মহম্মদ আদিল শাহ সুরি প্রসঙ্গে আদিল শাহের বিরুদ্ধে অসন্তোষ, উজির হিমু, সাম্রাজ্যের চারটি খণ্ড, সিকান্দার শাহের দিল্লি অধিকার, হিমুর যুদ্ধ, হিমুর আগ্ৰা দখল, মুঘল জাতির সাথে যুদ্ধ ও আফগান জাতির সংঘর্ষের অবসান সম্পর্কে জানবো।
মহম্মদ আদিল শাহ সুরি
সুলতান | মহম্মদ আদিল শাহ |
রাজত্বকাল | ১৫৫৩-১৫৫৭ খ্রি: |
বংশ | শূর বংশ |
পূর্বসূরি | ফিরোজ শাহ |
প্রতিষ্ঠাতা | শেরশাহ |
ভূমিকা :- সুলতান আদিল শাহ বৈধ উত্তরাধিকারীকে হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং অভিজাতদের সমর্থন আদায়ের জন্য প্রচুর সম্পদ ও পদ বিতরণ করে তাঁদের শান্ত করার চেষ্টা করেন।
আদিল শাহের বিরুদ্ধে অসন্তোষ
বংশানুক্রমিক অধিকার অগ্রাহ্য করে গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করায় চারদিকে আদিল শাহের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং এই অসন্তুষ্টিই শেষপর্যন্ত শের শাহের প্রতিষ্ঠিত শূরবংশের ‘কাফিনে’ পরিণত হয়।
আদিল শাহর উজির হিমু
- (১) আদিল শাহ দুর্বল ও অপদার্থ ছিলেন। কিন্তু হিমু নামে একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিকে তিনি ‘উজির’ পদে নিয়োগ করেন। হিমু ছিলেন জাতিতে হিন্দু। হীনাবস্থা থেকে তিনি জীবন আরম্ভ করেছিলেন। ইসলাম শাহ-এর রাজত্বকালে তিনি ‘সাহানা’ পদে অভিষিক্ত ছিলেন।
- (২) তারপর তিনি সামরিক বিভাগের অতি উচ্চপদে আসীন হন। তিনি সুলতান মহম্মদ আদিল শাহের বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। পরবর্তীকালে হিমু যে সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তার জন্য ভারত-ইতিহাসে তিনি অক্ষয় হয়ে আছেন।
- (৩) প্রকৃতপক্ষে সুলতান আদিল শাহের চেয়েও হিমু ছিলেন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সুলতানের অযোগ্যতা ও উদাসীনতা সাম্রাজ্য-এর চারদিকে বিদ্রোহীদের উৎসাহিত করে এবং এই বিদ্রোহগুলি সাম্রাজ্যের ভিতে ফাটল ধরিয়ে দেয়। সাম্রাজ্যের চারদিকের বিশৃঙ্খলা থেকে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার মতো শক্তি এরকম দুশ্চরিত্র ও অপদার্থ সুলতানের ছিল না।
মহম্মদ আদিল শাহর সময় স্বাধীনতা ঘোষণা
আদিল শাহের সিংহাসনে আরোহণের পর আগ্রার শাসক ইব্রাহিম খান শূর, লাহোরের শাসক সিকন্দার শূর ও বঙ্গদেশের শাসক মহম্মদ খান শূর বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এঁরা শুধু আদিল শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন তা নয়, নিজেদের মধ্যেও পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হন। প্রত্যেকেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
আদিল শাহর আমলে সাম্রাজ্যের চারটি খণ্ড
স্বভাবতই শের শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য আদিল শাহের সময় প্রধান চারটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায় – দিল্লি ও আগ্রা ইব্রাহিম শাহ অধিকার করেন, পাঞ্জাব সিকন্দার শাহ, সামসউদ্দিন মহম্মদ শাহ বঙ্গদেশ এবং আগ্রার কিয়দংশ থেকে বিহারের সব অঞ্চল মহম্মদ আদিল শাহের অধীনস্থ হয়।
আদিল শাহর সময় সিকান্দার শাহের দিল্লি অধিকার
সিকন্দার শাহ পাঞ্জাব অধিকার করেও সন্তুষ্ট না হয়ে ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে দিল্লি ও আগ্রা দখলের জন্য যুদ্ধযাত্রা করেন এবং ফারহতে ইব্রাহিমকে পরাজিত করে ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করেন।
আদিল শাহর আমলে হুমায়ুনের সুযোগ
