একজন প্রখ্যাত বাঙালি দার্শনিক, বিজ্ঞানী, লেখক এবং শিক্ষাবিদ হলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪–১৯১৯)। তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত। তাঁর রচিত বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধসমূহ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী শিক্ষাজীবনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে শিক্ষকতা ও লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানরহস্য, প্রকৃতিবিদ্যা, এবং মানবপ্রকৃতি। তিনি সমাজ সংস্কার ও নারীশিক্ষা প্রসারেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
স্বদেশ প্রেমিক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
ঐতিহাসিক চরিত্র | রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী |
জন্ম | ২০ আগস্ট ১৮৬৪ খ্রি |
জন্মস্থান | মুর্শিদাবাদ, ব্রিটিশ ভারত |
পেশা | দার্শনিক, লেখক, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ |
উল্লেখযোগ্য রচনা | বিজ্ঞান রহস্য, প্রকৃতিবিদ্যা, মানবপ্রকৃতি |
কর্মক্ষেত্র | শিক্ষকতা, লেখালেখি |
অবদান | বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার অগ্রদূত, সমাজসংস্কারক |
মৃত্যু | ৬ জুন, ১৯১৯ খ্রি |
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
ভূমিকা :- বাংলার শিক্ষা ও সাহিত্য জগতে বিশিষ্ট অবদানের জন্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি ছিলেন আদর্শ শিক্ষাব্রতী। বিশিষ্ট সাহিত্যসাধক ও একনিষ্ঠ স্বদেশ প্রেমিক। সাহিত্য ছাড়াও বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, ও সংস্কৃত শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর জন্ম
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট মুর্শিদাবাদ জেলার জেমোকান্দি গ্রামে এক সারস্বত পরিবারে রামেন্দ্রসুন্দরের জন্ম। তাঁর পিতার নাম গোবিন্দসুন্দর ত্রিবেদী। মাতা চন্দ্রকামিনী দেবী। তাঁর পিতামহ ও পিতৃব্য উপেন্দ্রসুন্দর সকলেই ছিলেন সাহিত্যানুরাগী।
সাহিত্যিক পরিমন্ডলের সাহচর্যে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
বাল্য বয়স থেকেই এক স্নিগ্ধ সাহিত্যিক পরিমন্ডলের সাহচর্য লাভ করায় সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর শিক্ষা
- (১) পাঁচবছর বয়সেই পড়াশুনা শুরু হয়েছিল তাঁর। বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত হলে ছয় বছর বয়সে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে তাঁকে কান্দি ইংরাজি স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। বাল্যবয়স থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী।
- (২) পিতা গোবিন্দসুন্দরের উৎসাহে ও শিক্ষায় তাঁর মধ্যে জাগরিত হয়েছিল জ্ঞানের স্পৃহা। স্কুলপাঠ্য বইয়ের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়ার আগ্রহ শৈশব থেকেই জন্মেছিল। গোবিন্দসুন্দর গল্পের মাধ্যমে পুত্রকে শোনাতেন দেশ বিদেশের ইতিহাসের কাহিনী। দেশীয় বীরদের আত্মত্যাগের কাহিনী।
