বিখ্যাত রোমান সমাজের ভিত্তি ছিল শক্তিশালী সেনাবাহিনী, আইনী কাঠামো, এবং সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস। প্যাট্রিসিয়ান ও প্লেবিয়ান শ্রেণির মধ্যে বিভক্ত সমাজে, সম্রাট, সেনেট ও নাগরিকদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। রোমান সমাজে স্থাপত্য, আইন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল, যা আজও আধুনিক সমাজে প্রভাবিত করে।
প্রাচীন রোমান সমাজ
ঐতিহাসিক ঘটনা বা গল্প | রোমান সমাজ |
সাম্রাজ্য | রোমান সাম্রাজ্য |
প্রতিষ্ঠা | খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দী |
সামাজিক শ্রেণি | প্যাট্রিসিয়ান (উচ্চ শ্রেণি) ও প্লেবিয়ান (সাধারণ মানুষ) |
প্রধান ধর্ম | পলিথিজম (পরে খ্রিস্টধর্মের প্রসার) |
শিক্ষা ও সংস্কৃতি | সাহিত্য, স্থাপত্য, আইন ও দর্শন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে |
প্রভাব | আধুনিক পশ্চিমা সমাজের আইন, সরকার, এবং সংস্কৃতির উপর বিশাল প্রভাব |
ভূমিকা :- রোমান সমাজ ছিল মূলত পিতৃতান্ত্রিক ও একান্নবর্তী পরিবারভিত্তিক। এই সমাজের প্রধান পরিচিত ছিলেন ‘প্যাটার ফ্যামিলিয়াস’ নামে। রোমান সমাজ প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত ছিল। যথা – প্যাট্রিসিয়ান বা অভিজাত শ্রেণি, প্লেবিয়ান বা অনভিজাত সাধারণ মানুষ এবং সমাজের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থানকারী মানুষ, যারা দাস নামে পরিচিত ছিল।
রোমান সমাজে প্যাট্রিসিয়ানদের অবস্থান
প্রাচীন রোম-এর আদি বাসিন্দাদের বংশধর এবং ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে ব্যক্তিরা প্যাট্রিসিয়ান নামে পরিচিত ছিলেন। রোমে প্রজাতান্ত্রিক শাসনের প্রথম পর্যায়ে সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ছিলেন প্যাট্রিসিয়ানরাই। তাঁরা সমাজে অধিকারভোগী শ্রেণিতে পরিণত হন। প্রশাসনের প্রথম দুজন কনসালকে প্যাট্রিসিয়ানদের মধ্যে থেকেই নির্বাচন করা হত। প্যাট্রিসিয়ানরা প্রশাসনের বিভিন্ন উচ্চপদগুলিও দখল করতেন। তাঁরা প্লেবিয়ানদের থেকে নিজেদের পৃথক অভিজাততান্ত্রিক মর্যাদা রক্ষায় প্রয়াসী ছিলেন। তাঁরা বিপুল সম্পত্তির মালিক ছিলেন। নানা পরিস্থিতিতে প্যাট্রিসিয়ানরা দরিদ্র হয়ে গেলেও সমাজে বংশমর্যাদা অনুযায়ী এঁদের স্থান ছিল প্লেবিয়ানদের উপরে।
প্লেবিয়ানদের রোমান সমাজে অবস্থান
রোমান সমাজে প্লেবিয়ান বলতে রোমের সাধারণ মানুষ, দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, মধ্যবিত্ত, সৈনিক প্রমুখদের বোঝাত। এই শ্রেণির কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিল না।
রোমান সমাজে প্যাট্রিসিয়ান ও প্লেবিয়ান শ্রেণির সংঘর্ষ
প্লেবিয়ানরা নানা অধিকার আদায়ের দাবিতে প্যাট্রিসিয়ানদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। প্যাট্রিসিয়ানরা ছিল রাজনৈতিক দিক থেকে প্রভাবশালী। তারাই সেনেটের সদস্য নির্বাচিত হত। প্লেবিয়ানরা ছিল করদাতা এবং তারা সামরিক বাহিনীতে যোগ দিত। প্রজাতন্ত্রের সূচনার পর প্যাট্রিসিয়ান-প্লেবিয়ান দ্বন্দ্ব তীব্র রূপ নেয়। দীর্ঘকাল ধরে এই দ্বন্দ্ব চলার পর প্লেবিয়ানরা জয়ী হয় এবং রোমে পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা পায়। এর ফলে শেষপর্যন্ত তারা বেশ কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার লাভ করে।
দাসদের রোমান সমাজে অবস্থান
সমাজের তৃতীয় শ্রেণিতে ছিল দাসরা। তারা ছিল সমাজে সর্বাপেক্ষা শোষিত ও নিপীড়িত। বিভিন্ন সময়ে তারা দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য বিদ্রোহেও সামিল হত।
