মুন্সী প্রেমচন্দ (১৮৮০-১৯৩৬) হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে পরিচিত। তাঁর রচনায় সমাজের অবহেলিত ও শোষিত মানুষের জীবনচিত্র অত্যন্ত জীবন্তভাবে উঠে আসে। প্রেমচন্দ তাঁর গল্প ও উপন্যাসে সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, শোষণ এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। তাঁর বিখ্যাত রচনাগুলোর মধ্যে “গবন”, “কর্মভূমি”, “গোধান”, এবং “নমক কা দারোগা” উল্লেখযোগ্য।
সাহিত্যিক মুন্সী প্রেমচন্দ
ঐতিহাসিক চরিত্র | মুন্সী প্রেমচন্দ |
পূর্ণ নাম | ধনপত রায় শ্রীবাস্তব (ছদ্মনাম: মুন্সী প্রেমচন্দ) |
জন্ম | ৩১ জুলাই ১৮৮০, লমহি গ্রাম, বারাণসী, ব্রিটিশ ভারত |
সাহিত্যধারা | বাস্তববাদ, মানবতাবাদ |
উল্লেখযোগ্য রচনা | গোধান, গবন, কর্মভূমি, ঈদগাহ, পঞ্চপরমেশ্বর |
ভাষা | হিন্দি ও উর্দু |
পেশা | শিক্ষক, লেখক, সম্পাদক |
বিষয়বস্তু | সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, শোষণ, স্বাধীনতা সংগ্রাম |
সাহিত্যিক প্রভাব | লিও তলস্তয়, চেখভ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় |
সাহিত্য জীবনের সূচনা | উর্দু রচনায়, পরে হিন্দিতে সাহিত্য রচনা |
সাহিত্যিক পদবি | “উপন্যাস সম্রাট” (উর্দু ও হিন্দি সাহিত্যে) |
ভূমিকা :- দেশ কালের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বসাহিত্যের যে মহান স্রষ্টাদের নাম উচ্চারিত, মুন্সী প্রেমচন্দ তাঁদের একজন। তাঁর রচনায় ব্যক্ত হয়েছে সর্বকালের সর্বহারা নিঃস্ব মানুষদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা আর সহানুভূতি মানবতার এই অকৃত্রিম মহান শিল্পী হিন্দী ভাষায় সাহিত্য রচনা করলেও, তাঁর রচনা আজ বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
মুন্সী প্রেমচন্দের জন্ম
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে জুলাই বারাণসীর লমহী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মুন্সী প্রেমচন্দ। বাবা ছিলেন ডাক বিভাগের সামান্য একজন কর্মচারী। মা ছিলেন অসুস্থ। এমনি এক পরিবেশেই বড় হয়ে উঠেছিলেন প্রেমচন্দ।
কবি মুন্সী প্রেমচন্দের নাম
তার প্রকৃত নাম ধনপত। মা-বাবা ডাকতেন নবাব। কিন্তু বর্তমানে যে নামে তিনি পরিচিত তা হল প্রেমচন্দ। পরিণত বয়সে সাহিত্য সৃষ্টির সময়ে তিনি গ্রহণ করেন এই নাম।
সৎমায়ের সাথে মুন্সী প্রেমচন্দের ছেলেবেলা
আট বছর বয়সে মা মারা গেলে তার বাবা পুনরায় বিয়ে করলেন। সৎমায়ের সঙ্গে শিশু প্রেমচন্দের সম্পর্ক মোটেই ভাল ছিল না। সংসারে একরকম নিঃসঙ্গ প্রেমচন্দের শৈশবের একমাত্র সঙ্গী বলতে ছিল তাঁর বড়দিদি। বিয়ে হয়ে দিদি শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে কিশোর প্রেমচন্দ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। সংসারে স্নেহ পাবার মতো আর কেউ ছিল না। কর্মক্ষেত্রে ব্যাস্ত থাকতেন বলে বাবার সঙ্গও তিনি পেতেন না। তাছাড়া বাবা ছিলেন অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ।
গ্রামের পাঠশালায় মুন্সী প্রেমচন্দ
