ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

একজন বিশিষ্ট বাঙালি দার্শনিক, লেখক ও চিন্তাবিদ ছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীল (১৮৬৪-১৯৩৮)। তিনি আধুনিক ভারতীয় দর্শনচর্চার অগ্রপথিকদের মধ্যে অন্যতম এবং তার চিন্তাধারা ব্রাহ্মধর্ম ও পাশ্চাত্য দর্শনের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ধর্ম, নৈতিকতা ও বিজ্ঞান নিয়ে গভীর বিশ্লেষণমূলক রচনা লিখেছেন এবং তার কাজ ভারতীয় সমাজ ও দর্শনের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।

ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

ঐতিহাসিক চরিত্রব্রজেন্দ্রনাথ শীল
জন্ম৩ সেপ্টেম্বর ১৮৬৪ খ্রি
জন্মস্থানকলকাতা, ব্রিটিশ ভারত
পেশাদার্শনিক, লেখক, চিন্তাবিদ
বিশেষ অবদানভারতীয় দর্শন ও ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচার
দর্শনচর্চাব্রাহ্মধর্ম, নৈতিকতা, বিজ্ঞান ও পাশ্চাত্য দর্শনের সংমিশ্রণ
বিখ্যাত রচনাPositive Science of the Ancient Hindus
প্রভাবআধুনিক ভারতীয় সমাজ, নৈতিক দর্শন ও চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব বিস্তার
মৃত্যু৩ ডিসেম্বর ১৯৩৮ খ্রি

ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

ভূমিকা :- সার্বভৌমিক জ্ঞানের সাধনাকেই যিনি জীবনের ব্রত রূপে গ্রহণ করেছিলেন, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, অধ্যাত্মবিদ্যা, প্রভৃতি জ্ঞানের সমুদয় শাখাতেই ছিল যাঁর স্বকীয় বিচরণ, বহুমুখী জ্ঞানের প্রশংসায় যিনি দেশে বিদেশে গুণীজনের দ্বারা স্তুত, তাঁর যথাযথ প্রশস্তি রচনা কবিগুরু ভিন্ন আর কার দ্বারা সম্ভব হত। জীবিতকালে তিনি চলমান বিশ্ববিদ্যালয় নামে আখ্যাত হয়েছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত পন্ডিত স্যার মাইকেল স্যাডলার তাঁকে অভিহিত করেছিলেন এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী বলে। বহুমুখী প্রতিভা ও অপরিসীম জ্ঞানের স্তম্ভস্বরূপ ব্রজেন্দ্রনাথের ভাষাবিদ রূপে পরিচয়ও সামান্য নয়। ইউরোপীয় ও ভারতীয় মিলিয়ে প্রাচীন ও আধুনিক দশটি ভাষায় ছিল তাঁর ব্যুৎপত্তি। জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ ব্রজেন্দ্রনাথের আরো একটি পরিচয়, তুলনামূলক সাহিত্য ও ধর্মদর্শন বিচারে এবং দর্শন আলোচনায় গণিতের সূত্র প্রয়োগে ভারতে তিনিই পথিকৃৎ।

ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের জন্ম

হুগলী জেলার হরিপাল গ্রামে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রজেন্দ্রনাথের জন্ম। তাঁর পিতা মহেন্দ্রনাথ শীল ছিলেন কলকাতা হাইকোর্ট-এর আইনজীবী।

দার্শনিক ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের শৈশব

শৈশবেই মাতাপিতাকে হারিয়ে মাতুল রাধারমণ নানের আশ্রয়ে পালিত হন। অসাধারণ কৌতূহল ও মেধা ছিল বালক ব্রজেন্দ্রনাথের সহজাত। এই কৌতূহলই উত্তরকালে তাঁর মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিল বহুমুখী জ্ঞানের স্পৃহা।