রোমান সমাজে নারী-পুরুষের স্থান
রোমান সাম্রাজ্যের ভিত্তি ছিল পিতৃতান্ত্রিক ছোটো যৌথ পরিবার। তবে সমাজের উচ্চশ্রেণির প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরা পিতার পরিবারে থাকত না। যদিও নিম্নশ্রেণিতে এই প্রথা ছিল না। রোমান নারীরা সমাজে পুরুষের অধীন ছিলেন।
প্রাচীন রোমান সমাজে সাক্ষরতা
সাম্রাজ্যের সর্বত্র সাক্ষরতার হার সমান ছিল না। সৈনিক, সামরিক আধিকারিক, সরকারি কর্মচারী প্রমুখের মধ্যে শিক্ষার হার ছিল বেশি।
রোমান সমাজে শিক্ষা
প্রাচীন যুগে রোমে পারিবারিক শিক্ষার প্রচলন ছিল। পরে অবশ্য প্রজাতন্ত্রের শেষদিকে এবং সাম্রাজ্যের যুগে গৃহশিক্ষকের ভিত্তিতে পড়াশোনা শুরু হয়। রোমান শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল গ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী। রোমের অধিকাংশ গৃহশিক্ষকই ছিল গ্রিক ক্রীতদাস বা মুক্ত মানুষ (Freedmen)। রোমান সাম্রাজ্যের যুগে দাতব্য বিদ্যালয় প্রায় ছিল না বললেই চলে। রোমান সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে নীতি সাহিত্য, ভাষা, দর্শন, বিজ্ঞান, চিত্রকলা, সংগীত, খেলাধুলো সহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করা হত। খ্রিস্টান ধর্ম প্রসারের পর খ্রিস্টান চার্চ ও মঠগুলি শিক্ষাদানের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
রোমান সমাজে অবসর বিনোদন
সমাজে রোমানদের অবসর বিনোদনের সাধারণ মাধ্যম ছিল খেলাধূলা, কুস্তি, দৌড় প্রভৃতি। রোমে বল খেলাও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। দাবা, চেকার ইত্যাদিও এসময়ে খেলা হত। তবে জনসাধারণের বিনোদনের সবথেকে জনপ্রিয় মাধ্যমগুলি ছিল-রথের দৌড়, গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ, সংগীত ও নাটক প্রদর্শন ইত্যাদি।
প্রাচীন রোমান সমাজে নারীর অবস্থান
- (১) রোমান সমাজ ছিল পুরুষতান্ত্রিক। এই সমাজে নারীরা সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করতেন না, এমনকি তাঁদের পুরুষের সমান আইনি মর্যাদাও ছিল না। রোমান আইনে ‘প্যাটার ফ্যামিলিয়াস’ এর কথা বলা হয়েছে, যার অর্থ নারীরা পুরুষের অধীনে থাকতেন। দরিদ্র পরিবারের রোমান মহিলারা পুরুষদের মতোই কঠোর পরিশ্রম করতেন। ধনী পরিবারের মেয়েরা বাড়ির মধ্যেই বড়ো হতেন। তারা বাড়ির বাইরে খুব কম বের হতেন।
- (২) বেশিরভাগ সম্ভ্রান্ত নারীদের কিশোরী অবস্থায় বিবাহ হত। রোমান সমাজে কুড়ি বছর বয়সে বিবাহিতা নন এমন মহিলাকে সমাজবিচ্যুত নারী বলে মনে করা হত। এই ব্যাপারে একটি আইন পাস করে সম্রাট অগাস্টাস তাদের দণ্ডদানের ব্যবস্থা করেন। মেয়েরা সাধারণভাবে পিতার নির্বাচিত পাত্রকেই বিয়ে করেতেন। রোমান সমাজে পরিবারের মধ্যে এবং রক্তসম্পর্কের মধ্যে বিবাহরীতির প্রচলন ছিল। নারীদের প্রধান কর্তব্য ছিল সন্তান জন্ম দেওয়া।
- (৩) রোমান নারীদের সম্পর্কে জানা যায় নানা সমাধি লেখ থেকে। এগুলিতে তাঁদের দুঃখের কাহিনিও লিপিবদ্ধ আছে।। সমাধি লেখতে দেখা যায় যে, বহু নারী বারো বা তেরো বছর বয়সে বিবাহ করেছিলেন। অনেকেই প্রায় পাঁচ-ছয়টি সন্তানের জননী হতেন এবং কুড়ি বছর বয়সে মারা যেতেন। এইসব লেখতে নারীদের পবিত্র, আজ্ঞাবহ, মিত্রভাবাপন্ন, মিত্যবয়ী, ধার্মিক, সরল, বয়নকর্মে সুনিপুণা প্রভৃতি বলা হয়েছে। কোনও নারীর পক্ষে উদাসীন, উচ্চাভিলাষী বা স্ব-প্রচার করা সামাজিকভাবে নিন্দনীয় ছিল।
