আহম্মদ শাহ আবদালির উপাধি ধারণ, পূর্বকথা, ভারতের আক্রমণের উদ্দেশ্য, ১৭৪৮-১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নয় বার ভারত আক্রমণ, পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ, যুদ্ধে জয়লাভ, ভারত ত্যাগ, শিখ শক্তির বিরুদ্ধে অভিযান ও আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণের ফলাফল সম্পর্কে জানবো।
আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণ প্রসঙ্গে আহম্মদ শাহ আবদালির ৯ বার ভারত আক্রমণ, আহম্মদ শাহ আবদালির সম্পদ লুণ্ঠন ও শোষণ, আফগান শাসক আহম্মদ শাহ আবদালি, আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণ ও পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ, আহম্মদ শাহ আবদালির আক্রমণে মুঘলদের পরাজয়, আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণের সময় মোগল সম্রাট ও আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণের ফলাফল সম্পর্কে জানব।
আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণ (১৭৪৮-৬৭ খ্রিঃ)
ঐতিহাসিক ঘটনা | আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণ |
সময়কাল | ১৭৪৮-১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ |
মোগল সম্রাট | আহম্মদ শাহ |
তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ | ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দ |
ফলাফল | আহম্মদ শাহ আবদালির জয়লাভ |
ভূমিকা :- ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে পারসিক সম্রাট নাদির শাহ এক আততায়ীর ছুরিকাঘাতে নিহত হলে তাঁর আফগান অনুচর আহম্মদ শাহ আবদালি সাম্রাজ্য-এর পূর্বাংশ আফগানিস্তান-এ এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
আহম্মদ শাহ আবদালির উপাধি ধারণ
তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে তিনি ‘দর-ই-দুরান’ (শ্রেষ্ঠ মুক্তা) বা ‘দর-ই-দররান’ (দুর্গের মুক্তা) উপাধি ধারণ করেন।
আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত অভিযানের পূর্বকথা
- (১) নাদির শাহের ভারত অভিযানের অন্যতম সেনাপতি হিসেবে তিনি ভারতে আসেন। এই সময় ভারতের পতনোন্মুখ রাজনৈতিক অবস্থা এবং ভারতের অতুল ঐশ্বর্য তাঁর নজরে আসে।
- (২) স্বভূমি আফগানিস্তানের সিংহাসনে বসে রাজ্যের পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক কাজে তিনি বিপুল অর্থের প্রয়োজন বোধ করেন।এই প্রয়োজন মেটাবার উদ্দেশ্যে তিনি প্রথমে কাবুল, পেশোয়ার ও সিন্ধুদেশের রাজস্বের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
- (৩) পূর্বে এই অঞ্চল নাদির শাহের অধিকারভুক্ত ছিল এবং তিনি এই অঞ্চল থেকে রাজস্ব আদায় করতেন। এই রাজস্ব তাঁর প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হলে নাদির শাহের সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহ-র কাছে গজনী, কাবুল, পেশোয়ার, মুলতান ও সিন্ধুদেশ দাবি করেন।
- (৪) মোগল সম্রাট এই দাবি মানতে অস্বীকৃত হলে তিনি পেশোয়ার পর্যন্ত সকল ভূভাগ জয় করেন এবং পেশোয়ার দখলের ফলে তাঁর ভারত অভিযানের পথ প্রশস্ত হয়।
আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য
তাঁর ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। যেমন –
(১) এলফিনস্টোনের অভিমত
ঐতিহাসিক এলফিনস্টোন বলেন যে, বিবদমান আফগান উপজাতিদের ঐক্যবদ্ধ করে স্বদেশে নিজআধিপত্য সুদৃঢ় করার জন্য ভারত থেকে ধন-সম্পদ লুণ্ঠন অতি প্রয়োজনীয় ছিল।
(২) নারায়ণ সরকারের অভিমত
ডঃ জগদীশ নারায়ণ সরকার বলেন যে, তাঁর ভারত-লুণ্ঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সোনা ও ক্রীতদাস সংগ্রহ করা (“….he yearned for acquiring gold and silver from India.”)। এই সময় আফগানিস্তানের মানুষ সোনাকে ‘মানুষের ঈশ্বর’ বলে মনে করত (“…. gold in Afghani stan, more than anywhere else, was the god of the people.”)।
(৩) কালীকিংকর দত্তের অভিমত
ঐতিহাসিক ডঃ কালীকিঙ্কর দত্ত বলেন যে, আহম্মদ শাহ আবদালির আক্রমণ নিছক লুন্ঠনমাত্র ছিল না। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল পতনোন্মুখ মোগল সাম্রাজ্যের ওপর আফগান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।”
আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত অভিযান
১৭৪৮ থেকে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি মোট নয়বার ভারত আক্রমণ করেন।
(১) প্রথম আক্রমণ
১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মানপুরের যুদ্ধে শাহজাদা আহম্মদ শাহ ও সেনাপতি মির মন্নু-র প্রতিরোধের কাছে পরাস্ত হয়ে ফিরে যান।
(২) দ্বিতীয় আক্রমণ
১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি দ্বিতীয়বার ভারত আক্রমণ করেন। তিনি পাঞ্জাবে প্রবেশ করলে মির মন্নু বাধা দেন, কিন্তু ইরানি-তুরানি দলের দ্বন্দ্বে দ্বিধা-বিভক্ত দিল্লি দরবার থেকে কোনও সাহায্য না আসায় তিনি পরাজিত হন। সিন্ধুনদের পশ্চিমাঞ্চল আবদালির অধিকারভুক্ত হয়।
(৩) তৃতীয় আক্রমণ
