১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব হিসেবে সর্বস্তরের মানুষের যোগদান, কংগ্রেসের প্রভাব বৃদ্ধি, স্বাধীনতার ভিত্তি প্রস্তুতি, জাতীয় জাগরণ, গণ আন্দোলন, অম্বাপ্রসাদের অভিমত, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রসার, ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে ভারতের জয় অনিবার্য, বিভিন্ন দলের ওপর প্রভাব এবং জওহরলাল নেহেরু ও রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত সম্পর্কে জানবো।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব প্রসঙ্গে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের নেতা, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গান্ধীজির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য হিসেবে কংগ্রেসের প্রভাব বৃদ্ধি, জাতীয় জাগরণ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রসার, গণআন্দোলনের, মুক্তি সংগ্রামে ভারতের জয় অনিবার্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে জওহরলাল নেহেরুর মন্তব্য সম্পর্কে জানব।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব
ঐতিহাসিক ঘটনা | ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব |
সূচনা কাল | ৯ আগস্ট, ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ |
প্রধান নেতা | মহাত্মা গান্ধী |
স্লোগান | করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে |
ফলাফল | ব্যর্থতা |
ভূমিকা:- ডঃ বিপান চন্দ্র বলেন জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা ৪২ -এর আন্দোলন হল চূড়ান্ত পর্যায়। এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে, জনমনে কংগ্রেসের প্রভাব ব্যাপক ও সর্বাত্মক।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব
ভারত ছাড়ো আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কিন্তু সবসময় কোনো বিষয়ের ব্যর্থতা দিয়ে সেই বিষয়ের গুরুত্ব বিচার করা যুক্তিসংগত নয়। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব বিচার করার সময় এই কথা সত্য। এই আন্দোলনের বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল। যেমন –
(১) সর্বস্তরের মানুষের যোগদান
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষক, শ্রমিক, নারী-পুরুষ, ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে সরকারের বিরোধিতায় গণ-আন্দোলনে অংশ নেয়। জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে তাঁর সম্পাদিত ‘The Indian Nation in 1942’ গ্রন্থে এই আন্দোলনকে জাতীয়তাবাদী গণআন্দোলন বলেছেন।
(২) কংগ্রেসের প্রভাব বৃদ্ধি
ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের মতে, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ৪২-এর আন্দোলন হল চূড়ান্ত পর্যায়। কংগ্রেসের ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশের সর্বস্তরের মানুষ শামিল হয়। ফলে জনমনে কংগ্রেসের প্রভাব ব্যাপক ও সর্বাত্মক হয়।
(৩) স্বাধীনতার ভিত্তি প্রস্তুতি
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভারতবাসী স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রস্তুত এবং তা অর্জনের জন্য তারা সব ধরনের ত্যাগ, তিতিক্ষা, অত্যাচার, লাঞ্ছনা এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত।
(৪) জাতীয় জাগরণ
অরুণচন্দ্র ভুঁইয়া তাঁর ‘The Quit India Movement’ গ্রন্থে বলেছেন যে, এই আন্দোলনের ফলে একটি অভূতপূর্ব জাতীয় জাগরণ ও জাতীয় ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে। এর ফলে ইংরেজরা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়। তাঁর মতে, এই আন্দোলন ছিল ‘যুবকদের আন্দোলন’।
(৫) গণআন্দোলন
প্রকৃত অর্থে এই আন্দোলন ছিল গণ-বিপ্লব। জাতীয় আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রমিক-কৃষক সামিল হলেও, আগস্ট আন্দোলনে নেতাদের অংশ গ্রহণ ছিল ব্যাপক, সর্বাত্মক ও স্বতঃস্ফূর্ত। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি -র মতে এই আন্দোলন ছিল ‘গণযুদ্ধ’। জওহরলাল নেহরু একে স্বতঃস্ফূর্ত গণ অভ্যুত্থান’ বলে অভিহিত করেছেন।
(৬) অম্বাপ্রসাদের অভিমত
ড. অস্বাপ্রসাদ বলেন যে, “১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও তা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তি প্রস্তুত করে।”
(৭) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রসার
মুসলিম লিগ এই আন্দোলনে যোগ না দিলেও বহু মুসলিম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই আন্দোলনকে সমর্থন ও সহায়তা করে। মুসলিম লিগের বিরোধিতা সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশ, বিহার, চট্টগ্রাম, শিলচর প্রভৃতি স্থানের বহু মুসলিম এই আন্দোলনে অংশ নেয় এবং আন্দোলনে নানাভাবে সহায়তা করে। এই সময় কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি।
(৮) ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি
বড়োলাট লর্ড ওয়াভেল ব্রিটিশ সরকারকে লেখেন, “ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-এর দিন শেষ হয়েছে। পুনরায় এই ধরনের একটি আন্দোলন হলে তা মোকাবিলা করার শক্তি সরকারের নেই। ব্রিটিশ সরকার আয়ার্ল্যান্ড ও মিশর-এ যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে, ভারতে এখনই তা করা দরকার।”
(৯) মুক্তিসংগ্রামে ভারতের জয় অনিবার্য
এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে, মুক্তিসংগ্রামে ভারতের জয় অনিবার্য। কখন ও কী অবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ভারতে কী ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে এরপর কেবলমাত্র ওইটুকুই অমীমাংসিত থাকে।
(১০) বিভিন্ন দলের ওপর প্রভাব
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষেত্রে পৃথক পৃথকপ্রভাব ফেলেছিল বলে ড. সুমিত সরকার মনে করেন। এই আন্দোলন জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে শুভ হয়েছিল এবং এতে কংগ্রেসের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছিল। অন্যদিকে আন্দোলনের প্রতি বামপন্থী দলগুলির নেতিবাচক মনোভাবের ফলে তাদের জনপ্রিয়তা কমে যায়।
জওহরলাল নেহেরুর মন্তব্য
জওহরলাল নেহরু এই আন্দোলনকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ -এর সঙ্গে তুলনা করে লেখেন যে, “নেতা নেই, সংগঠন নেই, উদ্যোগ-আয়োজন নেই, কোন সম্বল নেই, অথচ একটা অসহায় জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মপ্রচেষ্টার আর কোন পন্থা পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠল—এই দৃশ্য প্রকৃতই বিস্ময়ের ব্যাপার।”
রমেশ চন্দ্র মজুমদারের অভিমত
ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, “১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের গণবিদ্রোহ প্রকৃত অর্থেই ছিল সৈনিকের যুদ্ধ। সেনাপতি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কিন্তু সৈনিকদের ভূমিকা ছিল গৌরবময়। কারণ, তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে শহীদ হয়েছিলেন।”
উপসংহার:- ঐতিহাসিক ফ্রান্সিস হাটচিনস ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব বলে চিহ্নিত করেছেন। বড়লাট লিনলিথগো এই আন্দোলনকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের পর সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেছেন।
(FAQ) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
আগস্ট আন্দোলন ও বিয়াল্লিশের আন্দোলন।
মহাত্মা গান্ধী।
৯ আগস্ট ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে।