বাপ্পি লাহিড়ী

বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ও পরিচালক বাপ্পি লাহিড়ীর জন্ম, পিতৃপরিচয়, ব্যক্তিগত জীবন, রাজনৈতিক জীবন, সঙ্গীত জীবন, চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ, নেপথ্য কণ্ঠ শিল্পী, গান রচনা, গজল রচনা, সঙ্গীত পরিচালনা, পুরস্কার লাভ ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।

গীতিকার বাপ্পি লাহিড়ীর জীবনী

ঐতিহাসিক চরিত্রবাপ্পী লাহিড়ী
আসল নামঅলোকেশ বাপ্পী লাহিড়ী
জন্ম২৭ নভেম্বর, ১৯৫২ খ্রি:
পরিচিতিসুরকার, গীতিকার, গায়ক
পিতামাতাঅপরেশ লাহিড়ী ও বাঁসুরী লাহিড়ী
মৃত্যু১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ খ্রি:
বাপ্পি লাহিড়ী

ভূমিকা :- হিন্দী চলচ্চিত্র সহ বাংলা গানের গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও গায়ক হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ পরিচিত ব্যক্তিত্ব হলেন বাপ্পী লাহিড়ী।

বাপ্পী লাহিড়ীর জন্ম

২৭ নভেম্বর ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে বাপ্পী লাহিড়ি পশ্চিমবঙ্গ -এর কলকাতায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সমৃদ্ধ এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

বাপ্পী লাহিড়ীর নাম পরিচয়

তার ডাক নাম অলোকেশ বাপ্পী লাহিড়ী। সঙ্গীত জগতে তিনি বাপ্পী দা নামে সমধিক পরিচিত।

বাপ্পী লাহিড়ীর পিতৃপরিচয়

তার বাবা অপরেশ লাহিড়ী ছিলেন বাংলা সঙ্গীতের একজন জনপ্রিয় গায়ক। মা বাঁসুরী লাহিড়ীও ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও গায়িকা। তিনি শাস্ত্রীয় ঘরাণার সঙ্গীত এবং শ্যামা সঙ্গীতে বিশেষ পারঙ্গমতা দেখিয়েছিলেন। তাদের পরিবারেরই একমাত্র সন্তান বাপ্পী লাহিড়ী।

বাপ্পী লাহিড়ীর আদি নিবাস

তার পিতা পূর্ব বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) পাবনা ও সিরাজগঞ্জের লাহিড়ী মোহন পরিবারের অন্তর্গত ছিলেন।

সঙ্গীতকলায় বাপ্পী লাহিড়ীর হাতে খড়ি

তিন বছর বয়সেই তিনি তবলা বাজাতে শুরু করেন। তার মায়ের আত্মীয় ছিলেন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী কিশোর কুমার এবং এস. মুখার্জী। পিতা-মাতার সান্নিধ্যেই তিনি সঙ্গীতকলায় হাতে খড়ি ও প্রশিক্ষণ নেন।

বাপ্পী লাহিড়ীর ব্যক্তিগত জীবন

ব্যক্তিগত জীবনে বাপ্পী লাহিড়ী চিত্রাণীকে বিবাহ করেন। তাদের দুই সন্তান – কন্যা রিমা এবং পুত্র বাপ্পা।

বাপ্পি লাহিড়ীর রাজনৈতিক জীবন

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ভারতীয় জনতা পার্টির তৎকালীন জাতীয় সভাপতি রাজনাথ সিংহের উপস্থিতিতে ৩১ জানুয়ারি ২০১৪ সালে বাপ্পী লাহিড়ী ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগদান করেন। ২০১৪ সালে তাকে শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী করা হয়েছিল। কিন্তু কল্যাণ ব্যানার্জির কাছে তিনি হেরে যান।

চলচ্চিত্রে বাপ্পী লাহিড়ীর প্রথম কাজ

১৯৭২ সালে তিনি ১৯ বছর বয়সে দাদু নামক বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ করেন।

প্রিসলির অনুকরণে বাপ্পী লাহিড়ী

শৈশব থেকেই তিনি আমেরিকান সঙ্গীতশিল্পী এলভিস প্রিসলিকে অনুকরণ করেছিলেন। তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সোনার চেইন এবং সোনার গয়না পরতেন। তিনি সোনাকে তার জন্য “ভাগ্যবান” বলে মনে করেন।

অলঙ্কারের ভক্ত বাপ্পী লাহিড়ী

বাপ্পী লাহিড়ী অলঙ্কারের ভক্ত হিসেবে পরিচিত। তাকে সাধারণত পোশাকের সাথে স্বর্ণের অলঙ্কার এবং কালো চশমা পরিধান করতে দেখা যায়।