সাত বছর বয়সে তাঁকে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। এক মৌলভীর কাছে শিখেছেন ফারসী আর উর্দু।
বাবার সঙ্গে প্রেমচন্দের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ
কর্মসূত্রে বাবা মাঝে মাঝে নানা স্থানে বদলি হয়ে যেতেন। বাবার সঙ্গে প্রেমচন্দও গেছেন বান্দা, আজমগড়, কানপুর, গোরখপুর, লক্ষ্ণৌ। মাঝে মাঝে এই পরিবেশ পরিবর্তন প্রেমচন্দ খুব পছন্দ করতেন। পরিবেশের বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছিল তাঁর কিশোর মন। পরবর্তীকালে এই অভিজ্ঞতা তাঁর রচনাকে পুষ্ট করেছে।
বুদ্ধিলালের সাথে প্রেমচন্দ
শাসনহারা কিশোর বয়সে অনিবার্যভাবেই প্রেমচন্দের জীবনে জুটেছিল কিছু বদ সঙ্গী। সঙ্গীদের প্রভাবে তাঁর জীবন হয়তো অন্য খাতেই প্রবাহিত হত, যদি না সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হত বুদ্ধিলালের। বুদ্ধিলাল ছিল বই-এর দোকানদার। শিশু বয়স থেকেই প্রচন্ড বই পড়ার নেশা ছিল প্রেমচন্দর। হিন্দী জানতেন না। তাই বুদ্ধিলালের দোকানে এসে তিনি পড়তেন উর্দু ভাষার বই। এইভাবে অল্প বয়সেই সমৃদ্ধ উর্দু ভাষার অনেক বিখ্যাত উপন্যাস তাঁর পড়া হয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধিলালের দোকানে প্রেমচন্দ বই পড়ার সুযোগ পেতেন, কিন্তু তার বদলে তাঁকে করে দিতে হত কিছু কাজ। বুদ্ধিলালের দেওয়া ইংরাজি স্কুলের বই তাঁকে স্কুলে স্কুলে ঘুরে বিক্রি করতে হত।
সংসারের দায়িত্বে মুন্সী প্রেমচন্দ
পনেরো বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করা হল প্রেমচন্দকে। কিন্তু নবম শ্রেণীতে ওঠার আগেই বাবা তাঁর বিয়ে দিয়ে বাড়িতে ছেলের বৌ নিয়ে এলেন। বিয়ের কিছুদিন পরেই মারা গেলেন বাবা। ফলে একেবারে অসহায় হয়ে পড়লেন প্রেমচন্দ। সৎমা, দুটি সৎভাই আর নিজের বালিকা বউ নিয়ে গোটা সংসারের দায়-দায়িত্ব চাপল তাঁর কাঁধে
কলেজে ভর্তি হতে ব্যর্থ মুন্সী প্রেমচন্দ
বাবার আকস্মিক মৃত্যুর কারণে সেই বছর পরীক্ষায় বসা হল না। পরের বছর পাশ করলেন দ্বিতীয় বিভাগে, কিন্তু ফেল করেছিলেন অঙ্কে। আর্থিক অনটন ও অঙ্কে ফেল থাকার জন্য তিনি কোন কলেজেই ভর্তি হতে পারলেন না।
শহরে এলেন মুন্সী প্রেমচন্দ
অভাব অনটনে সংসার তখন ধুঁকছে। নিরুপায় হয়ে প্রেমচন্দ এলেন শহরে। এক উকিলের বাড়িতে বাচ্চাদের পড়াবার কাজ নিলেন। মাইনে ছিল পাঁচ টাকা। দুটাকা নিজের কাছে রেখে তিনি তিন টাকা পাঠিয়ে দিতেন বাড়িতে। সেই উকিলের বাড়িতেই বাইরের একটা ছোট ঘরে তিনি থাকতেন। দু’টাকাতে সারা মাস পেট ভরে খাওয়া জুটতো না। ভাল কাপড় জামাও ছিল না।
স্কুল শিক্ষক মুন্সী প্রেমচন্দ
একদিন খাবার কেনার মতো পয়সা হাতে ছিল না। ঠিক করলেন একটা বই বিক্রি করে দেবেন। বাধ্য হয়ে অঙ্কের বইটা নিয়ে গেলেন বাজারের একটা বইয়ের দোকানে। সৌভাগ্যবশতঃ সেখানে আলাপ হল এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে। তিনি ছিলেন একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রেমচন্দের সঙ্গে কথা বলে তার দুরবস্থার কথা জানতে পেরে দয়াপরবশ তিনি তাঁকে নিজের স্কুলে শিক্ষকের চাকরি দিলেন। মাইনে ছিল আঠারো টাকা। প্রেমচন্দের কর্মস্থল ছিল চুনারে। বারাণসী থেকে দূরত্ব চল্লিশ মাইল। কিন্তু স্কুলের পরিবেশ ছিল শান্ত নির্জন। এই পরিবেশে এসে তাঁর নিরীহ ভাবুক মন যেন ডানা মেলার অবকাশ পেল।
