শাহজাহানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

সম্রাট শাহজাহানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রসঙ্গে জুঝর সিং এর বিদ্রোহ, খান-ই-জাহানের দক্ষিণ নীতি, খান-ই-জাহানের দক্ষিণ নীতির সমর্থন, খান-ই-জাহানের দক্ষিণ নীতির বিরোধিতা, খান-ই-জাহানকে দরবারে তলব, খান-ই-জাহানের বিদ্রোহ, শিখদের বিরুদ্ধে বিরোধের কারণ, শিখ সংগঠন ভাঙার অজুহাত, মোগল বাহিনী নিয়োগ ও গুরু হরগোবিন্দ সম্পর্কে জানবো।

সম্রাট শাহজাহানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

ঐতিহাসিক ঘটনাশাহজাহানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
সম্রাটশাহজাহান
জাঠ বিদ্রোহজুঝর সিং
দক্ষিণে বিদ্রোহখান-ই-জাহান লোদী
শিখদের বিদ্রোহগুরু হরগোবিন্দ
সম্রাট শাহজাহানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

ভূমিকা :- আকবর-র রাজত্বের শেষ দিকে রাণা বীর সিং বুন্দেলা বিদ্রোহী সেলিমের পক্ষ নিয়ে আকবরের প্রিয় মিত্র ও পরামর্শদাতা আবুল ফজলকে নিহত করেন। সেলিম সিংহাসনে বসে জাহাঙ্গীর নাম নেন এবং বীর সিং বুন্দেল্লাকে নানাভাবে পুরস্কৃত করেন।

শাহজাহানের বিরুদ্ধে জুঝর সিংহের বিদ্রোহ

  • (১) বীর সিং বিরাট জায়গীর পান এবং অন্যান্য জমিদারের সম্পত্তি হরণ করে প্রভূত ধনশালী হন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জুঝার সিং বুন্দেলাদের রাজা হন। তিনি আগ্রায় সম্রাট শাহজাহানকে আনুগত্য জানাতে যান।
  • (২) শাহজাহানের কাছে বুন্দেলা রাজার অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে, সম্রাট এ সম্পর্কে জুঝর সিংকে কৈফিয়ত তলব করেন।  জুঝর সিং বিপদ বুঝে সম্রাটের বিনা অনুমতিতে আগ্রা ত্যাগ করে নিজ রাজ্যে ফিরে যান।
  • (৩) জুঝর সিংহের এই ঔদ্ধত্যের জন্য সম্রাট তাঁকে দমনের ব্যবস্থা করেন। যেহেতু বুন্দেলারা কুশলী যোদ্ধা ছিলেন, সেজন্য শাহজাহান তাঁর বিখ্যাত সেনাপতিদের যথা মহাবত খাঁ, খান-ই-জাহান, আবদুল্লা খাঁকে বিভিন্ন দিক থেকে ওরছা বা বুন্দেলখণ্ড আক্রমণের নির্দেশ দেন।
  • (৪) জুঝর সিং বাধা দিয়ে পরাস্ত হন এবং তিনি সম্রাটের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। তিনি ১ হাজার আশরফি, ১৫ লক্ষ টাকা ও ৪০টি হাতি সম্রাটকে দেন। জুঝর সিংকে তার রাজ্য ও জায়গীর ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
  • (৫) জুঝর সিং কিন্তু লুঠপাটের অভ্যাস ত্যাগ করেন নি। তিনি মুঘলের সঙ্গে সন্ধির পর গোণ্ড রাজা ভীম নারায়ণকে পরাস্ত ও নিহত করে ১ কোটি টাকা হস্তগত করেন। এজন্য শাহজাহান জুঝর সিংহের বিরুদ্ধে অভিযান পাঠান। জুঝর সিং নিহত হন। ওরছা বা বুন্দেলখণ্ড রাজ্য একজন মুসলিম মনসবদারের অধীনে স্থাপন করা হয়। জুঝার সিংহের বংশের দেবী সিংহ জমিদারী পান।

শাহজাহানের সময় খান-ই-জাহানের দক্ষিণ নীতি

  • (১) শাহজাহানের রাজত্বকালে দক্ষিণের শাসনকর্তা খান-ই-জাহান লোদী বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। খান-ই-জাহান একদা সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয়পাত্র ছিলেন। কিন্তু জাহাঙ্গীরের রাজত্বের শেষ দিকে এবং শাহজাহানের রাজত্বের গোড়ার দিকে তিনি দক্ষিণে যে নীতি নেন শাহজাহান তা অনুমোদন করতেন না।
  • (২) খান-ই-জাহান দক্ষিণে আহমদনগরের নিজামশাহী রাজ্যকে মুঘলের অধিকৃত স্থান ছেড়ে দিয়ে মিত্রতা স্থাপন করতে চেষ্টা করেন। তিনি বালাঘাট অঞ্চল আহমদ নগরের সুলতানকে মাত্র কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেন।

