রাইট ভ্রাতৃদ্বয়

রাইট ভ্রাতৃদ্বয় প্রসঙ্গে উইলবার রাইট ও অলিভার রাইটের জন্য, ছেলেবেলা, কারখানা তৈরি, উড়োজাহাজ আবিষ্কার, উড়োজাহাজের প্রথম উড়ান, শক্তিশালী বিমান নির্মাণ, সফলভাবে বিমান উড়ান ও মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাদের কাজ সম্পর্কে জানবো।

রাইট ভ্রাতৃদ্বয়

ঐতিহাসিক চরিত্ররাইট ভ্রাতৃদ্বয়
অরভিল রাইট১৮৭১–১৯৪৮
উইলবার রাইট১৮৬৭-১৯১২
দেশআমেরিকা
বিখ্যাত আবিষ্কারউড়োজাহাজ
রাইট ভ্রাতৃদ্বয়

ভূমিকা :- অরভিল রাইট ও উইলবার রাইট নামে রাইট ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন দু’জন মার্কিন প্রকৌশলী, যাদের উড়োজাহাজ আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তারা ১৯০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রথম নিয়ন্ত্রিত, শক্তিসম্পন্ন এবং বাতাসের চাইতে ভারী সুস্থিত মানুষ-বহনযোগ্য উড়োজাহাজ তৈরি করেন।

রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের জন্ম

উইলবারের জন্ম ১৮৬৭ সালে আমেরিকার ইওয়ানা প্রদেশে। অরভিলের জন্ম ১৮৭১ সালে।

আমেরিকান প্রকৌশলী রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের ছেলেবেলা

ছেলেবেলা থেকেই দুই ভাই-এর মধ্যে ছিল যেমন কল্পনাশক্তি তেমনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি।

রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের কারখানা তৈরি

  • (১) পড়াশুনা শেষ করে দুই ভাই হাতে কলমে কাজ করবার জন্য ছোট কারখানা তৈরি করলেন, প্রথমে তাঁরা কিছুদিন বাজারে প্রচলিত ছাপার যন্ত্র নিয়ে কাজ শুরু করলেন যাতে তার ব্যবহার আরো সহজ সরল ও উন্নত হয়।
  • (২) এর পর বাইসাইকেলের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হলেন। দুটি ক্ষেত্রেই তাঁরা অনেকাংশে সফল হয়েছিলেন। এবং তাঁদের প্রবর্তিত আধুনিক যন্ত্র ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল।

রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের উড়োজাহাজ আবিষ্কার

  • (১) যে উড়োজাহাজ আবিষ্কারের জন্য দুই ভাই-এর খ্যাতি, তার চিন্তাভাবনা শুরু হয় ১৮৯৬ সাল থেকে একজন জার্মান ইঞ্জিনিয়ার অটো লিলিয়েনথাল কয়েক বছর যাবৎ উড়ন্ত যান নিয়ে গবেষণা করছিলেন। লিলিয়েনথালের তৈরি যান আকাশে উড়লেও তাতে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হত।
  • (২) ১৮৯৬ সালে লিলিয়েনথালের আকস্মিক মৃত্যুতে গবেষণার কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। লিলিয়েনথালের তৈরি উড়ন্ত যানের (Gliding Machine) নক্সা ভালভাবে পরীক্ষা করে রাইট ভ্রাতৃদ্বয় দেখলেন যেমন তা অসম্পূর্ণ অন্যদিকে তেমনি নানা ভুলত্রুটিতে ভরা।
  • (৩) অল্প কিছুদিন পর তাঁরা বুঝতে পারলেন এই ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রকৃত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন আরো জ্ঞানের। পরিপূর্ণ জ্ঞান না হলে সাফল্য অনিশ্চিত। ইতিমধ্যে এই বিষয়ে যা কিছু লেখা হয়েছে সমস্তই তাঁরা সংগ্রহ করলেন। নিরলস অধ্যাবসায় নিয়ে শুরু হল তাঁদের অধ্যায়ন।
  • (৪) শুধু যে পূর্বসূরীদের প্রচেষ্টা, তাদের সাফল্য ব্যর্থতার ইতিবৃত্ত অধ্যায়ন করলেন তাই নয়, তাঁরা বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন রচনা থেকে জানলেন বাতাসের গতিবেগ, নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের মধ্যে তার চাপ, ভারসাম্য নির্ণয়ের পদ্ধতি। তাছাড়া কিভাবে এতদিন বিভিন্ন উড়ন্ত যান নির্মাণ করা হত তার নির্মাণ কৌশল, আরো অসংখ্য বিষয়।
  • (৫) এল গ্লাইডার বা ছোট ছোট খেলনার আকৃতির যন্ত্র। যা নানান প্রক্রিয়ায় বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু তাতে তো মানুষের উড়া সম্ভব হত না। দুই ভাই ছোট একটা কারখানা তৈরি করলেন। দীর্ঘ এক বছরের প্রচেষ্টায় সেই কারখানায় তৈরি হল এক বিশাল গ্লাইডার বা উড়ন্ত যান।
  • (৬) এতদিন যে ধরনের গ্লাইডার তৈরি হত এই গ্লাইডার তার চেয়ে একেবারে স্বতন্ত্র। এই গ্লাইডার বাতাসে ভারসাম্য রেখে সহজেই উড়ে যেতে পারে। গ্লাইডার-এর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে রাইট ভাইয়েরা তৈরি করলেন দুই পাখাবিশিষ্ট ছোট বিমান।
  • (৭) এই বিমানের সামনে ও পেছনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটা ছোট যন্ত্র জুড়ে দেওয়া হল। এর নাম এলিভেটর। এই এলিভেটরের সাহায্যেই পাইলট কোনো বিমানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সমস্ত নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর শহরে থেকে দূরে এক নির্জনে এই দুই পাখাওলা বিমানকে শূন্যে ভাসিয়ে দেওয়া হল।
  • (৮) বেশ কয়েকবার বিমানকে আকাশে ওড়বার পর দুই ভাই বুঝতে পারলেন এখনো তাঁদের উদ্ভাবিত বিমানের কলাকৌশলের কিছু পরিবর্তন করার প্রয়োজন হলেও তাঁরা সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন।
  • (৯) আবার শুরু হল তাঁদের কর্মযজ্ঞ। এবার লক্ষ্য কিভাবে গ্লাইডারকে শক্তিচালিত করা যায়। বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিন নিয়ে পরীক্ষা করবার পর দেখা গেল একমাত্র পেট্রল চালিত ছোট ইঞ্জিনই বিমান চালনার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
  • (১০) প্রতি তিন পাউন্ড ওজনের জন্য এক অশ্বশক্তি সম্পন্ন ইঞ্জিনের আবশ্যক। বাজারে যে সমস্ত ইঞ্জিন পাওয়া যায় তার প্রতিটিই গাড়ির ব্যবহারের জন্য, বিমানে ব্যবহারের অনুপযুক্ত দুই ভাই ইঞ্জিন তৈরির কাজে হাত দিলেন। কয়েক মাসের চেষ্টায় তৈরি হল বিমানে ব্যবহারের উপযুক্ত ইঞ্জিন।

প্রকৌশলী রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের এরোপ্লেনের প্রথম উড়ান

  • (১) অবশেষে এল সেই দিন, ১৭ই ডিসেম্বর ১৯০৩। উইলবার ও অরভিল তাঁদের তৈরি বিমান নিয়ে এলেন Kitty Hawk শহরের প্রান্তে। মানুষ বিমানে চেপে মহাশূন্যে ভেসে বেড়াবে। এই সংবাদ আগেই শহরময় প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু কেউই একথা বিশ্বাস করল না। উপরন্তু দিনটা ছিল কনকনে ঠাণ্ডার দিন।
  • (২) প্রথমে দুই ভাই তাঁদের বিমানের সাথে ইঞ্জিন যুক্ত করলেন। সমস্ত যন্ত্রপাতি শেষবারের মত পরীক্ষা করলেন। শেষ পর্যন্ত দুই ভাইই নিশ্চিত হলেন তাঁদের তৈরি প্রথম এলোপ্লেন ওড়বার জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হয়েছে। যদিও সেই সময় এরোপ্লেন (Aeroplane) নাম দেওয়া হয়নি। নাম দেওয়া হয়েছে রাইট ফ্লাইয়ার (Wright Flyer)
  • (৩) ঘড়িতে দেখা গেল বারো সেকেণ্ড বাতাসে ভেসেছিল রাইট ভাইদের প্রথম এরোপ্লেন। মাত্র বারো সেকেণ্ড। কিন্তু উপস্থিত পাঁচজন এমনকি রাইট ভাইরাও সেদিন কল্পনা করতে পারেননি, ঐ স্বল্পক্ষণের বিমানযাত্রাই নতুন যুগের সূচনা করল, যে যুগ গতির যুগ, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছোটার যুগ।
  • (৪) নিরাপদে অবতরণ করে অরভিল বিমান থেকে বেরিয়ে এলেন। এইবার উইলবারের পালা। ভাই-এর সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে উইলবার আকাশে ভেসে রইলেন ঊনষাট সেকেণ্ড এবং প্রায় ৮২০ ফিট দূরত্ব অতিক্রম করলেন। তারপর ধীরে ধীরে অবতরণ করলেন। সেই দিন আর আকাশে ওড়া সম্ভব হয়নি। ঝড়ো বাতাসের বেগ বাড়ছিল। সাফল্যের আনন্দে দুজনেই আত্মহারা।

রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের বৃহৎ শক্তিশালী বিমান তৈরি

কয়েকদিন কেটে গেল। প্রাথমিক উত্তেজনার রেশটুকু স্তিমিত হয়ে আসতেই নতুন উদ্যমে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন দুই ভাই। এইবার তৈরি হল আগের চেয়ে বড় আর শক্তিশালী বিমান।

প্রতিটি সংবাদপত্রকে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের আমন্ত্রণ

দুই ভাই ঠিক করলেন তাঁদের এই সাফল্যের কথা সমস্ত মানুষকে জানাতে হবে। এতদিন যা ছিল শুধুমাত্র তাদের, আজ থেকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে। আমেরিকার প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রকে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁদের আকাশে ওড়ার দৃশ্যকে প্রত্যক্ষ করতে।

রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের ওড়ার পরিকল্পনা বাতিল

সেদিন সকাল থেকে ঝোড়ো বাতাস বইছিল। নতুন ইঞ্জিনটাও ঠিকমত কাজ করছিল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আকাশে ওড়ার পরিকল্পনা বাতিল করতে হল।

আমেরিকান প্রকৌশলী রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের সফলভাবে বিমান উড়ান

  • (১) রাইট ভাইরা শুধু সাংবাদিক নয়, বিশিষ্ট কিছু মানুষকেও নিমন্ত্রণ জানালেন তাঁদের আকাশে ওড়বার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করবার জন্য। এই বার আর বিফলতা নয়। সকলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে রাইট ভাইরা কেমন করে একে একে পাখির মত স্বচ্ছন্দে আকাশপথে বিমানে চড়ে উড়ে চলেছে।
  • (২) বাতাসের মত এই সংবাদ শুধু আমেরিকা নয়, ইউরোপ-এও ছড়িয়ে পড়ে। চতুর্দিক থেকে প্রশংসা আর অভিনন্দনবার্তা আসতে থাকে।

আমেরিকান গভর্নমেন্টের সাথে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের চুক্তি

তবুও নিজেদের অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট হতে পারেন না রাইট ভাইয়েরা। আরো উন্নত ধরনের বিমান তৈরি করবার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থের। এগিয়ে আসে এক সিণ্ডিকেট। তারাই প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদানের সব ভার গ্রহণ করে। নতুন সিণ্ডিকেট আমেরিকান গভর্নমেন্টের সাথে চুক্তিবদ্ধ হল। অরভিল চুক্তির শর্ত অনুসারে আমেরিকায় রয়ে গেলেন, উদ্দেশ্য আরো উন্নত ধরনের বিমান তৈরি করা।

উইলবার রাইটের ফ্রান্স গমন

ফ্রান্স-এ গেলেন উইলবার। সেখানে দেখালেন বিমানে ওড়বার কলাকৌশল। ফ্রান্সের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি প্রতিদিন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসত।

গুরুতর আহত অরভিল রাইট

একদিন আমেরিকায় অরভিল রাইট সামরিক বাহিনীর এক অফিসারকে সাথে নিয়ে যখন বিমানে আকাশপথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, সেই সময় আকস্মিক ভাবে একটা প্রপেলার ভেঙে প্লেন মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল। সৌভাগ্যক্রমে গুরুতর আহত অরভিলের প্রাণ রক্ষা হলেও সঙ্গী অফিসার দুর্ঘটনাস্থলেই মারা যান। কিছুদিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলেন অরভিল।

মৃত্যু পর্যন্ত রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের কাজ

অবশেষে ১৯১২ সালে উইলবার মারা গেলে। অরভিল তারপরেও বহু বছর বেঁচে ছিলেন। আমৃত্যু তিনিও বিমানে উন্নয়ন ও উৎপাদনের কাজে জীবন উৎসর্গ করে গিয়েছেন।

উপসংহার :- পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এরোপ্লেন কেনবার জন্য আবেদন জানাতে থাকে। রাইট ভাইরা বুঝতে পারেন তাঁদের সুদীর্ঘ পরিশ্রম নিষ্ঠা অধ্যবসায় এতদিনে সফল হয়েছে। সমস্ত পৃথিবীর সামনে তাঁরা এনে দিয়েছেন এক নতুন গতি। যে গতির কথা মানুষ কল্পনা করতে পারেনি।

(FAQ) রাইট ভ্রাতৃদ্বয় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. রাইট ভ্রাতৃদ্বয় কারা?

অরভিল রাইট ও উইলবার রাইট।

২. উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেন কারা ?

অরভিল রাইট ও উইলবার রাইট নামে দুই ভাই।

৩. রাইট ভ্রাতৃদ্বয় কবে উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেন?

১৭ই ডিসেম্বর, ১৯০৩ সালে।

Leave a Comment