কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধ -এর সময়কাল, স্থান, বিবাদমান পক্ষ, ফরাসি ও ইংরেজদের বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন, প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র, বাণিজ্য বিস্তার, কর্ণাটকের যুদ্ধ, কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধের প্রেক্ষাপট হিসেবে স্বাধীন কর্তৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা, মারাঠা আক্রমণ, অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধ, ইংরেজ বাহিনীর পণ্ডিচেরী আক্রমণ, ফরাসি বাহিনীর মাদ্রাজ অবরোধ, সেন্ট থোমের যুদ্ধ, যুদ্ধের অবসান ও যুদ্ধের গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।
দাক্ষিনাত্যে কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধ
সময়কাল | ১৭৪৬-১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ |
স্থান | কর্ণাটক |
বিবাদমান পক্ষ | ইংরেজ ও ফরাসি বাহিনী |
ফলাফল | ফরাসিদের জয়লাভ |
ভূমিকা :- অষ্টাদশ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনোন্মুখতার সুযোগে দক্ষিণ ভারতও প্রায় স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। দাক্ষিণাত্যের মুঘল সুবাদার নিজাম-উল-মুলক ছিলেন কার্যত স্বাধীন। আবার তার অধীনস্থ আঞ্চলিক শাসকরাও প্রায় স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন।
ফরাসি ও ইংরেজদের বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন
দাক্ষিণাত্যের এ হেন রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সুযোগে ফরাসী ও ইংরেজ বণিকেরা ঐ অঞ্চলে নিজ নিজ বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনে সমর্থ হয়েছিল।
প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র
দাক্ষিণাত্যে ফরাসীদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল পণ্ডিচেরী এবং ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটি ছিল মাদ্রাজের সেন্ট ডেভিড।
বাণিজ্য বিস্তার
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের স্বাধীনতাকামিতা, বিচ্ছিন্নতা ও পারস্পরিক মতভেদের সুযোগ নিয়ে বণিক সম্প্রদায়ই ভারতীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। অবশ্য তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল নিজ বাণিজ্য বিস্তার করা।
কর্ণাটকের যুদ্ধ
ক্ষমতাদখলের জন্য এই অঞ্চলে ইংরেজ ও ফরাসী বণিকেরা তিনটি বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এগুলিই সাধারণভাবে ‘কর্ণাটের যুদ্ধ’ বা ‘কর্ণাটকের যুদ্ধ নামে খ্যাত।যেমন – কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধ, কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধ, কর্ণাটকের তৃতীয় যুদ্ধ।
কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
দাক্ষিণাত্যের এক অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মাঝে কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধের সূচনা ঘটে। যেমন –
(১) স্বাধীন কর্তৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা
দাক্ষিণাত্যের সুবাদার যেমন মুঘল বাদশাহকে অগ্রাহ্য করে কার্যত স্বাধীন হয়ে উঠেছিলেন তেমনি কর্ণাটের (রাজধানী আর্কট) নবাবও নিজামকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীন কর্তৃত্ব স্থাপনে সচেষ্ট ছিলেন।
(২) মারাঠা আক্রমণ
১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে মারাঠারা কর্ণাটক আক্রমণ করে নবাব দোস্ত আলীকে হত্যা করে এবং নবাবের জামাতা চাঁদা সাহেবকে বন্দী করে সাতারায় নিয়ে চলে যায়।
(৩) উত্তরাধিকার সমস্যা
১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে নিজাম স্বয়ং এসে আনওয়ারউদ্দিন নামক একজন দক্ষ কর্মচারীকে নবাব নিযুক্ত করেন। কিন্তু এতে সমস্যার সম্যক সমাধান হল না। কারণ দোস্ত আলীর আত্মীয়বর্গ এবং চাঁদা সাহেব এতে খুবই রুষ্ট হন।
(৪) অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত যুদ্ধ
