আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব নীতি

আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব নীতি প্রসঙ্গে অভিজাতদের দমন, অভিজাতদের জমি বাজেয়াপ্ত, অভিজাতদের উদ্বৃত্ত অর্থ বাজেয়াপ্ত, বিশ্বস্ততার অভাবের অজুহাত, তিন শ্রেণির প্রজা, হিন্দু সামন্ত শ্রেণি সম্পর্কে রাজস্ব নীতি, মধ্যস্বত্ব ভোগী শ্রেণি ও রাজস্ব নীতির ফল সম্পর্কে জানবো।

আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব নীতি

ঐতিহাসিক ঘটনাআলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব নীতি
সুলতানআলাউদ্দিন খলজি
বংশখলজি বংশ
সাধারণ কৃষকবলহার
হিন্দু সামন্তরায়, রণক, ঠাকুর
আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব নীতি

ভূমিকা :- আলাউদ্দিন ছিলেন স্বৈর শাসক। শাসন ব্যবস্থার সুপরিচালনা, তাঁর রাজ্য জয়ের ব্যয়, মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য বিরাট সেনাদলের ব্যয় নির্বাহ রাজস্বের প্রয়োজনীয় করতে তাঁর প্রভুত অর্থ লাগত। তিনি সাধারণ সেনাদের ২৩৪ তঙ্কা হারে নগদ বেতন দিতেন। এই অর্থ যোগাড়ের জন্য তিনি রাজস্ব রাজস্ব নীতিকে ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করেন।

আলাউদ্দিন খলজি কর্তৃক অভিজাতদের দমন

সুলতান আলাউদ্দিন তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিন্দু ও মুসলিম অভিজাতদের দমন করার জন্য তাদের হাতে বাড়তি টাকা যাতে না জমে সেজন্য চেষ্টা করেন। আলাউদ্দিন মনে করতেন যে, অভিজাতদের হাতে অর্থ পুঞ্জীভূত হওয়ার দরুন তারা বিদ্রোহ করে।

আলাউদ্দিন খলজি কর্তৃক অভিজাতদের জমি বাজেয়াপ্ত

সুলতান আলাউদ্দিন তাঁর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই তাঁর রাজস্ব নীতির সংস্কার করেন। ডঃ বরণীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে মুসলিম অভিজাতদের ইনাম, মিলক, ওয়াকফ বাবদ যে জমি দান করা হয় তা বাজেয়াপ্ত করে তিনি খলিশা জমিতে পরিণত করেন।

আলাউদ্দিন খলজি কর্তৃক অভিজাতদের উদ্বৃত্ত অর্থ বাজেয়াপ্ত

রাজস্ব কর্মচারীদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয় যে অভিজাতদের হাত থেকে উদ্বৃত্ত অর্থ যেন বাজেয়াপ্ত করা হয়। মোরল্যান্ড (Moreland) অবশ্য মনে করেন যে আলাউদ্দিন তাঁর এই আদেশ পুরোপুরি কার্যকরী করতে পারেননি।

আলাউদ্দিন খলজির সময় বিশ্বস্ততার অভাবের অজুহাত

  • (১) যে সকল জালালি অভিজাত জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে আলাউদ্দিনের পক্ষে যোগ দেন তাঁদের বিশ্বস্ততার অভাবের অজুহাতে তাদের জমি-জায়গা বাজেয়াপ্ত করা হয়।
  • (২) এই দুইটি রাজস্ব বন্দোবস্ত আলাউদ্দিন তার স্বৈরতন্ত্রকে সুরক্ষিত করার জন্য করেন। বার্ধক্য ভাতা বা পেনশন বাবদ যে জমি দান করা হয় তাও তিনি বাজেয়াপ্ত করেন।

আলাউদ্দিন খলজির সময় তিন শ্রেণির প্রজা

এরপর সুলতান আলাউদ্দিন সাধারণভাবে রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রাজস্ব সংস্কার করেন। তিনি দেখেন যে অধিকাংশ জমিগুলি তিন শ্রেণীর প্রজার হাতে আছে – হিন্দু সামন্ত শ্রেণী, যাদের রায়, রণক, ঠাকুর বলা হত, গ্রামের মুখিয়া শ্রেণী বা খুৎ, মুকাদ্দম চৌধুরী প্রভৃতি এবং সাধারণ কৃষক বা বলহার।

হিন্দু সামন্ত শ্রেণি সম্পর্কে আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব নীতি

  • (১) ডঃ নিজামীর মতে আলাউদ্দিন উপলব্ধি করেন যে তার বেশীর ভাগ প্রজা অ-মুসলিম। সুতরাং অ-মুসলিম বা হিন্দুদের চিরাচরিত ভূমি প্রথা তিনি মেনে না চললে বিপদ হবে।
  • (২) যেহেতু হিন্দুরা জমিতে বংশানুক্রমিক অধিকারে বিশ্বাস করত, সেহেতু তিনি হিন্দু সামন্তশ্রেণী যথা রায়, রণক প্রভৃতির বংশানুক্রমিক অধিকার মেনে নেন। সুলতানের প্রাপ্য কর তাঁরা প্রদান করলে। তিনি সন্তুষ্ট থাকেন।
  • (৩) এই সকল সামন্ত রাজার অধীনে যে সকল হিন্দু প্রজা ছিল তাদের ওপর তিনি হস্তক্ষেপ করেন নি। বরণী সামন্ত শ্রেণীর সঙ্গে মধ্যস্বত্ব শ্রেণীকে এক করে ফেলেছেন।

