পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতন

বিখ্যাত পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ১৪৫৩ সালে, যখন অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল বিজয় করেন। এটি মধ্যযুগের সমাপ্তি এবং আধুনিক যুগের সূচনা হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজনৈতিক দুর্বলতা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, এবং বাইরের আক্রমণসহ বিভিন্ন কারণ এই পতন ত্বরান্বিত করে।

বাইজানটাইন বা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতন

ঐতিহাসিক ঘটনা বা গল্পপূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতন
সাম্রাজ্যপূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য
পতনের তারিখ২৯ মে, ১৪৫৩ খ্রি
পতনের প্রধান কারণঅটোমান সাম্রাজ্যের আক্রমণ ও কনস্টান্টিনোপল বিজয়
পতনের জন্য দায়ী শাসকশেষ বাইজেন্টাইন সম্রাট কনস্টান্টাইন XI পালাইওলোগোস
বিজয়ী শাসকসুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ (অটোমান সাম্রাজ্য)
রাজধানীকনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল)
সাম্রাজ্যের ধর্মীয় পরিচয়খ্রিস্টধর্ম (ইস্টার্ন অর্থোডক্স)
সাম্রাজ্যের অবস্থানবর্তমানের তুরস্ক, গ্রিস, বলকান এবং আশেপাশের অঞ্চল
পতনের প্রধান কারণরাজনৈতিক দুর্বলতা, অর্থনৈতিক সংকট, সামরিক অক্ষমতা, এবং বাইরের আক্রমণ
পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতন

ভূমিকা :- ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। টিকে থাকে শুধু পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য। অবশেষে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্ট্যান্টিনোপল-এর পতনের মাধ্যমে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তথা বাইজানটাইন সাম্রাজ্যেরও অবসান ঘটে। এই সাম্রাজ্য পতনেরও নান্য কারণ ছিল।

পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণসমূহ

বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি হল নিম্নরূপ –

(১) পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা

বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা এই সাম্রাজ্য পতনের মূল কারণ হয়ে উঠেছিল। এই সময় সংঘটিত নানা গৃহযুদ্ধ, সামরিক নেতাদের ক্ষমতা দখলের প্রবণতা, ক্রমাগত বহিরাগত আক্রমণ প্রভৃতি সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করেছিল। তা ছাড়া সম্রাটদের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা রোমান অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়। ফলে বাইজানটাইন সাম্রাজ্য পতনের পথে অগ্রসর হয়।

(২) পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটদের দুর্বলতা

একমাত্র জাস্টিনিয়ান ছাড়া বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের বাকি সম্রাটরা দুর্বল ছিলেন। অবক্ষয়ের যুগে কোনো কোনো সম্রাটের পাশাপাশি আমলারাও দুর্নীতিগ্রস্ত এবং বিলাসী হয়ে ওঠে। ফলে সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, যা পতনের পথ সুগম করে।

(৩) বাইজানটাইন বা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি

বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। এই বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর জন্য কৃষিক্ষেত্রকে আরও আধুনিক করার দরকার ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

(৪) পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর দুর্বলতা

ক্রমাগত বহিরাগত জাতিগুলির আক্রমণে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে এক ধরনের অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। বাইজানটাইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক শক্তি ছিল রাজকীয় নৌবাহিনী। অর্থনৈতিক সংকটের ফলে এই নৌশক্তি দুর্বল হতে থাকে। ফলে সম্রাটরা বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন। এইভাবে কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযোগে নবম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে স্থানীয় সামন্ডপ্রভুদের হাতে সাম্রাজ্যের ক্ষমতা বিভক্ত হতে থাকে।

