স্বাধীন ভারতের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক প্রসঙ্গে আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা বন্টন ও কেন্দ্রের প্রাধান্য, শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা বন্টন ও কেন্দ্রের প্রাধান্য, অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা বন্টন ও কেন্দ্রের প্রাধান্য সম্পর্কে জানবো।
ভারতের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক প্রসঙ্গে স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় তালিকা, স্বাধীন ভারতের রাজ্য তালিকা, স্বাধীন ভারতের যুগ্ম তালিকা, স্বাধীন ভারতের আইন-সংক্রান্ত ক্ষমতা বণ্টন, স্বাধীন ভারতের শাসন-সংক্রান্ত ক্ষমতা বণ্টন ও স্বাধীন ভারতের অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা বন্টন সম্পর্কে জানব।
স্বাধীন ভারতের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক
ঐতিহাসিক ঘটনা | স্বাধীন ভারতে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক |
রেল, ডাক, মুদ্রা | কেন্দ্রীয় তালিকা |
পুলিশ, জনস্বাস্থ্য | রাজ্য তালিকা |
বিবাহ, শিক্ষা | যুগ্ম তালিকা |
কেন্দ্রীয় তালিকা | আয়কর, উৎপাদন কর |
রাজ্য তালিকা | ভূমিরাজস্ব, মাদকদ্রব্যে কর |
ভূমিকা :- ব্রিটেনের ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ঔপনিবেশিক ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে ভারতীয়দের সুদীর্ঘ লড়াই এবং ব্রিটিশ শাসননীতি – উভয়েরই প্রভাব পড়েছিল।
আম্বেদকরের মন্তব্য
সংবিধান রচনা পরিষদের সভাপতি বি. আর. আম্বেদকর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ নভেম্বর বলেন “১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি আমরা একটি পরস্পর বিরোধী জীবনে প্রবেশ করতে চলেছি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা সাম্যের অধিকার পাব এবং অর্থনৈতিক জীবনে আমরা পাব অসাম্য।”
গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ভারত
৪৪৪টি ধারা, ১২টি তপশিল এবং ৯৭টি সংশোধন নিয়ে ভারতের সংবিধান বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংবিধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতবর্ষকে একটি ‘সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ বলে ঘোষণা করা হয়।
ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান তিনটি দিক
স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান তিনটি দিক আছে। যথা –
- (A) কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা,
- (B) অঙ্গরাজ্যের বা স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা,
- (C) কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক।
ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো
সংবিধান অনুসারে ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূল নীতি অনুসারে দিল্লিতে একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে একটি করে রাজ্য সরকারের অস্তিত্ব রয়েছে।
ভারতে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক
সংবিধানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে সম্পর্ক অর্থাৎ ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে মূলত তিন ধরনের ক্ষমতা বণ্টিত হয়েছে। যথা – আইন-সংক্রান্ত, শাসন-সংক্রান্ত এবং অর্থ-সংক্রান্ত।
আইন-সংক্রান্ত ক্ষমতা বণ্টন
সংবিধানে আইন প্রণয়ন-সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে তিনটি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যথা –
(১) কেন্দ্রীয় তালিকা
প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, রেল, ডাক, মুদ্রা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি কেন্দ্রীয় তালিকার অন্তর্ভুক্ত। এই তালিকাভুক্ত বিষয়ে একমাত্র কেন্দ্রীয় আইনসভা বা পার্লামেন্টই আইন প্রণয়নের অধিকারী।
(২) রাজ্য-তালিকা
পুলিশ, আইন শৃঙ্খলা, স্বায়ত্বশাসন, ভূমিরাজস্ব, জনস্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয়গুলি রাজ্য-তালিকার অন্তর্ভুক্ত। এই তালিকাভুক্ত বিষয়ে সাধারণ অবস্থায় রাজ্য-আইনসভা আইন প্রণয়নের অধিকারী।
(৩) যুগ্ম-তালিকা
বিবাহ, দেওয়ানি, ফৌজদারি আইন, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, সংবাদপত্র প্রভৃতি বিষয়গুলি যুগ্ম-তালিকার অন্তর্ভুক্ত। এই তালিকাভুক্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য উভয় আইনসভা আইন প্রণয়নের অধিকারী।
আইন-সংক্রান্ত ক্ষমতায় কেন্দ্রের প্রাধান্য
আইন প্রণয়নের বিষয়ে তিনটি তালিকার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য আইনসভার ক্ষমতা পৃথক থাকলেও বাস্তবে এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আইনসভা বেশি ক্ষমতা ভোগ করে। যেমন –
- (১) দেশে জরুরি অবস্থা থাকলে, রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি থাকলে, আন্তর্জাতিক সন্ধি বা চুক্তির শর্ত পালনের প্রয়োজন থাকলে, দুই বা ততোধিক রাজ্যের আইনসভার অনুরোধ করলে সংশ্লিষ্ট রাজ্য-তালিকাভুক্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় আইনসভা আইন পাস করতে পারে।
