প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ -এর সময়কাল, বিবাদমান পক্ষ, খড়গ সিংহের সিংহাসন দখল, শের সিংহের সিংহাসন দখল, শিখ রাজ্যে চরম নৈরাজ্য, খালসা বাহিনীর ক্ষমতা দখল, জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি, ইংরেজ আক্রমণে রাজমাতা ঝিন্দনের প্ররোচনা, ঝিন্দনের অভিপ্রায়, পাঞ্জাব দখলের জন্য ইংরেজদের প্রস্তুতি, শিখদের আশঙ্কা, ইংরেজ রেসিডেন্টের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ, শিখদের পরাজয়, লাহোরের সন্ধি, সন্ধির শর্ত, লাহোরের দ্বিতীয় সন্ধি, দ্বিতীয় সন্ধির শর্ত গুলি সম্পর্কে জানবো।
১৮৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ
বিষয় | প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ |
সময়কাল | ১৮৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দ |
বিবাদমান পক্ষ | ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও শিখ শক্তি |
ফলাফল | শিখ শক্তির পরাজয় |
ভূমিকা :- রণজিৎ সিংহ -এর মৃত্যুর পর (১৮৩৯ খ্রিঃ) সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে তাঁর দুই পুত্র খড়গ সিংহ ও শের সিংহ -এর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই সংঘর্ষে শিখ দরবারও পরস্পর-বিরোধী দুই পক্ষে যোগদান করে পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তোলে।
খড়গ সিংহের সিংহাসন দখল
রণজিৎ সিংহের জ্যেষ্ঠ পুত্র অহিফেনসেবী, ইন্দ্রিয়াসক্ত ও অপদার্থ খড়গ সিংহ সিংহাসনে বসেন। তাঁর পুত্র নওনেহাল সিংহ ছিলেন প্রতিভাধর ও যোগ্য প্রশাসক। অপদার্থ পিতাকে প্রায় বন্দি করে রেখে তিনি সুষ্ঠুভাবে প্রশাসন চালান এবং রাজ্যে স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হন।
শের সিংহের সিংহাসন দখল
১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে খড়গ সিংহের মৃত্যু হয় এবং আশ্চর্যের কথা এর পরদিনই এক দুর্ঘটনায় বা পূর্ব পরিকল্পিত চক্রান্তের ফলে নওনেহাল সিংহ মারা যান। এর ফলে সিংহাসন নিয়ে পুনরায় গোলযোগ শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত দরবারের ডোগরা গোষ্ঠী ও খালসা বাহিনীর সাহায্য নিয়ে শের সিংহ সিংহাসনে বসেন (১৮৪১ খ্রিঃ)।
শিখ রাজ্যে চরম নৈরাজ্য
শের সিংহের রাজত্বকালে রাজ্যের শান্তি-শৃঙ্খলা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে শের সিংহ ও তাঁর শিশু পুত্র আততায়ীর হাতে নিহত হলে শিখ রাজ্যে চরমতম নৈরাজ্য দেখা দেয়।
খালসা বাহিনীর ক্ষমতা দখল
উপযুক্ত নেতার অভাবে খালসা বাহিনী রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ‘খালসা’ বাহিনীর দুই নায়ক লাল সিংহ ও তেজ সিংহ রণজিৎ সিংহের পাঁচ বছর বয়স্ক নাবালক পুত্র দলীপ সিংহ-কে সিংহাসনে বসিয়ে (১৮৪৩ খ্রিঃ) রাজ্যের সকল ক্ষমতা হস্তগত করেন। রাজমাতা ঝিন্দন দলীপ সিংহের অভিভাবিকা নিযুক্ত হন।
শিখ রাজ্যে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি
‘খালসা’ বাহিনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলে অবস্থা জটিল হয়ে ওঠে। বীর ও সাহসী হলেও তাঁরা স্বার্থপর ও ক্ষমতালোভী ছিলেন। দরবারে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়, প্রশাসন ভেঙ্গে পড়ে। খুন, জখম, হত্যা, দাঙ্গা ও অরাজকতা শিখ রাজ্যের সাধারণ নিয়মেপরিণত হয়।
ইংরেজ আক্রমণে মাতা ঝিন্দনের প্ররোচনা
শিখ নেতৃবৃন্দ খালসা বাহিনীর ঔদ্ধত্যে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। বলা হয়ে থাকে যে, খালসা বাহিনীর ঔদ্ধত্যের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যই রাজমাতা ঝিন্দন তাদের ইংরেজ রাজ্য আক্রমণে প্ররোচনা দেন।
রাজমাতা ঝিন্দনের অভিপ্রায়
তিনি মনে করেন যে, যুদ্ধে পরাজিত হলে খালসা বাহিনীর বিষদাঁত ভেঙ্গে যাবে এবং তারা সংযত হবে, আর জয়ী হলে শিখ রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি পাবে।
পাঞ্জাব দখলের জন্য ইংরেজদের প্রস্তুতি
শিখরাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইংরেজ-পক্ষও এই সময় পাঞ্জাব দখলের জন্য তৈরি হচ্ছিল। ১৮৪০ ও ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে ইংরেজ গভর্নর জেনারেল অকল্যাণ্ড ও এলেনবরা-র পাঞ্জাব দখল সম্পর্কে মন্তব্যই তার প্রমাণ।
পাঞ্জাব জয় প্রসঙ্গে অকল্যান্ডের বক্তব্য
১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে লর্ড অকল্যাণ্ড বলেন যে, “পাঞ্জাব জয়ের জন্য কোম্পানির সেনাবাহিনী ও কর্মচারীরা অধীর হয়ে উঠেছে।” এলেনবরা বলেন যে, “পাঞ্জাব অধিকার আসন্ন।”