সাহিত্যচর্চার অবকাশ পেলেন মুন্সী প্রেমচন্দ
শিক্ষক হিসেবে প্রেমচন্দ ছাত্রদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। এখানে কর্মরত অবস্থাতেই তিনি কুইন্স কলেজের প্রিন্সিপাল মিঃ বেকনের সাহায্যে একটি সরকারী স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে যান। এবারে এলো কিছুটা নিশ্চয়তা। ফলে নিভৃতে সাহিত্যচর্চার অবকাশ পেলেন।
মুন্সী প্রেমচন্দের প্রথম উপন্যাস রচনা
কুড়ি বছর বয়সেই তিনি উর্দুতে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। একটি ছোট পত্রিকায় আসবাব-ঈ-মাবিদ নামে সেটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই লেখায় ছিল স্বপ্নচারী কল্পনাবিলাসী মনের ছোঁওয়া। কিন্তু এর পর নিজের কঠোর জীবন-সংগ্রাম ও বাস্তবের রুঢ় আঘাত তাঁর চিন্তায় আনল আমূল পরিবর্তন।
কবি মুন্সী প্রেমচন্দের বাস্তবমুখী রচনা
জীবনের চলার পথে তিনি লাভ করেছিলেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। কৃষক, শ্রমিক, কুলী, শিক্ষক, ছাত্র-এদের জীবন ও যন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন কাছে থেকে। তাই তাঁর হাদয়ের সহানুভূতি সবটুকুই দখল করেছিল সমাজের নিচুতলার অবহেলিত নির্যাতিত মানুষেরা। তাদের সুখ দুঃখ আশা-আকাঙক্ষা এবারে উপজীব্য হল তাঁর রচনার। ফলে বাস্তবমুখী রচনার এক নতুন ধারার প্রবর্তন করতে সক্ষম হলেন তিনি ভারতীয় সাহিতে। ইতিপূর্বে ভারতীয় সাহিত্যে আর কারও রচনাতেই বাস্তবের এমন বাঙময় রূপ প্রকাশ লাভ করে নি।
প্রেমচন্দের প্রেমা উপন্যাস
এক বাল্যবিধবার দুঃখময় জীবনের কাহিনী নিয়ে লেখা প্রেমচন্দের প্রেমা উপন্যাস প্রকাশিত হল ১৯০৭ খ্রিঃ। সেই রচনায় তিনি বিধবাবিবাহকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় তাঁর এই পদক্ষেপ ছিল অসমসাহসিক।
কবি প্রেমচন্দের ছোটগল্প সংকলন মজ-ঈ-ওতান
প্রেমা প্রকাশের দু’বছর পরে প্রকাশিত হল তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্প সংকলন মজ-ঈ-ওতান। এই রচনাগুলির মধ্যে প্রকাশ পেল ইংরাজ সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বলাবাহুল্য, ইংরাজ শাসনাধীন থেকে ইংরাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারণ করার জন্য তিনি নিয়েছিলেন নবাব রাই ছদ্মনাম। ছোটগল্পের এই সংকলনটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পড়লেন তিনি ইংরাজ সরকারের রোষ দৃষ্টিতে। বাজেয়াপ্ত হল মজ-ঈ-ওতান (মাতৃভূমির ব্যথা)।
সংগ্রামী মানুষ প্রেমচন্দ
নিরীহ গোবেচারা চেহারার মানুষ প্রেমচন্দের ভেতরে ছিল এক অদম্য সাহসী ও তেজী মানুষ। আঘাত পেয়ে এবারে জেগে উঠল অন্তস্থিত সেই সংগ্রামী মানুষটি। নাম পাল্টে, প্রেমচন্দ নামে লিখতে শুরু করলেন তিনি।
মুন্সী প্রেমচন্দের গোসা-ঈ-আফিয়াত উপন্যাস
দেশের ও বিদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন প্রেমচন্দ। রুশ বিপ্লব-এর সংবাদ তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। এই সময়ে তাঁর চিন্তাভাবনায়ও যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর গোসা-ঈ-আফিয়াত উপন্যাসে।
