সামন্ততন্ত্রের কর ব্যবস্থা

সামন্ততন্ত্রের কর ব্যবস্থা প্রসঙ্গে জমির খাজনা, টাইলে, শিভাজ, বেনালিতে, ক্যাপিটাশিও, প্রেসটেশন, টাইথ, কর্ভি, অন্যান্য কর, মাত্রাতিরিক্ত শোষণ, কৃষকদের অবস্থা, ভূমিদাসদের অবস্থা ও কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে জানবো।

ভূমিকেন্দ্রীক সামন্ততন্ত্রের কর ব্যবস্থা প্রসঙ্গে সামন্ততন্ত্রে জমির খাজনা, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কর টাইলে, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কর শিভাজ, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কর বেনালিতে, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কর ক্যাপিটাশিও, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কর টাইথ, সামন্ততন্ত্রের অন্যান্য কর সম্পর্কে জানব।

সামন্ততন্ত্রের কর ব্যবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনাসামন্ততন্ত্রের কর ব্যবস্থা
টাইলেসম্পত্তি কর
টাইথধর্মকর
বেগার শ্রমকর্ভি
সার্ফভূমিদাস
ইংল্যান্ড-এ কৃষক বিদ্রোহওয়াট টাইলার
ফ্রান্স-এ কৃষক বিদ্রোহগিয়োম কালে
সামন্ততন্ত্রের কর ব্যবস্থা

ভূমিকা :- সামন্তপ্রভুর বিভিন্ন ধরনের শোষণে জর্জরিত হয়ে কৃষকরা প্রকৃতপক্ষে ভূমিদাসে পরিণত হয়েছিল। দরিদ্র কৃষকের ওপর প্রভু এবং চার্চ বিভিন্ন ধরনের কর চাপিয়ে তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলত। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষককে যে সব কর দিতে হত সেগুলি হল –

(ক) জমির খাজনা

কৃষক তার প্রভুর কাছ থেকে কিছু জমি পেয়ে তাতে চাষাবাদ করত। এই জমির জন্য কৃষক ম্যানর-প্রভুকে নির্দিষ্ট পরিমাণ বার্ষিক খাজনা দিতে বাধ্য ছিল। যথা সময়ে কৃষক এই খাজনা প্রদানে ব্যর্থ হলে বা খাজনা প্রদানে কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটলে কৃষক জমিচ্যুত হত।

(খ) টাইলে

কৃষক তার উৎপাদনের একটি বড়ো অংশ টাইলে বা মেটায়েজ নামে কর হিসেবে দিতে বাধ্য ছিল। টাইলে ছিল সম্পত্তি কর। কৃষকের হাঁস-মুরগির মাংস ও ডিম, পুকুরের মাছ, গোরুর দুধ ও মাংস প্রভৃতিও এই করের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

(গ) শিভাজ

কোনো কোনো সামন্ত প্রভু তার অধীনস্থ কৃষকদের কাছ থেকে শিভাজ নামে একরকম কর আদায় করত।

(ঘ) বেনালিতে

সামন্ত ব্যবস্থায় কৃষককে বেনালিতে নামে এক প্রকার কর প্রদান করতে হত। প্রভুর হাটে পণ্য বিক্রি করা, প্রভুর কলে গম ভাঙানো, আঙুর পেষাই করা, প্রভুর চুল্লিতে রুটি সেঁকা প্রভৃতির জন্য কৃষককে এই কর দিতে হত। কোনো কোনো ম্যানর-এ কৃষকের প্রয়োজনীয় ষাঁড় বা শূকর অর্থের বিনিময়ে একমাত্র প্রভুই জোগান দিত।

(ঙ) ক্যাপিটাশিও

ভূমিদাস পরিবারের সকল সদস্য ক্যাপিটাশিও নামে একপ্রকার কর দিতে বাধ্য ছিল।

(চ) প্রেসটেশন

ভূস্বামী তাঁর অধীনস্থ কৃষকের কাছ থেকে প্রেসটেশন নামে এক প্রকার কর আদায় করতেন। ফসল কাটার সময় ভূস্বামীর লোকজন প্রেসটেশন আদায়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরতেন এবং বিভিন্ন কৃষকের বাড়িতে অবস্থান করতেন। এই সময় কৃষককে ভূস্বামীসহ তাঁর লোকজনের আপ্যায়নের ব্যয় বহন করতে হত। এমনকি কৃষককে প্রভু বা তাঁর লোকজনের বাহন ঘোড়ার দেখাশোনাও করতে হত।

