একজন জার্মান সুরকার এবং পিয়ানোবাদক ছিলেন লুডউইগ ভন বিটোভেন (১৭৭০–১৮২৭), যাকে সঙ্গীতের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ক্লাসিকাল ও রোমান্টিক সঙ্গীত যুগের মধ্যে সেতুবন্ধনকারী হিসাবে পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত সিম্ফনি, সোনাটা, এবং কোয়ার্টেট সঙ্গীতশিল্পে এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে। যদিও জীবনের শেষের দিকে তিনি বধির হয়ে যান, তবুও তিনি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনাগুলি এই সময়েই তৈরি করেন। তাঁর সৃষ্টিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নবম সিম্ফনি, মুনলাইট সোনাটা, এবং ফিদেলিও।
সঙ্গীতজ্ঞ লুডউইগ ভন বিটোভেন
ঐতিহাসিক চরিত্র | লুডউইগ ভন বিটোভেন |
জন্ম | ১৬ ডিসেম্বর ১৭৭০ খ্রি |
জন্মস্থান | বন, জার্মানি |
পেশা | সুরকার ও পিয়ানোবাদক |
বিশেষ প্রতিভা | বধিরতা অবস্থাতেও সঙ্গীত রচনা |
বিখ্যাত রচনা | নবম সিম্ফনি, পঞ্চম সিম্ফনি, মুনলাইট সোনাটা, ফিদেলিও |
সঙ্গীত যুগ | ক্লাসিকাল থেকে রোমান্টিক |
মৃত্যু | ২৬ মার্চ ১৮২৭ খ্রি |
লুডউইগ ভন বিটোভেন
ভূমিকা :- বিশ্বের সঙ্গীত শিল্পের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরস্রষ্টা জার্মানীর লুডউইগ ভন বিটোভেনের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাঁর কালজয়ী অসাধারণ সুরমূর্ছনা একদিকে যেমন মানুষকে বিতরণ করে অনাবিল আনন্দ লহরী তেমনি দুঃখ, বেদনা হতাশার ক্ষণে জোগায় সান্ত্বনা ও প্রেরণা। বিশ্ববন্দিত এই সঙ্গীত সাধকের জীবন ছিল বড়ই বেদনাময়। বিধাতার নির্মম পরিহাসে সুর আর শব্দের ছন্দময় সৌন্দর্যের সাধনায় যিনি ছিলেন উৎসর্গীকৃতপ্রাণ, মাত্র ত্রিশ বৎসর বয়সেই তাঁর জীবন থেকে মুছে গিয়েছিল সমস্ত শব্দ। বধিরত্ব তাঁকে নিমজ্জিত করেছিল চির নৈঃশব্দের জগতে। তবুও হার মানেন নি এই মহান শিল্পী। নৈঃশব্দের দুস্তর বেদনায় নিমজ্জিত থেকেও তিনি রচনা করেছেন নতুন নতুন সুর।
ভন বিটোভেনের জন্ম
বিটোভেনের জন্ম জার্মানির বন নগরীর রাইনল্যান্ড নামক স্থানে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর। তাঁর বাবা ও ঠাকুরদা উভয়েই ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ। বাবা জোহন বিটোভেন কোলনের পুরপ্রধানের সভায় বেহালা বাজাতেন।
সঙ্গীতে বিটোভেনের হাতেখড়ি
বিটোভেনের সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর বাবার কাছেই। ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা লাভ করেছিলেন বিটোভেন। তাই সুর আর সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হতেন বাল্য বয়সেই। তাই দেখে মাত্র চার বছর বয়সেই বাবা তাঁকে বসিয়ে দিয়েছিলেন পিয়ানোর সামনে। বাবার নির্দেশে একটা ছোট্ট কুঠুরিতেই বেহালা আর পিয়ানোর সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা রেওয়াজে বন্দি থাকতে হত তাঁকে।
কঠোর শাসনে বিটোভেন
সমবয়সী বন্ধুরা যখন খেয়াল-খেলায় সঙ্গীদের নিয়ে হৈ হুল্লোড় করত ছোট্ট বিটোভেনকে তখন ক্লান্তিহীন ভাবে তাঁর বাদ্যযন্ত্রে বাজাতে হত একঘেয়ে ভাবে। কখনও মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে বাবা তাঁকে বসিয়ে দিতেন রেওয়াজে। ঢুলু ঢুলু চোখে পিয়ানো বাজাতে গিয়ে কিংবা বেহালার হড় টানতে টানতে ভুল হয়ে যেত। বাবার চড় খেয়ে আবার সম্বিৎ ফিরে পেতেন।