সাহিত্য রচনায় মুন্সী প্রেমচন্দের অক্লান্ত পরিশ্রম
স্কুল আর সাহিত্য রচনার মধ্যেই প্রেমচন্দের জীবন ক্রমশ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়তে লাগল। স্কুল থেকে বিকেলে বাড়ি ফিরে এসে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে তিনি বসতেন লিখতে। কখনো রাত জেগে লেখার কাজ করতেন। সংসারের টুকটাক কাজে যেটুকু সময় ব্যয় হত তা তিনি পুষিয়ে নিতেন রাত জেগে কাজ করে। এ ভাবেই অক্লান্ত পরিশ্রমে সাহিত্য রচনার কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন তিনি।
মুন্সী প্রেমচন্দের অতি সাধারণ জীবনযাত্রা
দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা যন্ত্রণা-জ্বালা অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলেন প্রেমচন্দ। তাই তিনি সমাজের একজন হিসেবে নিজেও বেছে নিয়েছিলেন অতি সাধারণ জীবনযাত্রা। তাঁর জীবনে ছিল না সুখ ভোগ বা বিলাসিতার বিন্দুমাত্র স্থান। এই সরল সাধারণ জীবনই ছিল তাঁর হাতিয়ার আর ছিল তাঁর গভীর আত্মবিশ্বাস। যাকে সত্য বলে মনে করতেন তা প্রকাশ করতে কখনো দ্বিধা করতেন না। ঋজু প্রতিবাদে তাই লেখনী হয়ে উঠেছিল ক্ষুরধার তরবারির মতো।
স্বাধীনতার আন্দোলনে মুন্সী প্রেমচন্দ
সমসাময়িক সময়ের সামাজিক রাজনৈতিক সঙ্কট, আন্দোলন ও জনমতের বাস্তবচিত্র রূপায়িত হয়েছে তাঁর রচনায়। দেশাত্মবোধক ছোট গল্প ছাড়া দুটি উপন্যাসও লিখেছিলেন প্রেমচন্দ। তার একটি জলবা-ঈ-ইশার। অন্যটি বাজার-ঈ-হুসন। প্রথম উপন্যাসটি ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসের অনুসরণে লেখা। সেই সময় ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। জনজাগরণের উদ্দেশ্যে গান্ধীজি ঘুরছেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। সেই পরিক্রমায় তিনি এলেন গোরখপুরে। সময়টা ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ। গান্ধীজির বক্তৃতা শুনে উদ্বুদ্ধ হলেন প্রেমচন্দ। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ইংরাজ সরকারের চাকরি ছেড়ে সামিল হবেন স্বাধীনতার আন্দোলনে।
পত্রিকার সম্পাদক মুন্সী প্রেমচন্দ
ইংরাজের গোলামি আর করবেন না বলে সরকারী স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেন তিনি। জোগাড় হল একটি পত্রিকার সম্পাদকের চাকরি। এই কাজে তাঁকে একা হাতেই প্রচুর কাজ করতে হত বলে সারাক্ষণ প্রচন্ড চাপের মধ্যে কাটত। বাধ্য হয়ে কিছুদিন পরে এই কাজ ছেড়ে দিতে হল। এভাবে নিজেই প্রকাশ করলেন হংস আর জাগরণ নামে দুটি পত্রিকা। কিন্তু ব্যবসা চালাবার মত ব্যবসায় বুদ্ধি তাঁর ছিল না। তার ওপরে ছিল আর্থিক সংকট। ফলে হাজারো ঝামেলায় তাঁকে সারাক্ষণ উত্যক্ত থাকতে হত।
জীবন-শিল্পী প্রেমচন্দ
কিন্তু অদম্য ছিল তাঁর প্রাণশক্তি। দিনভর সমস্ত সমস্যা সামলে রাতের নিভৃতে বসতেন কলম নিয়ে। তখন আর তিনি পত্রিকার মালিক সম্পাদক নন। তখন তিনি জীবন-শিল্পী প্রেমচন্দ। তাঁর মধ্যে জেগে উঠত নিপীড়িত মানুষের হাহাকার, পরাধীনতার জ্বালা।
