ট্রুম্যান নীতি প্রসঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যানের বক্তব্যের বিষয়, ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার কারণ বা পটভূমি প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডের সতর্কবার্তা, সক্রিয় পদক্ষেপের দাবি, বণিক ও শিল্পপতিদের চাপ, বিদেশের বাজার দখল, ট্রুম্যান নীতির সাফল্য ও সংকট হিসেবে সক্রিয় বৈদেশিক নীতি, ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সূচনা, বেষ্টনী নীতি, গ্ৰীস ও তুরস্কে অর্থ সাহায্য ও আন্তর্জাতিক সংকট সম্পর্কে জানবো।
ট্রুম্যান নীতি বা টুম্যানের ঘোষণা
ঐতিহাসিক ঘটনা | ট্রুম্যান নীতি |
ঘোষণাকাল | ১২ মার্চ, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ |
ঘোষণাকারী | আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান |
উদ্দেশ্য | বিশ্বজুড়ে সক্রিয় হস্তক্ষেপ |
ফলাফল | ঠাণ্ডা লড়াই |
ভূমিকা:- মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ মার্কিন কংগ্রেসে এক বক্তৃতা দেন। তার প্রদত্ত এই বক্তৃতা ট্রুম্যান নীতি নামে পরিচিত।
বক্তব্যের বিষয়
ট্রুম্যান তার বক্তৃতায় বলেন যে,
- (১) বিশ্ব এখন দুটি পরস্পর বিরোধী আদর্শ ও জীবনচর্যায় বিভক্ত— একটি হল মুক্ত গণতান্ত্রিক দুনিয়া, অন্যটি হল সাম্যবাদী দুনিয়া।
- (২) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হল মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও স্বাধীনতা রক্ষা করা।
- (৩) আন্তর্জাতিক কমিউনিজম বা সাম্যবাদের আদর্শ অতি সক্রিয় ও সম্প্রসারণশীল। এই সাম্যবাদী ভাবধারার প্রধান কার্যালয় মস্কো থেকে সমস্ত নির্দেশ পাঠানো হয়।
- (৪) বিশ্বের যে-কোনো স্থানে কোনো মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সশস্ত্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী (অর্থাৎ কমিউনিস্ট গোষ্ঠী) বা কোনো বিদেশি রাষ্ট্র (অর্থাৎ কমিউনিস্ট রাষ্ট্র) দ্বারা আক্রান্ত হলে আক্রান্ত রাষ্ট্রকে আমেরিকা সব ধরনের সহায়তা দান করবে।
ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার পটভূমি বা কারণ
যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউরোপ -এর বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্টদের শক্তিবৃদ্ধি, পূর্ব ইউরোপে রুশ অগ্ৰগতি প্রভৃতি ঘটনা আমেরিকা-সহ পশ্চিমিগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে যথেষ্ট উদবিগ্ন করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বিভিন্ন কারণ। যেমন –
(১) ইংল্যান্ডের সতর্কবার্তা
ইংল্যান্ড তার মিত্র আমেরিকাকে সতর্ক করে যে, ব্রিটিশ সৈন্য ফিরে আসার পর গ্রিস-এ কমিউনিস্ট প্রাধান্য স্থাপিত হলে সমগ্র ভূমধ্যসাগর ও বলকান অঞ্চল মিত্রশক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এই সতর্কবার্তায় আমেরিকা সচকিত হয়ে পড়ে।
(২) সক্রিয় পদক্ষেপের দাবি
কট্টর সাম্যবাদ-বিরোধী মার্কিন রিপাবলিকান দল, মার্কিন পররাষ্ট্র-সচিব জর্জ সি. মার্শাল এবং সহকারী পররাষ্ট্র সচিব ডিন অ্যাকসিন রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।
(৩) বণিক ও শিল্পপতিদের চাপ
কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ -এর পরবর্তীকালে মার্কিন বাণিজ্যে যাতে মন্দা না দেখা দেয় বা অস্ত্র কারখানাগুলিতে যাতে উৎপাদন হ্রাস এবং কর্মী ছাঁটাই না হয় সেই উদ্দেশ্যে মার্কিন বণিকগোষ্ঠী এবং অস্ত্রনির্মাণ সংস্থাগুলি ট্রুম্যান প্রশাসনের ওপর চাপ দিতে থাকে। এই চাপের ফলে ট্রুম্যান তাঁর নীতি ঘোষণা করতে বাধ্য হন।
(৪) বিদেশি বাজার দখল
কোনো কোনো ঐতিহাসিক আবার বলেছেন যে সাহায্য ও ঋণদানের নামে আমেরিকার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল বিদেশের বাজার দখল। আমেরিকা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিনা শুল্কে ঋণদান, উৎপাদিত শিল্পসামগ্রী ও অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছিল। এই উদ্দেশ্যেই ট্রুম্যান তাঁর নীতি ঘোষণা করেন।
ট্রুম্যান নীতির সাফল্য ও সংকট
ট্রুম্যান নীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে একদিকে যেমন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য লাভে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। অন্যদিকে তেমনি আন্তর্জাতিক সংকট বৃদ্ধি করেছিল। যেমন –
(১) সক্রিয় বৈদেশিক নীতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বৈদেশিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নিষ্ক্রিয় ও উদাসীন নীতি নিয়ে চলত টুম্যান নীতির দ্বারা এর পরিবর্তন ঘটে। এখন থেকে আমেরিকা বৈদেশিক বিষয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সক্রিয় হস্তক্ষেপের নীতি নেয়।
(২) ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সূচনা
ট্রুম্যান নীতির ফলে পৃথিবীতে আপাতত প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অবসান হলেও আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট ও সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোটের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়। ঐতিহাসিক আইজ্যাক ডয়েসচার ট্রুম্যান নীতিকে ঠান্ডা লড়াইয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বলে অভিহিত করেছেন।
(৩) বেষ্টনী নীতি
ট্রুম্যান নীতির দ্বারা সোভিয়েত রাশিয়ার প্রসার ও প্রভাবকে আমেরিকা সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করে। এজন্য এই নীতিকে ‘বেষ্টনী নীতি’ (Containment Policy) নামেও অভিহিত করা হয়।
(৪) গ্রিস ও তুরস্কে অর্থ সাহায্য
ট্রুম্যান নীতির সিদ্ধান্ত অনুসারে গ্রিস ও তুরস্ক-এ আমেরিকা ৪০ কোটি ডলার সাহায্য পাঠায়। এর দ্বারা গ্রিস ও তুরস্কে কমিউনিস্টদের প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
(৫) আন্তর্জাতিক সংকট
ডি. এফ. ফ্লেমিং বলেছেন, ট্রুম্যান ঘোষণার ফলে এমন ধারণার সৃষ্টি হয় যে, এখন থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘চাপ’ ও ‘পালটা চাপ’ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হবে না। তিনি এই পরিস্থিতিকে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে অভিহিত করেছেন।
উপসংহার:- মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে টুম্যান নীতি হল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল চরিত্রই ছিল নিষ্ক্রিয়তা ও নির্লিপ্ততা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে আমেরিকা এই নিরাসক্ত মনোভাব কাটিয়ে ওঠে এবং বিশ্বজুড়ে সক্রিয় হস্তক্ষেপ নীতির কথা ঘোষণা করে।
(FAQ) ট্রুম্যান নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান ১৯৪৭ সালের ১২ মার্চ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
ঠাণ্ডা লড়াই।