পারস্যের স্যাট্রাপ ব্যবস্থা প্রসঙ্গে আত্মপ্রকাশ, পরিচয়, বিভিন্ন স্যাট্রোপি, কার্যাবলী, সম্রাটের সঙ্গে সম্পর্ক, স্যাট্রাপের স্বাধীনতা ও বিদ্রোহ সম্পর্কে জানবো।
খ্রিস্টপূর্ব যুগে পারস্যের স্যাট্রাপ ব্যবস্থা প্রসঙ্গে স্যাট্রাপি হল একটি স্যাট্রাপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল, প্রাচীন পারসিক অর্থে স্যাট্রাপ বলতে সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তাকে বােঝায়, পারস্যের স্যাট্রাপ ব্যবস্থার আত্মপ্রকাশ, পারস্যের স্যাট্রাপ ব্যবস্থার পরিচয়, পারস্যের স্যাট্রাপ ব্যবস্থায় কার্যাবলী, সম্রাটের স্যাট্রাপদের সঙ্গে সম্পর্ক, পারস্যের স্যাট্রাপদের স্বাধীনতা ও বিদ্রোহ সম্পর্কে জানব।
পারস্যের স্যাট্রাপ ব্যবস্থা
ঐতিহাসিক ঘটনা | পারস্যের স্যাট্রাপ ব্যবস্থা |
স্থান | পারস্য |
সাম্রাজ্য | আকিমেনিয় সাম্রাজ্য |
প্রশাসনিক একক | স্যাট্রাপি |
গভর্নর | স্যাট্রাপ |
অর্থ | সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তা |
বৃহৎ স্যাট্রাপি | ব্যাবিলোনিয়া, মিশর |
ক্ষুদ্র স্যাট্রাপি | আরমেনিয়া, আসিরিয়া |
ভূমিকা :- খ্রিস্টপূর্ব যুগে পৃথিবীতে যেসব শক্তিশালী সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল পারস্যের আকিমেনীয় সাম্রাজ্য (৫৫০-৩৩০ খ্রিস্টপূর্ব)। প্রতিবেশী মিশর, মেসোপটেমিয়া, থ্রেস, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়ার বৃহদংশ ও গ্রিস-এর অংশবিশেষ এই সাম্রাজ্যের অধীনে চলে গিয়েছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আকিমেনীয় সাম্রাজ্যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস ছিল।
স্যাট্রাপ ব্যবস্থা
সুবিশাল আকিমেনীয় সাম্রাজ্যে সর্বদা কেন্দ্রীয় আধিপত্য বজায় রাখা এবং সারা দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে আকিমেনীয় বা পারস্য সাম্রাজ্যে আইয়োনীয়, মিডীয়, ব্যাকট্রীয় ইত্যাদি প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এটি ‘স্যাট্রাপি ব্যবস্থা’ নামে পরিচিত।
স্যাট্রাপের আত্মপ্রকাশ
পারস্যে স্যাট্রাপের আত্মপ্রকাশের বিভিন্ন দিক গুলি হল
(১) প্রশাসনিক একক
‘স্যাট্রাপি’ ছিল প্রাচীন আকিমেনীয় বা পারস্য সাম্রাজ্যের প্রদেশ বা প্রশাসনিক একক। শাসন পরিচালনার সুবিধার্থে বিশাল আকিমেনীয় সাম্রাজ্যকে ক্ষুদ্র-বৃহৎ প্রশাসনিক এককে ভাগ করা হত। এই অঞ্চলগুলির নাম ছিল ‘স্যাট্রাপি’। পারস্যের প্রতিটি স্যাট্রাপি বা প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন একজন করে গভর্নর। তারা স্যাট্রাপনামে পরিচিত ছিলেন।
(২) ইতিহাসের উপাদান
হেরোডোটাসের বিবরণ, আলেকজান্ডার-এর আমলের কয়েকজন ইতিহাসবিদের বিবরণ, আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের শিলালিপি প্রভৃতি থেকে স্যাট্রাপি বা পারস্যের প্রদেশ এবং স্যাট্রাপ বা সেই প্রদেশের শাসকের কথা জানা যায়।
(৩) উত্থান
আনুমানিক ৬৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিডিয়ান যুগে পারস্যে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার বিকাশ শুরু হয়। এরপর পারসিক সম্রাট মহান কাইরাসের সময় থেকে, আনুমানিক ৫৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ পারস্যে ব্যাপক মাত্রায় স্যাট্রাপি বা প্রদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রথম দারাউসের রাজত্বকালে (৫২২ খ্রি.পূ.-৪৮৬ খ্রি.পূ.) স্যাট্রাপিগুলির গঠন পরিপূর্ণতা লাভ করে।