বাপ্পী লাহিড়ীর সঙ্গীত জীবন

  • (১) ১৯ বছর বয়সে বাপ্পী লাহিড়ী মুম্বাইয়ে স্থানান্তরিত হন। ১৯৭৩ সালে হিন্দী ভাষায় নির্মিত নানহা শিকারী ছবিতে তিনি প্রথম গীত রচনা করেন। এরপর তাহির হুসেনের জখমী (১৯৭৫) চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এতে তিনি গীত রচনাসহ গায়কের দ্বৈত ভূমিকায় অংশ নেন।
  • (২) অসম্ভব কিছু নয় শিরোনামে মোহাম্মদ রফি এবং কিশোর কুমারের সঙ্গেও দ্বৈত সঙ্গীতে অংশ নেন। তার পরের চলচ্চিত্র হিসেবে চলতে চলতে ছবিটির গানও দর্শক-শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
  • (৩) রবিকান্ত নাগাইচের সুরক্ষা ছবিতে গান গেয়ে সঙ্গীতকার হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। এছাড়াও, তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে পরিচালিত অনেক হিন্দী চলচ্চিত্রের গানে অংশ নিয়েছেন।

বাপ্পী লাহিড়ী ও মিঠুন চক্রবর্তী

মিঠুন চক্রবর্তীর ডিস্কো নাচের চলচ্চিত্রগুলিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮০ এর দশকে মিঠুন চক্রবর্তী এবং বাপ্পী লাহিড়ী একসাথে বেশ কিছু ভারতীয় ডিস্কো চলচ্চিত্রে কাজ করেন।

‘ডিস্কো কিং’ বাপ্পী লাহিড়ী

ডিস্কো ঘরাণার গান গুলির মাধ্যমে সমগ্র ভারতবর্ষে তিনি নিজেকে ‘ডিস্কো কিং’ নামে পরিচিতি লাভে সমর্থ হন।

নেপথ্য কণ্ঠ শিল্পী বাপ্পী লাহিড়ী

বাপ্পী লাহিড়ী নিজের লিখিত বেশ কিছু গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হল –

  • (১) রহি হু মে (ওয়ান্টেড : ডেড অর এলাইভ)।
  • (২) বোম্বাই সে আয়া মেরা দোস্ত (আপ কি খাতির)।
  • (৩) মৌসম হ্যায় গানে কা (সুরক্ষা)।
  • (৪) তুম জো ভি হো (সুরক্ষা)।
  • (৫) তু মুঝে জান সে ভি পিয়ার হ্যায় (ওয়াদাত)।
  • (৬) ইয়াদ আ রাহা হ্যায় (ডিস্কো ড্যান্সার)।
  • (৭) সুপার ড্যান্সার (ড্যান্স ড্যান্স)।
  • (৮) দেখা হ্যায় ম্যায়নে তুমহে ফির সে পলটকে (ওয়ারদাত)।
  • (৯) দিল মে হে তুম (সত্যমেব জয়তে)।
  • (১০) জে লা লা (টারজান)।
  • (১১) বোম্বাই নাগারিয়া (ট্যাক্সি নং ৯২১১)

ডিস্কো ঘরাণার পূর্বে বাপ্পী লাহিড়ীর গান রচনা

হিন্দী চলচ্চিত্রে ডিস্কো ঘরণার গীত প্রচলনের আগে তিনি কিছু চীরস্মরণীয় গান রচনা করেছেন। এগুলি হল –

  • (১) চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখনা (দিল সে মিলে দিল)।
  • (২) দিল সে মিলে দিল (দিল সে মিলে দিল)।
  • (৩) মুসকুরাতা হুয়া (লহো কে দো রং)।
  • (৪) চার দিন কি জিন্দেগী হ্যায় (এক বার কাহো)।
  • (৫) ধীরে ধীরে সুবহ হুয়ে (হৈসিয়াত)।
  • (৬) মান হো তুম (টুটে খিলোনে)।
  • (৭) তেরি ছোটি সি ভুল (শিক্ষা)।
  • (৮) ইয়ে নয়না ইয়ে কাজল (দিল সে মিলে দিল)।
  • (৯) গাও মেরে মন (আপনে পরায়ে)।
  • (১০) পিয়া হি জিনে কি (আরমান)।
  • (১১) পেয়ার মাঙ্গা হ্যায় তুমহি সে
  • (১২) কে পাগ ঘুঙ্গরাও বান্ধ মিরা নাচি থি।