রেওয়াজে ব্যস্ত বিটোভেন
জোহন শিশুপুত্রকে দিন রাতের বেশির ভাগ সময়টাই ব্যস্ত রাখতেন রেওয়াজে। ঘন্টার পর ঘন্টা একঘেয়ে সুরে সর গম বাজিয়েও বিরক্ত হবার উপায় ছিল না। এভাবেই বাবার কঠোর শাসন ও শিক্ষার মধ্যে থেকে শিশু শিল্পীর প্রতিভার বিকাশ হতে থাকে।
বিটোভেনের সংসারে অভাব
জোহন ছিলেন প্রচন্ড মদ্যপ। চূড়ান্ত বেহিসেবী ছিল তাঁর জীবনযাত্রা। ফলে সংসারে অভাব অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। সংসারের আয় বাড়াবার উদ্দেশ্যেই সম্ভবতঃ তিনি চেয়েছিলেন পুত্রকে শিশু সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলবেন। যে উদ্দেশ্যই থাক না কেন, সহজাত প্রতিভাবলে অল্প দিনের মধ্যেই শিশু বিটোভেন বাবার সমস্ত শিক্ষা রপ্ত করে নিলেন।
ভন বিটোভেনের শিক্ষা
পুত্রের পড়ালেখার বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না জোহন। কিন্তু জীবনে কাজ চলার মতো সামান্য বিদ্যা পেটে না থাকলে যে চলে না সেই বাস্তবজ্ঞানের অভাব ছিল না তাঁর। তাই একটা সাধারণ স্কুলে তিনি ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন শিশু বিটোভেনকে। সেখানেই তেরো বছর বয়স পর্যন্ত যা কিছু বিদ্যাচর্চা হয়েছিল’ তাঁর।
বিটোভেনের সঙ্গীত শিক্ষা
ভন বিটোভেনের বয়স যখন নয়, সেই সময় তাঁর বাবা তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার ভার দিলেন রাজসভার অর্গানবাদক ক্রিশ্চিয়ান গোৎলব নেফির ওপর। নেফি ছিলেন মনেপ্রাণে সঙ্গীতসাধক। তাই অল্পদিনেই তিনি সঠিক ভাবে বিটোভেনের সঙ্গীত প্রতিভাকে উপলব্ধি করতে পারলেন। তাঁর উপযুক্ত শিক্ষার ফলেই একটি সুশৃঙ্খল ধারায় বিটোভেনের প্রতিভা বিকাশের পথ পেল। ক্রমে তিনি একে একে পরিচিত হলেন সে যুগের শ্রেষ্ঠ সুরকারদের রচনার সঙ্গে। নিজেও উদ্বুদ্ধ হলেন সুর সৃষ্টির প্রেরণায়।
অর্গানবাদক বিটোভেন
মাত্র এগারো বছর বয়সে বিটোভেন তাঁর শিক্ষাগুরু নেফির উৎসাহে রচনা করলেন পিয়ানোর সোনাটো। শিশু শিল্পীর এই অসাধারণ সৃষ্টি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন মহামান্য পুরপ্রধানকে। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে মাত্র বারো বছর বয়সেই বিটোভেন পুরপ্রধানের দববারে সহকারী অর্গানবাদক রূপে যোগদান করেন।
নিষ্ঠাবান বিটোভেন
- (১) সঙ্গীতের বিশুদ্ধতা রক্ষার বিষয়ে বিটোভেন ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। বাল্য বয়সের সঙ্গীত রচনার সময়েও এ বিষয়ে তাঁর সচেতনতার অভাব ছিল না। তাই যখনই যে সুর রচনা করেছেন, তার জন্য তাঁকে করতে হয়েছে কঠোর পরিশ্রম।
- (২) যতক্ষণ পর্যন্ত না সৃষ্ট সুরের মূর্ছনা তাঁকে সন্তুষ্ট করত, ততক্ষণ পর্যন্ত একের পর এক সুর বাতিল করতেন নির্দ্বিধায়। সময়ের দিকে খেয়াল থাকত না। চূড়ান্ত সুরের সন্ধানে মগ্ন হয়ে থাকতেন পিয়ানোর টেবিলে।
- (৩) পছন্দমতো তাল মাত্রা সুর মিলিয়ে একটি পান্ডুলিপির পূর্ণতা আনার জন্য, বিশুদ্ধ ভাবে সঙ্গীতকে ফুটিয়ে তোলার জন্য মাসের পর মাসও ব্যয় করেছেন বিটোভেন। এমনি সুকঠিন অধ্যবসায় বলেই তিনি অর্জন করেছেন সাফল্যের সার্থকতা।
দরবারে অর্গান বাদক বিটোভেন
