মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রসঙ্গে ধারাবাহিক উত্তরাধিকার তত্ত্ব, উদ্দেশ্য, সার্বভৌম অধিকার তত্ত্ব, প্রধান দুটি বাধা, অভিজাত প্রভাব হীন রাষ্ট্র, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ, নতুন শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ, আমলাতন্ত্র গঠন, উলেমা বিরোধী নীতি, মৌলবাদীদের বিরোধিতা, বিচার ব্যবস্থা, ধর্ম সহিষ্ণুতা নীতি, আপোষ নীতি সম্পর্কে জানবো।
মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজতান্ত্রিক আদর্শ
ঐতিহাসিক ঘটনা | মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজতান্ত্রিক আদর্শ |
সুলতান | মহম্মদ বিন তুঘলক |
রাজত্ব | ১৩২৫-১৩৫১ খ্রি: |
বংশ | তুঘলক বংশ |
প্রতিষ্ঠাতা | গিয়াসউদ্দিন তুঘলক |
ভূমিকা :- সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক সাধারণ সুলতান ছিলেন না। কেবলমাত্র সিংহাসনে বসে রাজ্য শাসন করা তাঁর লক্ষ্য ছিল না। তিনি তার নিজস্ব রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা নিয়ে তাঁর রাজতন্ত্রকে গঠনের চেষ্টা করেন।
ধারাবাহিক উত্তরাধিকার তত্ত্ব
- (১) তিনি প্রথমেই একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, তুঘলক বংশের শাসন বলপূর্বক ক্ষমতা দখলের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। খলজি বংশ-এর ন্যায্য উত্তরাধিকারী হিসাবেই তুঘলক বংশ সিংহাসনে বসেন।
- (২) খলজি বংশের ধারাবাহিকতা তুঘলকরা রক্ষা করবেন। এজন্য তিনি মৃত সুলতান কুতুবউদ্দিন খলজির স্মৃতিস্তম্ভে ওয়াকফের বা ধর্মীয় দানের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। মহম্মদ নিজে কুতুবউদ্দিনের স্মৃতিস্তম্ভে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাতেন।
মহম্মদ বিন তুঘলক সম্পর্কে ডঃ ত্রিপাঠীর মন্তব্য
ডঃ ত্রিপাঠীর মতে, মহম্মদ এইভাবে একটি সাংবিধানিক ভ্রান্ত ধারণা (Constitutional fiction) তৈরি করার চেষ্টা করেন যে তুঘলকরা খলজি ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী।
মহম্মদ বিন তুঘলকের উদ্দেশ্য
সম্ভবত মহম্মদের উদ্দেশ্য ছিল বলপূর্বক খলজি বংশের হাত হতে ক্ষমতা দখলের কথাটি জনসাধারণের মন থেকে দূর করা এবং তুঘলক বংশের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা।
মহম্মদ বিন তুঘলকের সার্বভৌম অধিকার তত্ত্ব
- (১) মহম্মদ তাঁর শাসনকালের গোড়ার দিকে খলিফার প্রতি আনুগত্য জানান নি। তিনি নিজ যোগ্যতার উপর আস্থা বশত খলিফার নাম উল্লেখ না করে সরাসরি সুলতানের প্রতি প্রজাদের আনুগত্য পাওয়ার চেষ্টা করেন।
- (২) এজন্য তিনি তাঁর মুদ্রায় “আল সুলতান জিল্লী আল্লাহ” অর্থাৎ “সুলতান হলেন আল্লাহের ছায়া” এই কথাটি খোদাই করান। যে ব্যক্তি সুলতানকে আনুগত্য দেয়, সে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য জানায় এই মতও তিনি প্রচার করেন।
মহম্মদ বিন তুঘলকের প্রধান দুটি বাধা
সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক উপলব্ধি করেন যে, তার সার্বভৌম ক্ষমতা লাভের পথে দুটি বাধা ছিল – (ক) অভিজাত সম্প্রদায়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং (খ) উলেমা শ্রেণীর ধর্মীয় ও নৈতিক ক্ষমতা। সুলতান আলাউদ্দিন খলজিও একই সমস্যার সম্মুখীন হন।
অভিজাত প্রভাব হীন রাষ্ট্র গঠনে মহম্মদ বিন তুঘলকের ভূমিকা
মহম্মদও তার পূর্বসূরী আলাউদ্দিনের মত অভিজাত শ্রেণী ও উলেমাশ্রেণীর প্রভাব হতে রাষ্ট্রকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি সিংহাসনে বসার কিছুদিনের মধ্যেই বেশ কয়েকটি অভিজাত বিদ্রোহের সম্মুখীন হন। বাহাউদ্দিন ঘুরশাস্প, বাহারাম আইবা প্রভৃতির বিদ্রোহ তাকে চিন্তিত করে।
মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ
অভিজাত শ্রেণী তাদের ওপর সুলতানের হস্তক্ষেপ মানতে চায়নি। তিনি বংশানুক্রমিক অভিজাত কর্মচারীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ঔদ্ধত্যকে দমন করার জন্য যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগের প্রথা চালু করেন। খলজি আমল থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে উচ্চপদে নিয়োগের সূচনা হয়। মহম্মদ বিন তুঘলক এই নীতিকে অনেকদূর এগিয়ে দেন।
মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে নতুন শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ
ডঃ ত্রিপাঠীর ভাষায় “সংশোধনের অতীত উন্নাসিক অভিজাতদের বংশ মর্যাদার দাবীর হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনি নিম্ন ও বিশেষ সুবিধাহীন সম্প্রদায়ের নতুন শ্রেণীর কর্মচারী ক্রমশ নিয়োগ আরম্ভ করেন। এর ফলে সুলতান আমলাতন্ত্র বা শাসকের পদে পুরাতন অভিজাত বংশগুলির একচেটিয়া অধিকার লোপ করেন।
বরণীর সমালোচনায় মহম্মদ বিন তুঘলক
বংশ গৌরবহীন, নিম্ন সম্প্রদায়ের লোকদের প্রতি ঐতিহাসিক বরণী তীব্র ঘৃণা পোষণ করতেন। মহম্মদের এই নীতির জন্য তিনি সুলতানের তীব্র সমালোচনা করেন।
মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলাতন্ত্র গঠন
- (১) মহম্মদের আমলাতন্ত্র সাতটি সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত হয়। এর ফলে বংশানুক্রমিক অভিজাতরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। তাঁর কর্মচারী নিয়োগের প্রধান শর্ত ছিল যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন।
- (২) বংশ কৌলিন্যের স্থলে তিনি বুদ্ধি কৌলিন্য ও যোগ্যতাকেই গুরুত্ব দেন। ধর্মান্তরিত মুসলিম, হিন্দু পরিবারগুলি হতে তিনি যোগ্য লোকদের বাছাই করে উচ্চপদে বসান। বরণী এজন্য সুলতানের তীব্র নিন্দা করেছেন এবং নিম্ন শ্রেণীর লোকদের উচ্চপদে নিয়োগ গর্হিত বলেছেন।
- (৩) এই প্রতিক্রিয়াশীল, গোঁড়া লেখক, মহম্মদের সাম্য ও যোগ্যতাকে সম্মান প্রদর্শন নীতির তাৎপর্য বুঝেন নি। মহম্মদের এই নীতির ফলে বংশমর্যাদাশীল উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিজাতদের ক্ষমতা বহুল পরিমাণে কমে যায়।
মহম্মদ বিন তুঘলকের উলেমা বিরোধী নীতি
- (১) সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক তার সিংহাসনকে উলেমা প্রভাবমুক্ত করার ব্যবস্থা করেন। এই বিষয়ে তাঁর নীতি আলাউদ্দিনের নীতির সঙ্গে তুলনীয়। তবে আলাউদ্দিনের নীতি ছিল প্রয়োজনভিত্তিক। মহম্মদ একটি আদর্শের ভিত্তিতে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করেন।
- (২) আলাউদ্দিন নিজে ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ছিলেন, মহম্মদ ছিলেন ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত। এজন্য কোনো মৌলনা বা উলেমা তার কাছে ধর্মনীতির ব্যাখ্যা করতে ভয় পেতেন। বরণীর মতে, মহম্মদ চিরাচরিত শরিয়তী অনুজ্ঞার স্থলে তার যুক্তিবাদকে প্রাধান্য দেন।
- (৩) গ্রীক দর্শন পাঠ করার ফলে তিনি অতিরিক্ত যুক্তিবাদীতে পরিণত হন। প্রচলিত ধর্মীয় আইন ও প্রথাকে অগ্রাহ্য করে তিনি যুক্তির বিচারকে শ্রেষ্ঠত্ব দেন। যে সকল উলেমা তাঁর বিরোধিতা করেন তাঁদের দমন করতে তিনি দ্বিধা করেননি।
