চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা প্রসঙ্গে তার জন্ম, পিতৃপরিচয়, শিক্ষা, প্রকৃত নাম, কবিতা লেখা শুরু, ছন্নছাড়া ভাব, কুড়িটি প্রেমের কবিতা, উপন্যাস রচনা, নোবেল পুরস্কার লাভ ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।
চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা
ঐতিহাসিক চরিত্র | পাবলো নেরুদা |
জন্ম | ১২ জুলাই ১৯০৪ খ্রি |
জন্মস্থান | চিলি |
পরিচিতি | কবি |
নোবেল পুরস্কার | ১৯৭১ খ্রি: |
মৃত্যু | ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ খ্রি: |
ভূমিকা :- “আমি কোনো সমালোচক বা প্রবন্ধকার নই। আমি সাধারণ কবি মাত্র। কবিতা ভিন্ন অন্য ভাষায় কথা বলা আমার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যদি আমাকে জিজ্ঞাসা কর আমার কবিতা কি? তাহলে বলতে হয় আমি জানি না। কিন্তু যদি আমার কবিতাকে প্রশ্ন কর সে জবাব দেবে, আমি কে।” তিনি বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা।
পাবলো নেরুদার জন্ম
১২ই জুলাই ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে চিলিতে পাবলো নেরুদার জন্ম। দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে স্বাধীন দেশ চিলি। ইউরোপ-এর বিভিন্ন দেশের প্রবাসী মানুষ আর স্থানীয় উপজাতিরাই গড়ে তুলেছে এই দেশ। এখানে মিশ্র-ভাষা গড়ে উঠলেই সাহিত্যের ভাষা স্প্যানিশ।
বিশিষ্ট কবি পাবলো নেরুদার পিতৃপরিচয়
নেরুদার বাবা ছিলেন সামান্য কিছু জমির মালিক। তার মা একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। নেরুদার জন্মের এক মাস পরেই মা টি. বি. তে মারা যান। বাবা আবার বিয়ে করলেন। নিজের মা না হলেও সৎ মা নেরুদাকে ভালবাসতেন নিজের সন্তানের মত। নিজের সন্তানের সাথে কোনোদিন বিভেদ করেননি সৎ মা।
প্রতিবাদ ও ভালোবাসার কবি পাবলো নেরুদা
যথার্থ অর্থেই তাঁর কবিতার মধ্যেই তাঁর জীবনের প্রকাশ। তাঁর কবিতার মধ্যে ফুটে উঠেছে তাঁর ভালবাসা, তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-আবেগ, তাঁর আনন্দ, বেদনা, ক্রোধ, হতাশা আর সকলকে ছাপিয়ে তাঁর তীব্র প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের কবি, ভালবাসার কবির নাম পাবলো নেরুদা।
পাবলো নেরুদার প্রকৃত নাম
নেরুদার আসল নাম নেফতালি রিকার্দো রেয়েজ বোসোয়ালতো। কিশোর বয়সে যখন নেরুদার সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত হয়, সেই সময় চেকোশ্লোভাকিয়ায় ইয়ান নেরুদা বলে একজন বিখ্যাত লেখক ছিলেন। তাঁর নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করে নিজের নাম রাখেন পাবলো নেরুদা।
বিশিষ্ট কবি পাবলো নেরুদার জীবনে বৃষ্টি ও অরণ্যের প্রভাব
- (১) নেরুদার বয়স তখন দু বছর। দক্ষিণ চিলির সীমান্ত অঞ্চলে জঙ্গল কেটে নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। সংসারের আর্থিক অনটনের জন্য নেরুদার বাবা স্থির করলেন আরাউকো প্রদেশের সেই অরণ্য অঞ্চলে গিয়ে বসবাস করবেন।