সঙ্গীতকার ও পিয়ানোবাদক হিসেবে অল্প দিনেই বিটোভেনের নাম ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। স্বীকৃতিও এলো অচিরে। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে নতুন পুরপ্রধান হলেন ম্যাক্স ফ্রাঞ্জ। তরুণ সঙ্গীতশিল্পীকে তিনি নিযুক্ত করলেন দরবারের দ্বিতীয় অর্গান বাদক। মাসিক বেতন ১৫০ ফ্লোরিন। এতদিনে জীবনে প্রথম বেতনভুক পদ পেলেন বিটোভেন।
ভিয়েনায় বিটোভেনে
- (১) তিন বছর যোগ্যতা ও সম্মানের সঙ্গে এই পদে কাজ করার পর। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের পুরপ্রধান তাঁকে পাঠালেন ভিয়েনায়, মোৎজার্টের কাছে সঙ্গীতের নতুন পাঠ নেবার জন্য। প্রথম সাক্ষাতের পর বিটোভেন স্বরচিত তিনটি সঙ্গীত বাজিয়ে শোনালেন মোৎজার্টকে।
- (২) তরুণ শিল্পীর সঙ্গীত শুনে কিন্তু কোন মন্তব্য করলেন না মোৎজার্ট। নিস্পৃহ নির্বিকার মুখে উঠে চলে গেলেন পাশের ঘরে। কিন্তু ভবিষ্যতের বিশ্ববরেণ্য সঙ্গীতপ্রতিভাকে চিনতে ভুল হয় নি মোৎজার্টের।
- (৩) পরে তিনি এক বন্ধুকে বললেন, এই ছেলেটির ওপর তোমরা নজর রাখতে ভুল করো না। ভবিষ্যতে এর সৃষ্টি একদিন পৃথিবীতে আলোড়ন তুলবে। মোৎজার্টের ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি দেখে হতাশ হলেও বিটোভেন তাঁর কাছেই তালিম নিতে আরম্ভ করলেন।
মাকে হারালেন বিটোভেন
কিন্তু তাঁর ভাগ্য ছিল বিরূপ। বেশি দিন ভিয়েনায় থাকা সম্ভব হল না। মাস দুয়েকের মাথাতেই বাবার চিঠিতে জানতে পারলেন মা অসুস্থ। মোৎজার্টের কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন বিটোভেন। ফিরে আসার মাসখানেকের মধ্যেই মাকে হারালেন।
চূড়ান্ত দুর্ভোগে পড়লেন বিটোভেন
মদ্যপ যথেচ্ছাচারী বাবাকে কোনো দিনই পছন্দ করতেন না বিটোভেন। সংসারে মাই ছিল তাঁর একমাত্র অবলম্বন। মাকে হারিয়ে তাই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। সংসারেও দেখা দিল বিশৃঙ্খলা। বাবা দিনরাত মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে থাকেন। নিয়মিত রাজসভায়ও যেতে পারেন না। ফলে মাইনেও বন্ধ হল। দুটি অসহায় ভাই কার্ল আর জন। তাদের নিয়ে চূড়ান্ত দুর্ভোগে পড়তে হল বিটোভেনকে। তাদের মুখের দিকে তাকিয়েই অর্থ উপার্জনের চেষ্টায় নেমে পড়লেন।
শ্রোতাদের মন জয়ে সমর্থ বিটোভেন
মাত্র সতেরো বছরের কিশোর বিটোভেন এই সময় একদিকে যেমন রচনা করেছেন পর পর পিয়ানো কনসার্টো, ভায়োলিন কনসার্টো তেমনি নিয়মিত অংশ গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন সঙ্গিতানুষ্ঠানে। থিয়েটারে, চ্যাপেলে বাজিয়ে শ্রোতাদের মন জয় করেছেন।
হেডেনের কাছে বিটোভেনের তালিম
- (১) পুরঅধিকর্তার দরবারে বছর তিনেক কাজ করেছিলেন বিটোভেন। তার মধ্যেই একবার তাঁর পরিচয় হয় বিখ্যাত সঙ্গীতকার হেডেনের সঙ্গে। রাজসভায় এসেছিলেন হেডেন। এই সময় বিটোভেনের কয়েকটি স্বরচিত সুর শুনে মুগ্ধ হন শিল্পী।
- (২) নবীন শিল্পীকে কেবল প্রশংসা করেই ক্ষান্ত হলেন না তিনি, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁকে শেখালেন কয়েকটি সুর। পুরপ্রধান হেডেনকে অনুরোধ জানান বিটোভেনকে কিছুদিন তাঁর তত্ত্বাবধানে রেখে তালিম দেওয়ার জন্য।
- (৩) হেডেন সানন্দে সম্মতি জানালেন। কিন্তু সংসারের সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব তখন বিটোভেনের ওপরে। মদ্যাসক্ত বাবা, ছোট দুটি ভাই, সকলেই তাঁর রোজগারের ওপরে নির্ভরশীল। এই অবস্থায় বিদেশে যেতে হলে পুরপ্রধানের দরবারে চাকরিটা ছাড়তে হয়।