খান-ই-জাহানের দক্ষিণ নীতির সমর্থন

খান-ই-জাহানের এই নীতি কয়েক দিক থেকে ব্যাখ্যা করা হয়। তাঁর নীতির সমর্থনে বলা হয় যে, জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর আগ্রায় সিংহাসন নিয়ে বিরোধ হওয়ায় তিনি দক্ষিণে মীমাংসা নীতি অনুসরণ করা যুক্তিযুক্ত মনে করেন। কারণ, তিনি আশঙ্কা করেন যে, আগ্রা থেকে আপাতত কোনো সাহায্য দক্ষিণে যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য পাওয়া যাবে না।

খান-ই-জাহানের দক্ষিণ নীতির বিরোধিতা

দক্ষিণে তাঁর এই আপোষ নীতির সমালোচনা করে বলা হয় যে,

  • (১) শাহজাহানের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই তিনি এই সন্ধি করেন। ইহার উদ্দেশ্য ছিল আহমদ নগরকে তাঁর পক্ষে রাখা যাতে শাহজাহান তাকে কোনঠাসা করলে তিনি আহমদ নগরের সাহায্য পান।
  • (২) এই সময় আহমদ নগরের হাবসী-উজীর হামিদ খাঁর সুন্দরী ও তেজস্বিনী পত্নী দক্ষিণে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। তাঁর প্রেরণায় আহমদ নগরের সেনাপতিরা মুঘলের কাছ থেকে হৃতরাজ্য পুররুদ্ধারের চেষ্টা করেন এবং এই মহিলা খান-ই-জাহানের সঙ্গে আলোচনা করে আহমদ নগরের রাজ্য ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেন।
  • (৩) অপর একটি কারণ ছিল যে জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর ঠিক আগে খান জাহান লোদী আহমদ নগরের কাছ থেকে ৩ লক্ষ সোনার হুণ উপঢৌকন নেন বলে সন্দেহ করা হয়। মুঘলের অধিকৃত বালাঘাট অঞ্চলের একাংশ তিনি আহমদনগরকে হস্তান্তর করেন।
  • (৪) খান-ই-জাহান আহমদ নগরের প্রতি দুর্বলতা দেখান এই কারণে যে, আগ্রায় সিংহাসনের উত্তরাধিকারের গোলযোগে যদি তার নিজের ক্ষতি হয় তবে তিনি আহমদ নগরের সাহায্য নেবেন।
  • (৫) খান-ই-জাহান ভেবেছিলেন যে, শাহজাহান উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্বে সফল হতে পারবেন না। এজন্য শাহজাহান দক্ষিণ হতে আগ্রা যাওয়ার সময় তাঁকে সৈন্যসহ সঙ্গে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি রাজী হননি। এজন্যে সম্রাট খান-ই-জাহানের ওপর অসন্তুষ্ট হন।
  • (৬) শাহজাহান তাঁর অনুগত মহাবত খাঁকে মালবের জায়গীর দিলে খান-ই-জাহান তার বিরোধিতা করেন।

খান-ই-জাহানকে মোঘল দরবারে তলব

শাহজাহান সকল দিক বিবেচনা করে খান-ই-জাহানকে আগ্রায় তলব করেন। খান-ই-জাহান দরবারে হাজির হলেও নিজেকে খুবই নিঃসঙ্গ মনে করেন। সম্রাট তাকে নিরাপত্তার জন্য লিখিত আশ্বাস দিলেও তিনি সম্রাটের বিনা অনুমতিতে দরবার ছেড়ে দক্ষিণে পালান।

শাহজাহানের বিরুদ্ধে খান-ই-জাহানের বিদ্রোহ

দক্ষিণে আহমদ নগরের নিজাম শাহের সাহায্য নিয়ে খান-ই-জাহান বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মুঘল বাহিনী তার পিছু নিয়ে দক্ষিণে গেলে খান-ই-জাহান কালিঞ্জরে পালিয়ে আসেন। কালিঞ্জরের নিকটে মুঘল বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে মাধো সিং নামে এক রাজপুত সেনার বল্লমের আঘাতে এই প্রবীণ সেনাপতির মৃত্যু হয়।