আফগান যুদ্ধে শিখদের মর্যাদাহানি
আফগান যুদ্ধে শোচনীয় ব্যর্থতার পর মর্যাদা রক্ষার তাগিদে ইংরেজদের পাঞ্জাব জয় অপরিহার্য ছিল।
শিখদের আশঙ্কা
এই সময়ে লর্ড হার্ডিঞ্জ (১৮৪৪-৪৮ খ্রিঃ) শতদ্রু নদীর পূর্ব-তীরস্থ দুর্গগুলিতে ইংরেজ সৈন্যের সংখ্যাবৃদ্ধি করেন।সেখানে তাদের নিয়মিত কুচকাওয়াজ শুরু হয়, শতদ্রুর ওপর সেতু নির্মাণ শুরু হয় এবং মুলতান সীমান্তে একদল ইংরেজ সৈন্যের আগমন ঘটে। ইংরেজদের এই সব কার্যকলাপে শিখরা শঙ্কিত হয়ে ওঠে।
শিখদের প্রতি ইংরেজ রেসিডেন্টের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ
লাহোর দরবারে উপস্থিত ইংরেজ রেসিডেন্ট মেজর ব্রডফুটের উদ্ধত আচরণ ও অপমানজনক ব্যবহার শিখদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।
প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের সূচনা
এই পরিস্থিতিতে রাজমাতা ঝিন্দন খালসা বাহিনীকে ইংরেজদের আক্রমণে প্রণোদিত করেন। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ডিসেম্বর শিখবাহিনী শতদ্রু অতিক্রম করে ব্রিটিশ রাজ্য আক্রমণ করলে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ অমৃতসরের সন্ধি ভঙ্গের অভিযোগে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এইভাবে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ শুরু হয়।
প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে শিখদের পরাজয়
মুদকী (১৮৪৫ খ্রিঃ), ফিরোজ শাহ (১৮৪৫ খ্রিঃ), আলিওয়াল (১৮৪৬ খ্রিঃ) ও সেব্রাওঁ (১৮৪৬ খ্রিঃ)-এর যুদ্ধে যথার্থ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও তেজ সিংহ ও লাল সিংহের ‘নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতায়’ চারটি যুদ্ধেই শিখবাহিনী পরাজিত হয়।
ইংরেজ ও শিখদের মধ্যে লাহোরের সন্ধি স্বাক্ষর
বিজয়ী সেনাদল লাহোর দখল করলে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে শিখরা অপমানজনক লাহোরের সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়।
ইংরেজ ও শিখদের মধ্যে লাহোরের সন্ধির শর্ত
এই সন্ধির শর্তানুসারে,
- (১) বিপাশা ও শতদ্রু নদীর মধ্যবর্তী জলন্ধর-দোয়াব এবং শতদ্রু নদীর দক্ষিণস্থ সকল ভূভাগ ইংরেজদের হাতে সমর্পিত হয়।
- (২) ক্ষতিপূরণ হিসেবে শিখদের দেড় কোটি টাকা দিতে হয়—কিন্তু তাদের এত টাকা দেবার সামর্থ্য না থাকায় তারা কাশ্মীর রাজ্যটি ইংরেজদের ছেড়ে দেয়।
- (৩) শিখ সৈন্যের সংখ্যা হ্রাস করা হয় এবং
- (৪) লাহোরে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি (রেসিডেন্ট) রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
ইংরেজ ও শিখদের মধ্যে অমৃতসরের চুক্তি
পরে অমৃতসরের চুক্তি (মার্চ, ১৮৪৬ খ্রিঃ) দ্বারা কোম্পানি ১০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে কাশ্মীর রাজ্যটি জম্মুর ডোগরা সর্দার ও লাহোর দরবারের অন্যতম প্রধান সদস্য গোলাব সিংহকে বিক্রি করে। এই ঘটনায় লাহোর দরবারে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
অমৃতসরের চুক্তি সম্পর্কে কানিংহামের অভিমত
ইংরেজ ঐতিহাসিক কানিংহাম-এর মতে এই ব্যবস্থা ‘ইংরেজদের সুনাম ও মহত্ত্বের সঙ্গে একান্ত সামঞ্জস্যহীন (‘scarcely seems worthy of the British name and greatness’) ছিল।
ইংরেজ ও শিখদের মধ্যে লাহোরের দ্বিতীয় সন্ধি স্বাক্ষর
১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর শিখদের সঙ্গে ইংরেজদের লাহোরের দ্বিতীয় সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়।
ইংরেজ ও শিখদের মধ্যে লাহোরের দ্বিতীয় সন্ধির শর্ত
এই সন্ধির শর্তানুসারে,
- (১) ব্রিটিশ রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণাধীনে আটজন শিখ নেতাকে নিয়ে গঠিত একটি পরিষদের (Council of Regency) হাতে শিখরাজ্যের শাসনভার অর্পিত হয় এবং
- (২) লাহোরে একদল ইংরেজ সেনা রাখার ব্যবস্থা হয় এবং তার ব্যয় নির্বাহের জন্য শিখ সরকার বার্ষিক ২২ লক্ষ টাকা দিতে সম্মত হন।
উপসংহার :- বলা বাহুল্য, এর ফলে শিখ রাজ্যে কার্যত ব্রিটিশ শাসনই প্রবর্তিত হয় এবং ইংরেজ রেসিডেন্ট স্যার হেনরি লরেন্স-ই রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতার নিয়ামকে পরিণত হন।
(FAQ) প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দ।
লর্ড হার্ডিঞ্জ।
১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কোম্পানি ও শিখ শক্তির মধ্যে।