আলাউদ্দিন খলজির সময় মধ্যস্বত্ব ভোগী শ্রেণি

  • (১) অতঃপর তিনি গ্রামের মুখিয়া খুৎ, মুকাদ্দম, চৌধুরী ও বলহার শ্রেণীর রাজস্ব ব্যবস্থার বন্দোবস্ত করেন। এঁরা ছিলেন মধ্যস্বত্ব ভোগী শ্রেণী। খুৎ কথাটি বলতে গ্রামের মুখিয়া শ্রেণী বোঝায়।
  • (২) আলাউদ্দিন মনে করতেন যে এই মধ্যস্বত্ব ভোগী, জমিদার শ্রেণী তাদের নিজস্ব জমি থেকে প্রচুর আয় পেত। অথচ তারা সরকারকে বঞ্চিত করত। অধিকন্তু তারা বলহার বা কৃষকদের কাছ থেকে উপরি কর “খুতি” আদায় করত। এই অর্থে তারা দামী পোষাক পরত, আরবী ঘোড়ায় চড়ত, পাল্কী চড়ত এবং নিজেদের মধ্যে বেসরকারী লড়াই চালাত।
  • (৩) এজন্য আলাউদ্দিন দুটি জবিতা বা আদেশনামা জারী করেন – (ক) কর্ষিত জমি জরিপ করে খুৎ, মুকাদ্দম এবং কৃষক বা বলহার সকলের ক্ষেত্রে ফসলের ৫০ভাগ বা অর্ধাংশ খরজ বা ভূমি রাজস্ব হিসেবে ধার্য করা হবে। এক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী খুৎ, মুকাদ্দম এবং জমির স্বত্বভোগী বলহার বা চাষীর মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হবে না।
  • (৪) সকল শ্রেণীকে চরাই অর্থাৎ পশুচারণ কর দিতে হবে। আলাউদ্দিন সকল অঞ্চলে জমি জরিপ করেন একথা বলা যায় না। মোরল্যান্ডের মতে দিল্লী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, দোয়াব, রোহিলখণ্ড, মালব, রাজপুতানা অঞ্চল ও পাঞ্জাব এই জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
  • (৫) এছাড়া তিনি “করহি” নামে একটি আলাদা কর আদায় করতেন। এটি ছিল সম্ভবত আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক। ডঃ কে. এস. লালের মতে, হিন্দু বণিকরা শতকরা ১০ ভাগ এবং মুসলিম বণিকরা ৫ ভাগ হারে করহি আদায় দিত। এছাড়া আলাউদ্দিন ঘরাই বা গৃহকর ও সেচকর আদায় করতেন।

আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব নীতির ফল

  • (১) আলাউদ্দিনের রাজস্ব সংস্কারের ফলাফল সম্পর্কে ডঃ ইরফান হাবিব মন্তব্য করেছেন যে, “আলাউদ্দিন তার রাজস্ব সংস্কারের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে গ্রামীণ দুই শ্রেণীর মধ্যে প্রবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের রক্ষার ব্যবস্থা করেন।”
  • (২) অর্থাৎ তিনি মধ্যসত্বভোগী বা খুৎ, মুকাদ্দম প্রভৃতির বাড়তি অর্থ আদায়ের হাত থেকে বলহার বা কৃষকদের রক্ষা করেন। ডঃ কে. এস. লাল এই মত সমর্থন করেন না।
  • (৩) আলাউদ্দিন তাঁর কর ব্যবস্থার বিশেষত জরিপ দ্বারা প্রত্যক্ষ কর নির্ধারণের জন্য বহু কর্মচারী নিয়োগ করতে বাধ্য হন। কারকুন, মুতাশরিফ, গোমস্তা, মুহাশিল প্রভৃতি বিভিন্ন কর্মচারীরা রাজস্ব আদায়ের জন্য বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করত।
  • (৪) কিন্তু কর্মচারীদের দুর্নীতি তিনি রদ করতে পারেন নি। আলাউদ্দিনের বিখ্যাত উজীর শরফকাই খুব যোগ্য লোক ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত উজীর শরফকাই এজন্য গ্রামের পাটোয়ারীদের সাহায্য নিতেন। তিনি হাজার হাজার দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মচারীকে কারারুদ্ধ করেন। কিন্তু প্রজাদের ওপর শোষণ সার্বিকভাবে রদ করা সম্ভব হয়নি।

উপসংহার :- ডঃ কে এস লাল মন্তব্য করেছেন যে, “আলাউদ্দিনের রাজস্ব বিভাগীয় আইনগুলির উদ্দেশ্য ছিল ধনী জমিদারদের দমন করা, কিন্তু এই আইনগুলি কৃষকদের স্বার্থের কম হানিকারক ছিল না।”

(FAQ) আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আলাউদ্দিনের সময় আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক কি নামে পরিচিত ছিল?

ক্রসিং।

২. আলাউদ্দিনের রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীরা কি নাম পরিচিত?

কারকুন, মুতাশরিফ।

৩. আলাউদ্দিনের সময় সাধারণ কৃষক কি নামে পরিচিত ছিল?

বলহার।

৪. আলাউদ্দিনের সময় হিন্দু সামন্ত শ্রেণি কি কি নামে পরিচিত ছিল?

রায়, রণক, ঠাকুর।

Leave a Comment