- (৩) প্রকৃতির নানা রহস্যের কথাও সহজ সরল ভাষায় গল্পের মতো করে তিনি বুঝিয়ে দিতেন রামেন্দ্রসুন্দরকে। আকাশের তারাদের পরিচয়, তাদের অবস্থান-শিশু বয়সেই পিতার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন তিনি।
- (৪) প্রকৃতি শান্ত হওয়ায় স্কুলে ছাত্র শিক্ষক সকলেরই কাছে প্রিয়পাত্র ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর। পড়াশুনা ছাড়া কিছুই জানতেন না। ক্ষীণকায় ও দুর্বল শরীরের জন্য দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলোয় উৎসাহ পেতেন না। তাঁর প্রিয় খেলা ছিল ছক্কাপাঞ্জা, বাঘবন্দী, কড়ি খেলা প্রভৃতি-যা ঘরে বসেই একা বা সঙ্গীদের নিয়ে খেলা যেত।
- (৫) ক্ষীণজীবী হলেও পরীক্ষায় বরাবরই ভাল ফল করতেন। কান্দি ইংরাজি স্কুল থেকেই ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে বৃত্তি লাভ করেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করার পরে পিতৃব্য উপেন্দ্রসুন্দর তাঁকে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ-এ ভর্তি করে দেন। এখান থেকেই ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে বি.এ. পরীক্ষায় বিজ্ঞানে অনার্স সহ প্রথম স্থান লাভ করেন।
- (৬) কলেজে বিজ্ঞান পড়াতেন পেডলার সাহেব। রামেন্দ্রসুন্দর এই শিক্ষকের খুবই প্রিয় ছাত্র ছিলেন। তাঁরই উৎসাহ ও প্রেরণাতে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি এম. এ. পরীক্ষায় বিজ্ঞানশাস্ত্রের স্বর্ণপদক ও পুরস্কার সহ প্রথমস্থান লাভ করেন।
- (৭) পরের বছর প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তিপরীক্ষায় বসেন এবং রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞানে বৃত্তি পান। পরবর্তী দুই বছর প্রেসিডেন্সি কলেজ লেবরেটরীতে বিনা বেতনে গবেষণা করেন।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর বিবাহ
কান্দি স্কুলের পড়া শেষ হবার আগেই সেই কালের সামাজিক রীতি অনুযায়ী মাত্র ১৪ বছর বয়সে রমেন্দ্রসুন্দরের বিবাহ হয়। তাঁর বালিকা পত্নীর নাম ছিল ইন্দ্রপ্রভা দেবী। একটি বিয়োগান্তক ঘটনাও ঘটে তাঁর জীবনে এই সময়ে। অকালে পিতা গোবিন্দসুন্দরের মৃত্যুতে দারুণ শোকে ভেঙ্গে পড়েছিলেন।
পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ সম্পর্কে রামেন্দ্রসুন্দরের নিজের লেখা
পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ কেমন ছিল, রামেন্দ্রসুন্দরের নিজের লেখা থেকেই জানা যায়। স্মৃতিচারণায় এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “আমার যখন আট বছর বয়স, আমি যখন গ্রাম্য পাঠশালায় তখন বঙ্কিমচন্দ্র-এর বঙ্গদর্শন প্রথম বাহিব হয়। আমাদের বাড়িতে বঙ্গদর্শন যাইত। লুকাইয়া বঙ্গদর্শন পড়িতাম। সব বুঝিতাম না…..অথচ পড়িতাম, লুকাইয়া পড়িতাম।”
কলকাতায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
এই সময়ে তিনি সাহিত্য ও বিভিন্ন দেশের ইতিহাস নিয়েও গভীর ভাবে পড়াশুনা শুরু করেন। পড়াশুনার সুবিধার জন্য ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে কলকাতাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