(ছ) টাইথ

ভূস্বামী ছাড়াও খ্রিস্টান চার্চগুলি কৃষকদের ওপর বিভিন্ন ধরনের শোষণ চালাত। চার্চ দরিদ্র কৃষকদের কাছ থেকে টাইথ নামে উৎপাদনের ১/১০ অংশ ধর্মকর আদায় করত। এ ছাড়াও অন্যান্য কয়েকটি কর, বিভিন্ন উপঢৌকন ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বিভিন্ন দান দিতে চার্চগুলি কৃষককে বাধ্য করত। চার্চের শোষণ কৃষক মুখ বুজে মানতে বাধ্য ছিল।

(জ) কৰ্ভি

সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন কৃষক বাধ্যতামূলকভাবে বিনা পারিশ্রমিকে প্রভুর জমিতে শ্রম দিতে, রাস্তা ও সেতু তৈরিতে বাধ্য ছিল। এই শ্রম কর্ভি নামে পরিচিত ছিল। এ ছাড়া প্রভুর মালপত্র বহন, প্রভুকে যন্ত্রপাতি সরবরাহ প্রভৃতি কাজও কৃষক করতে বাধ্য হত। ব্যাঙের চিৎকারে যাতে প্রভুর বিশ্রামের ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য কৃষককে প্রাসাদের চারপাশে পরিখায় পাহারা দিতে হত। বিনা পারিশ্রমিকে প্রভুর কাজে ব্যস্ত বেগার কৃষক নিজের জমিতে কাজের যথেষ্ট সময় পেত না। ফলে প্রায়ই কৃষকের নিজের ফসল নষ্ট হত।

(ঝ) অন্যান্য কর

উক্ত বিভিন্ন ধরনের কর ছাড়াও ম্যানর-প্রভু কৃষকের কাছ থেকে জলকর, বনকর, বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে কর প্রভৃতি আদায় করতেন। প্রভুর নির্মিত রাস্তাঘাট ব্যবহার করতেও কৃষককে কর দিতে হত। একচেটিয়া নুনের ব্যবসায়ী ম্যানর-প্রভুর কাছ থেকে কৃষকরা নুন কিনতে বাধ্য ছিল। বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে কৃষকরা তাদের প্রভুর কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মদ কিনতে বাধ্য ছিল।

সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত শোষণ

বিভিন্ন ধরনের কর ছাড়াও সামন্তপ্রভু তাঁর অধীনস্থ কৃষকদের ওপর নানাভাবে শোষণ ও নির্যাতন চালাতেন। দিবারাত্র সীমাহীন পরিশ্রমের ফলে কৃষকের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ত এবং তারা অকালেই মারা যেত। যেমন –

  • (১) প্রভুর জন্য বেগার শ্রম দিতে গিয়ে কৃষক নিজের জমিতে বিশেষ দৃষ্টি দিতে না পারায় কৃষকের ফসল নষ্ট হত।
  • (২) প্রভুর ছেলের ‘নাইট’ উপাধি গ্রহণ বা মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠানের যাবতীয় ব্যয় দরিদ্র কৃষকদের বহন করতে হত।
  • (৩) কৃষকের মেয়ের বিয়ে, ছেলে যাজক হওয়া, স্ত্রীর প্রতি দুর্ব্যবহার প্রভৃতির জন্যও প্রভু তাঁর অধীনস্থ কৃষকের কাছ থেকে কর আদায় করতেন। এভাবে বিভিন্ন ধরনের শোষণের ফলে কৃষকের আয়ের অন্তত ৮০ শতাংশই ভূস্বামীর হাতে চলে যেত।
  • (৪) প্রভুর অনুমতি ছাড়া কৃষক তার গোরু বা ঘোড়া বিক্রি করতে পারত না। নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে গেলেও প্রভুর অনুমতির প্রয়োজন হত। অনুন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও পশুর স্বল্পতার ফলে প্রচুর কায়িক পরিশ্রম করে কৃষককে ফসল ফলাতে হত।

