ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি

দস্তয়েভস্কি (১৮২১-১৮৮১) একজন রাশিয়ান ঔপন্যাসিক, দার্শনিক এবং মনস্তাত্ত্বিক, যিনি মানব প্রকৃতি, নৈতিকতা এবং ধর্মের গভীর প্রশ্ন নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর বিখ্যাত রচনাগুলোর মধ্যে Crime and Punishment, The Brothers Karamazov, The Idiot, এবং Notes from Underground অন্তর্ভুক্ত। দস্তয়েভস্কির রচনায় মানুষের মানসিক দ্বন্দ্ব, নৈতিকতা ও নৈরাশ্যবাদ সম্পর্কিত গভীর অনুসন্ধান লক্ষ্য করা যায়, যা তাকে রাশিয়ান সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব করে তুলেছে।

সাহিত্যিক দস্তয়েভস্কি

ঐতিহাসিক চরিত্রফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি
জন্ম১১ নভেম্বর, ১৮২১ খ্রি
জন্মস্থানমস্কো, রাশিয়া
পেশাঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, দার্শনিক, মনস্তাত্ত্বিক
বিখ্যাত রচনাCrime and Punishment, The Brothers Karamazov, The Idiot, Notes from Underground
সাহিত্যিক ধারারাশিয়ান সাহিত্য, বাস্তববাদ, অস্তিত্ববাদ
প্রধান বিষয়নৈতিকতা, ধর্ম, মানবিক যন্ত্রণা, দার্শনিক অনুসন্ধান
প্রভাবরাশিয়ান সাহিত্য, বিশ্ব সাহিত্য, দর্শন ও মনস্তত্ত্ব
মৃত্যু৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮১ খ্রি
ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি

ভূমিকা :- আপন সৃষ্টির মহিমায় স্রষ্টা লাভ করেন অবিনশ্বর কীর্তি, তাঁর কীর্তিগাথা রচিত হয় সৃষ্টিকে অবলম্বন করেই যুগ যুগ ধরে। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি এমনি এক গৌরবোজ্জ্বল নাম। কালোত্তীর্ণ সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে অমরত্ব লাভ করেছেন তিনি। সৃষ্ট সাহিত্যের মতোই বহুবিচিত্র দস্তয়ভস্কির জীবন। পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর জীবনের আবর্ত তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে মহত্ত্বর উপলব্ধিতে। তাঁর জীবন কেটেছে দুঃখ-যন্ত্রণা আর পাপের পঙ্কিলতার মধ্যে। তাই তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যে যেমন রয়েছে ধ্বংসের আহ্বান, তেমনি আছে জীবনেরও জয়গান। স্রষ্টা হিসেবে এখানেই তাঁর মহত্ত্ব। মানুষের বেদনাময় জীবনের ছবি, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, দুঃখের মধ্য দিয়ে অপার পবিত্রতায় উত্তরণ, দস্তয়েভস্কির সৃষ্ট সাহিত্যকে কালজয়ী করেছে।

দস্তয়েভস্কির জন্ম

১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ৩০ অক্টোবর দস্তয়েভস্কির জন্ম। তাঁর পিতা মিখাইল অস্ত্রেভিচ দস্তয়েভস্কি ছিলেন মস্কোর এক হাসপাতালের ডাক্তার। তাঁকে প্রতিপালন করতে হত একটি বিরাট সংসার।

সাহিত্যিক দস্তয়েভস্কির পিতার নিষ্ঠুর ব্যবহার

ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেই সংসারের সদস্য সংখ্যা ছিল চোদ্দ জন। ফলে সংসারের চাপে চব্বিশ ঘন্টা ব্যতিব্যস্ত থাকতে হত তাঁকে। কখনও এমন হত যে, তিনি তাঁর মানসিক সংযম হারিয়ে ফেলতেন। ক্ষিপ্ত হয়ে সংসারের লোকজনকে গালিগালাজ ও নির্যাতন করতেন। পিতার এই নিষ্ঠুর ব্যবহার বালক দস্তয়েভস্কির মনে বিরূপ প্রতিক্রয়া সৃষ্টি করত।

টুলার গ্রাম্য পরিবেশে দস্তয়েভস্কি

মস্কোর বাইরে টুলা জেলায় ডরাভয়ইতে প্রতিবছর গ্রীষ্মের সময় ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেড়াতে যেতেন মিখায়েল দস্তয়েভস্কি। এখানে গ্রাম পরিবেশে ছোটখাট একটা সম্পত্তি ছিল তাঁর। বাবার ছোট্ট কোয়ার্টারের বদ্ধজীবনের বাইরে টুলার গ্রাম্য পরিবেশে এসে শিশু দস্তয়ভস্কির মন মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলত। তিনি গাছপালা, ঝিল, প্রান্তর, পাখিদের কিচিরমিচির এসবের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন। সবচেয়ে আনন্দের যা তা হল, এখানে থাকত না পিতার কঠোর শাসন।