অধ্যাপক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে রিপন কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। উল্লেখযোগ্য যে সেই বছর থেকেই এই কলেজে বি. এ. ক্লাশে বিজ্ঞান পড়ানো আরম্ভ হয়। বিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও রামেন্দ্রসুন্দরের আগ্রহ বরাবরই ছিল সাহিত্যের প্রতি। ফলে তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষায় থাকত সাহিত্যের স্পর্শ। তাঁর এই নতুন রীতির পাঠদান ছাত্রদের কাছে খুবই উপভোগ্য হয়ে উঠত এবং পাঠ্যবিষয়ের প্রতি তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পেত। অল্পদিনের মধ্যেই অধ্যাপক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। শোনা যায়, তাঁর বিজ্ঞানের ক্লাশে আশপাশের কলেজের ছাত্ররাও ভিড় করত।
মাতৃভাষার প্রতি রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অনুরাগ
পড়াবার সময় সেই কালে অধ্যাপকরা ইংরাজি ভাষাই ব্যবহার করতেন। ইংরাজের রাজত্বে ইংরাজি ছিল রাজভাষা। কাজেই ইংরাজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানই ছিল রীতি। রামেন্দ্রসুন্দর কিন্তু ক্লাশে ইংরাজির সঙ্গে বাংলা ভাষারও সাহায্য নিতেন। এই প্রসঙ্গে তিনি একবার নিজেই বলেছিলেন, “অধ্যাপকের আসনে বসে বাঙলা ভাষায় অধ্যাপনা যদি আপনারা অপরাধ বলিয়া গণ্য করেন, তাহা হইলে আমার মত অপরাধী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঙ্ঘমধ্যে খুঁজিয়া মিলিবে না।” বস্তুতঃ মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগ এবং তীব্র স্বদেশ প্রীতির বশেই তিনি প্রচলিত রীতি ভঙ্গে উৎসাহী হয়েছিলেন। তাঁর এই স্বদেশপ্রেম পরবর্তী বহু ঘটনার মধ্যেই তাঁকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছিল।
বিজ্ঞানশাস্ত্রের অনুসন্ধানী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
রামেন্দ্রসুন্দর বিজ্ঞানী ছিলেন না। কিন্তু ছিলেন বিজ্ঞানশাস্ত্রের গভীরের অনুসন্ধানী। তাঁর বিজ্ঞান দর্শনই তিনি ছাত্রদের দেখাতেন বোঝাতেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গী ও প্রণালীতে। বলাবাহুল্য ছাত্রদের কাছে তিনি দুরূহ বিষয়গুলো অঙ্কের সাহায্য ছাড়াই এমন প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরতেন যে পড়ার কাজ ক্লাশেই সমাধা হয়ে যেত।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলি তিনি সরলভাষায় অতি সাধারণেরও বোধ্যগম্য করে তুলবার দুর্লভ ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। এ ছিল তাঁর ব্যাপক সাহিত্য পাঠ ও নীরব সাহিত্যচর্চার প্রত্যক্ষ ফল। তাঁর একটি লেখা থেকে এই বক্তব্যের সমর্থন তুলে ধরা যায়। নিয়মের রাজত্ব প্রবন্ধের এক জায়াগায় তিনি লিখেছেন, “প্রকৃতির রাজ্যে নিয়মভঙ্গ হয় না; কাজেই যদি কেহ আসিয়া বলে, দেখিয়া আসিলাম অমুকের গাছের নারিকেল বৃক্ষচ্যুত হইবা মাত্র ক্রমেই বেলুনের মত উপরে উঠিতে লাগিল, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ সেই হতভাগ্য ব্যক্তির উপর বিবিধ নিন্দাবাদ বর্ষিত হইতে থাকিবে। কেহ বলিবে লোকটা মিথ্যাবাদী। কেহ বলিবে পাগল। যিনি সম্প্রতি রসায়ন নামক শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া বিজ্ঞ হইয়াছেন; তিনি বলিবেন হইতেও পারে, তবে ঐ নারিকেলটার ভিতরে জলের পরিবর্তে হাইড্রোজেন গ্যাস ছিল। কেননা তাহার ধ্রুব বিশ্বাস যে নারিকেল খাঁটি নারিকেল, যাহার ভিতর জল আছে, হাইড্রোজেন নাই, এহেন নারিকেল কখনই প্রাকৃতিক নিয়মভঙ্গে অপরাধী হইতে পারে না।”
অধ্যক্ষ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে রামেন্দ্রসুন্দর রিপন কলেজের অস্থায়ী অধ্যক্ষ পদ লাভ করেন ছয় মাসের জন্য। পরে অধ্যক্ষপদেই স্থায়ী হন। ছাত্রদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তিনি যেমন ছিলেন আদর্শ শিক্ষক তেমনি কলেজ পরিচালনার দায়িত্ব পালনেও তিনি প্রশ্নাতীত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর অধ্যক্ষতার সময়ে রিপন কলেজের পড়াশুনা ও বিধিব্যবস্থার এমন সুখ্যাতি ছড়িয়ে ছিল যে ছাত্রসংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। ক্রমে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল দুই হাজারে।
ছাত্রদের প্রতি রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মনোভাব
সুবিধা অসুবিধা জানার জন্য তিনি ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে মিশতেন। অত্যন্ত তৎপরতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে ছাত্রদের অভাব অভিযোগ অপনোদনের চেষ্টা করতেন। দরিদ্র ছাত্রদের দিকে তাঁর বিশেষ দৃষ্টি থাকত। বহু দরিদ্র ছাত্রকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিয়মিত সাহায্য করতেন। ছাত্রদের জরিমানার টাকা তিনি কলেজফাণ্ডে জমা দিতেন না। সেই অর্থ জমা পড়ত দরিদ্র ছাত্রদের ফাণ্ডে। ছাত্রদের মধ্যে দেশাত্মবোধ ও আত্মমর্যাদা জাগরিত করার উদ্দেশ্যে তিনি উপদেশচ্ছলে বলতেন যে তারা ভারতীয় ছাত্র। তাদের ওপরেই আমাদের দেশ ভারতবর্ষ-এর খ্যাতি অখ্যাতি নির্ভর করছে।
পত্রিকায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর লেখালেখি
লেখক রামেন্দ্রসুন্দরের সাহিত্যচর্চার শুরু ছাত্র জীবনেই। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত নবজীবন পত্রিকায় তাঁর প্রথম প্রবন্ধ মহাশক্তি প্রকাশিত হয়। পরে এই পত্রিকায় বিজ্ঞান ও ইতিহাস বিষয়ে তাঁর আরও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে সাধনা, ভারতী প্রভৃতি পত্রিকায় বিজ্ঞান, স্বদেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে নিয়মিত লিখতেন।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর জ্ঞানগর্ভ রচনা
তাঁর সকল রচনাই ছিল জ্ঞানগর্ভ। কিন্তু ভাষার সাবলীলতায় ও সুচারু প্রকাশ ভঙ্গীমায় ছিল অনবদ্য। অতি দুরূহ বিষয়ও স্বকীয় প্রাঞ্জল ভাষার গুণে অতি সহজবোধ্য হয়ে উঠত। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে বিচরণ করার দুর্লভ দক্ষতা তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
বিচিত্র বিষয় নিয়ে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর আলোচনা
কলেজে সহকর্মী অধ্যাপকদের সঙ্গেও তিনি প্রায় সময়ই বহু বিচিত্র বিষয় নিয়ে মেতে উঠতেন। কখনো বৌদ্ধদর্শন, কখনো বৈদিক যজ্ঞ, কিংবা ইহুদি জাতির ইতিহাস, অথবা প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার বিষয় তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু হত!