বাপ্পী লাহিড়ীর গজল রচনা

শুধুমাত্র ডিস্কো সঙ্গীতের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি তিনি। বেশ কিছু গজল গানও রচনা করেছেন তিনি। এর মধ্যে কিসি নজর কো তেরা ইন্তেজার আজ ভি হ্যায় (এইতবার), আওয়াজ দি হিয়া (এইতবার) অন্যতম।

সঙ্গীত পরিচালনায় বাপ্পী লাহিড়ী

এক বার কহো, সুরক্ষা, ওয়ারদাত, আরমান, চলতে চলতে, কমাণ্ডো, ইলজাম, পেয়ারা দুশমন, ডিস্কো ড্যান্সার, ড্যান্স ড্যান্স, ফিল্ম হি ফিল্ম, সাহেব, টারজান, কসম পয়দা করনে ওয়ালে কি, ওয়ান্টেড : ডেড অর এলাইভ, গুরু, জ্যোতি, নমক হালাল, শরাবী, এইতবার, জিন্দাগী এক জুয়া, হিম্মতওয়ালা, জাস্টিস চৌধুরী, নিপ্পু রাব্বা, রোদী ইন্সপেক্টর, সিমহাসনম, গ্যাং লিডার, ব্রহ্মা, হাম তুমহারে হ্যায় সনম, জখমী চলচ্চিত্রে বাপ্পী লাহিড়ী সঙ্গীত পরিচালনা করেন।

মালয়ালম ছবির সঙ্গীত পরিচালনায় বাপ্পী লাহিড়ী

তিনি মালায়ালম (কেরালা) চলচ্চিত্র দ্য গুড বয়েজ ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন।

সেরা সঙ্গীত পরিচালক বাপ্পী লাহিড়ী

শরাবী চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করে বাপ্পী লাহিড়ী ১৯৮৫ সালে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেন।

বাপ্পি লাহিড়ীর গান রচনার রেকর্ড

১৯৮৩-১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে প্রধান নায়ক হিসাবে জিতেন্দ্র অভিনীত ১২ টি সুপার-হিট রজত জয়ন্তী চলচ্চিত্রের জন্য গান রচনা করে বাপ্পি লাহিড়ী রেকর্ড তৈরি করেছিলেন।

বাপ্পী লাহিড়ীর ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে প্রবেশ

১৯৮৬ সালে ৩৩ টি চলচ্চিত্রের জন্য ১৮০ টিরও বেশি গান রেকর্ড করার জন্য তিনি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে প্রবেশ করেন।

চলচ্চিত্র জগত থেকে বাপ্পী লাহিড়ীর দূরত্ব

বাপ্পী লাহিড়ী ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ থেকে ১৯৯০র দশকের পর দূরে সরে যান। প্রকাশ মেহরার ‘দালাল’ ছবিতে তিনি স্বল্প সময়ের জন্য ফিরে এসেছিলেন।

কোভিড আক্রান্ত বাপ্পী লাহিড়ী

কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ী ২০২১ খ্রিস্টাব্দে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারপর থেকেই তার শরীর ভাল ছিল না। তিনি মুম্বইয়ের জুহুতে সিটিকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।

বাপ্পী লাহিড়ীর মৃত্যু

মুম্বাইয়ের হাসপাতালে ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাত্রি ১১টা ৪৫ মিনিটে ৬৯ বৎসর বয়সে অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগের কারণে বাপ্পী লাহিড়ী মৃত্যুবরণ করেন।

বাপ্পী লাহিড়ীর মৃত্যুতে সমবেদনা ও শোক প্রকাশ

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ক্যাবিনেট মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সহ রাজনীতিবিদরা বাপ্পী লাহিড়ীর প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগন, চিরঞ্জীবী, শ্রেয়া ঘোষাল, বিশাল দাদলানি, হিমেশ রেশমিয়া সহ অন্যান্যরাও শোক প্রকাশ করেছেন।

উপসংহার :- ১৯৮০ এর দশকের চলচ্চিত্র, বিশেষ করে ডিস্কো ড্যান্সার, নমক হালাল এবং শরাবীর ন্যায় বিভিন্ন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করে তিনি সমাদৃত হয়েছেন।

(FAQ) বাপ্পি লাহিড়ী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ডিস্কো কিং নামে পরিচিত ছিলেন কে?

বাপ্পী লাহিড়ী।

২. বাপ্পী লাহিড়ীর জন্ম কোথায়?

পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়।

৩. বাপ্পী লাহিড়ীর জন্ম কখন হয়?

২৭ নভেম্বর ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে।

৪. বাপ্পী লাহিড়ী কোন চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেন?

সরাবি, ১৯৮৫ সালে।

৫. বাপ্পী লাহিড়ীর মৃত্যু কখন হয়?

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে।

Leave a Comment