সুফী সম্প্রদায়

সুফী সম্প্রদায় প্রসঙ্গে প্রধান দুটি দল, সুরাবর্দী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা, খানকা স্থাপন, হিন্দু সম্প্রদায়ের আকর্ষণ, চিশতী সম্প্রদায়ের নামকরণ, মইনুদ্দিন চিশতী, বখতিয়ার কাকী, আওলিয়া ও চিরাগ, চিশতী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানবো।

সুফী সম্প্রদায়

বিষয়সুফী সম্প্রদায়
সুরাবর্দিশেখ বাহাউদ্দিন
চিশতীখাজা মইনুদ্দিন চিশতী
বিখ্যাত সন্তনিজামুদ্দিন আওলিয়া ও চিরাগ
সুফী সম্প্রদায়

ভূমিকা :- ভারত -এ আসার আগেই সুফীরা কতকগুলি সিলসিলা বা সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে যায়। ভারতেও কয়েকটি সুফী সম্প্রদায়ের কথা জানা যায়।

ভারতে সুফীদের দুটি প্রধান দল

সুফীরা দুটি প্রধান দলে বিভক্ত ছিলেন যথা বা-শরা অর্থাৎ যারা শরিয়ত বা ইসলামীয় আইন মেনে চলতেন এবং বে-শরা অর্থাৎ যারা তা মানতেন না। ভারতে এই দুই সম্প্রদায়কে দেখা যায়। দরবেশরা ছিলেন দ্বিতীয় সম্প্রদায়ের।

ভারতে সুফীদের সুরাবর্দী সম্প্রদায়

সুফীদের সুরাবর্দী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) প্রতিষ্ঠা

আরব দেশে সুরাবর্দী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেখ শিহাবুদ্দিন সুরাবর্দী। ভারতে এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেখ বাহাউদ্দিন। তিনি এবং ভারতে তাঁর সম্প্রদায়ের অনুগামীরা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং ধর্ম-সংক্রান্ত সরকারি পদে যোগ দিতেন। অর্থাৎ শাসক ও অভিজাতদের সঙ্গে তাদের যোগ ছিল।

(২) ইলতুৎমিসের পক্ষ গ্ৰহণ

স্বয়ং বাহাউদ্দিন নাসিরুদ্দিন কুবাচার বিরুদ্ধে ইলতুৎমিস -এর পক্ষ নেন। তাঁর পৌত্র রুকুন উদ্দিন আবুল ফৎ সুলতান আলাউদ্দিন খলজি ও তুঘলক সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা পান।

(৩) খানকা স্থাপন

সুরাবর্দী সিলসিলার সুফী সন্ত বাহাউদ্দিন জ্যাকেরিয়া দ্বাদশ শতকে মূলতানে এক খানকা স্থাপন করেন।

(৪) জালালুদ্দিন তাব্রিজী

সুরাবর্দী সিলসিলার সন্ত শেখ জালালুদ্দিন তাব্রিজী বাংলাদেশ -এর লখনৌতি ও পাণ্ডুয়ায় খানকা স্থাপন করেন এবং বহু বাঙালী হিন্দুকে ইসলামে দীক্ষিত করেন।

(৫) হিন্দু সম্প্রদায়ের আকর্ষণ

পাঞ্জাব, সিন্ধু, মূলতান ও বাংলায় সুরাবর্দী সম্প্রদায়ের সুফীদের প্রভাব বেশী ছিল। তারা ইসলামে ধর্মান্তরকরণের জন্য উৎসাহ দেখান। সরকারের ওপর তাদের প্রভাব থাকায় বহু হিন্দু তাঁদের দ্বারা আকৃষ্ট হয়।

ভারতে সুফীদের চিশতী সম্প্রদায়

ভারতীয় সুফীদের অপর বিখ্যাত সিলসিলা ছিল চিন্তীয়া বা চিশতী সম্প্রদায়। এর বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) নামকরণ

হেখটের চিশত শ্রম থেকে এই সম্প্রদায়ের চিশতী নামকরণ হয়। খাজা মইনুদ্দিন চিশতী ভারতে চিশতী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। তার খানকা ছিল আজমীরে।

(২) মইনুদ্দিন চিশতী

পৃথ্বীরাজ চৌহান-এর পরাজয়ের অল্পকাল পরেই খাজা মইনুদ্দিন চিশতী আজমীরে আসেন। তাঁর সরল জীবনযাত্রা ও সহনশীল নীতির জন্য বহু রাজপুত তাঁর অনুরক্ত হয়। ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