- (৪) এই সঙ্কটাপন্ন অবস্থা থেকে বিটোভেনকে রক্ষা করলেন পুরপ্রধানের এক সদাশয় বন্ধু ওয়েন্ডস্টেইন। বিটোভেনের প্রতিভায় আস্থাশীল ছিলেন ওয়েন্ডস্টেইন। প্রধানতঃ তাঁরই চেষ্টায় পুরপ্রধান তাঁর জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন যাতে নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে তিনি হেডেনের কাছে গিয়ে সঙ্গীত শিক্ষা করতে পারেন।
ভিয়েনায় বিটোভেনের উপস্থিতি
মোৎজার্ট, হেডেন প্রমুখ প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীদের উপস্থিতির সুবাদে সেই কালে ভিয়েনা হয়ে উঠেছিল পাশ্চাত্য সঙ্গীতের তীর্থক্ষেত্র। দেশ বিদেশের শিল্পীদের প্রতিনিয়ত আনাগোনা সেখানে। বিটোভেন যখন ভিয়েনায় উপস্থিত হন, তার কিছুকাল আগেই মোৎজার্ট গত হয়েছেন। উপস্থিত হেডেনই ভিয়েনার সঙ্গীত আসরের মধ্যমণি। হেডেন সাদরে গ্রহণ করলেন বিটোভেনকে। সযত্নে চলতে লাগল তাঁর শিক্ষাদান পর্ব।
গুরু শিষ্যের দ্বন্দ্ব
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই হতাশায় বিমর্ষ হয়ে পড়তে লাগলেন বিটোভেন। হেডেনের সবই কেমন সেই পুরনো গতে বাধা নতুন সুরের ছোঁয়া কোথাও নেই। কিন্তু তিনি যে নতুন পথের পথিক। গতানুগতিকতার বন্ধন ছিন্ন করে নতুন সৃষ্টির উম্মাদনায় ব্যাকুল তাঁর হৃদয়। হেডেন বিটোভেনকে শেখান এক ধারা, বিটোভেন তাঁকে পাশ কাটিয়ে তৈরি করেন অন্য ধারা। চিরাচরিত নিয়মের তোয়াক্কাই করেন না। ফল যা হবার তাই হল। শুরু শিষ্যের মধ্যে দেখা দিল মতবিরোধ। অভিযোগ শুনে বিটোভেন স্পষ্ট জানিয়ে দিতে দ্বিধা করেন না, পুরনো পথ আঁকড়ে থাকতে তাঁর ভাল লাগে না। নিত্য নতুন সুরের সন্ধান করেই তিনি আনন্দ পান। নবীন আর পুরাতনের মতবিরোধ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পরিণতি পেল বিচ্ছেদে।
সঙ্গীত শিক্ষক বিটোভেন
তাঁর ভিয়েনায় অবস্থানকালেই বিটোভেনের বাবা মারা যান। ভাইদের তিনি নিয়ে এলেন নিজের কাছে। পুরপ্রধানের নির্দিষ্ট ভাতায় তিনজনের খরচ সংকুলান হওয়ার নয়। তাই অর্থের প্রয়োজনে এই সময় ছোট ছোট অনুষ্ঠানে যোগ দিতে লাগলেন। কয়েকটি অভিজাত বাড়িতেও সঙ্গীত শিক্ষকের দায়িত্ব নিলেন।
স্যালিভির কাছে বিটোভেনের সঙ্গীত শিক্ষা
ভিয়েনায় এসেছিলেন সঙ্গীতে নতুন পাঠ নেবার জন্য। নিত্যদিনের টানাপোড়েনের মধ্যে সেকথাও কিন্তু ভুললেন না। বিখ্যাত ইতালিয় সঙ্গীতকার স্যালিভির কাছে নিয়মিত পাঠ নিয়েছেন তিনি। স্যালিভি ছিলেন মোৎজার্টের প্রতিদ্বন্দ্বী। অনেকেই মনে করতো, তাঁর বিষ-প্রয়োগের ফলেই মোৎজার্টের মৃত্যু হয়েছিল।
উদাসী বিটোভেন
ত্রিশের কোঠায় পা দেবার পর থেকেই বিটোভেনের স্বভাবে দেখা দিল এক অদ্ভুত পরিবর্তন। কেমন যেন উদাসী অন্যমনস্ক হয়ে উঠল তাঁর চলাফেরা। অবিন্যস্ত চুল, এলোমেলো পোশাকে ঘোরাফেরা করেন। কখনো আত্মগর্বে স্ফীত হয়ে এমন ব্যবহার করেন যেন কাউকে পরোয়া করেন না।
বিটোভেনের বিসদৃশ আচরণ
শহবের অভিজাত গণ্যমান্য ব্যক্তিরাই ছিল তাঁর বন্ধু। তাদের বাড়িতে ভোজসভায় প্রায়ই তাঁর আমন্ত্রণ হত। সেখানে গিয়েও এমন সব ব্যবহার ও মন্তব্য করে বসতেন যা সকলকে বিব্রত করে তুলত। কিন্তু তিনি যখন পিয়ানোর সামনে বসে সুরের মায়াজাল সৃষ্টি করতেন, নিমিষে তাঁর সব রুক্ষতা ধুয়ে মুছে যেত। তবুও অস্বাভাবিক দম্ভ আর বিসদৃশ আচরণের জন্য দিন দিনই জনপ্রিয়তা কমতে থাকে বিটোভেনের। বন্ধুরা প্রতিভাধর শিল্পীকে বুঝতে পারতেন। বেদনাহত হলেও তাঁকে কখনো সাহায্যদানে বঞ্চিত করেন নি।