- (৪) মালিক ও উলেমাগণ যতই তার বিরোধিতা করেন মহম্মদ ততই কঠোর হাতে তাদের দমন করেন। তার অর্থ এই নয় যে মহম্মদ ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেন। তিনি প্রতি সমাবেশে নমাজ পাঠ করার ওপর জোর দিতেন। এই কারণে সমকালীন ধর্মীয় ঐতিহাসিক বরণী ও ইসামী মহম্মদের নীতির ন্যায্য ব্যাখ্যা না করে সমালোচনা করেছেন।
মৌলবাদীদের বিরোধিতায় মহম্মদ বিন তুঘলক
- (১) মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে মুসলিম ধর্মনেতারা দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিলেন – মৌলবাদী, গোঁড়া উলেমা সম্প্রদায়। এঁরা ইসলামের পুনরুজ্জীবনের জন্য রাজশক্তিকে ইসলামের বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে চান।
- (২) অন্যদিকে সুফী মতাবলম্বী, ভাববাদী মরমিয়া সম্প্রদায় ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক রাখতে চাইতেন। সুলতান মহম্মদ এই দুই সম্প্রদায়কে সমদূরত্বে রেখে একটি মধ্যপন্থা নিয়ে চলতেন। এজন্য তিনি যুক্তিবাদের আশ্রয় নেন।
- (৩) বরণীর মত মৌলবাদী লেখকের চোখে মহম্মদের যুক্তিবাদ ছিল বিধর্মীতার সামিল। কিন্তু মহম্মদ এইভাবে তাঁর রাজতন্ত্রকে মৌলবাদী ও ভাববাদী উভয় সম্প্রদায়ের প্রভাব হতে রক্ষা করেন।
মহম্মদ বিন তুঘলকের বিচার ব্যবস্থা
সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও কাজিদের বিচার করার অধিকারে হস্তক্ষেপ করেন। তিনি এজন্য বিভিন্ন মামলায় কাজিদের দেওয়া রায়ের বৈধতা পরীক্ষা করতেন। বৈধভাবে বিচার না করা হলে হস্তক্ষেপ করতেন।
মহম্মদ বিন তুঘলকের ধর্মসহিষ্ণুতা নীতি
- (১) এই সঙ্গে তিনি ধর্মসহিষ্ণুতার আদর্শকেও গ্রহণ করেন। আলাউদ্দিনের মতই তিনি বুঝেছিলেন যে, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও ধর্মান্তরিত মুসলিমদের অগ্রাহ্য করা যুক্তিযুক্ত হবে না। এজন্য তিনি হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপ করতেন না।
- (২) তাঁর সরকারে বহু হিন্দু যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মে নিযুক্ত হয়। হিন্দু যোগী ও জৈন সাধুরা নির্ভয়ে তাঁর রাজ্যে চলাফেরা করত। তিনি তাদের ধর্মীয় তত্ত্বের বিচার শুনতেন। দাক্ষিণাত্য যুদ্ধে কল্যাণের হিন্দুমন্দির ধ্বংস হলে তিনি পুনর্নির্মাণ করে দেন। ইসামীর মতে তিনি হিন্দুদের হোলী উৎসবে যোগ দিতেন।
মহম্মদ বিন তুঘলকের আপোষ নীতি
- (১) মহম্মদ তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে গোঁড়া ও প্রতিক্রিয়াশীলদের বিদ্রোহ ও চক্রান্তে হতাশ হয়ে তার যুক্তিবাদী নীতির স্থলে আপোষ নীতি নেন। তিনি বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেন যে, মৌলবাদীদের এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরোধিতার ফলেই তাকে নিত্য বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
- (২) সুতরাং তিনি হঠাৎ নীতি পালটিয়ে খলিফাকেই তাঁর প্রভু বলে স্বীকৃতি জানান। তিনি আশা করেন যে, এর ফলে গোঁড়া ও মৌলবাদীরা শান্ত হবে এবং তাঁর সিংহাসনের ন্যায্যতা স্বীকার করবে। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে তিনি যুক্তিবাদে আস্থা হারান।
উপসংহার :- মহম্মদ বিন তুঘলকের আপোষনীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। তবুও একথা অনস্বীকার্য যে, সুলতানি যুগে আলাউদ্দিন ব্যতীত আর কোনো সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের মত স্বাধীন প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কথা ভাবেন নি।
(FAQ) মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মহম্মদ বিন তুঘলক।
আলাউদ্দিন খলজি ও মহম্মদ বিন তুঘলক।
মহম্মদ বিন তুঘলক।
মহম্মদ বিন তুঘলক।