স্যাট্রাপের পরিচয়
এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) অর্থ
প্রাচীন পারসিক ব্যাখ্যা অনুসারে ‘স্যাট্রাপ’ শব্দটির অর্থ হল সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তা। স্যাট্রাপ’ শব্দের বর্তমান আভিধানিক অর্থ হল প্রাচীন পারস্যের প্রাদেশিক শাসনকর্তা। প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘স্যাট্রাপিয়া’ (Satrapia) থেকে স্যাট্রাপি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ‘স্যাট্রাপি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল প্রাচীন পারস্যের প্রদেশ।
(২) সীমানা
প্রাচীন পারস্যের বিভিন্ন প্রদেশ বা স্যাট্রাপির সীমানা নির্ধারণে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাসের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হত।
(৩) মর্যাদা
স্যাট্রাপদের প্রশাসনিক মর্যাদা ছিল গভর্নরের সমতুল।
(৪) নিযুক্তি
বিভিন্ন প্রদেশের স্যাট্রাপগণ পারস্যের সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন।
(৫) কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ
স্যাট্রাপি ব্যবস্থার মাধ্যমে আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশগুলিতে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করা সম্ভব হয়েছিল।
বিভিন্ন স্যাট্রোপি
সমগ্র আকিমেনীয় সাম্রাজ্য বিভিন্ন বৃহৎ স্যাট্রাপি অর্থাৎ প্রদেশে বিভক্ত ছিল। এই বৃহৎ স্যাট্রাপি বা প্রদেশগুলি আবার কয়েকটি ক্ষুদ্র স্যাট্রাপিতে বিভক্ত হত। ক্ষুদ্র স্যাট্রাপিগুলির সীমানা মাঝেমধ্যেই পরিবর্তিত হত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি দুটি ক্ষুদ্র স্যাট্রাপির শাসন পরিচালনা করতে পারতেন। সুসা থেকে সারডিস পর্যন্ত ২,৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা পারস্যের ২০টি স্যাট্রাপির মধ্যে যোগসূত্র গড়ে তুলেছিল।
(১) বৃহৎ স্যাট্রাপি
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৃহৎ স্যাট্রাপি ছিল পারসিস, মিডিয়া, লিডিয়া, ব্যাবিলোনিয়া, মিশর, আরাকোসিয়া, ব্যাকট্রিয়া ইত্যাদি।
(২) কেন্দ্রীয় ক্ষুদ্র স্যাট্রাপি
কয়েকটি কেন্দ্রীয় ক্ষুদ্র স্যাট্রাপি ছিল পার্থিয়া, আরমেনিয়া, কাপাডোসিয়া, আসিরিয়া, নিম্ন মিশর, হারতাসিয়া ইতাদি।
(৩) অন্যান্য ক্ষুদ্র স্যাট্রাপি
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ক্ষুদ্র স্যাট্রাপি ছিল প্যারাট্যাসিল, হিরকানিয়া, কোলচিস, প্যালাগোনিয়া, সিরিয়া, সিটামিল, আরবেলিটিস, কারিয়া, ফিজিয়া, ওরিটাল ইত্যাদি।
স্যাট্রাপের কার্যাবলি
পারস্যের স্যাট্রাপকে প্রশাসনিক কাজকর্মে সহায়তা করার জন্য একটি পরিষদ বা কাউন্সিল থাকত। স্যাট্রাপি বা প্রদেশের প্রধান শাসক হিসেবে স্যাট্রাপদের বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব পালন করতে হত। যেমন –
(১) কর আদায়
স্যাট্রাপকে তাঁর সংশ্লিষ্ট শাসনাঞ্চল থেকে কর আদায় করে সেই অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারি কোশাগারে জমা দিতে হত।
(২) সামরিক ব্যবস্থা রক্ষা
স্যাট্রাপরা সেনাবাহিনীতে সৈনিক নিয়োগ এবং সামরিক ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণ করতেন।
(৩) আমলা নিয়োগ
প্রদেশ বা আঞ্চলিক কাজের প্রয়োজনে তাঁরা স্থানীয় আমলাদের নিয়োগ করতেন।
(৪) বিচারকার্য
স্যাট্রাপ ছিলেন তাঁর প্রশাসনিক অঞ্চলের বিচার বিভাগের প্রধান। তাঁকে পৌর এবং ফৌজদারি উভয় অপরাধের বিচার করতে হত।
(৫) বিদ্রোহ দমন