- (২) সেখানে রেললাইন সংলগ্ন কাজ, রাস্তা তৈরির ঠিকাদারির কাজ নিলেন। এ এক সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ। চারদিকে ঘন সবুজ অরণ্য। কোথাও অরণ্য নির্মূল করে গড়ে উঠেছে চাষের ক্ষেত। সর্বত্রই এক আদিম বন্য প্রকৃতি। কোনো ধর্মীয়, সামজিক নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল নেই।
- (৩) মুক্ত অরণ্যের মতই মানুষের বেড়ে ওঠা। অরণ্যের নিত্য সঙ্গী হয়ে সারা বছর ঝরে পড়ে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। শিশু নেরুদার জীবনে এই বৃষ্টি আর অরণ্য গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সকলের অজান্তেই তাঁর মধ্যে জেগে উঠেছিল এক কবি স্বত্তা।
পাবলো নেরুদার কবিতা লেখা শুরু
যখন তাঁর বয়স মাত্র দশ। তখনই শুরু হয় তাঁর কবিতা লেখা। শিশুমনের কল্পনায় যে ভাব জেগে ওঠে তাই লিখে ফেলেন। স্কুলে নিয়মিত পড়াশুনার সাথে সাথে বাইরের বই পড়ার নেশা জেগে ওঠে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ছেলেবেলায় আমি ছিলাম ঠিক যেন এক উটপাখি। কোনো কিছু বাছবিচার না করেই আমি যা পেতাম তাই পড়ে ফেলতাম।
বিশিষ্ট কবি পাবলো নেরুদার শান্তিয়াগোতে আগমন
নেরুদা-র পিতার ইচ্ছা ছিল ছেলে বড় হয়ে যেন সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক অগ্রণী পুরুষ হয়ে ওঠে। তাই ষোল বছর বয়েসে নেরুদাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল শান্তিয়াগোতে। সেই সময় কিশোর কবি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নেরুদা।
পাবলো নেরুদার সাহিত্য জীবনে গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালের ভূমিকা
তাঁর সাহিত্য জীবনে স্থানীয় মেয়েদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালের ভূমিকা বিরাট। মিস্ত্রাল শুধু চিলির নন, বিশ্বসাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি। তাঁর অসামান্য সৃষ্টির জন্য নোবেল পুরস্কার পান। মিস্ত্রাল নেরুদার মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ কবির সম্ভাবনাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি শুধু তাঁকে উৎসাহিত করতেন তাই নয়, নিয়মিত তাঁর কবিতা সংশোধন করে দিতেন।
বিশিষ্ট কবি পাবলো নেরুদার ছন্নছাড়া ভাব
১৯২১ সালে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নেরুদা এলেন সান্তিয়াগোতে। চিলির অন্যতম প্রধান শহর। সাহিত্য-সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল। এখানে এসে ফরাসী ভাষা শিখতে আরম্ভ করলেন। কলেজে ভর্তি হলেন কিন্তু পড়াশুনায় তেমন মন নেই। কেমন ছন্নছাড়া ভাব।
পাবলো নেরুদার ছদ্মনাম গ্ৰহণ
অল্পদিনের মধ্যেই কয়েকজন তরুণ কবির সাথে পরিচিত হলেন। তাঁর কবিতা তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে আরম্ভ হয়েছে। এই সময়েই তিনি পিতৃ নাম পরিত্যাগ করে ‘পাবলো নেরুদা’ এই ছদ্মনাম গ্রহণ করেন।
বিশিষ্ট কবি পাবলো নেরুদার জীবনে সুন্দরী তরুণীর আগমন
- (১) কবি হিসাবে যখন সাহিত্য রসিকদের দৃষ্টি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, নেরুদার জীবনে এল এক সুন্দরী তরুণী আলবার্তিনা। দীর্ঘ দিন তার পরিচয় গোপন রেখেছিলেন নেরুদা। প্রথম প্রেমের মুকুল বিকশিত হয়নি। অল্পদিনের মধ্যেই দুজনের সম্পর্কে ভাঙন ধরল।