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর রচনা সম্পর্কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মন্তব্য
তাঁর রচনা সম্পর্কে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, “দর্শনই হোক বা বিজ্ঞানই হোক, ইতিহাসই হউক বা প্রত্নতত্ত্বই হোক – রামেন্দ্রবাবু যাহাই লিখিতেন তাহাই যে শুধু প্রাঞ্জল হইত এমন হয়, সত্য সত্যই তাহার মধুরতায় প্রাণকে জল করিয়া দিত, পড়িতে কবিতার মত বোধ হইত। কল্পনায় মাখামাখি থাকত, রসে ও ভাবে ভোর করিয়া দিত।”
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উন্নতিকল্পে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অবদান
- (১) কলেজের অধ্যক্ষতার দায়িত্বপালনের পাশাপাশিই তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উন্নতিকল্পে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তাঁর কর্মপ্রচেষ্টা ও উদ্যোগে বাংলা সাহিত্য জগতে পরিষদ বহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়েছিল। একটা সময়ে পরিষদই হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র।
- (২) বিভিন্ন সময়ে পরিষদের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত থেকে পরিষদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিলেন। পরিষদের কাজের সঙ্গে তিনি দীর্ঘ পঁচিশ বছর যুক্ত ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে মাতৃভূমির অতীত গৌরব ও জাতির ধ্যানধারণাকে পরিষদের কাজের মাধ্যমে তুলে ধরবার লক্ষ্যে কঠোর পরিশ্রম স্বীকার করতে হয়েছিল তাঁকে।
বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জনের প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ও তুমুল আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। স্বদেশানুরাগী রামেন্দ্রসুন্দর বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রচনা করেন বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা। বাঙ্গালীজাতির মনের কথাই যেন অনবদ্য ভাষার তাঁর রচনায় ব্যক্ত হয়েছে, “মা লক্ষ্মী কৃপা কর। কাঞ্চন দিয়ে কাঁচ নেব না। শাঁখা থাকতে চুড়ি পরব না। ঘরে থাকতে পরের নেব না। পরের দুয়ারে ভিক্ষা করব না। ভিক্ষার ধন হাতে তুলে নেব না। মোটা অন্ন ভোজন করব। মোটা বসন অঙ্গে নেবো। মোটা ভূষণ আভরণ করব। পড়শীকে খাইয়ে নিজে খাব। ভাইকে খাইয়ে পরে খাব। মোটা অন্ন অক্ষয় হোক। ঘরের লক্ষ্মী ঘরে থাকুন। বাংলার লক্ষ্মী বাংলায় থাকুন।” তাঁর প্রস্তাবেই বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে সমগ্র বাংলাদেশ-এ অরন্ধন পালিত হয়।
বঙ্গীয় সম্মিলনে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ভাষণ
সমগ্র জাতিকে ঐক্যের বন্ধনে মিলিত করার উদ্দেশ্যে সেই সময়েই বঙ্গীয় সম্মিলনের আয়োজন করা হয়। কাশীমবাজারে উদ্বোধনী সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। সেই সভায় পরিষদের আদর্শ ব্যাখ্যা করে রমেন্দ্রসুন্দর যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে তাঁর গভীর স্বদেশানুরাগ ব্যক্ত হয়। তিনি বলেন, “যে মায়ের পূজা করিব বলিয়া বাঙ্গালী আজ ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছে, আমরা সাহিত্যসেবী, আমরাও আমাদের সামর্থ্য অনুসারে সেই মায়ের পূজা করিতে প্রবৃত্ত হইব।…… কিন্তু আমরা কিরূপে সেই মায়ের অর্চনা করিব? আমরা যে মায়ের কোলে অবস্থান করিয়া তাহার স্তন্যপানে বর্ধিত হইয়াছি, সেই মাকে আমরা ভাল করিয়া চিনিয়াছি কি? তাহা বলিতে পারি না-যেদিন আমরা মাকে চিনিতে পারিব, সেদিন আমাদের সাধনা পূর্ণ হইবে।”
বিজ্ঞান শাখার সভাপতি রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
কলকাতা টাউন হলে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সপ্তম অধিবেশনে বিজ্ঞান শাখার সভাপতি হয়েছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর স্বদেশপ্রীতি
তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল স্বাদেশিকতার বোধে জাগ্রত। তাই আমৃত্যু তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করে গেছেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা বিষয়ে তিনি এমনই সজাগ ছিলেন যে একবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপদেষ্টা রূপে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে তিনি বাংলায় প্রবন্ধ পাঠ করতে চান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় অনুমতি না দেওয়ায় তিনি প্রবন্ধ পাঠ প্রত্যাখ্যান করেন। পরে ভাইস চ্যান্সেলার স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী তাঁকে বাংলায় প্রবন্ধ পাঠের অনুমতি দেন। তাঁর স্বদেশপ্রীতি ছিল এমনই উগ্র। তাঁর সাহিত্য সাধনাও ছিল দেশ সেবারই ভিন্নরূপ। আর তাই বাঙ্গালীর সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অনুপম সাহিত্য কীর্তির জন্যই তাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
সাহিত্যিক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর রচনা
রামেন্দ্রসুন্দর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ, প্রকৃতি, কর্ম-কথা, জিজ্ঞাসা, বিচিত্র প্রসঙ্গ, নানাকথা ও জগৎ-কথা। এছাড়া রয়েছে শাস্ত্রীয় গ্রন্থ ঐতরেয় ব্রাহ্মণের অনুবাদ ও যজ্ঞ কথা। কয়েকটি পাঠ্যপুস্তকও তিনি রচনা করেন। তার মধ্যে Aids to Natural Philosophy বিখ্যাত। এছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিচিত্র বিষয়ের ওপর অসংখ্য রচনা বিক্ষিপ্ত ভাবে অগ্রন্থিত অবস্থায় রয়ে গেছে।
খাঁটি বাঙালী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
ব্যক্তিগত জীবনে রামেন্দ্রসুন্দর ছিলেন নিরহঙ্কারী ও সদালাপী। অনাড়ম্বর জীবনযাপনেই তিনি অভ্যস্থ ছিলেন। আচার আচরণে, পোষাকে পরিচ্ছদে তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালী।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছাড়াও কাশীর পন্ডিত সমাজের কাছ থেকে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধিও পেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো দিন তিনি নামের পাশে ডিগ্রি বা উপাধি ব্যবহার করেন নি। উপাধি প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য ছিল, এ দেশে ঈশ্বরচন্দ্রই একমাত্র বিদ্যাসাগর।
সাহিত্যিক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মৃত্যু
কর্মবহুল জীবনের শেষপ্রান্তে এসে শোকে রোগে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর। স্নেহময়ী জননী চন্দ্রকামিনী দেবীর ও কন্যা গিরিজার মৃত্যুশোক তাঁর কর্মোদ্যম হরণ করেছিল। তার ওপরে ছিল নানা রোগের আক্রমণ। অবশেষে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন মৃত্যুর অমৃতময় স্পর্শে তাঁর সব জ্বালাযন্ত্রণার অবসান ঘটে।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মৃত্যু সম্পর্কে হরপ্রসাদের মন্তব্য
রামেন্দ্রসুন্দরের শেষশয্যা পার্শ্বে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্যতাপস হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি মন্তব্য করেন, “আমাদের চোখের সামনে বিদ্যার একটা বড় জাহাজ ডুবিয়া গেল।”
উপসংহার :- রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ছিলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার অগ্রদূত এবং একজন সমাজ-সংস্কারক। তার লেখনী ও চিন্তাধারা বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানমনস্কতা এবং যৌক্তিকতার প্রবর্তন করে। তিনি বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলতে তার লেখাগুলোতে সহজ-সরল ভাষার ব্যবহার করেছিলেন। একইসঙ্গে, তিনি নারীশিক্ষা এবং সামাজিক প্রগতির পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেন। তার কর্ম ও অবদান শুধু তার সময়ের জন্য নয়, আজও সমান প্রাসঙ্গিক। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতিতে এক অনন্য অনুপ্রেরণা।
(FAQ) রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ছিলেন একজন বাঙালি দার্শনিক, বিজ্ঞানী, লেখক এবং শিক্ষাবিদ। তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত।
তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য করে তোলার জন্য কাজ করেছেন।
তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানরহস্য, প্রকৃতিবিদ্যা, এবং মানবপ্রকৃতি।
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী নারীশিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন এবং এই ক্ষেত্রের উন্নয়নে কাজ করেন।
তিনি ৬ জুন ১৯১৯ সালে মারা যান।