প্রেমচন্দের সাহিত্যকর্মের উল্লেখযোগ্য পর্ব
বস্তুতঃ কর্মব্যস্তময় জীবনের এই সময়টাই ছিল প্রেমচন্দের সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের উল্লেখযোগ্য পর্ব। প্রতিজ্ঞা, নির্মলা, কায়কর, রঙ্গভূমি-একের পর এক উপন্যাস প্রকাশিত হয়ে চলল। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কর্মভূমি প্রকাশিত হল ১৯৩১-৩২ খ্রিঃ। তাঁর এই উপন্যাসে বিধৃত সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া। প্রতিটি রচনা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বাড়তে লাগল প্রেমচন্দের খ্যাতি যশ। তিনি সমস্ত কিছুই গ্রহণ করলেন অতি স্বাভাবিকভাবে।
হিন্দী সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক প্রেমচন্দ
তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে। আর তা হল জাতীয় আন্দোলনে জয় লাভ-ভারতবর্ষের মুক্তি। দেশের বৃহত্তম মানুষের কাছে নিজের রচনা পৌঁছে দেবার তাগিদেই তিনি পরিবর্তন করেছিলেন ভাষার মাধ্যম। কর্মভূমি উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই প্রেমচন্দ হয়ে উঠলেন হিন্দী সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত লেখক।
বস্তুনিষ্ঠ রূপকার প্রেমচন্দ
নির্যাতিত মানুষের জ্বালা-যন্ত্রণা সুখ-দুঃখের কথার বস্তুনিষ্ঠ রূপকার ছিলেন প্রেমচন্দ। তাঁর রচনায় ছিল সাম্যবাদের আদর্শ। কিন্তু তিনি নিজেকে কখনো সাম্যবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেন নি। যদিও পরবর্তীকালে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন প্রগতিশীল লেখক সংঘের সঙ্গে। এই সংঘের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে তিনি বলেছিলেন, “যিনি দলিত, অবহেলিত, শোষিত মানুষের পক্ষে সাহিত্য রচনা করেন, তিনিই সমাজের সৌন্দর্য চেতনা ও ন্যায়বোধের প্রকাশ ঘটান।” প্রেমচন্দের এই বোধেরই প্রকাশ ঘটেছে তাঁর ছোটগল্পগুলির মধ্যে।
প্রেমচন্দের শ্রেষ্ঠ গল্প
জীবনরসে সিক্ত তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পগুলি হল, পিসনহারীর কুয়া, সতরঞ্জ কি খিলাড়ি, কফন, সদ্গতি, নিমকের দারোগা প্রভৃতি। প্রেমচন্দের প্রতিভা হিন্দী ছোটগল্পকে উন্নীত করেছে বিশ্বমানে।
চিত্রনাট্য লেখক প্রেমচন্দ
বাস্তবজীবনে নিতান্ত বেহিসেবী মানুষ প্রেমচন্দকে দুটি পত্রিকা চালাতে গিয়ে প্রচুর দেনার দায়ে জড়িয়ে পড়তে হল। ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। এই সময়ে নিতান্ত অর্থের প্রয়োজনেই সিনেমার চিত্রনাট্য লেখার একটি চাকরি নিলেন তিনি। তবে চুক্তি করলেন একবছরের জন্য, বম্বে হল তাঁর কর্মস্থল। নতুন কাজে নতুন জায়গায় এসে সম্মান অর্থ সবই পেলেন প্রেমচন্দ। কিন্তু এখানকার পরিবেশের কৃত্রিমতা আর অনাবশ্যক আড়ম্বর তাঁর মানসিক পীড়ার সৃষ্টি করল। তাছাড়া, সিনেমা শিল্পের অন্দর মহলের যে পরিচয় তিনি পেলেন তাও ছিল তাঁর চিন্তা ও আদর্শের পরিপন্থী।
মুন্সী প্রেমচন্দের চিঠি