বিরামহীন সুরের সাধনায় বিটোভেন
সুরের সাধনায় বিরাম ছিল না বিটোভেনের। কখনো বেহালা, কখনো পিয়ানো-এই ছিল তাঁর রাতের সঙ্গী। নিত্য নতুন সরের সন্ধানে তন্ময় হয়ে থাকতেন শিল্পী। এভাবে অতিবাহিত হয়েছে কত রাত।
ভন বিটোভেনের প্রেম
অভিজাত পরিবারগুলির সঙ্গে মেলামেশার ফলে বহু মহিলার সঙ্গেই তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বংশ মর্যাদায় তাদের কারোরই সমকক্ষ ছিলেন না তিনি। তাই কখনোই কোন সম্পর্ক গভীর হতে দিতেন না।
বধিরতার স্বীকার বিটোভেন
এই সময় আকস্মিক ভাবেই একদিন বিটোভেন লক্ষ্য করলেন, দূরের শব্দ যেন তিনি শুনতে পাচ্ছেন না। ক্রমে বুঝতে পারেন স্বরের পর্দার প্রভেদও সঠিক ধরতে পারছেন না। প্রথম কিছুদিন ততটা গুরুত্ব দেন নি। বধিরতার আশঙ্কা মনে স্থান দিতেন না। কিন্তু অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকলে, ডাক্তারের কাছে যেতেই হল। ডাক্তারেরা পরীক্ষা করে হতাশায় মাথা নাড়েন। জানান, অনিবার্য বধিরতা আসছে। এ রোগ তাঁর বংশানুক্রমিক, কিছু করার নেই। চরম হতাশায় ভেঙ্গে পড়লেন বিটোভেন। বিধ্বস্ত মন নিয়ে পিয়ানোর সামনে বসে শব্দহীন সুরশূন্য এক যন্ত্রণাময় জগতে ডুবে যেতে থাকেন।
স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী বিটোভেন
এবারে বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলেন বিটোভেন। স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি হলেন। বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা করতেন না। নিঃসঙ্গ, নিঃশব্দতার জগতে মাস কয়েক বন্দি রইলেন। এই সময়ের মধ্যে আশ্চর্যভাবে বদলে গেলেন সেই দাম্ভিক, উদ্ধত স্বভাবের রুক্ষ মানুষটি। বধিরতার দুর্গে বন্দি অবস্থায় যেন ব্যক্তি মানুষটিকে নতুন করে উপলব্ধি করলেন বিটোভেন। নিজের রুক্ষ ব্যবহারের জন্য, ব্যথিত, অনুতপ্ত হয়েছেন।
ভাইদের কাছে বিটোভেনের অনুরোধ
তাঁর এই মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে লেখা তাঁর সেই বিখ্যাত চিঠিতে, সেটি তাঁর উইল নামেই পরিচিত। হৃদয় নিংড়ানো-বেদনাসিক্ত ভাষায় তিনি লিখেছেন, ভাইদের জন্য তাঁর স্নেহ ভালবাসায় কোন খাদ ছিল না। মানুষের প্রতিও কোনও অভিযোগ ছিল না তাঁর। কেবল নিজের দৈহিক প্রতিবন্ধকতার অসনীয় বেদনায় ক্ষিপ্ত হয়ে অকারণে রুক্ষ ব্যবহার করে ফেলেছেন। ভাইদের তিনি বার বার অনুরোধ করেছেন তারা যেন তাঁর দৈহিক প্রতিবন্ধকতার কথা মনে করে, তাঁর দুর্ব্যবহারের জন্য তাঁকে ক্ষমা করে।
বিটোভেনের উপলব্ধি
নৈঃশব্দের দুর্গে বসে নিজের ভয়ঙ্কর এক পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে বিষাদের মধ্যেই যেন ক্রমশঃ সম্ভাবনার আলো দেখতে পেলেন। উপলব্ধি করলেন, সৃষ্টির মধ্যেই তাঁকে আনন্দের সন্ধান করতে হবে। যে আনন্দ তাঁকে পৌঁছে দেবে অমরতার পথে। নৈরাশ্যের গ্লানি মুছে ফেলে আবার বিটোভেন তাঁর সুর সৃষ্টির কাজে মন দিলেন। কথায়, সুরে, ব্যঞ্জনায় রচনা করতে বসলেন অমর সঙ্গীত।
প্রেমে প্রত্যাখ্যাত বিটোভেন
