় ইতিহাসের নিয়মেই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
(FAQ) অটোমান সাম্রাজ্যের পতন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
অটোমান সাম্রাজ্য
ভিয়েনা
সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট
পাশা