ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চা প্রসঙ্গে ভারতীয় ইতিহাস চর্চার সমস্যা, ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যার পার্থক্য, ভারতে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসনাধিকার, ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চার প্রয়োজনীয়তা, ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় স্বৈরতান্ত্রিক তত্ত্ব, ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় এশিয়াটিক সোসাইটি, ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগ, ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ কলেজ, ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় জেমস মিলের রচনা, ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় হিন্দু-মুসলমান বিভাজন, উনিশ শতকে ঔপনিবেশিক ইতিহাসচর্চা ও বিশ শতকে ঔপনিবেশিক ইতিহাসচর্চা সম্পর্কে জানবো।
ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চা
ঐতিহাসিক ঘটনা | ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চা |
হিস্ট্রি অব হিন্দুস্তান | জেমস মিল |
দ্য হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া | এলফিনস্টোন |
আর্লি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া | ভিনসেন্ট স্মিথ |
হোয়াট ইজ হিস্ট্রি | ই এইচ কার |
এশিয়াটিক সোসাইটি | ১৭৮৪ খ্রি |
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ | ১৮০০ খ্রি |
ভূমিকা :- ইতিহাস হল দেশ, কাল ও মানুষের কাহিনি। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও তাঁর মনোভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, ঐতিহাসিকরাই তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে তথ্য নির্বাচন করেন, ঘটনাবলি সাজান, বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করেন এবং ইতিহাস রচনা করেন।
ভারতীয় ইতিহাস চর্চার সমস্যা
- (১) ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত পার্থক্যের জন্য ভারত-এর ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সমস্যার সৃষ্টি হয়। ইংরেজ ঐতিহাসিকরাই সর্বপ্রথম ভারতের আধুনিক ইতিহাস চর্চা শুরু করেন।
- (২) যেহেতু ভারতে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার এবং অর্থনৈতিক শোষণ চালানোই সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, সেহেতু অতীত তাদের কাছে অবান্তর। বর্তমানই তাদের কাছে একমাত্র সত্য। তাই ইংরেজরা বিজেতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতের ইতিহাস রচনা করেন।
- (৩) অপরপক্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা ক্রমে ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ইংরেজদের দৃষ্টিভঙ্গির ত্রুটিগুলি উপলব্ধি করতে থাকে। ফলে ভারতীয় ঐতিহাসিকরা ইংরেজদের চেয়ে পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতের ইতিহাসচর্চা শুরু করে।
ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যার পার্থক্য
- (১) বিভিন্ন ঐতিহাসিকের পৃথক পৃথক মনোভাবের জন্য একই বিষয় নিয়ে লেখা দুজন ঐতিহাসিকের ইতিহাস গ্রন্থ পৃথক হতে পারে। তা ছাড়া ঐতিহাসিকের হাতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য আসে বলে ইতিহাস সর্বদা পরিবর্তনশীল।
- (২) এজন্য পলাশীর যুদ্ধ সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে ইংরেজ ঐতিহাসিক এস. সি. হিল সিরাজদ্দৌলাকে এবং ভারতীয় ঐতিহাসিক ব্রিজেন গুপ্ত ইংরেজদের দায়ী করেছেন।
- (৩) ইতিহাসের এরূপ পৃথক পৃথক ব্যাখ্যার জন্যই হয়তো আগাথা ক্রিস্টির উপন্যাসে একটি ছোট্ট মেয়ে তার স্কুলের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ইতিহাস সম্পর্কে বলে, “এত রকমের বাজে জিনিসও পড়ানো হয়, যেমন – ইতিহাস। প্রত্যেক বইতে পৃথক বর্ণনা।”
ই. এইচ. কার -এর মন্তব্য
এজন্য ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার বলেছেন, “ইতিহাসের পাঠ শুরু করার আগে ঐতিহাসিককে জানো।”
