বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের তুলনা প্রসঙ্গে সাদৃশ্য হিসেবে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিবাদ, কর্মফলবাদ, ধর্মমতের প্রবক্তা, বেদকে অস্বীকার, অহিংস নীতি, বৈসাদৃশ্য হিসেবে সর্বপ্রাণবাদ, কঠোরতা ও মধ্যপন্থা, হিন্দু ধর্মের প্রভাব, প্রচারকার্য ও বিস্তার সম্পর্কে জানবো।
ভারতের বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের তুলনা
ঐতিহাসিক ঘটনা | বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্ম -এর তুলনা |
বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক | গৌতম বুদ্ধ |
বৌদ্ধ ধর্মগ্ৰন্থ | ত্রিপিটক |
জৈন ধর্মের প্রচার | মহাবীর |
জৈন ধর্মগ্ৰন্থ | দ্বাদশ অঙ্গ |
ভূমিকা :- প্রাচীন যুগ থেকে ভারত -এ বহু ধর্মমতের উদ্ভব হয়েছে। খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতকে জৈন ও বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব হয়েছিল। এই দুই ধর্মের মধ্যে যেমন কিছু সাদৃশ্য ছিল তেমনি বেশ কিছু বৈসাদৃশ্য ছিল।
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মধ্যে সাদৃশ্য
জৈন ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য দেখা যায়। যেমন –
(১) ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিবাদ
উভয় ধর্মের উদ্ভবের পশ্চাতে ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম অর্থাৎ যাগ-যজ্ঞ ও আড়ম্বরপূর্ণ পুজো সম্পর্কে হতাশা বোধ। এই ব্যয়বহুল উপাসনা সাধারণ লোকের নাগালের বাইরে ছিল। তাছাড়া যাগ-যজ্ঞের অসারতা সম্পর্কে বহু লোকের মনে ধারণা জন্মায়। এই হতাশাবোধ থেকেই জৈন ও বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব হয়।
(২) কর্মফল মতবাদ
উভয় ধর্মের ওপর উপনিষদের যুগের কর্মফল মতবাদের বিশেষ প্রভাব ছিল। মানুষ তার কর্মফল থেকে মুক্ত থাকতে না পেরে দুঃখ ভোগ করে এই ছিল যষ্ঠ শতকের বিশ্বাস। জৈন ও বৌদ্ধধর্ম মানুষকে তার কর্মফলের হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে। এদিক থেকে এই দুই ধর্মের ওপর উপনিষদ ও সাংখ্য দর্শনের প্রভাব বিশেষভাবে ছিল বলা যায়।
(৩) ধর্মমতের প্রবক্তা
উভয় ধর্মমতের প্রবক্তা ছিলেন ক্ষত্রিয় শ্রেণীর লোক এবং উভয়েই ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য অস্বীকার করেন।
(৪) উদ্ভব স্থান
উভয় ধর্ম পূর্ব ভারতে উদ্ভব হয়। কারণ পূর্ব ভারতে বৈদিক হিন্দুধর্মের শিকড় খুব গভীরে যেতে পারেনি।
(৫) বেদকে অস্বীকার
উভয় ধর্মমতে বেদকে অস্বীকার করা হয়, তার অপৌরুষেয়তে অনাস্থা জানান হয়।
(৬) দেবতা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার
দেবতার ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব উভয় মতে আদিতে স্বীকার করা হয়নি।
(৭) অহিংসা নীতি
উভয় ধর্মে অহিংসা নীতিকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়।
(৮) ধর্মের বাণী প্রচার
মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ উভয়ে প্রাকৃত ভাষায় জনগণের নিকট তাদের বাণী রাখতেন।