এ সময়ে একটি চিঠিতে তাঁর এই মনোভাব স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে। তিনি লিখেছেন, “চলচ্চিত্রের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ যারা করেন তাদের কাছে এটি ব্যবসা ছাড়া কিছু নয়। শিল্প, জনরুচি বা সংস্কার নিয়ে এরা মাথা ঘামায় না। এরা শুধু শোষণ করে আর জনগণের অনুভূতিকে নষ্ট করে।” আর একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “আমাকে বম্বে ছেড়ে আগের জায়গায় ফিরে যেতে হবে। আমার শুধু মনে হচ্ছে আমি জীবনটাকে নষ্ট করছি।”
গ্রামে ফিরে আসেন মুন্সী প্রেমচন্দ
এক বছরের চুক্তি শেষ করেই বম্বের সিনেমা জগতের শৃঙ্খল কেটে বেরিয়ে এলেন প্রেমচন্দ। সামনে টাকা ও অর্থের জোরালো প্রলোভন ছিল। কিন্তু সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে তিনি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ৪ঠা এপ্রিল বোম্বে ত্যাগ করে ফিরে এলেন নিজের গ্রামে।
প্রেমচন্দের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস
এতদিনে মানসিক স্বস্তি ফিরে পেলেন তিনি। গো-দান উপন্যাসের প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। এবারে গ্রামের বাড়িতে বসে শুরু করলেন লেখা। প্রেমচন্দের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস গো-দান। এই উপন্যাসে তিনি চিত্রিত করেছেন এক দরিদ্র সৎ কৃষকের চরম কষ্ট সংগ্রামের রক্তক্ষরা কাহিনী। তারই পাশাপাশি আছে গ্রামীণ সমাজে ধনী মহাজন জোতদারদের নির্মম শোষণের বাস্তব চিত্র। প্রেমচন্দের প্রতিভার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে গো-দান উপন্যাসে। বঞ্চিত হতভাগ্য মানুষের প্রতি মমতা সহানুভূতি এবং পরধনপুষ্ট ধনীক সম্প্রদায়ের প্রতি সুতীব্র ঘৃণা-প্রেমচন্দের মহতী প্রতিভার স্পর্শে গো-দান উপন্যাস হয়ে উঠেছে সর্বজনীন, সর্বকালিক।
মুন্সী প্রেমচন্দের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে গো-দান প্রকাশের পরে তিনি মঙ্গলসূত্র রচনায় বসেন। প্রেমচন্দের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস এটি। কিন্তু দুঃখের বিষয় উপন্যাসটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তার আগেই তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
প্রগতিবাদী লেখক সংঘের প্রথম সম্মেলনে মুন্সী প্রেমচন্দ
সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে প্রেমচন্দকে। ভোগ করতে হয়েছে অসম্ভব মানসিক চাপ। তাই ক্রমশই শরীর পড়ছিল ভেঙ্গে। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে নবগঠিত ভারতীয় প্রগতিবাদী লেখক সংঘের প্রথম সম্মেলন বসে লক্ষ্ণৌ শহরে। প্রেমচন্দ নির্বাচিত হয়েছিলেন এই সম্মেলনের সভাপতি। তরুণ লেখকদের উদ্দমকে উৎসাহিত করবার জন্য অসুস্থ শরীর নিয়েই সম্মেলনে উপস্থিত হলেন প্রেমচন্দ। সেই সম্মেলনে দেশের তরুণদের আহ্বান জানিয়ে তিনি বললেন, ‘সাহিত্য সৃষ্টির মূল প্রেরণা হওয়া উচিত মহৎ আদর্শ। মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত সমাজের কল্যাণ।”
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে মুন্সী প্রেমচন্দের ভ্রমণ