দুই বন্ধু বিবেকানন্দ ও ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

এখনকার স্কটিশচার্চ কলেজের সেকালে নাম ছিল জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনসটিটিউশন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে এখানে যখন তিনি বি.এ ক্লাসের ছাত্র, নরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। নরেন্দ্রই ভবিষ্যতে বিবেকানন্দ নামে বিশ্বখ্যাত হয়েছিলেন। উভয়েই ছিলেন জ্ঞানের সাধক-সত্য-সন্ধানী। তাই গভীর বন্ধুত্বে আবদ্ধ হয়েছিলেন তাঁরা। বয়সে নরেন্দ্রনাথ ব্রজেন্দ্রনাথের চেয়ে এক বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু পড়তেন এক ক্লাশ নিচে। দুই বন্ধুই ব্রাহ্ম সমাজ-এর সভ্য ছিলেন। নিয়মিত তাঁরা উপাসনাতেও যোগ দিতেন।

এম.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন ব্রজেন্দ্রনাথ। সেই বছর তিনিই ছিলেন প্রথম বিভাগে একমাত্র উত্তীর্ণ ছাত্র।

ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের বিবাহ

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ হলে ব্রজেন্দ্রনাথের কর্মজীবন শুরু হয় সিটি কলেজে, ইংরাজীর অধ্যাপক পদে। চাকরি লাভের অব্যবহিত পরে তাঁর বিবাহ হয়। পত্নী ইন্দুমতী ছিলেন ইংরাজী সাহিত্যের অনুরাগিনী।

অধ্যক্ষ ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

সিটি কলেজে একবছর কাজ করার পরে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি নাগপুর মরিস কলেজে অধ্যাপক পদে যোগ দেন। প্রথমে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেও পরে অধ্যক্ষের পদের দায়িত্ব নিয়ে সব মিলিয়ে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিন বছর এখানে তিনি কর্ম নিযুক্ত ছিলেন।

কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যক্ষ ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

  • (১) ইতিমধ্যে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যক্ষ লিভিংস্টোন সাহেব চলে যাওয়ায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবার আহ্বান পেলেন ব্রজেন্দ্রনাথ। মরিস কলেজ ছেড়ে তিনি চলে এলেন বহরমপুরে এবং দীর্ঘ নয় বছর অধ্যক্ষের পদে খ্যাতি ও সম্মানের সঙ্গে কাজ করেন।
  • (২) এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপবাহাদুর। তিনি ব্রজেন্দ্রনাথের বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন। কর্তব্যনিষ্ঠা, ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রগুণে ব্রজেন্দ্রনাথ তাঁর সহকর্মী অধ্যাপকদেরও শ্রদ্ধা সম্মান অর্জন করতে সমর্থ হন।
  • (৩) সকলের সহায়তায় অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি নানা ভাবে কলেজের উন্নতি বিধান করেন। তাঁর অবদানের কথা স্বয়ং মহারাজা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতেন।

রোমে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে রোম-এ প্রাচ্যবিদ সম্মেলনের আয়োজন হয়। সেই সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেই ছিল তাঁর প্রথম ইউরোপ যাত্রা। প্রাচ্যদেশীয় পন্ডিতমন্ডলীর এই ঐতিহাসিক সমাবেশে তাঁর ভাষণে ব্রজেন্দ্রনাথ শ্রী চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্ম-এর তত্ত্বের এমন রসমধুর বিশ্লেষণ করেন যে রাতারাতি তাঁর পান্ডিত্য ও সুগভীর জ্ঞানের খ্যাতি সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।

ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধারে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

কুচবিহারে থাকাকালীন দ্বিতীয়বার ব্রজেন্দ্রনাথকে ইউরোপ যেতে হয়েছিল। সেবার তিনি গিয়েছিলেন ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য।

বিশ্ব জাতি কংগ্রেসে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

১৯১১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জাতি কংগ্রেসে (Universal Races Congress) অতিথিরূপে যোগদানের আমন্ত্রণ আসে। ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি এই সম্মেলনে যোগ দেন এবং প্রধান বক্তা নির্বাচিত হন। এবারে তাঁর ভাষণ, নৃতত্ত্ব ও সমাজ বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের সুচিন্তিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সকলকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে।

ছাত্রমহলে ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের গভীর প্রভাব

ব্রজেন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃত জ্ঞানভিক্ষু। জ্ঞানের অন্বেষণ ও অনুশীলকেই তিনি জীবনের ব্রতরূপে গ্রহণ করেছিলেন। ছাত্রদের প্রতিও ছিলেন স্নেহপরায়ণ ও কর্তব্যসচেতন। তাই একজন সফল ও কৃতী অধ্যাপক রূপে ছাত্রমহলে তিনি গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

