দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে মোগল আমলে প্রতিনিধি, নিজামতি ও দেওয়ান, মুর্শিদকুলি খাঁর প্রাধান্য, কোম্পানির প্রাধান্য, দেওয়ানি লাভ, নায়েব নাজিম নিয়োগ, দ্বৈত শাসন, দ্বৈত শাসনের ফলাফল হিসেবে আর্থিক শোষণ, কৃষকদের উচ্ছেদ, বাংলার রাজস্ব ব্যবহার, একচেটিয়া বাণিজ্য, লুণ্ঠন, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, দ্বৈত শাসনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে সুপারভাইজার নিয়োগ, সিলেক্ট কমিটি গঠন ও দ্বৈত শাসনের অবসান সম্পর্কে জানবো।
দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে বাংলার গভর্নর রবার্ট ক্লাইভের আমলে দ্বৈত শাসনের সূচনা, দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তক রবার্ট ক্লাইভ, ১৭৬৫ সালে বাংলায় দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার সূচনা, দ্বৈত শাসন বলতে দুজনের শাসন, দ্বৈত শাসন ব্যবস্থায় কোম্পানির শোষণ, কৃষকদের উপর অত্যাচার, বণিকদের দুরবস্থা, চরম সামাজিক বিশৃঙ্খলা, দেওয়ানি লাভের ফলে দ্বৈত শাসনের সূচনা, দ্বৈত শাসনের ফলাফল, দ্বৈত শাসনের কুফল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, দ্বৈত শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ও দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসান সম্পর্কে জানব।
দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা
ঐতিহাসিক ঘটনা | দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা |
প্রবর্তক | রবার্ট ক্লাইভ |
প্রবর্তন কাল | ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ |
অবসান কাল | ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ |
অবসান কারী | ওয়ারেন হেস্টিংস |
ভূমিকা :- ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ বাংলার নবাব থেকে দেওয়ানি সনদ প্রাপ্ত হলে যে শাসন প্রণালীর উদ্ভব হয়, তা ইতিহাসে দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত।
মোগল আমলে প্রতিনিধি
মোগল আমলে বাংলা-সহ প্রতিটি প্রদেশে কেন্দ্রীয় সরকারের দু-জন প্রতিনিধি থাকতেন। যথা –
(১) সুবাদার
সুবাদার বা প্রদেশপাল ছিলেন প্রদেশের সর্বোচ্চ শাসক। তাঁর হাতে ‘নিজামত অর্থাৎ প্রদেশের সামরিক প্রতিরক্ষা, পুলিশ, সাধারণ আইনশৃঙ্খলা, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা প্রভৃতি পরিচালনার দায়িত্ব ছিল।
(২) দেওয়ান
দেওয়ান ছিলেন প্রদেশের দেওয়ানি অর্থাৎ অর্থবিভাগের প্রধান। তিনি রাজস্ব আদায় ও দেওয়ানি বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।
নিজামত ও দেওয়ানি
মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব -এর আমল পর্যন্ত বাংলার শাসনকার্য দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল— ‘নিজামত’ ও ‘দেওয়ানি’। পরবর্তীকালে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে।
মুর্শিদকুলি খাঁর প্রাধান্য
মুর্শিদকুলি খাঁ প্রথমে বাংলার দেওয়ান ও পরে সুবাদার পদে নিযুক্ত হন ফলে ‘দেওয়ানি’ ও ‘নিজামত উভয় বিভাগের দায়িত্ব পেয়ে তিনি বাংলায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হন এবং উভয় বিভাগের পার্থক্য ঘুচে যায়।
কোম্পানির প্রাধান্য
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলার নবাব নজমউদ্দৌলার সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর দ্বারা নবাবের সকল ‘নিজামতি’ বা প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষমতা কোম্পানির মনোনীত ‘নায়ের নাজিম’-এর হাতে চলে যায়। নবাব কোম্পানির বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন।
দেওয়ানি লাভ
এরপর ১২ আগস্ট ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি বাংলা-বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা দখল করে। এভাবে নবাবের যাবতীয় ‘নিজামত’ ও ‘দেওয়ানি’ ক্ষমতার মালিক হয় কোম্পানি। তা সত্ত্বেও কোম্পানির দক্ষ প্রশাসক কিছু বাস্তব অসুবিধার কারণে তখনই বাংলার প্রশাসনিক দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ করেনি।
নায়েব নাজিম নিয়োগ
কোম্পানি বাংলায় মহম্মদ রেজা খাঁ-কে এবং বিহারে সিতাব রায়-কে নায়েব নাজিম অর্থাৎ নায়েব-সুবা পদে নিযুক্ত করে তাদের হাতে বাংলা ও বিহারে নিজামত ও দেওয়ানি বিভাগের যাবতীয় দায়িত্ব প্রদান করে। তাঁরা আইনত নবাবের অধীনে হলেও বাস্তবে নবাব নয়, কোম্পানি তাদের নিয়ন্ত্রণ করত। ফলে তাদের প্রধান কাজ ছিল কোম্পানির স্বার্থরক্ষা করা।
দ্বৈত শাসন
- (১) নায়েব নাজিমদের হাতে কোম্পানি নবাবের যাবতীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও নীচু স্তরে নবাবের কর্মচারিরাই শাসনকার্য পরিচালনা করত। নবাবের নামে শাসনকার্য চললেও বাস্তবে নবাবের কোনো ক্ষমতা ছিল না।
- (২) নবাবের যাবতীয় ক্ষমতা কোম্পানির হাতে চলে যায় এবং কোম্পানির লোকজনই সর্বত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে নবাবের হাতে বাংলার প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব থাকলেও তাঁর হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ছিল না। আবার কোম্পানির হাতে প্রকৃত ক্ষমতা থাকলেও তারা প্রশাসন পরিচালনা ও প্রশাসনিক ব্যয় বহনের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।
- (৩) এইভাবে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় নবাব ক্ষমতাহীন দায়িত্ব এবং কোম্পানি দায়িত্বহীন ক্ষমতা লাভ করে। বাংলায় নবাব ও কোম্পানির এই দ্বিমুখী শাসন ইতিহাসে ‘দ্বৈত শাসন’ (Diarchy) নামে পরিচিত।
দ্বৈত শাসনের ফলাফল
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ানী লাভ -এর পর ইংরেজ কোম্পানি বাংলার নবাবকে নামে মাত্র সিংহাসনে বসিয়ে রেখে নবাবের যাবতীয় ক্ষমতা কোম্পানির দ্বারা নিযুক্ত নায়েব নাজিমদের হাতে প্রদান করে। এর ফলে বাংলায় “দ্বৈত শাসনব্যবস্থা’র প্রবর্তন ঘটে।এই ব্যবস্থার বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল। যেমন –
(১) আর্থিক শোষণ
দ্বৈত শাসনের সময় কোম্পানি বাংলায় তীব্র আর্থিক শোষণ শুরু করে। দেওয়ানি লাভের আগে ১৭৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা থেকে ১ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এক বছর পর দেওয়ানি লাভ করে কোম্পানি ১৭৬৫ – ৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা থেকে রাজস্ব আদায় করে প্রায় দ্বিগুণ — ২ কোটি ২০ লক্ষ। রাজস্ব আদায়কারীদের তীব্র অত্যাচার সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ট করে তোলে।
(২) কৃষকদের উচ্ছেদ
আগে কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হত না। দেওয়ানি লাভের পর ইংরেজরা সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানে প্রতিশ্রুতিদানকারী ইজারাদারকে জমি ইজারা দিতে শুরু করে। কোম্পানিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পরিশোধ করতে গিয়ে ইজারাদারও কৃষকদের ওপর রাজস্বের হার অত্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। এই রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।
(৩) বাংলার রাজস্ব ব্যবহার
আগে ভারত-এ কোম্পানির বাণিজ্যের জন্য ইংল্যান্ড থেকে অর্থ পাঠানো হত। দেওয়ানি লাভের পর ইংল্যান্ড থেকে অর্থ পাঠানো বন্ধ হয় এবং বাংলার রাজস্বের অর্থ নিয়ে পণ্য ক্রয়ের ব্যবস্থা হয়। এই পণ্য বিক্রির লাভের অর্থ বিলেতে চলে যেতে থাকে।
(৪) একচেটিয়া বাণিজ্য
কোম্পানি বাংলার লবণ, সুপারি, তামাক ও অন্যান্য কয়েকটি পণ্যের ওপর কোম্পানি ও তার কর্মচারিরা একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার পায়। এর ফলে দেশীয় বণিকরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রব্যমূল্যও অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। সমকালীন ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন লিখেছেন যে, বাণিজ্যের কোনো শাখাই আর উন্মুক্ত নয়—সব শাখাই হয় কোম্পানি বা তার কর্মচারিদের দখলে চলে গেছে।
(৫) লুণ্ঠন
দ্বৈত শাসনের সময় কোম্পানি ও তার কর্মচারিরা বাংলায় অবাধ লুণ্ঠন শুরু করে। এ সম্পর্কে স্বয়ং ক্লাইভ বলেছেন যে, “আমি শুধু এটুকুই বলছি যে, পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত অরাজকতা, বিভ্রান্তি, ঘুষ, দুর্নীতি এবং উৎপীড়ন শোষণের ঘটনা কেউ শোনেনি বা দেখেনি—যতটুকুর লীলাক্ষেত্র হয়েছিল এই বাংলাদেশ। এত বিপুল সম্পদ এত অবৈধ উপায়ে এত উন্মুক্ত লালসার প্রেরণায় আর কোনো দেশ থেকে লুণ্ঠিত হয়নি।”