- (১) এই সময়েই এক ঝলক আলোর মতো আবির্ভূত হয়ে বিটোভেনের বিষাদময় জীবন আশায় আনন্দে উদ্বেল করে তুলল ১৬ বছরের এক কিশোরী গিউলিয়েত্তা গুইসিয়ারদি। তাঁর কাছে সঙ্গীত শিক্ষার জন্য এসেছিল চঞ্চল ছোট্ট এই কিশোরী। তাঁর আয়ত চোখে শিশুর সরলতা মাখানো, মাথাভরা কালো চুল।
- (২) এতদিনে এই শিষ্যার কাছে ধরা দিলেন বিটোভেন। মুনলাইট সোনেটা উৎসর্গ করলেন তাঁকে। অল্পদিনেই গুইসিয়ারদি তাঁর সমস্ত অন্তর দখল করে নিল। সমস্ত হৃদয় দিয়ে বিটোভেন কামনা করতে লাগলেন তাঁর প্রিয়তমার ভালবাসা, তার নিরন্তর সাহচর্য।
- (৩) বিটোভেন গুইসিয়ারদিকে জীবনসঙ্গিনী রূপেই পেতে চেয়েছিলেন। একথা জানা যায় গুইসিয়ারদিকে লেখা তাঁর একটি পত্র থেকে। বিটোভেনের মৃত্যুর পর তাঁর লেখার টেবিলের একটা গোপন ড্রয়ার থেকে উদ্ধার করা হয় এই পত্রটি।
- (৪) গুইসিয়রদি কিন্তু পীড়িত দরিদ্র শিল্পীর প্রেমে সাড়া দেন নি। প্রত্যাখ্যাত বিটোভেন মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়লেন। কিন্তু তাঁর শিল্পীসত্তাকে অন্তর্মুখী করার জন্য বুঝি এই আঘাতের প্রয়োজন ছিল। তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই নিজেকে সঁপে দেবার দুর্দমনীয় প্রেরণা উপলব্ধি করলেন।
নির্জন গ্রামে বিটোভেন
কিন্তু বধির অবস্থার কথাও ভুলে থাকতে পারেন না। দিন দিনই পীড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সময় ডাক্তার নগর কোলাহলের বাইরে কোনো শান্ত নির্জন গ্রামে গিয়ে বাস করার পরামর্শ দিলেন। বিটোভেন ভিয়েনা ত্যাগ করলেন। চলে এলেন হেলিজেনস্টেট (Heligenstadt) গ্রামে।
বিটোভেনের উইল রচনা
কিন্তু দীর্ঘ চার বছরেও অবস্থার কোনো উন্নতি দেখা গেল না। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। এই অবস্থায় বারবারই মৃত্যু চিন্তায় বিধ্বস্ত হতে থাকেন। সেই তাড়নাতেই ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সমস্ত ইচ্ছা প্রকাশ করে একটি উইল করেন। সেখানে তিনি প্রবল আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন, জীবনের সকল প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করে মানুষের কল্যাণকর শিল্পসৃষ্টির জন্যই তিনি বেঁচে থাকবেন। শেষ নিঃশ্বাস ফেলবার আগে অন্তরের সমস্ত অনুভূতিকে সঙ্গীতের মধ্যে রূপ দিয়ে যাবেন।
ভন বিটোভেনের সৃষ্টি সিম্ফনি
এর পর ছোট্ট একটা নোটবুক আর পিয়ানোই হল তাঁর প্রায় সারাক্ষণের সঙ্গী। আত্মমগ্ন শিল্পী একের পর এক সিম্ফনি সৃষ্টি করে চললেন। পিয়ানো কনসার্টো, পিয়ানো ফোর্ট সোনাটা, ভায়লিন সোনাটা, দি স্ট্রিং কোয়ার্টেট তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিই সৌন্দর্য আর গভীরতায় অনন্য। যা মানুষকে আজও উদবোধিত, উদবেলিত করে। ভিয়েনার থিয়েটার মালিক আর তাঁর রচনার প্রকাশকদের মাধ্যমে বিটোভেনের সঙ্গীত ক্রমশই ইউরোপ-এর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। লিপজিগ, লন্ডন, প্যারিস শহরে শিল্পীরা তাঁর সঙ্গীত নিয়ে অনুষ্ঠান করতে লাগল।
বিটোভেনের অস্ট্রিয়া যাবার পরিকল্পনা
সঙ্গীত রসিক মহলে হেডেন, মোৎজার্টের পরেই বিটোভেনের নাম উচ্চারিত হতে লাগল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভিয়েনার বল নাচ, অপেরা আর হাল্কা সঙ্গীতের চটুল পরিবেশে বিটোভেনের সঙ্গীতের গভীরতা ও সৌন্দর্য কেউ উপলব্ধি করতে পারল না। বিরক্ত হয়ে বিটোভেন ভিয়েনা পরিত্যাগ করে অস্ট্রিয়া যাবার সংকল্প নিলেন।