- (১) স্বভাবতই আফগান জাতির অভিজাতদের অন্তর্দ্বন্দ্ব শুধুমাত্র উত্তর-ভারতের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট করেছে তা নয়, এই অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে হুমায়ুন তাঁর হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন।
- (২) ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন আফগান জাতির এই অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে কাবুল থেকে ভারত অভিযানে অগ্রসর হন। হুমায়ুনের এই অগ্রগতির খবর শুনে তাতার খান কাশীতে রোটাস দুর্গ রক্ষায় কোনো বাধা না দিয়ে হুমায়ুনের জন্য দুর্গের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন।
- (৩) ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে হুমায়ুন বিনা বাধায় লাহোর দখল করেন এবং এই সময় হুমায়ুনের অপর এক বাহিনী আফগান বাহিনীকে পরাজিত করে দীপালপুর দখল করে নেয়। অতঃপর মুঘল সেনাবাহিনী জলন্ধর অধিকার করে সিরহিন্দ এর দিকে অগ্রসর হয়।
- (৪) এই অল্প সময়ে মুঘল সেনাবাহিনীর আধিপত্য বিস্তারের মূলে ছিল ইব্রাহিম শূর ও সিকন্দার শূরের সংঘাত। এই সংঘাতের সুযোগে হুমায়ুন পাঞ্জাব অঞ্চলে কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে, আফগান সেনাবাহিনীর সঙ্গে লুধিয়ানা জেলার মাছিয়ারা নামক স্থানে এক সম্মুখ-যুদ্ধে লিপ্ত হন। এই যুদ্ধে হুমায়ুন আফগানদের পরাজিত করে সিরহিন্দ দখল করেন।
- (৫) মাছিয়ারার যুদ্ধে জয়লাভ হুমায়ুনের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই যুদ্ধকে হুমায়ুনের সৌভাগ্যের সূচক বলে অভিহিত করা যায়। এই যুদ্ধের পরই হুমায়ুন দিল্লির দিকে অগ্রসর হন এবং দিল্লি দখল করেন। এইভাবে দ্বিতীয় আফগান সাম্রাজ্যের পতন হয়।
মানখেট দুর্গে আদিল শাহর আশ্রয় গ্রহণ
পাঞ্জাবের মুঘল শাসনকর্তার শাসনতান্ত্রিক অব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে সিকন্দার শূর পুনরায় তাঁর হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করতে আসেন, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে তিনি মানখেট দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
আদিল শাহর মন্ত্রী হিমুর যুদ্ধ
- (১) আফগানদের পারস্পরিক সংঘাত ও বিদ্রোহের যুগে আদিলের সেনাপতি হিমু বহু যুদ্ধ করেছিলেন এবং সব যুদ্ধেই সফল হয়েছিলেন। আগ্রার শাসক ইব্রাহিমকে হিমু কাল্পী ও খানুয়ার যুদ্ধে দু’বার পরাজিত করেছিলেন। ইব্রাহিম তখন বেয়ানা দুর্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
- (২) এদিকে বঙ্গদেশের শাসক মহম্মদ শাহ কাল্পী আক্রমণ করলে, এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আদিল শাহ তখন বাধ্য হয়ে তাঁর প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপতি হিমুকে ডেকে পাঠান এবং হিমু কাল্পীতে তাঁর প্রভু আদিলের সঙ্গে মিলিত হন।
- (৩) অতঃপর কাল্পী থেকে কুড়ি মাইল দূরে ছপ্পরঘট্টার যুদ্ধে হিমু মহম্মদ শাহকে পরাজিত করেন। আদিল তখন বঙ্গদেশ অধিকার করেন এবং শাহবাজ খানকে বঙ্গদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে তিনি চুনারে ফিরে আসেন। অতঃপর তিনি চুনারকে বাসস্থান ও রাজধানী হিসাবে গড়ে তোলেন।
আদিল শাহর মন্ত্রী হিমুর আগ্ৰা দখল
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুনের মৃত্যুর পর হিমু গোয়ালিয়র থেকে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করেন এবং সহজেই আগ্রা দখল করেন। আগ্রার শাসনকর্তা ইসকান্দার খান উজবেক কোনো বাধা না দিয়ে ভয়ে দিল্লি পালিয়ে যান।