হিন্দী ও উর্দু-দুই ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করেছেন প্রেমচন্দ। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এই দুই ভাষার সুসামঞ্জস ঐক্য ও মিলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। এই উদ্দেশ্যে তিনি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছেন। শরীর অশক্ত হয়ে পড়েছিল। তবু সাহিত্য রচনার বিরাম ছিল না। তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ের লেখা ছোটগল্প কফন, কেবল ভারতীয় সাহিত্যের নয়, বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প।
বেদনাহত মুন্সী প্রেমচন্দ
কিন্তু যে তিক্ত অভিজ্ঞতা সহ তিনি শেষ পর্যন্ত নিরস্ত হয়েছিলেন তা তাঁর কাছে ছিল এক চরম আঘাত। কেউই চায় না মিলন, বিরোধই কাম্য সকলের-এই ছিল তার অভিজ্ঞতা। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে চতুর্দিকে সমাজের অবক্ষয় দেখে বেদনাহত হয়েছিলেন মুন্সী প্রেমচন্দ। তাই স্বগত উক্তির স্বরে যেন সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন,”. চারদিকে জন্তু-জানোয়ার আছে বলেই আমাদের সশস্ত্র হতে হবে, আমাদের ছিঁড়ে খেতে দেওয়া মহত্ত্ব নয়, বোকামি।”
মুন্সী প্রেমচন্দের মৃত্যু
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসের শেষ দিক থেকে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। অসহ্য রোগযন্ত্রণা ভোগের পর ৮ই অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়। সহজ সরল জীবনের মতোই মৃত্যুকেও সহজ ভাবেই গ্রহণ করেছিলেন ভারতীয় সাহিত্যের এই কালজয়ী প্রতিভা।
উপসংহার :- সমগ্র জীবন দুটি সত্তা বহন করেছেন কথাশিল্পী প্রেমচন্দ। তার একটি হল, সাম্যবাদের প্রতি সমর্থন। অপরটি ধনতন্ত্রের প্রতি ঘৃণা। তাঁর সমস্ত রচনাতেই ঘুরে ফিরে এই দুই সুরই বারবার বহু বিচিত্র ধারায় উচ্চারিত হয়েছে।
(FAQ) মুন্সী প্রেমচন্দ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মুন্সী প্রেমচন্দ তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সমাজের শোষিত, বঞ্চিত, এবং দরিদ্র মানুষের জীবনের বাস্তবচিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর রচনায় ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন সমস্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যা তাঁকে হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক করে তুলেছে।
তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে “গোধান”, “গবন”, “কর্মভূমি”, “ঈদগাহ”, “পঞ্চপরমেশ্বর” ইত্যাদি বিখ্যাত।
মুন্সী প্রেমচন্দের আসল নাম ছিল ধনপত রায় শ্রীবাস্তব।
প্রেমচন্দ মূলত সামাজিক সমস্যাবলী, দারিদ্র্য, শোষণ, এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে বাস্তবধর্মী এবং মানবতাবাদী সাহিত্য রচনা করতেন।
প্রেমচন্দের সাহিত্যিক প্রভাবের মধ্যে রাশিয়ান লেখক লিও টলস্টয় এবং চেখভ, এবং ভারতীয় লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রভাব লক্ষণীয়।
মুন্সী প্রেমচন্দ ১৮৮০ সালের ৩১ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের বারাণসী জেলার লম্হি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যে প্রেমচন্দকে “উপন্যাস সম্রাট” হিসেবে অভিহিত করা হয়।