  • (১) সেই সময় বাংলার শিক্ষাজগতের অন্যতম রূপকার স্যার আশুতোষ ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রাণপুরুষ। তাঁর ঐকান্তিক প্রয়াসে বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিভাবান অধ্যাপকদের তিনি নিয়ে আসছেন এখানে।
  • (২) ব্রজেন্দ্রনাথের অধ্যাপনা ও পান্ডিত্যের খ্যাতি স্যার আশুতোষেরও কর্ণগোচরে হয়েছিল। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ব্রজেন্দ্রনাথকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে আহ্বান জানালেন তিনি। স্যার আশুতোষের সস্নেহ আহ্বানের মর্যাদা রক্ষা করতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করলেন না ব্রজেন্দ্রনাথ।
  • (৩) তিনি এখানে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে দর্শন শাস্ত্রের প্রধান অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হলেন। সাত বছর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ যোগ্যতার সঙ্গে করেন এবং স্নাতকোত্তর ক্লাশের ছাত্রদের শ্রদ্ধা ও সম্মান অর্জনে সমর্থ হন। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কাজেও নানাভাবে তিনি আশুতোষকে সহায়তা করেন।

ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের পি.এইচ.ডি উপাধি লাভ

  • (১) ব্রজেন্দ্রনাথের কলকাতার জীবন নানা দিক থেকেই সুফলপ্রসূ হয়েছিল। সংস্কৃত সহ প্রাচীন আধুনিক দশটি ভারতীয় ও ইউরোপীয় ভাষায় তিনি পূর্বেই ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানের ফলে সংগৃহীত তথ্যাদি সংযোগে এই সময়ে তিনি Positive Science of the Ancient Hindus নামে একটি নিবন্ধ প্রস্তুত করেন।
  • (২) এই প্রবন্ধটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশ করে তিনি পি.এইচ.ডি উপাধি লাভ করেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে এই নিবন্ধই পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে ব্রজেন্দ্রনাথ সংস্কৃত ভাষায় তাঁরা গভীর জ্ঞান, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুসন্ধান এবং অসাধারণ বিশ্লেষণ শক্তির পরিচয় দিয়েছেন।
  • (৩) ভারতের জ্ঞান সাধনার পরম্পরা সুপ্রাচীন। সেই সুদূর অতীতে ভারত থেকেই জ্ঞানের আলো যুগে যুগে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিস্মৃতপ্রায় গৌরবোজ্জ্বল সেই কীর্তিকাহিনী ব্রজেন্দ্রনাথ বিধৃত করেছেন তাঁর এই গ্রন্থে। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিএসসি উপাধি প্রদান করে।
  • (৪) বিশেষ করে সংস্কৃত সাহিত্য ও দর্শন শাস্ত্রে ব্রজেন্দ্রনাথের গভীর জ্ঞানের প্রকাশ ঘটেছে তাঁর বিভিন্ন সময়ের ভাষণ ও রচিত নিবন্ধে। স্নাতকোত্তর ক্লাশে তাঁর সারগর্ভ ভাষণ ও বিশ্লেষণ, তুলনামূলক আলোচনা ছাত্রদের গভীর ভাবে প্রভাবিত করত।

পথিকৃৎ ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

বর্তমানে তুলনামূলক সাহিত্য ও দর্শন বিচারে এবং দর্শন আলোচনায় গণিতের সূত্র প্রয়োগ এক অতি প্রচলিত রীতি। ব্রজেন্দ্রনাথই ভারতে এই রীতির পথিকৃৎ।

উপাচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

  • (১) ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ওই বছরেই মহীশূর রাজ্যের তদানীন্তন মহারাজার আহ্বানে তাঁকে ওই রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ গ্রহণ করতে হয়।
  • (২) মহারাজ উক্ত পদ গ্রহণের জন্য প্রথমে অনুরোধ জানিয়েছিলেন স্যাডলার কমিশনের চেয়ারম্যান, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত পন্ডিত স্যার মাইকেল স্যাডলারকে। তিনি সেই পদে প্রস্তাব করেন ব্রজেন্দ্রনাথের নিয়োগ।
  • (৩) নতুন কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে দায়িত্ব প্রতিপালন করেছিলেন রজেন্দ্রনাথ। সেই যুগে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে মহীশূরের অগ্রগতি বিশেষ ভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। একমাত্র এই রাজ্যেই তখনো পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল।
  • (৪) ইতিপূর্বে বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে প্রশাসনিক কার্যেও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ। সেই দক্ষতার সুদৃঢ় ভিত্তি ছিল তাঁর জ্ঞান ও পান্ডিত্য। ফলে বিদ্যোৎসাহী মহারাজার গুণগ্রাহীতার অনুরোধে আরও গুরুতর দায়িত্বভার পরে তাঁকে প্রতিপালন করতে হয়।

শান্তিনিকেতনে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

ইতিমধ্যে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর আমন্ত্রণে ব্রজেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন-এ যান এবং বিশ্বভারতীর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।

মহীশূরে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

  • (১) ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মহীশূরের শাসনতন্ত্র সংস্কারের জন্য যে সংসদ গঠিত হয় ব্রজেন্দ্রনাথকে করা হয় তার সভাপতি। দুই বছর পরেই ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মহীশূর সরকারের কার্যকরী পরিষদের অন্যতম সভ্য নিযুক্ত হন।
  • (২) মহীশূর রাজ্যের শাসনতন্ত্র সংস্কার বিষয়ে তিনি যে তথ্যপূর্ণ সুচিন্তিত ভাষণ দেন প্রধানত তারই ভিত্তিতে ওই রাজ্যের নতুন শাসনতন্ত্র রচিত হয়েছিল। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রজেন্দ্রনাথ মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে খ্যাতি ও সম্মানের সঙ্গে কাজ করেন।
  • (৩) মহীশূর ত্যাগ করার আগেই ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি নাইট বা স্যার উপাধিতে ভূষিত হন এবং পরে গুণমুগ্ধ মহীশূররাজ তাঁকে ‘রাজতন্ত্র প্রবীণ’ উপাধি দ্বারা সম্মানিত করেন। অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে মহীশূরে ব্রজেন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য ক্রমেই ভেঙ্গে পড়তে থাকে।

ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের ভগ্ন স্বাস্থ্য

ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েই ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মহীশূরের কর্মবন্ধন মুক্ত হয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। সেই সময় তাঁর দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। দুর্বল হয়েছে স্মরণশক্তি। কিন্তু অফুরন্ত কর্মশক্তি তাঁকে সতেজ প্রাণবন্ত রেখেছিল। কাজ ছাড়া তিনি থাকতে পারতেন না।

দেশবাসীর শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

মহীশূর থেকে ফিরে আসার পর প্রায় নয় বছর কাল দেশবাসী ব্রজেন্দ্রনাথের প্রেরণাদায়ী পবিত্র সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছিল। দেহ জীর্ণ হলেও অটুট কর্মশক্তি নিয়েই তিনি সকলের মধ্যে বিচরণ করেছেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ। দেশের জ্ঞানীগুণীরাও তাঁর সান্নিধ্য লাভে বঞ্চিত হতেন না। তাঁর আদর্শ চরিত্র ও গৌরবদীপ্ত কর্মময় জীবন তাঁকে দেশবাসীর শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাঁরা তাঁকে সম্মান জানিয়েছিল আচার্য সম্বোধনে।

রামমোহনের সার্থক উত্তরসাধক ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

কলকাতার নাগরিকদের পক্ষ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়-এর মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপিত হয়। সেই উপলক্ষে তিনি মূল্যবান ভাষণ দেন। জ্ঞানে কর্মে ও উপলব্ধিতে ব্রজেন্দ্রনাথ ছিলেন অখন্ড সত্যের সাধক, বিশ্বপথিক। রাজা রামমোহনের সার্থক উত্তরসাধক।

ব্রজেন্দ্রনাথ শীল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের প্রশস্তি রচনা