(৯) অনুরাগী ভক্ত
উভয় ধর্মের অনুরাগী ভক্তদের মধ্যে ধনী ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ছিল বেশী। উভয় ধর্ম নীতিবোধের ওপর স্থাপিত ছিল।
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মধ্যে বৈসাদৃশ্য
কিছু সাদৃশ্য থাকলেও উভয় ধর্মমতের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। যেমন –
(১) ধর্মের প্রচলন
জৈনধর্ম পূর্ব থেকে প্রচলিত ছিল। মহাবীর ২৪ জন জৈন ধর্মগুরু বা তীর্থঙ্করদের মধ্যে ২৪তম তীর্থঙ্কর। বৌদ্ধধর্ম গৌতম বুদ্ধই সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন।
(২) সর্বপ্রাণবাদ
জৈনধর্মে আত্মার চিন্তা অত্যন্ত ব্যাপক। তারা জড় পদার্থেও জীবনের অস্তিত্ব কল্পনা করেন। জৈনদের এই সর্বপ্রাণবাদ বৌদ্ধরা স্বীকার করেন না।
(৩) কঠোর ও মধ্যপন্থা
জৈনগণ অহিংসা নীতিকে অত্যন্ত কঠোরভাবে পালন করেন। তাঁরা কঠোর কৃচ্ছতা সাধনের পক্ষপাতী। কিন্তু বুদ্ধ মধ্যম পন্থার নির্দেশ করেছেন। ক্লেশ ভোগ ও ভোগ-বিলাস বর্জন করে সরল জীবন-যাপন ছিল বুদ্ধের নির্দেশ।
(৪) কর্মফলের প্রভাব নাশ
জৈনধর্মে কক্তৃতা, তপস্যা, উপবাস দ্বারা কর্মফলের প্রভাব নাশ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বুদ্ধ অষ্টমার্গের দ্বারা কর্মফল জনিত পাপ যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা করেন। তাঁর ব্যবস্থা ছিল প্রতিষেধমূলক।
(৫) হিন্দু ধর্মের প্রভাব
জৈনধর্মের ওপর হিন্দুধর্মের প্রভাব ছিল বেশী। তারা জাতিভেদ প্রথাকে বাস্তব ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেন নি। পরবর্তীকালে হিন্দুধর্মের বহু প্রথাকে জৈনগণ মেনে নেন। বৌদ্ধধর্ম কেবলমাত্র হিন্দুধর্মের বিভিন্ন প্রথা ও মতকে অগ্রাহ্য করে নি, বৌদ্ধ শাস্ত্রে জৈনধর্মেরও তীব্র সমালোচনা দেখা যায়।
(৬) প্রচারকার্য
জৈনধর্ম প্রচারের জন্য বৌদ্ধধর্মের ন্যায় তাঁর প্রচার কার্য চালান হয় নি। বৌদ্ধধর্মের মধ্যে প্রচারের আগ্রহ অনেক বেশী ছিল।
(৭) বিস্তার
জৈনধর্ম ভারতের বাইরে ছড়ায় নি। বৌদ্ধধর্ম ভারতের সীমানার বাইরে বহুদূরে বিস্তৃত হয়েছিল। জৈনধর্ম আজও ভারতে বিদ্যমান, কিন্তু বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে কার্যত লোপ পেয়েছে।
(৮) শাখা
বৌদ্ধধর্ম মহাযান ও হীনযান নামে দুই প্রধান সম্প্রদায়ে ভাগ হয়। জৈনধর্মও শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর নামে দুই সম্প্রদায়ে ভাগ হয়। কিন্তু বৌদ্ধদের মত জৈনদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধ তীব্র নয়।
উপসংহার :- ভারতে প্রায় সমকালে একই প্রেক্ষাপটে গৌতম বুদ্ধের বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্মের উত্থান ঘটে। জৈন ধর্ম আজও ভারতে বিদ্যমান। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম তার স্থান ধরে রাখতে পারে নি।
(FAQ) বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের তুলনা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
গৌতম বুদ্ধ।
ত্রিপিটক।
ঋষভদেব।
পার্শ্বনাথ বা পারেশনাথ।
মহাবীর।