আদিল শাহর মন্ত্রী রাজা বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্ৰহণ
এরপর হিমু দিল্লির শাসক তার্দি বেগকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করেন। হিমু অতঃপর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ‘রাজা বিক্রমাদিত্য’ উপাধি গ্রহণ করেন।
আদিল শাহর মন্ত্রী হিমুর ধনসম্পদ বিতরণ
আফগান অভিজাতদের ও সৈন্যদের সাহায্যপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি তাদের প্রচুর ধনসম্পদ বিতরণ করেন। আফগান প্রধানরা হিমুর পক্ষ অবলম্বন করেন।
মুঘল বাহিনীর সাথে আদিল শাহর যুদ্ধ যুদ্ধ
- (১) এই পরিস্থিতিতে অগ্রসরমান মুঘল বাহিনীর সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে। বৈরাম খান-এর অভিভাবকত্বে আকবর তখন দিল্লি ও আগ্রা পুনরাধিকারের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। হিমুও বিনা-যুদ্ধে এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না।
- (২) ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর ইতিহাস বিখ্যাত পানিপথের রণক্ষেত্রে মুঘল ও আফগান বাহিনীর যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে হিমু বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও, আকস্মিকভাবে একটি তীরের আঘাতে আহত অবস্থায় ধৃত হন।
আদিল শাহ সম্পর্কে ফিরিস্তার অভিমত
ফিরিস্তার মতে, বৈরাম খান হিমুকে প্রথম অস্ত্রাঘাত করেন এবং বৈরামের নির্দেশে আকবর তাঁকে হত্যা করেন।
আদিল শাহর পতনে মুঘলদের স্বর্ণযুগের সূচনা
- (১) পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধই মুঘলদের ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্বর্ণযুগের সূচনা করে। এই যুদ্ধই মুঘলদের ভাগ্য-বিপর্যয়ের দিনগুলির অবসান ঘটায়। মুঘলদের বিজয় এইভাবে সমাপ্ত হয়।
- (২) এই যুদ্ধ শুধুমাত্র হিমুর ভাগ্য নির্ধারিত করে নি, আফগানদেরও ভাগ্য নির্ধারিত করেছিল এবং মুঘলদের ভাগ্যকেও করেছিল সুনিশ্চিত। এরপর আকবর দিল্লি ও আগ্রা দখল করেন। আকবর ও বৈরাম খান পাঞ্জাব থেকে সিকান্দারকে উচ্ছেদ করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমে আফগান প্রাধান্যের অবসান ঘটে।
- (৩) এদিকে ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশের শাসনকর্তা ইব্রাহিম শূর উড়িষ্যায় আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে ১৫৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটে।
আদিল শাহর পতনে আফগান জাতির সংঘর্ষের অবসান
এইভাবে উত্তর-ভারতের রাজনীতিতে আফগান জাতির যে পারস্পরিক অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের সূচনা হয়েছিল, তার অবসান ঘটে। আফগানদের স্বার্থপর এই সংঘাতের ফলে উত্তর-ভারতের রাজনীতিতে যে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, তারই ফলে মুঘলদের ক্ষমতা দখল অত্যন্ত সহজ হয়।
উপসংহার :- ভারতের ইতিহাসে আফগানদের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘাত মহান আকবরের উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছিল। আকবরের মতো শাসকের আবির্ভাবের ফলে ভারতবর্ষে এক নতুন যুগের সূচনা হয়।
(FAQ) মহম্মদ আদিল শাহ সুরি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
হিমু।
রাজা বিক্রমাদিত্য।
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে।
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে।