বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি

বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি প্রসঙ্গে সাহিত্যের বিকাশ, স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ, দরবার হল, মন্দির নির্মাণ, সঙ্গীত ও চিত্রশিল্প, শিল্পরীতি, মন্দির নগর ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে জানবো।

বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি

বিষয়বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি
মন্দির নগরবিজয়নগর
বেদের টীকাসায়ণ আচার্য
অষ্টদিগ্‌গজকৃষ্ণদেব রায়
মন্দিরহাজারা ও বিঠলস্বামী মন্দির
বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি

ভূমিকা :- বিজয়নগর সাম্রাজ্য-এর সংস্কৃতির পরিচয় সম্পর্কে বেশ কয়েকজন বিদেশি পর্যটক বিজয়নগর পরিভ্রমণকালে তাদের বিবরণে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বিদেশি পর্যটকদের এই মনোরম বিবরণ বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল।

রাজাদের আনুকূল্যে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি

ভারতের বিজয়নগর সাম্রাজ্য সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এক গৌরবময় স্থান অধিকার করেছিল। বিজয়নগরের নরপতিগণ স্বয়ং শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সংস্কৃত, তেলেগু, তামিল ও কন্নড় ভাষা তাঁদের আনুকূল্যে যথেষ্ট সমুন্নতি লাভ করে।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যে সাহিত্যের বিকাশ

  • (১) বেদ-এর বিখ্যাত টীকাকার সায়ণ এবং তাঁর ভাই মাধব বিদ্যারণ্য বুক্কর শাসনকালে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন। রাজা কৃষ্ণদেব রায় স্বয়ং একজন কবি, লেখক ও তেলেগু ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
  • (২) তিনি বিদ্বান ও গুণী ব্যক্তিকে অর্থ ও ভূমিদান করে যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন। তাঁর রাজত্বকাল সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দাক্ষিণাত্যে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। ভারতীয় ঐতিহ্যের বিক্রমাদিত্যের নবরত্নের মতো কৃষ্ণদেব রায়ের রাজসভায় ‘অষ্টদিগ্‌গজ’ নামে আটজন পণ্ডিত উপস্থিত থাকতেন।
  • (৩) নাচ, গান, নাটক, ব্যাকরণ, তর্কবিদ্যা, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ের উন্নতিতে এইসব পণ্ডিতদের রাজ্য এবং মন্ত্রীগণ বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিতেন। কৃষ্ণদেব রায় স্বয়ং রাজনীতি বিষয়ক একটি গ্রন্থ আমুক্তমাল্যদা রচনা করেন। এই গ্রন্থখানি সাহিত্য ছাড়াও ঐতিহাসিক দিক থেকেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাই ঐতিহাসিক কে কে দত্ত বলেছেন, “the Vijaynagar Empire was a synthesis of South Indian culture”.

বিজয়নগর সাম্রাজ্যে স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ

  • (১) বিজয়নগর রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ থেকে জানা যায়, স্থাপত্যশিল্পেও বিজয়নগর দাক্ষিণাত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র ছিল এবং সেখানে একটি বিশিষ্ট স্থাপত্য-রীতি প্রচলিত হয়েছিল। বিজয়নগরের চিত্রশিল্প ও স্থাপত্য যে বিস্ময়কর ছিল, তা বিদেশিরাও স্বীকার করেছেন।
  • (২) স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন বিচার করতে গিয়ে ড. এস. কে. সরস্বতী বলেছেন “Significant as illustrating sumptuous phases of South Indian architecture”.
  • (৩) বিজয়নগরের নরপতিগণ যে সমস্ত জমকালো প্রাসাদ ও মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, সেগুলিতে এক উচ্চস্তরের শিল্পসুষমার চিহ্ন স্পষ্ট। এই প্রাসাদগুলি ও মন্দিরগুলির সৌন্দর্য বিচার করতে গিয়ে ড. এস. কে সরস্বতী বলেছেন, “চিত্রশিল্প ও স্থাপত্যশিল্প উভয়েরই অলঙ্করণ অত্যন্ত শিল্পরীতিসম্পন্ন ছিল।”

পায়েস-এর বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি

বিজয়নগর শহরের সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্যের চরম পরিচয় পাওয়া যায় পায়েস-এর বর্ণনায়। তিনি বিজয়নগর সম্পর্কে বলেছেন, “রোম শহরের মতো অতীব সুন্দর ও বৃহদায়তন নগর ছিল বিজয়নগর।”

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের দরবার হল

রাজার দরবার হলের শিল্পসৌন্দর্য ছিল অতুলনীয়। পায়েস দরবার হলকে ‘house of victory’ বলে উল্লেখ করেছেন। আবদুর রাজ্জাক দরবার হলকে “elevated above all the rest of the lofty buildings in the citadel” বলে বর্ণনা করেছেন।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যে মন্দির নির্মাণ

  • (১) বিজয়নগরের শিল্পসৌন্দর্যের এক স্বতন্ত্র ধারা লক্ষ্য করা যায় মন্দির নির্মাণে। কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে বিজয়নগরের হাজারা মন্দির ও বিঠলস্বামী মন্দিরটি স্থাপত্যশিল্পের এক চরম নিদর্শন।
  • (২) এই দুটি মন্দির তখনকার পুণ্যার্থীদের কাছে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ছিল। এই দুটি মন্দিরের অলঙ্করণ বৈচিত্র্য ও সৌষ্ঠব সর্বাধিক আকর্ষণীয় ছিল। তবে বিজয়নগর-শিল্পশৈলীকে নিখুঁত ও যথাযথ সম্পূর্ণভাবে প্রতিফলিত করার প্রয়াস হাজারা রামন্দিরের নির্মাণরীতিতে দেখা যায়।
  • (৩) হাজারা রামমন্দিরের কাঠামো ছিল তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রায়তন। বিদেশি স্থপতিরা এই দুটি মন্দিরের শিল্প সুষমা দেখে বিস্মিত হয়েছেন হাজারা মন্দির সম্পর্কে Longhurst মন্তব্য করেছেন, “One of the most perfect specimens of Hindu temple architecture in existence.”

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের মন্দির সম্পর্কে ফার্গুসনের মন্তব্য

বিঠলস্বামী মন্দির সম্পর্কে ফার্গুসন মন্তব্য করেছেন, “Shows the extreme limit in florid magnificence to which the style advanced.”

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গীত ও চিত্রশিল্প

স্থাপত্যশিল্পের মতো সঙ্গীত ও চিত্রশিল্পও বিজয়নগরে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছিল।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শিল্পরীতি

  • (১) বিজয়নগরের স্থাপত্যরীতি ও শিল্পশৈলী তার মন্দির স্থাপত্যকে সবথেকে গৌরবময় করেছে। তাদের শিল্পরীতিতে হিন্দু শিল্পকলা ও সংস্কৃতির নব জন্ম ঘটেছে। তাদের শিল্পরীতি দক্ষিণ ভারতের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পরীতিতে একটা গভীর পরিবর্তন এনেছিল।
  • (২) এই শিল্পশৈলী ও শিল্পসৌন্দর্য ছিল অভূতপূর্ব। মন্দিরের আরাধ্য দেবতার ও সঙ্গিনীদেবীর মূর্তির জন্য পৃথক মন্দির ছিল। বিজয়নগরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য রীতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তার অপূর্ব সমৃদ্ধিশালী সূক্ষ্ম ও জটিল অলঙ্করণ ও কারুকার্য।
  • (৩) মন্দির স্থাপত্যের একটি বৈশিষ্ট্য হল তথাকথিত ‘হাজার স্তম্ভযুক্ত মণ্ডপ। সাধারণত এইসব সুউচ্চ স্তম্ভের স্তরে স্তরে নানা ধরনের ভাস্কর্য খোদাই করা ছিল। স্তম্ভগাত্রের কালোপাথরের গায়ের ভাস্কর্যে কাল্পনিক পশু থেকে দুরন্ত ঘোড়া ও নানা পশুর ছবি খোদিত হয়েছে।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের মন্দির নগর

রাজধানী বিজয়নগর তার অজস্র মন্দিরের জন্য প্রসিদ্ধিলাভ করেছিল। বিজয়নগর শুধু রাজধানী শহর হিসাবে পরিচিত ছিল না, ‘মন্দিরনগর’ হিসাবেও সকলের কাছে পরিচিত হয়েছিল।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ধর্ম বিশ্বাস

  • (১) বিজয়নগরের নরপতিদের ধর্মবিশ্বাস আলাদা হলেও, অপর ধর্মের মানুষের প্রতি সহনশীল ছিলেন। এমনকি, বিদেশিদের সঙ্গেও তাঁরা সদয় ব্যবহার করতেন। সব বিদেশি পর্যটকই এই কথা অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করেছেন। এখানে সব ধর্মের মানুষই বাস করতেন।
  • (২) সব ধর্মের উপাসনা সমগ্র বিজয়নগর সাম্রাজ্যে বিনা বাধায় প্রচলিত ছিল। বিজয়নগর সাম্রাজ্য হিন্দু সাম্রাজ্য বলে বিবেচিত হলেও, মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা থেকে তাঁরা মুক্ত ছিলেন।
  • (৩) ফিরিস্তার বিবরণ থেকে জানা যায় যে, বিজয়নগরের শাসকগণ বুঝেছিলেন যে শক্তিশালী ঘোড়া ও তিরন্দাজ বাহিনীর জন্যই বাহমনি রাজ্য সামরিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল।
  • (৪) তাই দেবরায় দুহাজার মুসলিমকে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা দেবার জন্য তাঁর সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করেন। ফিরিস্তার বিবরণে আরও জানা যায় যে, দেবরায়ের সেনাবাহিনীতে দশ হাজার মুসলিম সেনা ছিল। সংস্কৃতির দিক থেকে মধ্যযুগের ভারতবর্ষ-এ বিজয়নগরের শাসকদের এটা কম গৌরবের নয়।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি সম্পর্কে বারবোসার মন্তব্য

এই প্রসঙ্গে বিদেশি পর্যটক বারবোসার মন্তব্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর বিবরণে বলেছেন, “every man may come and go and live according to his need. without suffering any annoyance and without any enquiry whether he is a Christian, Jew, Moor or Heathen.”

উপসংহার :- বারবোসার এই মন্তব্য থেকে বলা যায়, বিজয়নগরের শাসকগণ পরধর্মমতসহিষ্ণু ছিলেন। এর থেকে মধ্যযুগের ইতিহাসে বিজয়নগরের শাসকদের এক মার্জিত, সুসংস্কৃত ও আধুনিক মনের পরিচয় পাওয়া যায়।

(FAQ) বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মন্দির নগর নামে পরিচিত কোন শহর?

বিজয়নগর।

২. কৃষ্ণদেব রায় কোন মন্দির নির্মাণ করান?

হাজারা মন্দির ও বিঠলস্বামী মন্দির।

৩. কার রাজসভায় অষ্টাদিগগজ ছিলেন?

কৃষ্ণদেব রায়।

৪. আমুক্তমাল্যদা রচনা করেন কে?

কৃষ্ণদেব রায়।

Leave a Comment