জীবনের শেষ সময়ে ভিয়েনাতে বিটোভেন
এদিকে অনটনও বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি ইউরোপের নানা শহর থেকে প্রকাশকরা তাঁর রচনা প্রকাশ করার জন্যও আগ্রহ প্রকাশ করছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কয়েকজন গুণমুগ্ধ বন্ধুর সহৃদয়তায় তাঁর আর অস্ট্রিয়া যাওয়া হল না। ধনী বন্ধুরা প্রস্তাব দিলেন, তিনি ভিয়েনা পরিত্যাগ না করলে তাঁকে বছরে ৪০০০ ফ্লোরিন দেওয়া হবে। এরপর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিটোভেন ভিয়েনাতেই অবস্থান করেছেন। যত দিন বেঁচেছিলেন ক্লান্তিহীন ভাবে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছেন সঙ্গীত রচনার কাজে। প্রকৃতির অনির্বচনীয় সৌন্দর্য, সুখ, আনন্দ, দুঃখ, বেদনা, অন্তর্মুখী জীবনে যখন যে আবেগ অনুভূতির সঞ্চার হয়েছে, তাকেই সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সুরে সুরে।
বেটিনার প্রেমে আসক্ত বিটোভেন
- (১) একদিন এক বন্ধুর বাড়িতে সঙ্গীতানুষ্ঠানে আকস্মিক ভাবে বিটোভেনের সঙ্গে পরিচয় হল বেটিনা নামে অপূর্ব রূপ লাবন্যবতী এক তরুণীর। শিল্পীর গুণমুগ্ধ ভক্ত সে। তাই এসেছে চোখের দেখা দেখতে। প্রথম পরিচয়েই মুগ্ধ হলেন বিটোভেন।
- (২) তিনি জানতে পারলেন বেটিনা কবি গ্যেটের প্রণয়ী। কেবল তাই নয় জার্মানীর প্রতিভাবান বিখ্যাত মানুষরা সকলেই তাঁর পরিচিত। উদ্বেল উল্লসিত বেটিনা গভীর আবেগে নিজের হাতের আংটি খুলে পরিয়ে দিলেন বিটোভেনের হাতে।
- (৩) নিজের সবচেয়ে প্রিয় কবির প্রণয়ী হলেও অল্পদিনের মধ্যেই বেটিনার প্রেমে আবদ্ধ হলেন বিটোভেন। বেটিনাকে সামনে বসিয়ে তিনি সুর রচনা করেন। বেটিনা তাঁকে আবৃত্তি করে শোনান গ্যেটের কবিতা, কখনো উচ্ছ্বসিত আবেগে বলে যান নিজের কথা।
কবি গ্যেটের সাথে বিটোভেনের সাক্ষাৎ
একদিন বেটিনার মাধ্যমে গ্যেটের সঙ্গে পরিচিত হলেন বিটোভেন। জার্মানীর শ্রেষ্ঠ কবি উষ্ণ অভিনন্দনে অভিষিক্ত করলেন জার্মানীর শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত শিল্পীকে। উভয়েই ছিলেন উভয়ের গুণমুগ্ধ। বিটোভেন ছিলেন উচ্ছ্বাসময় উদ্দাম। কিন্তু গ্যেটে ছিলেন উচ্ছ্বাসহীন নিরুত্তাপ। বিটোভেনের সঙ্গীত প্রতিভার স্বরূপ উপলব্ধি করেও গ্যেটে ছিলেন নিরুচ্চার। তাঁর আচরণের এই শীতলতা মেনে নিতে পারেন নি বিটোভেন। তাই তাঁদের পরিচয় ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পায় নি।
বিটোভেনের পারিবারিক সংকট
- (১) ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে অকস্মাৎ এক পারিবারিক সংকট উপস্থিত হল বিটোভেনের জীবনে। তাঁর ভাই কার্ল মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে নয় বছরের শিশু পুত্রকে দিয়ে গেলেন বিটোভেনের দায়িত্বে।
- (২) শিশুর অভিভাবকত্বের দাবি নিয়ে কার্লের স্ত্রীর সঙ্গে কিছুদিন পরেই বিরোধ দেখা দিল। তা গড়াল আদালত পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত শিশুর ভরণপোষণ ও প্রয়োজনীয় সব ব্যাপারই বর্তালো বিটোভেনের ওপরে।
- (৩) নিজের ছন্নছাড়া পীড়িত জীবন নিয়ে ছিলেন বিধ্বস্ত। শিশুর দায় দায়িত্ব তাঁকে আরো বিব্রত অসহায় করে তুলল। শেষে বালকটিকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।