- (২) যুগ্ম-তালিকাভুক্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য-আইনসভার আইনের বিরোধ বাধলে কেন্দ্রীয় আইন কার্যকর হয়।
শাসন-সংক্রান্ত ক্ষমতা বণ্টন
ভারতীয় সংবিধানে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে শাসন-সংক্রান্ত সম্পর্ক বিশদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। –
(১) কেন্দ্রের প্রশাসনিক এক্তিয়ার
কেন্দ্রের প্রশাসনিক এক্তিয়ার হল সমগ্র ভারত এবং কখনো কখনো ভারতের বাইরেও। সংবিধান অনুসারে, কেন্দ্র যেসব বিষয়ে আইন প্রণয়নের অধিকারী সেসব বিষয়ে তার শাসন ক্ষমতা থাকবে।
(২) রাজ্যের প্রশাসনিক এক্তিয়ার
রাজ্যের প্রশাসনিক এক্তিয়ার রাজ্যের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। রাজ্য যেসব বিষয়ে আইন প্রণয়নের অধিকারী সেসব বিষয়ে তার শাসন ক্ষমতা থাকবে। সাধারণভাবে যুগ্ম- তালিকাভুক্ত বিষয়েও শাসন ক্ষমতা রাজ্যের হাতে থাকবে।
শাসন-সংক্রান্ত ক্ষমতায় কেন্দ্রের প্রাধান্য
শাসন-সংক্রান্ত বিষয়ে রাজ্যের হাতে বিভিন্ন ক্ষমতা থাকলেও বাস্তবে এবিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করে। যেমন –
- (১) সংবিধানে বলা হয়েছে যে, পার্লামেন্ট বা কেন্দ্রীয় আইনসভার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়, এমনভাবে রাজ্যকে শাসনক্ষমতা পরিচালিত করতে হবে।
- (২) কেন্দ্রীয় সরকার তার শাসনের সুবিধার্থে রাজ্যকে শাসননীতি সম্পর্কে নির্দেশ দিতে পারে।
- (৩) কেন্দ্রীয় আইনসভা কোনো আইন প্রণয়ন করে রাজ্যের যে-কোনো মন্ত্রী বা কর্মচারিকে তা কার্যকর করার নির্দেশ দিতে পারে।
- (৪) আন্তঃরাজ্য বিরোধের মীমাংসার জন্যও পার্লামেন্ট আইন পাস করতে পারে।
- (৫) দেশে বা কোনো রাজ্যে জরুরি অবস্থা বা কোনো রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘোষণা হলে রাজ্যের শাসন-বিষয়ক ক্ষমতা কেন্দ্র বা কেন্দ্রের প্রতিনিধি রাজ্যপাল-এর হাতে চলে যায়।
অর্থ-সংক্রান্ত ক্ষমতা বণ্টন
ভারতীয় সংবিধানে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে অর্থ-সংক্রান্ত ক্ষমতা বণ্টন করা হয়েছে। এর প্রধান চারটি দিক লক্ষ্য করা যায়। যথা –
(১) কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে রাজস্ব বণ্টন
দুটি পৃথক তালিকার মাধ্যমে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ভাগ করা হয়েছে। যেমন –
(i) কেন্দ্রীয় তালিকা
কোম্পানি কর, উৎপাদন কর, আয়কর (কৃষি ছাড়া), বাণিজ্য শুল্ক প্রভৃতি ১৩টি বিষয়ে কেন্দ্রের হাতে কর আদায়ের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
(ii) রাজ্য তালিকা
ভূমিরাজস্ব, কৃষি-আয় ও কৃষিজমির উত্তরাধিকারের ওপর কর, খনিজ অধিকারের ওপর কর, মাদক দ্রব্যের ওপর কর প্রভৃতি ১৯টি বিষয়ে রাজ্যের হাতে কর আদায়ের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
(২) কেন্দ্রীয় অনুদান
রাজ্যগুলির রাজস্বে ঘাটতি পুরণ ও উন্নয়ন কার্য রূপায়ণের উদ্দেশ্যে রাজ্যগুলিকে কেন্দ্র সাধারণ এবং বিশেষ – এই দুই ধরনের অনুদান দিতে পারে।
(৩) ঋণ সংগ্রহ
কেন্দ্রীয় সরকার স্বদেশ ও বিদেশ থেকে ঋণ সংগ্রহ করতে পারে। রাজ্য সরকার শুধু দেশের ভিতর থেকেই ঋণ নিতে পারে।
(৪) অর্থকমিশন
কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে আর্থিক সম্পর্ক নির্ধারণের উদ্দেশ্যে প্রতি পাঁচ বছর পরপর অর্থকমিশন গঠিত হয়।
অর্থ-সংক্রান্ত ক্ষমতায় কেন্দ্রের প্রাধান্য
অর্থ-সংক্রান্ত বিষয়ে রাজ্যের হাতে বিভিন্ন ক্ষমতা থাকলেও বাস্তবে এবিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করে। যেমন –
- (১) রাজ্য-তালিকাভুক্ত বিষয়ে কর আদায়ের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির ওপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে।
- (২) কোন রাজ্যকে কেন্দ্র কী পরিমাণ কেন্দ্রীয় অনুদান দেবে তা কেন্দ্রের ইচ্ছাধীন হওয়ায় কোনো কোনো রাজ্য বৈষম্যের শিকার হয়।
- (৩) ঋণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের তুলনায় রাজ্যের ক্ষমতা অনেক সীমাবদ্ধ।
- (৪) অর্থকমিশনের গঠন ও কার্য পরিচালনার কোনো ক্ষমতা রাজ্যগুলির হাতে দেওয়া হয় নি, যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে দেওয়া হয়েছে।
উপসংহার :- কেন্দ্র ও রাজ্যে একই রাজনৈতিক দল বা জোটের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষ সমস্যা হয় না। কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্যে পরস্পর-বিরোধী দল বা জোটের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে কেন্দ্রীয় সরকার আইন-সংক্রান্ত, শাসন-সংক্রান্ত এবং অর্থ-সংক্রান্ত প্রতিটি বিষয়েই রাজ্যের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে। তা ছাড়া রাজ্যপালের মাধ্যমে তাঁর ‘স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করেও রাজ্য সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্র বহুলাংশে কেড়ে নিতে পারে।
(FAQ) স্বাধীন ভারতের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
কেন্দ্রীয় তালিকা।
রাজ্য তালিকা।
যুগ্ম তালিকা।
কেন্দ্রীয় তালিকা।
রাজ্য তালিকা।