(৫) বাইজানটাইন বা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সংকট

কৃষিক্ষেত্রে সংকট, বাণিজ্যিক অবনতি, শিল্পকারখানায় সংকট, করব্যবস্থার সংকট শেষপর্যন্ত বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। এইসব অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর জন্য বাইজানটাইন সম্রাটরা একদিকে যেমন কৃষকদের ওপর করের বোঝা চাপাতে থাকেন, অপরদিকে তেমনি দীর্ঘদিনের সঞ্চিত রাজকোষাগার শূন্য করে ফেলেন। যার ফলে সাম্রাজ্য অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। সমাজে কৃষক ও কারিগর শ্রেণি বিকল্প পেশার অভাবে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। ক্রুসেড-এর ফলে কনস্ট্যান্টিনোপল-এর হাত থেকে বাণিজ্য পথগুলির কর্তৃত্ব চলে যায় ইতালির হাতে। ফলে বাইজানটাইন-বাণিজ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।

(৬) পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের বৈদেশিক আক্রমণের প্রভাব

বাইজানটাইন সাম্রাজ্যকে বিপর্যস্ত করে তোলে ক্রমাগত বৈদেশিক আক্রমণ। এশিয়া মাইনরের উর্বর কৃষি অঞ্চলগুলি একাদশ শতকে সেলজুক তুর্কি আক্রমণের ফলে বাইজানটাইনের হাতছাড়া হয়ে যায়। দশম শতকে নর্মানরা থিবস্ ও করিন্থের রেশম কারখানাগুলির ওপর আক্রমণ চালায়। ফলে কারখানাগুলি সিসিলিতে স্থানান্তরিত হয়। ক্রুসেডাররা বাইজানটাইন সাম্রাজ্যকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে দেয়। বাইজানটাইন সাম্রাজ্য আক্রমণে সবচাইতে বেশি সফল হয় অটোমান তুর্কিরা।

কনস্ট্যানটিনোপলের পতন

১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২১ বছর বয়সী অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ (Sultan Mehmed II)-এর নেতৃত্বে অটোমান তুর্কিরা বাইজানটাইন সম্রাট কনস্টানটাইন একাদশ পালাইওলোগোস-এর নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করে। এইভাবে অটোমান তুর্কিরা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল অধিকার করে এবং পতন ঘটায়। ফলে ১৫০০ বছরেরও পুরোনো পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তথা বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।

উপসংহার :- পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ১৪৫৩ সালে, যখন অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল বিজয় করেন। এটি মধ্যযুগের সমাপ্তি এবং আধুনিক যুগের সূচনা হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজনৈতিক দুর্বলতা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, এবং বাইরের আক্রমণসহ বিভিন্ন কারণ এই পতন ত্বরান্বিত করে।

(FAQ) পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের বা বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের পতন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য কবে এবং কেন পতিত হয়?

পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য ১৪৫৩ সালের ২৯ মে অটোমান সাম্রাজ্যের হাতে পতিত হয়। এর প্রধান কারণ ছিল অটোমান বাহিনীর কনস্টান্টিনোপল বিজয়। এছাড়াও সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং বাইরের শক্তির আক্রমণ এর পতনে ভূমিকা রাখে।

২. পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতনের প্রধান কারণ কী?

প্রধান কারণ ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং তাদের কনস্টান্টিনোপল অবরোধ ও বিজয়। এছাড়াও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্বল অর্থনীতি, এবং সামরিক অক্ষমতা পতনকে ত্বরান্বিত করে।

৩. পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট কে ছিলেন?

পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ছিলেন কনস্টান্টাইন XI পালাইওলোগোস, যিনি অটোমানদের বিরুদ্ধে কনস্টান্টিনোপল রক্ষার শেষ চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হন।

৪. কনস্টান্টিনোপল পতনের পর কী ঘটেছিল?

কনস্টান্টিনোপল পতনের পর, শহরটি অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে এবং এটি তাদের নতুন রাজধানী হয়। শহরটির নাম পরিবর্তন করে ইস্তাম্বুল রাখা হয় এবং এটি অটোমান সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে উন্নতি লাভ করে।

৫. পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কী?

পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতনকে মধ্যযুগের সমাপ্তি এবং আধুনিক যুগের সূচনা হিসেবে ধরা হয়। এটি ইউরোপীয় রাজনীতির ধারায় একটি বড় পরিবর্তন আনে এবং অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থানকে শক্তিশালী করে।

Leave a Comment