(৬) দুর্নীতি
দ্বৈত শাসনের সময় কোম্পানির কর্মচারিরা ব্যাপক দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। জর্জ কর্নওয়াল পার্লামেন্টে সাক্ষ্যদানকালে বলেন যে, “আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে একথা জানাতে চাই যে, ১৭৬৫-৮৪ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অপেক্ষা বেশি দুর্নীতিপূর্ণ, বেশি ভণ্ড, বেশি অত্যাচারি ও লুন্ঠন প্রবৃত্তির তথাকথিত সভ্য সরকার পৃথিবীর বুকে আর দেখা যায়নি।” কোম্পানির কর্মচারি বোল্টস্ লিখেছেন যে, কোম্পানির কর্মচারিদের নির্যাতন ও দুর্নীতিতে সাধারণ মানুষের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়েছিল।
(৭) বিশৃঙ্খলা
দ্বৈত শাসনের ফলে বাংলার সমাজ ও জনজীবনে প্রবল বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ঐতিহাসিক জনকে বলেছেন যে, দ্বৈত শাসনব্যবস্থা বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থাকে আরও বিশৃঙ্খল করে তোলে।
দ্বৈত শাসনের কুফল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর
রবার্ট ক্লাইভ প্রবর্তিত দ্বৈত শাসনের কুফল হিসেবে বাংলাতে মর্মান্তিক ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (বঙ্গাব্দ ১১৭৬ ইংরেজি ১৭৭০ খ্রি.) দেখা দেয়। প্রথমে অনাবৃষ্টির কারণে শস্যহানির ফলে এই দুর্ভিক্ষ ঘটলেও প্রকৃতপক্ষে কোম্পানির উদাসীনতা ও নিষ্ঠুর শাসননীতির জন্য তা বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়।
দ্বৈত শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া
দ্বৈত শাসনের ব্যর্থতা এবং কোম্পানির দুর্নীতি প্রকট হয়ে উঠলে বিলেতে এরবিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে। ফলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতে কোম্পানির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের কথা চিন্তাভাবনা করতে শুরু করে।
(১) সুপারভাইজার নিয়োগ
কোম্পানির কর্মচারিদের দুর্নীতি ও অত্যাচার দমনের উদ্দেশ্যে ক্লাইভের পরবর্তী গভর্নর ভেরেলেস্ট (১৭৬৮-৬৯ খ্রি.) প্রত্যেক জেলায় একজন করে ইংরেজ ‘সুপারভাইজার’ বা পরিদর্শক নিয়োগ করেন। তাদের কাজ ছিল কৃষকদের স্বার্থরক্ষা ও সরকারি কর্মচারিদের অত্যাচার থেকে তাদের রক্ষা করা, বে আইনি জমি উদ্ধার করা প্রভৃতি।
(২) সিলেক্ট কমিটি
সুপার ভাইজাররাও শীঘ্রই অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং অবাধ ব্যক্তিগত বাণিজ্যে লিপ্ত হয়। এতে কোম্পানির রাজস্ব আদায় কমে যায় এবং কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। এই অবস্থার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে সরকার ‘সিলেক্ট কমিটি গঠন করে। এই কমিটির তদন্তে কোম্পানির কর্মচারিদের ব্যাপক দুর্নীতি ধরা পড়ে।
(৩) দ্বৈত শাসনের অবসান
কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণে এনে বাংলার দূরবস্থা দূর করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এই সময় কয়েকটি আইন পাশ করে। পরবর্তী গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলায় দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলার শাসনভার সরাসরি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়। নায়েব নাজিম মহম্মদ রেজা খাঁ ও সিতাব রায়কে পদচ্যুত করা হয়। এভাবে কোম্পানি প্রকৃত অর্থে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের চরিত্র লাভ করে।
উপসংহার :- ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা রদ করেন এবং কোম্পানি প্রত্যক্ষ ভাবে দেওয়ানির কার্যভার গ্ৰহণ করে।
(FAQ) দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
রবার্ট ক্লাইভ ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে।
ওয়ারেন হেস্টিংস, ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে।
১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর ‘আনন্দমঠ‘ উপন্যাসে।