দস্তয়েভস্কির রুটিনে বাঁধা বাল্য জীবন

গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হলেই আবার সকলকে ফিরে আসতে হত মস্কোর কোয়ার্টরের সঙ্কীর্ণ জীবনে। এখানে জীবন ছিল রুটিনে বাঁধা। সকালেই যেতে হত স্কুলে। স্কুল থেকে ফিরে এসে বাড়ির বাইরে যাওয়া বা সকলের সঙ্গে মেলামেশা করা ছিল বারণ। তাই শাসনের গন্ডিতে আবদ্ধ থেকে হাঁপিয়ে উঠতেন দস্তয়েভস্কি।

সাহিত্যিক দস্তয়েভস্কির মায়ের মৃত্যু

১৮৩৪ থেকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চেরনাক-এর আবাসিক ইস্কুলে পড়াশুনো শেষ করে বাড়ি ফিরে আসার এক বছরের মধ্যেই তাঁর মা মারা যান। দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে শয্যাশায়ী হয়েছিলেন তিনি। ছেলেমেয়েরা মায়ের কাছে যেতে পারত না। অথচ মায়ের একটু স্পর্শ পাবার জন্য বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠত দস্তয়েভস্কির। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মায়ের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে দুচোখ জলে ভরে উঠত তাঁর বেদনায়।

উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দস্তয়েভস্কির প্রবৃত্তি

মায়ের চরিত্রের কোমলতা ও ভালবাসা দস্তয়েভস্কির কোমল মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই প্রভাবের ফলেই তিনি লাভ করেছিলেন মানুষের প্রতি ভালবাসা। তেমনি পরবর্তী জীবনে তাঁর মধ্যে যে নিষ্ঠুরতা ও লাম্পট্য প্রকাশ পেয়েছে তা তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন পিতার কাছ থেকে।

ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমিতে দস্তয়েভস্কি

স্ত্রীর মৃত্যুর পর মিখায়েলের জীবনের সুর কেটে গেল। শহরের জীবন, চাকরিবাকরি তাঁর আর ভাল লাগল না। শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে তিনি পরিবারের সকলকে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে গ্রামে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। এখানে আসার পরেই দস্তয়েভস্কি ও তাঁর দাদা মাইকেলকে ভর্তি করে দেওয়া হল মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমিতে।

দস্তয়েভস্কির পিতার মৃত্যু

গ্রামের সম্পত্তি চাষবাস ইত্যাদি দেখাশোনা করার জন্য মিখায়েলের শতাধিক ভূমিদাস ও ক্রীতদাস ছিল। তাদের প্রতি তিনি করতেন অত্যন্ত নির্দয় ব্যবহার। কারণে অকারণে তাদের তিনি নির্যাতন করতেন। কেবল তাই নয়, সুযোগ মতো গ্রামের মেয়েদেরও তিনি ধরে নিয়ে আসতেন নিজের শয়নকক্ষে। মিখায়েলের অত্যাচারে অল্পদিনের মধ্যেই গ্রামের লোকেদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠল। একদিন খুন হলেন তিনি। তাঁর ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া গেলেও পুলিশ ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দিয়েছিল। তাঁর প্রজারা টাকা দিয়ে পুলিশের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল।

মৃগীরোগগ্রস্ত দস্তয়েভস্কি

পিতার আকস্মিক মৃত্যুর পর দস্তয়েভস্কির মনোজগতে এক বিরাট বিপর্যয় নেমে এলো। এটা সত্য কথা যে বাল্য বয়স থেকেই পিতার প্রতি তাঁর মন ছিল বিরূপ। পিতার আর্থিক কৃপণতার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমিতে খুবই অর্থকষ্টে কাটাতে হত তাঁকে। এই সকল কারণে মনের অবচেতনে তিনি কামনা করতেন পিতার মৃত্যু হলেই এই নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে পারেন। এই অবস্থায় পিতার নিহত হবার ঘটনা তাঁর মনকে অপরাধবোধে আচ্ছন্ন করে ফেলল। তাঁর মনে হতে লাগল, পিতার মৃত্যুর জন্য দায়ী তিনিই। এই মানসিকতা থেকে ক্রমেই তাঁর মধ্যে দেখা দিল বিকার। তিনি মৃগীরোগগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। পরবর্তীকালে শোক বা মৃত্যুর কারণ জনিত আঘাত, উত্তেজনা, ইত্যাদির সংস্পর্শে এলেই তিনি ঘন ঘন মূর্ছা যেতেন। এই অসুস্থ মানসিক বিকার তাঁকে আমৃত্যু বহন করতে হয়েছে।