ভারতে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসনাধিকার
ইংরেজরা ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। এরপর শীঘ্রই ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চার প্রয়োজনীয়তা
ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও শাসনাধিকার লাভ করার পর স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজদের কাছে ভারতের মানুষ, সমাজ, ইতিহাস, অর্থনীতি প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের খুবই প্রয়োজন ছিল। এই প্রয়োজনের তাগিদেই হেস্টিংসের আমল থেকে ব্রিটিশরা এদেশের ইতিহাসচর্চা শুরু করে। তাদের ইতিহাসচর্চায় তুলে ধরা হয় যে, ভারতের অতীত সমাজ ও সভ্যতা ইউরোপ-এর বিপরীত।
ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় স্বৈরতান্ত্রিক তত্ত্ব
- (১) প্রথম থেকেই শ্বেতাঙ্গ জাতির শ্রেষ্ঠত্বের মানসিকতা নিয়ে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা ভারতের ইতিহাসচর্চা শুরু করেন। প্রথম দিকের রচনাগুলিতে প্রাচ্যদেশীয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিফলিত হয়। তাতে তুলে ধরা হয় যে, ভারতে আইনের শাসনের অস্তিত্ব বা প্রজার কোনো অধিকার নেই।
- (২) এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলেকজান্ডার ডাও ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন, ‘হিস্ট্রি অব হিন্দুস্তান’। এই গ্রন্থে তিনি বলেন যে, ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্বৈরতন্ত্র। এই সময় রবার্ট ওর্ম ভারতের ইতিহাস বিষয়ে দুই খণ্ডে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় এশিয়াটিক সোসাইটি
প্রাচ্যবিদ্যা চর্চা এবং ভারতের অতীত ইতিহাসচর্চার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম ভারতের ইংরেজ শাসক লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস উদ্যোগ নেন। প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার উদ্দেশ্যে হেস্টিংসের উদ্যোগে উইলিয়াম জোন্স ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণা শুরু হয় এবং গবেষণামূলক পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগ
ইউরোপ থেকে ভারতে আগত খ্রিস্টান মিশনারিরা ভারতীয় ভাষা ও ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেয়। ভারতের ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্যে জেসুইট পাদ্রীরা অষ্টাদশ শতকে সংস্কৃত ভাষা চর্চা শুরু করেন। উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড-এর প্রচেষ্টায় ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। উইলিয়াম কেরি ‘ইতিহাসমালা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ কলেজ
ভারতে ব্রিটিশ কর্মচারীদের ভারতীয় ভাষা ও ইতিহাস শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতের ইংরেজ শাসক লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই কলেজের অধ্যাপক রামরাম বসু ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার ‘রাজাবলী’ (১৮০৮ খ্রি.) রচনা করেন। পরবর্তীকালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ তুলে দিয়ে ভারতের ব্রিটিশ কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড-এ হেইলেবেরি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় জেমস মিলের রচনা
ভারতের ইতিহাস রচনায় ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জেমস মিল। তিনি ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ নামে তিন খণ্ডে ভারতের ইতিহাস রচনা করেন। ভারত-বিদ্বেষী মিল তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে ভারতীয়দের রাজনৈতিক মূল্যবোধহীন একটি বর্বর জাতি হিসেবে তুলে ধরেন। মিলের লেখা ইতিহাস গ্রন্থ অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। হেইলেবেরি কলেজে তাঁর বই পাঠের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়।
ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় হিন্দু-মুসলমান বিভাজন
- (১) জেমস মিলের অনুকরণে অন্যান্য ব্রিটিশ লেখকরাও ভারতে হিন্দু ও মুসলিম সভ্যতাকে পৃথক হিসেবে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালান।
- (২) তাঁদের মতে, বেশিরভাগ মুসলমানই মনে করত যে, প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম শাসকরা যে ভারতের প্রভু ছিলেন এবং এদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে মুসলিমরা আবার তাদের পুরোনো অধিকার ফিরে পাবে।
- (৩) ইংরেজ লেখকদের মতে, ইসলাম ছিল বর্বর, লুঠেরা ও দখলদারদের ধর্ম। ভারতে একের পর এক নিষ্ঠুর আক্রমণ ও ধ্বংসকাণ্ড চালিয়ে এই ধর্ম ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে।
- (৪) আলেকজান্ডার ডাও বলেছেন যে, মুসলিম শাসকরা তরবারির জোরে এদেশের মানুষের দেহ ও মনকে বন্দি করে নিজেদের অবস্থান সুরক্ষিত করেছে।
- (৫) বিশপ হেবার ভারতীয়দের বারংবার মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, “ব্রিটিশরা তাদের দখল করে নি, বরং তারা অধিকৃত অবস্থাতেই ছিল। … পূর্বতন শাসকরা ছিল ব্রিটিশ শাসকদের মতোই রক্তের সম্পর্কে বা ধর্মের দিক থেকে ভারতে আগন্তুক এবং তারা ছিল ব্রিটিশদের চেয়েও অত্যাচারী প্রভু।”
উনিশ শতকে ঔপনিবেশিক ইতিহাসচর্চা
ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকদের লেখা ভারতের বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এসব ঐতিহাসিকদের বেশিরভাগই ছিলেন ব্রিটিশ কর্মচারী। তাঁদের লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল –
- (১) মার্ক উইলক্স রচিত ‘হিস্টোরিকাল স্কেচেস অব দ্য সাউথ অব ইন্ডিয়া’ (১৮১০-১৪),
- (২) জেমস গ্রান্ট ডাফ রচিত ‘হিস্ট্রি অব দ্যা মারাঠাস’ (১৮২৬),
- (৩) জেমস টড রচিত ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিস অব রাজস্থান’ (১৮২৯- (৩২),
- (৪) এলফিনস্টোন রচিত ‘দ্য হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ (১৮৪১),
- (৫) এডওয়ার্ড থনটন রচিত ‘দ্য হিস্ট্রি অব দ্য ব্রিটিশ পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া’ (১৮৪১-৪৫),
- (৬) উইলিয়াম হান্টার রচিত ‘অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল’ (১৮৬৮),
- (৭) হেনরি ইলিয়ট ও ডাউসন রচিত ‘দ্য হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া অ্যাজ টোল্ড বাই ইটস ওন হিস্টোরিয়ানস’ (১৮৬৭-৭৭) প্রভৃতি।
- (৮) এ ছাড়া বেভারিজ, স্টিওয়ার্ট ও অন্যান্য ব্রিটিশ ঐতিহাসিকগণ ভারতের ইতিহাস-বিষয়ক বহু গ্রন্থ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
বিশ শতকে ঔপনিবেশিক ইতিহাসচর্চা
বিংশ শতকে ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের চর্চা অব্যাহত থাকে। এই সময়ে তাদের লেখা উল্লেখযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থগুলি হল –
- (১) ভিনসেন্ট স্মিথ রচিত ‘আর্লি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ (১৯০৮) এবং ‘অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ (১৯১৯),
- (২) পি.ই. রবার্টস রচিত ‘হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া টু দ্য এন্ড অব দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি‘(১৯২১),
- (৩) ডডওয়েল রচিত ‘কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ (১৯২৯),
- (৪) কীথ রচিত ‘কনস্টিটিউশনাল হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ (১৯৩৬) প্রভৃতি।
উপসংহার :- সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের অধিকাংশই ছিলেন ভারত-বিদ্বেষী। তাঁরা ভারতবাসীকে স্বশাসনের অনুপযুক্ত বলে মনে করতেন। তাঁরা মূলত ভারতীয়দের অনগ্রসরতা এবং ইংরেজদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।
(FAQ) ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
হোয়াট ইজ হিস্ট্রি।
জেমস মিল।
ভিনসেন্ট স্মিথ।
জেমস গ্ৰান্ট ডাফ।
উইলিয়াম হান্টার।