- (৪) কার্লের প্রতি বিটোভেনের ছিল গভীর ভালবাসা। তাই তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন ভাইপোটি মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠুক। তার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেননি কখনো।
- (৫) কিন্তু তাঁর স্নেহের সুযোগ নিয়ে ভাইপোটি হয়ে উঠেছিল জেদি, উদ্ধত আর অভদ্র। সুযোগ পেলেই জ্যেঠার ড্রয়ার থেকে সে টাকা চুরি করত। ভাইপোর অধঃপতন দেখে দুঃখে হতাশায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন বিটোভেন। কিন্তু সংসারে দুঃখ ছাড়া আর কীই বা পেয়েছেন তিনি।
নিজেকে গুটিয়ে ফেললেন বিটোভেন
জীবন ও জগতের প্রতি বিতশ্রদ্ধ বিটোভেন এরপর নিজেকে গুটিয়ে ফেললেন। নীরবে আশ্রয় নিলেন সুরে অঙ্গনে। রচনা করলেন তাঁর জগৎবিখ্যাত মহত্তম নাইনথ সিম্ফনি। যার পরতে পরতে অনুরণিত হয়েছে যন্ত্রণাদীর্ণ হৃদয়ের আকৃতি। শেষদিকে পিয়ানো ছেড়ে বড় একটা উঠতেন না বিটোভেন। কচিৎ বাইরে যেতেন। অবিন্যস্ত এলোমেলো বেশবাস, সর্বদাই বিষণ্ণ বিমনা। ক্রমে সৃষ্টির ক্ষমতাও কমে এলো। বুঝতে পারলেন, শেষের দিন ঘনিয়ে আসছে।
লুডউইগ ভন বিটোভেনের মৃত্যু
অবশেষে এগিয়ে এল ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে মার্চ দিনটি। সকালের দিকেই বাইরের আকাশে সুরু হল দুর্যোগ। তুমুল ঝড়ের সঙ্গে নেমে এলো অঝোরে বৃষ্টি। জানালার বাইরে প্রকৃতির তান্ডব দেখতে দেখতে অচৈতন্য হয়ে পড়লেন বিটোভেন। তারপর একসময় অর্ধঅচেতন অবস্থাতেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
উপসংহার :- লুডউইগ ভন বিটোভেন ছিলেন সঙ্গীত জগতের এক অনন্য প্রতিভা, যিনি ক্লাসিকাল এবং রোমান্টিক যুগের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে সঙ্গীতের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর রচনাগুলিতে আবেগ, সৃজনশীলতা এবং মানবিকতার মিশ্রণ স্পষ্ট। শ্রবণশক্তি হারানোর মতো গভীর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, তিনি সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রে অতুলনীয় উচ্চতা অর্জন করেন। বিটোভেনের নবম সিম্ফনি, পঞ্চম সিম্ফনি এবং মুনলাইট সোনাটার মতো রচনাগুলি আজও বিশ্বজুড়ে শ্রোতাদের অনুপ্রাণিত করে। তাঁর জীবন ও কাজ আমাদের শেখায় যে সৃজনশীলতার শক্তি এবং আত্মপ্রত্যয়ের মাধ্যমে যেকোনো বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।
(FAQ) লুডউইগ ভন বিটোভেন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বিটোভেন ক্লাসিকাল এবং রোমান্টিক যুগের মধ্যে একটি সেতু তৈরি করেন। তাঁর সঙ্গীতে আবেগ, শক্তি এবং সৃজনশীলতার মিশ্রণ ছিল যা সেই যুগের সঙ্গীতকে পুনর্নির্মাণ করে।
বিটোভেন বধিরতার স্বীকার ছিলেন।
তাঁর নবম সিম্ফনি (Ode to Joy), পঞ্চম সিম্ফনি, এবং মুনলাইট সোনাটা সবচেয়ে বিখ্যাত।
বধিরতা ছিল তাঁর জীবনের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও, তিনি আর্থিক সংকট এবং পারিবারিক সমস্যার মুখোমুখি হন।
তাঁর সঙ্গীতের গভীর আবেগ এবং স্বাধীনতাবোধ রোমান্টিক যুগের সঙ্গীতে এক নতুন ধারা স্থাপন করে, যা পরবর্তী সুরকারদের অনুপ্রাণিত করে।
তাঁর শেষ পূর্ণাঙ্গ রচনা ছিল নবম সিম্ফনি, যা মানবজাতির ঐক্যের প্রতীক হিসাবে পরিচিত।