চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন -এর সময়কাল, নেতৃত্ব, সূর্য সেন ও তার অনুগামী, ব্রিটিশ শাসন বিলুপ্ত, রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত, জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধ, গেরিলা পদ্ধতি অনুসরণ, সূর্য সেনের পলায়ন, নারীদের অংশগ্রহণ, লুন্ঠনের গুরুত্ব, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলা, বন্দীদের মুক্তির পরিকল্পনা, সূর্য সেনের গ্রেফতার, সূর্য সেনের বিচার, অকথ্য অত্যাচার ও তার পরিণতি সম্পর্কে জানবো।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন

ঐতিহাসিক ঘটনাচট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন
সময়কাল১৮ এপ্রিল, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ
নেতাসূর্যসেন
জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধ২২ এপ্রিল, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ
সূর্যসেনের ফাঁসি১২ জানুয়ারি, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন

ভূমিকা:- ভারত-এর পূর্বপ্রান্তে চট্টগ্রামের ঘটনা সারা ভারতকে সচকিত করে দেয়। ১৮ই এপ্রিল, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী সূর্য সেন-এর নেতৃত্বে তাঁর কিছু দুঃসাহসী অনুগামী চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে।

সূর্যসেন ও তার অনুগামী

মাস্টার দা সূর্যসেনের অনুগামীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, অনন্ত সিংহ, নির্মল সেন, জীবন ঘোষাল,অম্বিকা চক্রবর্তীসহ ৬৫ জন বিপ্লবী।

ব্রিটিশ শাসন বিলুপ্ত

বিপ্লবীরা পুলিশের ব্যারাক দখল করে নেয়।ফলে ১৮-২১ এপ্রিল এই চারদিন চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসনের অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত ছিল।

রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত

ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন ঘটনাকে ভারতের বিপ্লবী কর্মকান্ডের সবচেয়ে সাহসিকতাপূর্ণ কাজ বলে অভিহিত করেছেন।

বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা

সূর্য সেন ও তার অনুগামীরা টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ লাইন ধ্বংস করে চট্টগ্রামে এক বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। পরে সামরিক বাহিনী চট্টগ্রামে প্রবেশ করলে বিপ্লবীরা নিকটস্থ জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন।

জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধ

জালালাবাদ পাহাড়ে দু’পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয় (২২শে এপ্রিল)। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বিশাল সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এই অসম-যুদ্ধে ১১ জন বিপ্লবী নিহত হন। অপরদিকে সরকারি পক্ষের ৬৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়।

গেরিলা পদ্ধতি অনুসরণ

বিপ্লবীরা অনুধাবন করেন যে, প্রবল শক্তিধর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এভাবে যুদ্ধ চালানো অর্থহীন। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালাবার কর্মসূচি গ্রহণ করেন।

সূর্যসেনের পলায়ন

বিপ্লবীরা ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসনকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিলেন। মাস্টার দা সূর্য সেন যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মাস্টার দা

স্কুল-শিক্ষক সূর্য সেন বিপ্লবী মহলে ‘মাষ্টার-দা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর বিপ্লবী কর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় মাস্টার দা।

নারীদের অংশগ্রহণ

  • (১) নারীদেরও তিনি গুপ্ত সমিতির অভ্যন্তরে টেনে আনেন। প্রীতিলতা ওয়েদ্দেদারকল্পনা দত্ত তাঁর দুই উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
  • (২) তাঁর নির্দেশে বীরাঙ্গনা প্রীতিলতার নেতৃত্বে পাহাড়তলির ইওরোপীয় ক্লাবে আক্রমণ চালানো হয় (২২শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ খ্রিঃ)।এই আক্রমণ কালে প্রীতিলতা মৃত্যুবরণ করেন।
  • (৩) আসলে মাষ্টারদা প্রমাণ করতে চান যে, মাতৃমুক্তি যজ্ঞে নারীরাও পেছিয়ে নেই।

গুরুত্ব

  • (১) চট্টগ্রামের সংবাদ সারা জাতির প্রাণে এক শিহরণ এনে দেয় এবং বিপ্লবী তরুণ ও দেশবাসীকে নতুন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে।
  • (২) আতঙ্কিত ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র সচিব স্যার স্যামুয়েল হোর মন্তব্য করেন যে, চট্টগ্রাম বিদ্রোহের মত ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ভারতে ইংরেজ শাসনের বিদায়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে।
  • (৩) সরকারি রিপোর্টে এই ঘটনাকে ‘বিপ্লববাদের ইতিহাসে অভূতপূর্ব’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বস্তুত,১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ-এর পর ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে এই ধরনের সশস্ত্র সংগ্রাম আর কখনো হয় নি।
  • (৪) মৃত্যুভয়হীন এই যুবকের দল স্বল্পকালের জন্য হলেও চট্টগ্রামের বুকে ব্রিটিশ প্রশাসনকে অচল করে দিয়েছিল।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা

বিপ্লবীদের খোঁজে পুলিশ চারদিকে ব্যাপক তল্লাশি শুরু করে, ফলে বিপ্লবীরা ধরা পড়েন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের নিয়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা শুরু হয়।

বন্দীদের মুক্তির পরিকল্পনা

মামলা শুরু হলে মাস্টার দা সূর্য সেন মাইন ব্যবহার করে জেলের প্রাচীর উড়িয়ে দিয়ে বন্দিদের মুক্ত করার এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

সূর্যসেন বন্দী

নেত্র সেন নামে জনৈক বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ সূর্য সেনকে গ্রেফতার করে।

বিচার

শেষপর্যন্ত মামলায় সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির আদেশ হয়। অনন্ত সিং, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ-সহ ১২ বিপ্লবীর দ্বীপান্তর হয়।

অকথ্য অত্যাচার

জেলবন্দি সূর্য সেনের ওপর অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর দাঁত ও হাড় ভেঙে দেওয়া হয়।

পরিণতি

১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর হয়। তাঁর মৃতদেহ বহু দূরে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়।

উপসংহার:- ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, “ইংরেজের সাথে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম -এর পরিকল্পনা ও তার জন্য প্রস্তুতি বঙ্গদেশে ও ভারতের অন্যান্য স্থানে পরিলক্ষিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এর প্রথম দৃষ্টান্ত জালালাবাদে চট্টগ্রামের যুদ্ধ এবং শেষ ও চরম দৃষ্টান্ত নেতাজী সুভাষচন্দ্র -এর আজাদ হিন্দ ফৌজ -এর অভিযান।”

(FAQ) চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কবে, কার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন করা হয়?

১৮ এপ্রিল, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মাস্টার দা সূর্যসেনের নেতৃত্বে।

২. জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধ কবে হয়?

২২ এপ্রিল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে।

৩. মাস্টার দা সূর্যসেনের দুজন নারী বিপ্লবীর নাম লেখ।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত।

৪. মাস্টার সূর্যসেনের ফাঁসি কার্যকর করা হয় কখন?

১২ জানুয়ারি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment