শশাঙ্কের ধর্মমত প্রসঙ্গে বাণভট্টের বর্ণনা, শশাঙ্কের বৌদ্ধ নীতি ও শশাঙ্কের বৌদ্ধ নীতির রাজনৈতিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানবো।
শশাঙ্কের ধর্মমত
ঐতিহাসিক ঘটনা | শশাঙ্কের ধর্মমত |
রাজ্য | গৌড় |
রাজধানী | কর্ণসুবর্ণ |
রাজা | শশাঙ্ক |
ধর্ম | শৈব ধর্ম |
ভূমিকা :- শশাঙ্কের মুদ্রায় মহেশ্বর বা শিবের মূর্তি খোদাই ছিল। তিনি ছিলেন শিবের উপাসক। শৈব শশাঙ্কের ধর্মনীতি সম্পর্কে বৌদ্ধ হিউয়েন সাঙ কটাক্ষ করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলিতে শশাঙ্কের বৌদ্ধ বিদ্বেষের উল্লেখ দেখা যায়।
বাণভট্টের বর্ণনায় শশাঙ্ক
বাণভট্টের রচনায় শশাঙ্ককে “গৌড়াধর্ম” “গৌড়ভুজঙ্গ” বলা হয়েছে। হিউয়েন সাঙের রচনা থেকে জানা যায় যে, শশাঙ্কের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছিল। তিনি বুদ্ধগয়ার পবিত্র বোধিবৃক্ষ ছেদন করেন এবং এই বৃক্ষের শিকড় উপড়ে দেন। তিনি পাটলিপুত্র -এ বুদ্ধের পদচিহ্ন পাথরের বুক থেকে তুলে ফেলেন। দ্বাদশ শতকের বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতেও শশাঙ্কের গোঁড়ামির উল্লেখ আছে।
শশাঙ্কের বৌদ্ধ নীতি
- (১) উপরের প্রমাণের ওপর নির্ভর করে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় ও ডঃ বসাক প্রমুখ পণ্ডিতেরা সমালোচনা করেন। যদিও হিউয়েন সাঙের শশাঙ্কের বিরুদ্ধে পক্ষপাত ছিল তথাপি কিছুটা সত্য না থাকলে তিনি একথা বলতে পারতেন না। শশাঙ্কের বৌদ্ধ নির্যাতন সম্পর্কে সত্যতা না থাকলে পাঁচ শত বছর পরেও তা কিংবদন্তি হয়ে বেঁচে থাকত না।
- (২) ডঃ বসাকের মতে, শশাঙ্কের বীরত্বের জন্য আমরা তার প্রশংসা করি, কিন্তু তার অবিবেচক ও অধার্মিক কাজকে কেউ সমর্থন করবেন না। ডঃ মজুমদার, ডঃ আর. পি. চন্দ প্রমুখ এই মতের বিরোধিতা করেছেন।
- (৩) ডঃ চন্দের মতে, শশাঙ্ক রাজনৈতিক কারণে হয়ত বৌদ্ধ নির্যাতন করেন। বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধনের প্রতি বৌদ্ধদের পক্ষপাতের জন্যই হয়ত শশাঙ্ক একাজ করেছিলেন। হর্ষবর্ধন ছিলেন শশাঙ্কের প্রধান শত্রু। বৌদ্ধরা তাঁর প্রতি আনুগত্য জানালে শশাঙ্ক স্বভাবতই বৌদ্ধ-বিদ্বেষী হন।
- (৪) সম্ভবত শশাঙ্কের বৌদ্ধ নির্যাতনের কাহিনীর মধ্যে অতিশয়োক্তি আছে। হিউয়েন সাঙ হর্ষবর্ধনের অনুগত ছিলেন এবং তিনি শশাঙ্কের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ ছিলেন। তার বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া যায় না। দ্বাদশ শতকের বৌদ্ধ রচনা শশাঙ্কের ৫০০ বছর পরের রচনা। এগুলি নির্ভরযোগ্য নয়।
- (৫) প্রাচীন ভারত -এর ইতিহাসে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার উদাহরণ বিরল। তাছাড়া হিউয়েন সাঙ নিজেই বলেছেন যে, বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসার যথেষ্ট ছিল। তিনি তাম্রলিপ্ত, কর্ণসুবর্ণ প্রভৃতি স্থানে বৌদ্ধ স্তূপ দেখেছিলেন। তাহলে বলা যায় যে, শশাঙ্ক ব্যাপকভাবে বৌদ্ধ বিরোধিতা করতেন একথা ঠিক নয়।
শশাঙ্কের বৌদ্ধ নীতির রাজনৈতিক ব্যাখ্যা
- (১) হিউয়েন সাঙের বক্তব্যকে একেবারে ভিত্তিহীন মনে করা যায় না। তিনি ছিলেন শশাঙ্কের প্রায় সমকালীন লেখক। হিউয়েন সাঙ বলেছেন যে, বোধিবৃক্ষ ছেদন করার পর শশাঙ্ক কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হন।
- (২) তাঁর কথার সত্যতা বৃহদ্ধর্ম পুরাণ হতে জানা যায়। এই পুরাণের মতে, শশাঙ্ক তাঁর রোগ নিরাময়ের জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে গ্রহবিপ্র বা শাকদ্বীপি ব্রাহ্মণদের বাংলায় বসবাসের জন্য আনেন। এর থেকে শশাঙ্কের রোগের কথা জানা যাচ্ছে।
- (৩) আসলে সপ্তম খ্রিস্টাব্দে বাংলায় উচ্চশ্রেণীর লোকেরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি অনুরাগ দেখাত এবং নিম্নশ্রেণীর লোকেরা বৌদ্ধধর্মের প্রতি আনুগত্য দিত। শশাঙ্ক এই সমকালীন সঙ্কীর্ণ ভাবধারার উর্দ্ধে ছিলেন না। তার শৈবধর্মের প্রতি অনুরক্তির একটি শ্রেণীগত চরিত্র ছিল।
- (৪) তাছাড়া তাঁর বৌদ্ধ-বিদ্বেষের পশ্চাতে রাজনৈতিক কারণও ছিল। শশাঙ্কের শত্রু হর্ষবর্ধন ছিলেন বৌদ্ধ। সুতরাং বাংলার বৌদ্ধরা তাঁর প্রতি আনুগত্য দেখায়। এজন্য শশাঙ্ক বৌদ্ধ নির্যাতন করেন। বাংলায় এই সময় ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হাতে।
- (৫) ডঃ নীহার রঞ্জনের মতে, বাংলার অর্থনীতি বৌদ্ধরাই এই সময় নিয়ন্ত্রণ করত। এই সম্প্রদায় শৈব শশাঙ্ককে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সাহায্য করতে বিরত থাকে। শশাঙ্কের মুদ্রার নিম্নমান তার আর্থিক দুর্গতির প্রমাণ দেয়। এজন্য তিনি হয়ত বৌদ্ধ-বিদ্বেষী হন।
উপসংহার :- শশাঙ্ক শৈব ছিলেন। বৌদ্ধ হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তাঁর বিরোধিতাও ছিল। তবে নিছক ধর্মীয় গোঁড়ামির বশে শশাঙ্ক বৌদ্ধ নির্যাতন করেন একথা মনে করা যায় না।
(FAQ) শশাঙ্কের ধর্মমত সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
শশাঙ্ক।
কর্ণসুবর্ণ।
মেদিনীপুর লিপি, গঞ্জাম লিপি।
৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে।
শৈব ধর্ম।