- (৪) একজন নারী স্ত্রী, প্রেমিকা, মা, বোন বা কন্যার ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি রাজনৈতিক, ধর্মীয় এমনকি সামরিক ক্ষেত্রেও প্রতিভার পরিচয় দিতেন। এক্ষেত্রে সম্রাট অগাস্টাসের স্ত্রী ও টাইবেরিয়াসের মা লিভিয়া, বিদ্রোহিনী বৌদিকা এবং সম্রাট কনস্টানটাইন-এর মা সেন্ট হেলেনার কথা বলা যায়। সম্রাট সিজার-এর মৃত্যুর পর অগাস্টাসের মা আতিয়া অগাস্টাসকে উপযুক্ত করে তুলেছিলেন। অপর একজন মহিলা যিনি রোমান সাম্রাজ্যের রাশ নিজের হাতে ধরেছিলেন তিনি হলেন সম্রাট ট্রাজানের স্ত্রী প্লোটিনা। অন্যান্য নারীদের মধ্যে সম্রাট সেভেরাসের স্ত্রী জুলিয়া ডোমনা, জেনোবিয়া ও জাস্টিনিয়াসের রানি থিওডোরার কথা বলা যায়।
- (৫) পেশাগত ক্ষেত্রে নারীদের যোগদান ছিল সীমিত। তবে মহিলা চিকিৎসক, কেরানি, আইনজীবী, সচিব প্রমুখের কথা জানা যায়। প্রাচীন রোমের পতিতাবৃত্তি আইনগতভাবে স্বীকৃত ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্রীতদাসী বা প্রাক্তন দাসী বা জন্মগতভাবে অবহেলিত নারী পতিতাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য হতেন। এঁরা সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হতেন।
- (৬) সার্বিক বিচারে বলা যায় যে, আইনের চোখে নারীরা নিকৃষ্টরূপে গণ্য হতেন। তবে রোমান পুরুষেরা মহিলাদের সমান মর্যাদা না দিলেও তাঁদের ঘৃণা করতেন না। পুরুষদের নারীদের প্রতি এই দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় মেটেলাস নুমিডিকাসের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, অগাস্টাস তাঁর ভাষণে নারীদের সম্পর্কে বলেন, “প্রকৃতি যা তৈরি করেছে যাতে আমরা তাদের সাথে আরামে থাকতে পারি এবং আমরা তাদের ছাড়া কিছুতেই বাঁচতে পারি না।”
উপসংহার :- রোমান সমাজ ছিল প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ও সমৃদ্ধিশালী সভ্যতা, যা খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দী থেকে মধ্যযুগের শুরু পর্যন্ত টিকে ছিল। এর রাজনৈতিক কাঠামো, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস, এবং আইনি ব্যবস্থা আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। রোমান স্থাপত্য, সাহিত্য, এবং সংস্কৃতি আজও বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও রোমান সাম্রাজ্য শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়েছিল, তাদের অবদান মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে অমূল্য ভূমিকা রেখেছে।
(FAQ) রোমান সমাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
রোমান সমাজ দুটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল: প্যাট্রিসিয়ান (উচ্চবিত্ত) ও প্লেবিয়ান (সাধারণ মানুষ)। এ ছাড়াও, দাস এবং মুক্ত মানুষও ছিল সমাজের অংশ। রাজনৈতিক কাঠামোতে প্রথমে প্রজাতন্ত্র ছিল, পরে সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়।
রোমান সমাজে নারীরা সাধারণত গৃহস্থালির দায়িত্বে থাকত এবং সরাসরি রাজনৈতিক বা সামাজিক ক্ষমতা কম ছিল। তবে কিছু উচ্চবিত্ত নারী প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল এবং পরিবার বা সম্পদের উপর কিছু নিয়ন্ত্রণ করত।
দাসত্ব রোমান অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। দাসরা কৃষি, খনন, গৃহকর্ম এবং অন্যান্য কাজে নিয়োজিত থাকত। তারা আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল, যদিও কখনও কখনও তাদের মুক্তি দেওয়া হতো।
রোমান সমাজে লাতিন ভাষা প্রচলিত ছিল, যা সরকারি, প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। এই ভাষা থেকেই পরবর্তী ইউরোপীয় ভাষার অনেকগুলোর উদ্ভব হয়েছে, যেমন ফরাসি, স্প্যানিশ, ইতালিয়।