১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি তৃতীয়বার ভারত আক্রমণ করেন। পাঞ্জাবের তৎকালীন শাসনকর্তা মির মন্নু পরাজিত হন এবং মোগল সম্রাট আহম্মদ শাহ পাঞ্জাবের সরহিন্দ পর্যন্ত সকল ভূভাগ আবদালিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
(৪) চতুর্থ আক্রমণ
- (ক) ইতিমধ্যে মোগল সুবাদার মির মন্নু-র মৃত্যু হলে পাঞ্জাবে মোগল আধিপত্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় সুযোগ নিয়ে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় আলমগীরের রাজত্বকালে আবদালি পুনরায় ভারত আক্রমণ করেন।
- (খ)মোগল সাম্রাজ্যের তৎকালীন ‘ওয়াজির’ ইমাদ-উল-মূলক বিদেশি আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়েও কার্যত বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন। আবদালি দিল্লিতে ঢুকে অবাধ লুণ্ঠন চালান। জাঠ অধ্যুষিত মথুরা ও বৃন্দাবন ও লুণ্ঠিত হয়।
- (গ) দুর্বল মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর পাঞ্জাব, কাশ্মীর ও সিন্ধুদেশ আবদালিকে ছেড়ে দেন। আবদালি তাঁর পুত্র তৈমুরকে অধিকৃত অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে স্বদেশে ফিরে যান।
(৫) পঞ্চম আক্রমণ
- (ক) তৈমুরের কুশাসনে পাঞ্জাবে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে জলন্ধরের মোগল শাসনকর্তা আদিনা বেগ খান আফগানদের বিতাড়নের জন্য মারাঠাদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। পেশোয়ার নির্দেশে মারাঠা নেতা রঘুনাথ রাও পাঞ্জাব থেকে আফগানদের বিতাড়িত করেন।
- (খ) এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ আবদালি ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত আক্রমণ করে পুনরায় পাঞ্জাবে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন। অতঃপর তিনি মারাঠাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্য দিল্লির দিকে অগ্রসর হন।
পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ
পেশোয়ার নির্দেশে মারাঠা বাহিনী দিল্লির সন্নিকটে পানিপথের প্রান্তরে আফগান বাহিনীকে বাধা দেয়। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ -এ মারাঠারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
আহম্মদ শাহ আবদালির জয়লাভ ও ভারত ত্যাগ
এই যুদ্ধে জয়লাভ করে আহম্মদ শাহ আবদালির বিশেষ কোনও লাভ হয় নি, কারণ মোগল সম্রাট শাহ আলম-এর কাছ থেকে বার্ষিক ৪০ লক্ষ টাকা কর হিসেবে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করে তিনি ভারত-ত্যাগ করেন।
(৬) শিখ শক্তির বিরুদ্ধে অভিযান
আবদালির ভারত-ত্যাগের পর পাঞ্জাবের উদীয়মান শিখশক্তি আফগানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে ১৭৬৪ থেকে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আবদালিকে অন্তত চারবার পাঞ্জাবে শিখদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হয়। তা সত্ত্বেও শিখদের দমন করা সম্ভব হয় নি।
আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণের ফলাফল
আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণের ফলাফল নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী ছিল।
- (১) নাদির শাহের ভারত আক্রমণ মোগল সাম্রাজ্যের ভিতকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আহম্মদ শাহ আবদালির আক্রমণ সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করে। মোগল সাম্রাজ্য কেবলমাত্র দিল্লি ও তার সন্নিহিত জেলাগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
- (২) আফগান আক্রমণ প্রতিরোধে মোগল সম্রাটের শোচনীয় ব্যর্থতা সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট সম্মান ও মর্যাদার বিলুপ্তি ঘটায়। আফগানরা দিল্লি, মথুরা ও বৃন্দাবনে যথেচ্ছ লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালায়।
- (৩) দিল্লির অভিজাতরাও এই লুন্ঠন ও অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পান নি। দিল্লি নগরী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং দিল্লির অগণিত নরনারীকে দাসে পরিণত করা হয়। ডঃ তারা চাঁদ বলছেন যে, “There was no atrocity which was not perpetrated.”।
- (৪) আবদালির মূল লক্ষ্যই ছিল লুণ্ঠন। ভারতের প্রায় ১২ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ দেশের বাইরে চলে যায় এবং বারংবার আক্রমণ ও লুণ্ঠনের ফলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো একেবারে ভেঙ্গে পড়ে।
- (৫) মারাঠাদের ওপর এই আক্রমণের ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ফলে মারাঠারা গতিহীন হয়ে পড়ে এবং অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও মারাঠা সাম্রাজ্যবাদের অগ্রগতি স্তব্ধ হয়ে যায়।
উপসংহার :- আহম্মদ শাহ আবদালির আক্রমণের ফলে মোগল দরবারে অভিজাতদের মধ্যে দলাদলি বৃদ্ধি পায় এবং মারাঠা আধিপত্য দুর্বল হওয়ায় ভারতে শিখ ও ইংরেজ শক্তির অভ্যুদয়ের পথ সুগম হয়।
(FAQ) আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৭৪৮-১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৯ বার।
আহম্মদ শাহ।
১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে আহম্মদ শাহ আবদালি ও মারাঠা বাহিনীর।