- (২) জীবন থেকে হারিয়ে গেলেও আলবার্তিনাকে কবি অমর করে রেখেছেন তাঁর অসাধারণ সব প্রেমের কবিতায়। এই কবিতাগুলি নিয়ে ১৯২৪ সালে কুড়ি বছর বয়সে প্রকাশিত হল Twenty Love poems. এর আগে আর একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছিলেন Twilight Book. সেই বইটি তেমন কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি।
পাবলো নেরুদার কুড়িটি প্রেমের কবিতা
তার “কুড়িটি প্রেমের কবিতা” বইটি প্রকাশিত হতেই চারদিকে আলোড়ন পড়ে গেল। প্রচলিত ধারাকে অনুসরণ করলেও এর আঙ্গিক, ভাব, ভাষায় নিয়ে এলেন পরিবর্তন। আনন্দ-বেদনার সুরের মূর্ছনা এতে এমনভাবে পরিস্ফুট হয়েছে সহজেই পাঠকের অন্তরকে স্পর্শ করে কবি হিসাবে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
বিশিষ্ট কবি পাবলো নেরুদার উপন্যাস রচনা
১৯২৬ সালে প্রকাশিত হল দুটি রচনা। এক বন্ধুর সাথে যৌথভাবে একটি ছোট উপন্যাস। আর একটি কবিতার বই Venture of Infinite man-এর প্রতিটি কবিতায় প্রচলিত সমস্ত প্রথা ভেঙে নিয়ে এলেন নতুন আঙ্গিক, ছন্দ। মানব চরিত্রের এক অস্থিরতা, নিঃসঙ্গতাই এখানে যেন প্রকট হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ কিন্তু এই বইটিকে গ্রহণ করতে পারল না।
পাবলো নেরুদার আর্থিক অনটন
ছেলে পড়াশুনা বন্ধ করে কবিতা লিখছে এই ব্যাপারটি ভাল লাগল না নেরুদার বাবার। তিনি সমস্ত মাসোহারা বন্ধ করে দিলেন। মহা ভাবনায় পড়ে গেলেন নেরুদা। তিনটি বই বার হলেও তার থেকে সামান্যই অর্থ পেয়েছেন। অর্থ ছাড়া কেমন করে নিজের খরচ মেটাবেন। পিতার কাছে হাত পাততে মন সায় দিল না।
বিশিষ্ট কবি পাবলো নেরুদার চাকরির চেষ্টা
- (১) এরপর শুরু হল চাকরির চেষ্টা। কয়েক মাস চেষ্টা করেও কোথাও চাকরি পেলেন না। সেই সময় চিলির বিদেশ দপ্তর থেকে রেঙ্গুন অফিসে পাঠাবার জন্য একজন লোকের খোঁজ করা হচ্ছিল।
- (২) কোনো লোকই সেখানে যেতে চায়নি। কয়েক হাজার মাইল দূরে বার্মার রেঙ্গুন তখন ব্রিটিশ অধিনস্ত বার্মার রাজধানী। এখানে পরিচিত কোনো মানুষ নেই। স্থানীয় মানুষেরা কেউ স্প্যানিশ ভাষা জানে না। অফিসের দু-চারজন যেটুকু ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ জানে তাতেই কোনো রকমে কথাবার্তা চালান।
- (৩) অসহনীয় পরিবেশ, কথা বলবার লোক নেই, তার উপর সব মাসে ঠিক মত মাইনে পান না, তবুও রেঙ্গুনে রয়ে গেলেন। এই নির্জন প্রবাসে তাঁর একমাত্র সঙ্গী কবিতা।
পাবলো নেরুদার বার্মার জীবন
- (১) চার বছর কেটে গেল। স্থানীয় ভাষা মোটামুটি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন নেরুদা। অনেক বার্মিজ পরিবারের লোকজনের সাথেই তাঁর আলাপ পরিচয় ছিল। এদের মধ্যে ছিল এক তরুণী। তার মধ্যেকার উদ্দামতা দেখে ভাল লেগে গিয়েছিল। প্রেমে পড়ে গেলেন।
- (২) কিছু দিন যেতেই নেরুদা অনুভব করলেন মেয়েটির মধ্যে আছে এক আদিম বন্য উদ্দামতা। মনের মধ্যে যদি কখনো সন্দেহ দেখা দেয়, সাথে সাথে ছুরি দিয়ে হত্যা করবে নেরুদাকে। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন নেরুদা।