(৩) হামিদউদ্দিন নাগোরী

শেখ হামিদউদ্দিন নাগোরী রাজপুতানার নাগোরে রাজপুত কৃষকের মতোই জীবন-যাপন করেন। তিনি আলগজ্জালীর দার্শনিক মতবাদের ব্যাখ্যাকার ছিলেন। তিনি নিরামিষ ভোজন ও অনাড়ম্বর জীবনের জন্য সকলের শ্রদ্ধা পান। রাজনীতি, ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে তিনি দূরে থাকতেন। তিনি হিন্দভী বা হিন্দী ভাষায় তাঁর বাণী প্রচার করায় বহু লোক তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়।

(৪) বখতিয়ার কাকী

চিশতী সিলসিলার বিখ্যাত সন্ত ছিলেন খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী ও তার শিষ্য ফরিদউদ্দিন গঞ্জ-ই-শকর। বখতিয়ার কাকীর ত্যাগময় জীবনের জন্য তিনি বিরাট প্রসিদ্ধি পান। দিল্লীতে তাঁর খানকায় হিন্দু-মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের লোক আসত।

(৫) ফরিদউদ্দিন

বখতিয়ার কাকীর শিষ্য ফারিদউদ্দিনের আমলে দিল্লী চিশতী সম্প্রদায়ের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। ফারিদউদ্দিনের প্রভাব পাঞ্জাব ও হান্সি বা হারিয়ানায় বিশেষভাবে ছিল।

(৬) আওলিয়া ও চিরাগ

  • (ক) চিশতী সম্প্রদায়ের সর্বাধিক বিখ্যাত সন্ত ছিলেন শেখ নিজামুদ্দিন আওলিয়া (১২৮৭-১৩২৫) ও তাঁর শিষ্য শেখ নাসিরুদ্দিন চিরাগ। তাঁরা দিল্লীকেই তাদের প্রধান কর্মকেন্দ্র করেন। গোটা উত্তর ভারতে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।
  • (খ) তাঁরা জনসাধারণের সঙ্গে সহজভাবে মিশতেন এবং হিন্দী ভাষায় তাদের ধর্মমত ব্যাখ্যা করতেন। নিজামুদ্দিন যোগ সাধনার জন্যে বিখ্যাত ছিলেন। তারা ‘সমা’ গানের জন্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন। নিজামুদ্দিন দিল্লীর সুলতানদের কাছ থেকে দূরে থাকতেন।
  • (গ) তিনি ছিলেন অকৃতদার সন্ন্যাসী। তাঁর মধুর ও মানবিক ব্যবহারের জন্যে তাঁর অসাধারণ জনপ্রিয়তা ছিল। দিল্লীর অভিজাতরা তাকে তাদের মুরিদ বা গুরু হিসেবে মান্য করতেন।

(৭) চিশতী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য

  • (ক) এই সম্প্রদায়ের গুরুরা দারিদ্রব্রত ও পবিত্র নৈতিক জীবন-যাপনের ওপর জোর দিতেন। তাঁরা যা দান পেতেন তার দ্বারাই জীবনযাত্রা চালাতেন। অতিরিক্ত অর্থ যা পেতেন দরিদ্রদের তা বিতরণ করতেন।
  • (খ) তাঁরা যোগাভ্যাস করতেন এবং অনেকে বছরে ৪০ দিন গুহাতে যোগসাধনা করতেন। তাঁরা “সমা” গানে পারদর্শী ছিলেন। সুফীবাদ ও একেশ্বরবাদ বা ওয়াদাত-উল-উজুদ যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পায়।

উপসংহার :- বাংলায় সুফীবাদী সিলসিলা চিশতী ভাবধারার প্রসার ঘটান শেখ সিরাজউদ্দিন-আখী-সিরাজ (১৩৫৭ খ্রি)। তিনি গৌড়-এ খানকা স্থাপন করেন। বাংলায় তাঁর বিখ্যাত শিষ্য ছিলেন নূর কুতব আলম (১৪১০ খ্রি), পাণ্ডুয়াতে তার খানকা ছিল।

(FAQ) সুফী সম্প্রদায় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভারতে সুফীদের কটি সম্প্রদায়ের কথা জানা যায়?

দুটি, সুরাবর্দী ও চিশতী সম্প্রদায়।

২. ভারতে সুরাবর্দী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন কে?

শেখ বাহাউদ্দিন।

৩. ভারতে চিশতী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

খাজা মইনুদ্দিন চিশতী।

৪. চিশতী সম্প্রদায়ের বিখ্যাত সন্ত কারা?

নিজামুদ্দিন আওলিয়া ও নাসিরুদ্দিন চিরাগ।

Leave a Comment