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রজেন্দ্রনাথের বাহাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে কলকাতায় এক সাড়ম্বর উৎসব পালিত হয়। সেনেট হলে এই উৎসবের আয়োজন করেছিল ভারতীয় দর্শন কংগ্রেস। এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ব্রজেন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রশস্তি রচনা করেছিলেন, “জ্ঞানের দুর্গম ঊর্দ্ধে উঠেছ সুউচ্চ মহিমায়, যাত্রী তুমি, যেথা প্রসারিত তব দৃষ্টির সীমায় সাধন শিখর শ্রেণী, যেথায় গহনগুহা হতে সমুদ্রবাহিনী বার্তা চলেছে প্রস্তরভেদী স্রোতে নব নব তীর্থ সৃষ্টি করি। সেথাকার শুভ্র আলো বরমাল্য রূপে সমুদার ললাটে জড়ালো বাণীর দক্ষিণ পাণি। বিদায় কালের অর্থ মোর বাহুতে বাঁধিনু তব সপ্রেম শ্রদ্ধার রাখীডোরে।”

ধর্ম সম্মেলনের সভাপতি ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

দু বছর পরেই ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পরমহংস রামকৃষ্ণদেব-এর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে কলকাতা টাউন হলে এক ঐতিহাসিক ধর্ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে ব্রজেন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেন। জীবনের সর্বশেষ প্রকাশ্য সভায় সভাপতির ভাষণে আজীবন সত্যের ও সুন্দরের পূজারী ব্রজেন্দ্রনাথ সেদিন দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “বিশ্বের মধ্যে মানুষকে আর মানুষের মধ্যে বিশ্বকে প্রত্যক্ষ করতে পারলেই মানবতাকে সকল রকম সংকীর্ণতা মুক্ত করা যেতে পারে।”

ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের মৃত্যু

অবশেষে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ৩ ডিসেম্বর কলকাতায় তাঁর কর্মবহুল জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

উপসংহার :- জীবন সায়হ্নে আত্মজীবনী লিখবার পরিকল্পনা করেছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর। দুই খন্ডে সম্পূর্ণ করবার ইচ্ছা নিয়ে মৃত্যুর কয়েক বছর আগে এই কাজে হাত দেন তিনি। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসায় নিজের হাতে লেখার ক্ষমতা ছিল না। লেখার কাজটি তাঁর সেক্রেটারিই সম্পন্ন করছিলেন। তিনি মুখে মুখে বলে যেতেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম খন্ডের কাজ শেষ করেছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ। কিন্তু দ্বিতীয় খন্ড শুরু করার আগেই মৃত্যুলোকের আহ্বান এসে পৌঁছেছিল। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে মায়ীক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলেও বঙ্গ মাতার এই জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ সন্তান তাঁর দেশবাসীর অন্তরে শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন।

(FAQ) ব্রজেন্দ্রনাথ শীল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কে ছিলেন?

ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি দার্শনিক, লেখক এবং চিন্তাবিদ। তিনি ব্রাহ্মধর্ম এবং পাশ্চাত্য দর্শনের মিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন চিন্তাধারা তৈরি করেছিলেন।

২। ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের প্রধান অবদান কী?

তার প্রধান অবদান ছিল নৈতিকতা, বিজ্ঞান ও ব্রাহ্মধর্মের উপর ভিত্তি করে আধুনিক ভারতীয় সমাজের দর্শনচর্চা সমৃদ্ধ করা।

৩। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কোন রচনা লিখেছেন?

তার বিখ্যাত রচনার মধ্যে রয়েছে “The Positive Science of Morals” এবং অন্যান্য দর্শন ও নৈতিকতা বিষয়ক বিশ্লেষণাত্মক রচনা।

৪। ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের দর্শন কীসের উপর ভিত্তি করে গঠিত?

ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের দর্শন ব্রাহ্মধর্ম এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের চিন্তাধারার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল।

৫। ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের দর্শন ভারতীয় সমাজে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে?

তার দর্শন ভারতীয় সমাজের নৈতিকতা ও আধুনিক চিন্তাচেতনার বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

৬। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কোন সময়ে জীবনযাপন করেছেন?

তিনি ১৮৫২ থেকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের সময়ে জীবনযাপন করেছিলেন।

৭। ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের চিন্তার মূল বৈশিষ্ট্য কী?

তার চিন্তার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্ম, নৈতিকতা ও বিজ্ঞানকে একীভূত করে মানব সমাজের উন্নতির পথ খোঁজা।

Leave a Comment