ভূমিকেন্দ্রীক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষকের দুরবস্থা

  • (১) উক্ত বিভিন্ন ধরনের কর ও শ্রম আদায় করার উদ্দেশ্যে ভূস্বামী তাঁর অধীনস্থ কৃষকদের ওপর নির্দয় অত্যাচার চালাতেন। কৃষককে চুনের গুদামে বন্দি করে নির্যাতন চালানো হত, এমনকি কখনো কখনো মেরেও ফেলা হত। নির্যাতন ও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে দরিদ্র কৃষক পরিবার নিজেদের সর্বস্ব তার প্রভুর হাতে তুলে দিয়ে নিজেরা এক ভগ্ন, অস্বাস্থ্যকর কুঁড়েঘরে বসবাস করত।
  • (২) তীব্র ঠান্ডায়, অনাহারে-অর্ধাহারে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠত। কৃষকের অমানুষিক পরিশ্রমে ম্যানর-প্রভুর জীবন আলোকিত হলেও কৃষক তার নিজের ঘরে আলো জ্বালাতে সমর্থ ছিল না। কৃষকদের সন্তানদের লেখাপড়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
  • (৩) অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটিয়ে কলেরা, মহামারি ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত কৃষক পরিবারগুলিতে মৃত্যুর মিছিল চলত। তা ছাড়া প্রভুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ রাজস্ব ও শ্রম প্রদানে কৃষক ব্যর্থ হলে কৃষকের জমি ভোগের অধিকার বাতিল হয়ে যেত। ম্যানর-প্রভু আইনত তাঁর অধীনস্থ কৃষককে হত্যা বা আহত করার অধিকারী না হলেও মাঝেমধ্যেই এই অধিকার লঙ্ঘন করতেন।

সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভূমিদাসদের দুরবস্থা

  • (১) সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবচেয়ে করুণ অবস্থা ছিল ‘সার্ফ’ বা ভূমিদাসদের। ভূস্বামী তাঁর অধীনস্থ ভূমিদাসদের নিজের গৃহপালিত পশুর মতো অস্থাবর সম্পত্তি বলে মনে করতেন। প্রভুর কৃষিজমিতে, খামারে ও অন্যত্র দিবারাত্র পরিশ্রম করে তাদের দিন কাটত। তারা ছিল সম্পূর্ণ পরাধীন।
  • (২) কোনো ভূমিদাস তার মেয়েকে ভূস্বামীর এলাকার বাইরে কোথাও বিয়ে দিতে চাইলে, ছেলেকে লেখাপড়া শেখানো বা কোনো কাজ শিখতে শহরে পাঠাতে চাইলে প্রভুর অনুমতি নিতে বাধ্য ছিল। ভূমিদাসকে তার প্রভুর জমিতে সপ্তাহে অন্তত দুই-তিন দিন বিনা পারিশ্রমিকে বেগার খাটতে হত। নিজের জমির কাজ বন্ধ রেখে তাকে এই কাজ করতে হত, প্রভুর রাস্তা, খাল, সাঁকো প্রভৃতি নির্মাণে নিযুক্ত হতে হত।
  • (৩) ভূমিদাসকে ভূমিকর, জলকর, বিবাহ কর, পশুচারণ কর, ধর্মকর (টাইথ) প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের কর দিতে হত। ভূমিদাসের পুত্র উত্তরাধিকারসূত্রে তার পিতার জমি লাভ করলেও প্রভুকে ‘হেরিয়ট’ নামে কর দিতে বাধ্য হত। কোনো ভূমিদাস পালানোর চেষ্টা করলে তাকে অবর্ণনীয় শাস্তি ভোগ করতে হত।

সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষক বিদ্রোহ

মধ্যযুগে ইউরোপ-এ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষক ও ভূমিদাসরা সীমাহীন শোষণ ও নিপীড়নে জর্জরিত ছিল। করভারে নিঃস্ব হয়ে, নানা রকম অত্যাচারের শিকার হয়ে তারা মাঝেমধ্যেই সামন্তপ্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথে পা বাড়াত। এরূপ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কৃষক বিদ্রোহ ছিল –

  • (১) বেলজিয়ামের ফ্ল্যান্ডার্সে ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে নিকোলাস জানেকিন-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ,
  • (২) ফ্রান্সে ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে গিয়োম কালের নেতৃত্বে জাকেরি বিদ্রোহ,
  • (৩) ইংল্যান্ডে ১৩৮১ খ্রিস্টাব্দে ওয়াট টাইলারের নেতৃত্বে বিদ্রোহ প্রভৃতি।

উপসংহার :- পরবর্তীকালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামন্তপ্রভুর বিরুদ্ধে কৃষক ও ভূমিদাস বিদ্রোহ এক নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এইভাবে কৃষক ও ভূমিদাসদের বিদ্রোহ সামন্ততন্ত্রের পতন ডেকে এনেছিল।

(FAQ) সামন্ততন্ত্রের কর ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্মকর কি নামে পরিচিত ছিল?

টাইথ।

২. সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় বেগার শ্রম কি নামে পরিচিত ছিল?

কর্ভি।

৩. সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সম্পত্তিকর কি নামে পরিচিত ছিল?

টাইলে।

৪. ইংল্যান্ডে কখন, কার নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল?

 ১৩৮১ খ্রিস্টাব্দে ওয়াট টাইলারের নেতৃত্বে।

৫. সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভূমিদাসরা কি নামে পরিচিত ছিল?

সার্ফ।

Leave a Comment