কর্ণাটকে যখন এরূপ রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে তখনই ইউরোপ অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত যুদ্ধ (১৭৪০ খ্রীঃ) শুরু হয়। এই যুদ্ধে ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্স ছিল বিরোধী পক্ষ। এই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কর্ণাটকেও ইঙ্গ-ফরাসী সংঘর্ষ দেখা দেয়।
(৫) ফরাসি গভর্নর ডুপ্লে চেষ্টা ব্যর্থ
পণ্ডিচেরীর ফরাসী গভর্নর ডুপ্লে ইউরোপে যুদ্ধ বাধলেও এদেশে নিরপেক্ষ থাকার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে তা ব্যর্থ হয়ে যায়।
(৬) ইংরেজ বাহিনীর পণ্ডিচেরী আক্রমণ
১৭৪৫ খ্রীষ্টাব্দে নৌ-সেনাপতি বার্নেটের নেতৃত্বে এক ইংরেজ বাহিনী পণ্ডিচেরী আক্রমণ করে। এর বিরুদ্ধে ডুপ্লে কর্ণাটকের নবাবের দ্বারস্থ হন। নবাবের নির্দেশে ইংরেজ-বাহিনী পিছু হটে আসে।
(৭) ফরাসীদের মাদ্রাজ অবরোধ
মরিসাসের ফরাসী গভর্নর লা-বুরদনে’র নেতৃত্বে এক বিরাট নৌ-বাহিনী ডুপ্লের সাহায্যে স্বাধীন কর্ণাটকে এসে উপস্থিত হয়। লা-বুরদনের সাহায্যে ডুপ্লে ইংরেজ ঘাঁটি মাদ্রাজ অবরোধ করেন।
কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধ
আনওয়ারউদ্দিন ডুপ্লেকে অবরোধ তুলে নিতে আদেশ দেন। কিন্তু ডুপ্লে নবাবের আদেশ অমান্য করলে কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়।
সেন্ট থোমের যুদ্ধ
বিপন্ন ইংরেজদের পক্ষে ১০০০০ সৈন্য নিয়ে কর্ণাটকের নবাব আনোয়ার উদ্দিন ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু তার বিরাট বাহিনী ১৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে মাইলাপুর বা সেন্ট থোমের যুদ্ধে ফরাসি বাহিনীর মাত্র ৯৩০ জন সৈন্যের কাছে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়।
কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধের অবসান
১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে ‘আই-লা-শ্যাপেল’-এর সন্ধি দ্বারা ইউরোপীয় যুদ্ধের অবসান ঘটে। ফলে ভারতেও ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্বের অবসান হয় এবং উভয়েই অপরের অধিকৃত অঞ্চল প্রত্যর্পণ করে দেয়।
কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধের গুরুত্ব
আপাত দৃষ্টিতে কর্ণাট বা কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধ ছিল নিষ্ফল। কারণ যুদ্ধান্তে পূর্বাবস্থাই বলবৎ হয়েছিল। কিন্তু একটু গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এই যুদ্ধ বহু মূলগত পরিবর্তন সাধন করেছিল। যেমন –
(১) কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধের ফলে ভারতের শাসকদের দুর্বলতা প্রকাশ
ভারতীয় শাসকদের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির দুর্বলতা বিদেশী বণিকদের নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এদেশের রাজাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধিতাকে কাজে লাগিয়ে ভারতে ক্ষমতাবিস্তার করা যে সহজতর, তা ইউরোপীয়দের কাছে প্রতিভাত হয়েছিল।
(২) কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধের ফলে ভারতের সামরিক দুর্বলতা প্রকাশ
তাছাড়া মুষ্টিমেয় ফরাসী-সৈন্যর হাতে বিশাল সংখ্যক নবাবী ফৌজ পরাজিত হবার ফলে, এদেশের সামরিক দুর্বলতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে ডুপ্লে ভারতে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন।
(৩) কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধে নৌ শক্তির গুরুত্ব
কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধে নবাবের বিশাল বাহিনী পরাজিত হয়। ফলে এই যুদ্ধে নৌ-শক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি হয়েছিল।
উপসংহার :- বস্তুত প্রথম কর্ণাটক যুদ্ধের সাফল্যজনিত উচ্চাকাঙ্ক্ষাই ডুপ্লেকে বাস্তবতা বর্জিত নীতি গ্রহণে প্রলুব্ধ করেছিল। তাই ডড়ওয়েল (Dodwell) বলেছেন, “In short it (Ist carnatic war) set the stag for the experiments of Duplex and accomplishment of clive.”
(FAQ) কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৭৪৬-১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ।
১৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে।
আনোয়ার উদ্দিন।
ডুপ্লে।