স্থানীয় বিদ্রোহ দমন, বিশৃঙ্খলা দূরীকরণ প্রভৃতি দায়িত্ব তাঁদের পালন করতে হত।
(৬) নিরাপত্তা
রাস্তায় যাতায়াতের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও তাঁকে করতে হত।
(৭) আক্রমণ প্রতিরোধ
বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধে তিনি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন।
(৮) সমস্যার মোকাবিলা
প্রদেশের যাবতীয় সমস্যার মোকাবিলা করার দায়িত্ব তাঁর উপর থাকত।
(৯) বার্ষিক বিবরণ পেশ
প্রদেশের বাৎসরিক বিবরণ নির্দিষ্ট সময়ে সম্রাটের কাছে পেশ করা তাঁর অন্যতম দায়িত্ব ছিল।
সম্রাটের সঙ্গে স্যাট্রাপের সম্পর্ক
এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) সম্রাটের কাছে দায়বদ্ধতা
পারস্যের বিভিন্ন প্রদেশে শাসন ক্ষমতা ভোগকারী স্যাট্রাপরা ছিলেন মহান সম্রাটের প্রতিনিধি। তাঁরা তাদের কাজের জন্য সরাসরি সম্রাটের কাছে দায়বদ্ধ থাকতেন। বিভিন্ন প্রদেশের স্যাট্রাপ এবং সাম্রাজ্যের প্রধান শাসক সম্রাটের মধ্যে সম্পর্ক নির্ভর করত সামরিক শক্তি ও রাজকীয় কর্তৃত্ব পালনের ওপর।
(২) পর্যবেক্ষক
‘রাজার নয়ন’ নামে পরিচিত পর্যবেক্ষকরা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্যাট্রাপিতে ঘুরে ঘুরে স্থানীয় প্রশাসন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতেন এবং তা সম্রাটকে জানাতেন।
(৩) সতর্কীকরণ
স্যাট্রাপরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে এবং তাঁদের শাসনাঞ্চলের বাৎসরিক বিবরণ নির্দিষ্ট সময়ে সম্রাটের কাছে জানাতে ব্যর্থ হলে সম্রাট প্রথমে স্যাট্রাপদের সতর্ক করে দিতেন।
(৪) পদচ্যুতি
সতর্কীকরণে কোনো কাজ না হলে সম্রাট স্যাট্রাপির দায়িত্ব থেকে তাঁদের সরিয়ে দিতেন।
স্যাট্রাপের স্বাধীনতা
সাধারণভাবে স্যাট্রাপরা সম্রাট বা কেন্দ্রীয় সরকারের নামে প্রশাসন পরিচালনা করতেন। কিন্তু যখন পারস্যের কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়ত তখন বিভিন্ন স্যাট্রাপির শাসক যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করতেন।
স্যাট্রাপ গুলির বিদ্রোহ
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে পারস্যের বিভিন্ন স্যাট্রাপদের বিদ্রোহ একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পারসিক শাসক প্রথম দরায়ুসকে এরূপ বিভিন্ন স্যাট্রাপের বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের আমলে এশিয়া মাইনর ও সিরিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলের স্যাট্রাপরা বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল। তৃতীয় আলেকজান্ডারের আমলে পারস্যে স্যাট্রাপদের সর্বশেষ বড়ো বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল।
উপসংহার :- পারস্যের আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের প্রাদশিক শাসনকর্তা বা স্যাট্রাপরা সাম্রাজ্যের সংকট মোকাবিলায় এবং সাম্রাজ্যের বিস্তার ও উন্নতিতে প্রধান দায়িত্ব পালন করত। প্রকৃত অর্থে স্যাট্রাপরা সমগ্র আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের ওপর শাসন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করত।
(FAQ) পারস্যের স্যাট্রাপ ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
প্রাচীন পারস্যের আকিমেনীয় সাম্রাজ্যে।
সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তা।
প্রাচীন পারস্যের প্রদেশ।
ব্যাবিলোনিয়া ও মিশর।
আরমেনিয়া, আসিরিয়া।