মোঘল সম্রাট শাহজাহানের বিরুদ্ধে শিখদের বিরোধের কারণ

  • (১) শাহজাহানের সঙ্গে ষষ্ঠ শিখগুরু হরগোবিন্দের সংঘাত বাধে। জাহাঙ্গীরের শাসনকালে উদীয়মান শিখ শক্তির সঙ্গে মুঘলদের সংঘাতের সূচনা হয়। শাহজাহানের আমলে তা আরও তীব্র হয়।
  • (২) স্থানীয় মুঘল শাসকরা তুচ্ছ কারণে শিখপন্থের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। তাঁরা সম্রাটকে শিখদের বিরুদ্ধে প্রভাবিত করেন। আসলে শিখদের সংগঠন, শৃঙ্খলা ও ঐক্য তারা পছন্দ করেন নি।

শাহজাহানের বিরুদ্ধে শিখ সংগঠন ভাঙার অজুহাত

এভাবে শিখ শক্তি মজবুত হলে পাঞ্জাবে মুঘলের বিপদ হবে এটা বুঝতে পেরে তারা নানা অজুহাতে শিখদের শিশু সংগঠনকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা চালান। যেমন –

  • (১) সম্রাটের দুটি পোষা বাজপাখি অমৃতসরে গুরু হরগোবিন্দের শিবিরে ধরা পড়লে গুরু তা ফেরৎ দিতে অস্বীকার করায় সেনাপতি মুখলিন খাঁকে শিখদের শায়েস্তা করার জন্য পাঠান হয়। কিন্তু শিখদের পাঠান সেনাপতি পিন্ডা খাঁ মুঘল বাহিনীকে হঠিয়ে দেন। এটিই ছিল শিখ ও মুঘলের প্রথম প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ।
  • (২) বিয়াসের তীরে শিখরা গুরুর নামে শ্রীহরগোবিন্দপুর নগরের পত্তন করায় পাঞ্জাবের মুঘল শাসনকর্তা বিচলিত হন। যোদ্ধা জাঠ কৃষকরা এই নগরের নেতৃত্ব মেনে মুঘলের বিরোধিতা করবে এই আশঙ্কায় গুরুকে এই নগর নির্মাণ রদ করার আদেশ দেওয়া হয়। এই আদেশ কার্যকরি করতে যে বাহিনী পাঠান হয় শিখরা তা প্রতিহত করে।
  • (৩) ইতিমধ্যে সম্রাটের অশ্বশালার দুটি উৎকৃষ্ট অশ্ব খোয়া যায় এবং জানা যায় যে এই দুটি অশ্ব গুরু গ্রহণ করেছেন।

পাঞ্জাবের শিখদের বিরুদ্ধে মুঘল বাহিনী নিয়োগ

  • (১) উপরের সকল অজুহাতে মুঘল বাহিনীকে শিখদের বিরুদ্ধে নিয়োগ করা হয়। কর্তারপুরে শিখরা মুঘলদের প্রবল বাধা দেয়। ফলে মুঘল আক্রমণ প্রত্যাহার করা হয়।
  • (২) মুঘল আক্রমণের ফলে শিখ জাতির লোকবল ও অর্থবলের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু লোহা আগুনে পুড়ে যেমন ইস্পাতে পরিণত হয়, তেমন দুঃখকষ্ট বরণ করে শিখজাতি সংকল্পে কঠোর ও প্রতিজ্ঞায় অটল হয়।

শিখ গুরু হরগোবিন্দ

  • (১) গুরু হরগোবিন্দ উপলব্ধি করেন যে, এখন শিখকে যুদ্ধে নিয়োজিত না করে তাকে আত্মগঠনের জন্যে সময় দেওয়া দরকার। সুতরাং তিনি পাঞ্জাব ত্যাগ করে কাশ্মীরের কিরাতপুরে তাঁর কেন্দ্র স্থাপন করেন।
  • (২) এইস্থানে ধ্যান ও প্রার্থনায় তিনি নিজেকে সমর্পন করেন। ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেহত্যাগ করলে তাঁর পুত্র হররায় সপ্তম গুরুর পদে বসেন।

উপসংহার :- এই ভাবে বিভিন্ন কৌশল ও বাহিনী প্রেরণ করে শাহজাহান তার বিরুদ্ধে সংঘটিত বিদ্রোহ গুলির মোকাবিলা করেন।

(FAQ) সম্রাট শাহজাহানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. শাহজাহানের সময় কোন জাঠ নেতা বিদ্রোহ করে?

জুঝর সিং।

২. শাহজাহানের সময় দক্ষিণে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন কে?

খান-ই-জাহান লোদী।

৩. শাহজাহানের সঙ্গে কোন শিখ গুরুর সংঘাত বাধে?

ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ।

৪. গুরু হরগোবিন্দের মৃত্যু হয় কখন?

১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment