সুলতান রাজিয়ার ব্যর্থতা

সুলতান রাজিয়ার ব্যর্থতা প্রসঙ্গে তুর্কি আমিরদের অপবাদ গুঞ্জন, ইয়াকুবের পক্ষপাতিত্ব, পুরুষের বেশ ধারণ, কবীর খানের বিদ্রোহ আলতুনিয়ার বিদ্রোহ, জামাল উদ্দিনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, মিনহাজের মন্তব্য ও হেগের অভিমত সম্পর্কে জানবো।

সুলতান রাজিয়ার ব্যর্থতা

বিষয়রাজিয়ার ব্যর্থতা
সুলতানরাজিয়া
রাজত্বকাল১২৩৬-৪০ খ্রি:
সাম্রাজ্যসুলতানি সাম্রাজ্য
পিতাইলতুৎমিস
পূর্বসূরিরুকনুদ্দিন ফিরোজ শাহ
উত্তরসূরিমুইজুদ্দিন বাহারাম শাহ
সুলতান রাজিয়ার ব্যর্থতা

ভূমিকা :- রাজিয়া গোঁড়া মুসলিম মানসিকতাকে আঘাত করেন। কারণ, তিনি পুরুষের পরিচ্ছদ পরিধান করে, প্রকাশ্য রাজদরবারে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। হাতির পিঠে যাতায়াত করতেন ও পর্দা-প্রথাকে তিনি মোটেই আমল দেন নি। তিনি ঘোড়ার পিঠে চেপে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন।

রাজিয়ার প্রতি তুর্কি আমিরদের অপবাদ গুঞ্জন

স্বভাবতই তুর্কি আমিরগণ রাজিয়ার বিরুদ্ধে অনেক অপবাদের গুঞ্জন প্রচার করতে শুরু করেন। তাই অশেষ গুণাবলীর অধিকারিণী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনকাল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

রাজিয়ার ইয়াকুবের পক্ষপাতিত্ব

  • (১) রাজিয়ার জামালউদ্দিন ইয়াকুব নামে জনৈক হাবসি ‘অশ্বপালের প্রতি অতিরিক্ত অনুগ্রহ প্রদর্শনকে, কেউ ভালো চোখে দেখে নি। যদিও রাজিয়া উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এই পক্ষপাতিত্ব দেখাতেন।
  • (২) কারণ, এই অনুগ্রহ দেখানোর পশ্চাতে তাঁর নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল, তুর্কি অভিজাতদের একচেটিয়া অধিকারকে ভেঙে দেওয়া। এই অন্যায় পক্ষপাতিত্ব দর্শনে তুর্কি আমিরগণ রাজিয়ার প্রতি বিরক্ত হন।

রাজিয়ার পুরুষের বেশ পরিধান

নারী হয়ে পুরুষের বেশে প্রকাশ্য দরবারে উপস্থিত হওয়া, গোঁড়া মুসলমানদের নিকট যথেষ্ট আপত্তির কারণ হয়ে উঠেছিল।

সুলতান রাজিয়ার বিরুদ্ধে কবীর খানের বিদ্রোহ

রাজিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন লাহোরের শাসনকর্তা কবীর খান। ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে রাজিয়া সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে এই বিদ্রোহ দমন করেন।

রাজিয়ার বিরুদ্ধে আলতুনিয়ার বিদ্রোহ

  • (১) এরপর আলতুনিয়া নামে সিরহিন্দের শাসনকর্তা প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। দরবারের আমিরগণের সঙ্গেও আলতুনিয়ার যোগাযোগ ছিল। রাজিয়া স্বয়ং এই বিদ্রোহ দমন করতে অগ্রসর হন।
  • (২) কিন্তু বিদ্রোহীদের হাতে তিনি পরাজিত হয়ে বন্দিনী হন। তাঁর প্রিয়পাত্র জামালউদ্দিন নিহত হন। তখন আমিরগণ রাজিয়ার ভ্রাতা মুইজউদ্দিন বাহারামকে সিংহাসনে স্থাপন করেন।

আলতুনিয়াকে রাজিয়ার বিবাহ

রাজিয়া বিদ্রোহীদের নেতা আলতুনিয়াকে বিবাহ করে, স্বীয় শক্তিবৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু ভাগ্যলক্ষ্মী তাঁর প্রতি বিরূপ ছিলেন। আলতুনিয়া ও রাজিয়া সিংহাসন অধিকার করার জন্য দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হলে, বিদ্রোহীরা উভয়কেই পরাজিত ও নিহত করেন।

রাজিয়ার পতন

এইভাবে রাজিয়ার সাড়ে তিন বছরের রাজত্বকালের অবসান ঘটে। রাজিয়া ব্যতীত অন্য কোনো নারী দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেননি।

রাজিয়া দিল্লির উত্তরাধিকারী মনোনীত

সুলতান রাজিয়া অসাধারণ প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন। তিনি পিতার জীবিতাবস্থায় শুধুমাত্র যোগ্যতার মাপকাঠিতেই দিল্লির সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি পিতার জীবিতাবস্থাতেই শাসনকার্যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন।

রাজিয়ার পুরুষোচিত গুণাবলী

দিল্লীশ্বরী হয়ে তিনি অসাধারণ কর্মশক্তির ও মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি সর্বপ্রকার পুরুষোচিত গুণাবলীর প্রমাণ দেন। সুলতানি যুগের তিনিই ছিলেন প্রথম ও শেষ নারী যিনি রাষ্ট্র শাসনের অধিকারী হয়েছিলেন।

সুলতান রাজিয়া

রাজিয়া ‘সুলতান’ ছিলেন ‘সুলতানা’ ছিলেন না। কারণ, তুর্কি ভাষায় সুলতানা শব্দের অর্থ সুলতানের পত্নী। কিন্তু রাজিয়া তাঁর মুদ্রাতেও সুলতান খেতাব ব্যবহার করেছেন।

রাজিয়ার যোগ্যতা সম্পর্কে মিনহাজের মন্তব্য

মিনহাজ বলেছেন যে, “সুলতান পদ অধিকার করার মতো সকল যোগ্যতা তাঁর ছিল। রাজনীতিক হিসাবেও তিনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি রাজনীতিকে শিল্পে পরিণত করেছিলেন। তিনিই রাজার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

রাজিয়া কর্তৃক রাজকীয় প্রভূত্ব স্থাপন

ইলতুৎমিসের বংশে রাজিয়াই প্রথম ও শেষ দিল্লির শাসিকা, যিনি দিল্লির রাজনীতিকে নিজের ক্ষমতার জোরে, রাজকীয় প্রভুত্বকে দিল্লির আমির ও মালিকদের উপর স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

নরপতির যাবতীয় গুণাবলীর অধিকারী রাজিয়া

সমসাময়িক ঐতিহাসিক মিনহাজ-উস-সিরাজের মতে, “তিনি ছিলেন একজন মহান সার্বভৌম শাসক, তীক্ষ্ণধী, ন্যায়পরায়ণ, দয়ালু, বিদ্যোৎসাহী, ন্যায়বিচারক, প্রজাকল্যাণকামী, সামরিক প্রতিভাসম্পন্ন এবং নরপতির প্রয়োজনীয় যাবতীয় গুণাবলীর অধিকারী।”

জামাল উদ্দিনের প্রতি রাজিয়ার পক্ষপাতিত্ব

  • (১) কোনো কোনো ঐতিহাসিক রাজিয়ার ব্যর্থতার জন্য, জামালউদ্দিনের প্রতি তাঁর অন্যায় পক্ষপাতিত্বকে দায়ী করেছেন। সমকালীন ঐতিহাসিক ইসামি বলেছেন, রাজিয়ার সঙ্গে জামালউদ্দিনের প্রণয় ছিল।
  • (২) এলফিনস্টোনও এই মতকে সমর্থন করেছেন। ইবন বতুতাও রাজিয়ার এই ভালোবাসাকে “জঘন্যতম অপরাধ” বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু সমকালীন ঐতিহাসিক মিনহাজ এরকম কোনো অভিযোগ করেন নি।

রাজিয়ার ব্যর্থতা সম্পর্কে হেগের অভিমত

উলসি হেগের মতে, আধুনিক ঐতিহাসিকগণ উপরের সব মতবাদকে বাতিল করে দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি নারী ছিলেন বলেই, তাঁর বিভিন্ন সদ্গুণ ব্যর্থ হয়ে যায়। সমসাময়িক তুর্কি আমিরগণ একজন নারীর প্রভুত্ব স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না বলেই রাজিয়ার জীবনে এই রকম চরম বিয়োগান্ত পরিণতি ঘটে।

উপসংহার :- এইসব দিক লক্ষ করেই উলসি হেগ বলেছেন যে, রাজিয়ার ব্যর্থতার জন্য দায়ী ছিল ‘নারীর প্রতি মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি’। মধ্যযুগীয় মানসিকতা রাজিয়ার গতিশীলতাকে পছন্দ করে নি।

(FAQ) সুলতান রাজিয়ার ব্যর্থতা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সুলতান ইলতুৎমিস কাকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন?

কন্যা রাজিয়া।

২. রাজিয়া দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন কখন?

১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে।

৩. রাজিয়ার রাজত্বকাল কত?

১২৩৬-১২৪০ খ্রিস্টাব্দ।

৪. রাজিয়ার পর কে সিংহাসনে আরোহণ করেন?

মুইজুদ্দিন বাহারাম শাহ।

Leave a Comment