- (৩) সৌভাগ্যক্রমে সেই সময় সিংহলে তাঁর বদলির আদেশ হল। কাউকে কিছু না জানিয়ে রওনা হলেন সিংহল। মেয়েটি নেরুদার সন্ধান পাওয়ার জন্য সিংহল পর্যন্ত গিয়েছিল। তার এই বন্য প্রেমকে নেরুদা বহু কবিতায় অবিস্মরণীয় রূপ দিয়েছেন।
- (৪) বার্মার জীবনের নিঃসঙ্গতাকে ভুলতে বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। এই কবিতাগুলি সংকলন করেই পরে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ Residence on earth (পৃথিবীতে বাসা)।
বিশিষ্ট কবি পাবলো নেরুদার বিবাহিত জীবন
- (১) সিংহলে অল্প কিছুদিন থাকার পর এলেন বাটাভিয়ায়। প্রবাস জীবনে একাধিক মেয়ের সান্নিধ্যে এলেও কাউকে বিবাহ করবার কথা ভাবেননি। বাটাভিয়াতে প্রথম ডাচ তরুণী মারিয়া এস্তোনিয়েতাকে দেখে বিবাহ করবার কথা মনে হল।
- (২) একদিন সরাসরি মারিয়াকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। সম্মত হল মারিয়া। প্রথম কয়েক মাস সুখেই কেটে গেল। মারিয়া ডাচ মেয়ে, স্প্যানিশ ভাষা জানত না।
- (৩) নেরুদার চেষ্টা সত্ত্বেও স্প্যানিশ ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে তার সামান্যতম আগ্রহ ছিল না। নেরুদার কবিতার ব্যাপারেও ছিল উদাসীন। দুজনের মধ্যেকার মতাদর্শগত পার্থক্য, দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠতে থাকে।
পাবলো নেরুদার নোবেল পুরস্কার লাভ
তিনি ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
সকল ভাষার মহান কবি পাবলো নেরুদা
কলম্বিয়ার ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ একদা তাঁকে “বিংশ শতাব্দীর সকল ভাষার মহান কবি” হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
পিতার কাছে পাবলো নেরুদার প্রত্যাবর্তন
বাটাভিয়াতে থাকতে মন চাইল না, ফিরে এলেন তেমুকোতে বাবার কাছে। ছেলেবেলাতে দেখা তেমুকোর অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। সেই বনভূমি নির্জন প্রকৃতি আর নেই, সেখানে গড়ে উঠেছে শহর, কত অসংখ্য মানুষের আবাসস্থল। এখানকার মানুষের সাথে বহুদিন কোনো যোগাযোগ নেই। নিজেকে যেন পরবাসী বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন।
পাবলো নেরুদার মৃত্যু
তেমুকোতে বন্দী অবস্থায় ১২ দিন পর ২৩শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে মারা গেলেন কবি।
পাবলো নেরুদার আবক্ষ মূর্তি
অরগানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস ভবনের চত্বরে নেরুদার একটি আবক্ষ মূর্তি অবস্থিত।
উপসংহার :- পাবলো নেরুদার মৃত্যুতে সামরিক শাসনের সমস্ত নিষেধ উপেক্ষা করে পথে বার হল লক্ষ লক্ষ মানুষ কবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবার জন্য। স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সেই তাদের প্রথম প্রতিবাদ।
(FAQ) চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
একজন চিলীয় কবি, কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদ।
আমেরিকার চিলিতে।
১২ই জুলাই ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে।
বিশটি কবিতা ভালোবাসার একটি গান হতাশার।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে।
২৩শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ সালে।