জুয়ার নেশায় আসক্ত দস্তয়েভস্কি

ইতিমধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমি থেকে পাস করে সামরিক বিভাগে ডিজাইনারের চাকরি নিলেন দস্তয়েভস্কি। এই কাজে সারা দিন তাঁকে নক্সা আঁকা, মাপজোপ, অঙ্ক কষা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হতো। ফলে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। মানসিক অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করার জন্য তিনি প্রায়ই জুয়ার টেবিলে বসতে আরম্ভ করলেন। ক্রমে আসক্তি বাড়ল। ফল হল, অফিসের সারা মাসের খাটুনির সম্বলটুকু দুচার দিনের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যেত। জুয়ার নেশার সঙ্গে সঙ্গে আমোদ ফুর্তির বিলাসিতাও অনিবার্য ভাবেই আঁকড়ে ধরল যুবক দস্তয়েভস্কিকে। ফলে টাকার চাহিদা দিন দিন বাড়তেই থাকে। জমিদারি থেকে যে টাকাকড়ি আসত, তার সমস্তই উড়ে যেতে লাগল আমোদ ফুর্তির পেছনে।

অনুবাদ কর্মে দস্তয়েভস্কি

আর্থিক চাহিদা সংকুলান করার উদ্দেশ্যে এই সময় দস্তয়েভস্কি স্থির করলেন ফরাসী, জার্মান সাহিত্য অনুবাদ করবেন। দাদা মাইকেলকেও টেনে নিলেন এই পরিকল্পনার মধ্যে। দুজনে মিলে ফরাসী সাহিত্যিক বালজাক-এর উপন্যাস অনুবাদের কাজ শুরু করলেন। লেখাটি ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে একটি রাশিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হল এবং তাতে কিছু অর্থাগমও হল। এই ভাবে অনুবাদ কর্মের মাধ্যমেই দস্তয়েভস্কির সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত হল বলা চলে। ক্রমে সাহিত্য জীবনের আকর্ষণ তাঁর কাছে দুর্নিবার হয়ে উঠল। ফলে চাকরি জীবনের বন্ধন কাটাতে হল। জীবিকা হিসেবে সাহিত্যকেই পুরোপুরি অবলম্বন করলেন এবার থেকে।

লেখার প্রতি দস্তয়েভস্কির নিষ্ঠা

লেখার ব্যাপারে বরাবরই তিনি ছিলেন অত্যন্ত খুঁতখুঁতে। পছন্দ না হলে পাতার পর পাতা লেখা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে লিখতে বসতেন। লেখার উৎকর্ষ সাধনের এই চেষ্টাই হল নিষ্ঠা। দস্তয়েভস্কির লেখার প্রতি নিষ্ঠা এমন ছিল যে, পাওনাদারের ঘন ঘন তাগিদ সত্ত্বেও, এমনকি জেলে পাঠাবার হুমকি সত্ত্বেও লেখা সম্পূর্ণ করেও পছন্দ না হওয়ায় সমস্ত পান্ডুলিপিই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। অথচ প্রকাশকের হাতে লেখা পৌঁছনো মাত্রই অর্থপ্রাপ্তি ছিল নিশ্চিত।

দস্তয়েভস্কির মৌলিক উপন্যাস রচনা

  • (১) অনুবাদ সাহিত্য দিয়ে লেখালিখি শুরু হলেও ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের বছর শেষ হবার আগেই দস্তয়েভস্কি একটি মৌলিক উপন্যাস রচনার কাজ শেষ করলেন। উপন্যাসটির নাম দিয়েছিলেন Poor Folk । এই সময়ে একই বাড়িতে বাস করতেন দস্তয়েভস্কির ইনজিনিয়ারিং একাডেমির বন্ধু গ্রিগরভিচ। তিনি একদিন বন্ধুর পান্ডুলিপিটি নিয়ে গেলেন উদিয়মান কবি সম্পাদক নেক্রাসভের কাছে।
  • (২) দুজনে মিলে রাত জেগে উপন্যাসটি পড়লেন। রাত শেষ হল মুগ্ধতা আর বিস্ময়ের মধ্য দিয়ে। দিন শুরুর প্রথম লগ্নেই দুই বন্ধু দস্তয়েভস্কিকে ঘুম থেকে তুলে অভিভূত স্বরে বলে উঠলেন, তোমার রচনা আমাদের মুগ্ধ করেছে। তুমি হবে আগামী দিনের মহৎ স্রষ্টা।
  • (৩) মুগ্ধ নোসভ উপন্যাসের পান্ডুলিপিটি নিয়ে গেলেন সে যুগের রাশিয়ান সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচক বেলিনস্কির কাছে। নতুন লেখকের রচনা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলেন তিনি। মুগ্ধ কণ্ঠে অভিনন্দন জানালেন লেখককে। বললেন, রাশিয়ান সাহিত্যে বাস্তবতার প্রবক্তা রূপে আবির্ভাব হল সম্ভাবনাময় এক প্রতিভার। আমি এক নতুন গোগোল-এর আর্বিভাব প্রত্যক্ষ করছি।

সাহিত্যিক মহলে দস্তয়েভস্কির দক্ষতার স্বীকৃতি

প্রথম উপন্যাস পুওর ফোক প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই লেখক হিসাবে পরিচিতি লাভ করলেন দস্তয়েভস্কি। দ্বিতীয় উপন্যাস দি ডবল প্রকাশিত হলে তিনি লাভ করলেন সুখ্যাতি। তাঁর রচনার মরমী আবেদন সহজেই পাঠক মনকে আকৃষ্ট করল। মানুষের বেদনাময় জীবনের বাস্তব শিল্পরূপ রূপায়নে দস্তয়েভস্কির দক্ষতা স্বীকৃতি পেল সাহিত্যিক মহলে।

বিপ্লবী সংগঠনে দস্তয়েভস্কি

  • (১) সময়টা ছিল জারের শাসনকাল। অত্যাচারী জার প্রথম নিকোলাস-এর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠেছিল বিপ্লবী সংগঠন। এমনি একটি সংগঠনের সঙ্গে এক বন্ধুর মাধ্যমে জীবনের প্রতিষ্ঠার সূত্রপাতেই যুক্ত হয়ে পড়লেন দস্তয়েভস্কি। সংগঠনটির নিয়মিত অধিবেশন বসত প্রটাসভস্কি নামে এক তরুণ সরকারী অফিসারের বাড়িতে।
  • (২) প্রতি শুক্রবারে সন্ধ্যায় সদস্যরা সেখানে জড়ো হতেন। এদের মধ্যে ছিলেন যেমন সরকারী কর্মচারী, তেমনি ব্যবসায়ী, শিক্ষক প্রভৃতি বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তি। সকলেরই লক্ষ্য অত্যাচারী শাসকের কবল থেকে দেশবাশীকে রক্ষা করা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, অভাব, অত্যাচার, অসাম্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চলত আলোচনা।
  • (৩) আগামী দিনের অত্যাচার নিপীড়নমুক্ত এক সুখী সমৃদ্ধ রাশিয়া গঠনের স্বপ্ন ভেসে বেড়াত প্রতিটি প্রতিবাদী তরুণের চোখে। দস্তয়েভস্কি একপাশে চুপচাপ বসে থেকে সকলের বক্তব্য শুনতেন। আলোচনার গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য করতেন। সভার কাজকর্ম সাধারণ আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। গঠনমূলক কোনো কর্মপ্রস্তুতির আয়োজন ছিল না।

দস্তয়েভস্কির ঘরে পুলিসের হামলা

ইতিমধ্যে জারের গুপ্তচরদের নজর পড়ল এই গুপ্তসভার প্রতি। সদস্যদের বিরুদ্ধে যথারীতি রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের রিপোর্ট তৈরি হল। এক রাতে পুলিসের হামলা হল দস্তয়েভস্কির ঘরে। ১৮৪৯ খিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল, নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই তিনি প্রেপ্তার হলেন।

বিনা অপরাধে বন্দি দস্তয়েভস্কি

আলোবাতাসহীন এক ছোট্ট কুঠুরিতে শুরু হল বন্দিজীবন। সেখানে তাঁর মতোই আরো অনেককে অটকে রাখা হয়েছিল। সমস্ত দিনে সামান্য সময়ের জন্য মাত্র কয়েক দফায় কুঠুরির বাইরে আসার সুযোগ পেতেন বন্দীরা। কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি ছিল না। দেওয়া হত না পড়ার জন্য কোনো বই বা পত্র পত্রিকা। জেলের এই বদ্ধ জীবনে তীব্র মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতেন দস্তয়েভস্কি। সম্পূর্ণ বিনা অপরাধেই তাঁকে বন্দী করা হয়েছিল। শাস্তি পাবার মতো কোন অপরাধ তিনি করেন নি। এমনকি জারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত হন নি। তথাপি জীবনে নেমে এলো অন্ধকার। এই অন্ধকারময় বদ্ধ জীবনের পরিণতি কী তা তিনি জনেন না। বিনা অপরাধে শাস্তি ভোগের দুঃসহ যন্ত্রণায় জর্জরিত হতে থাকে তাঁর মন।

দস্তয়েভস্কির নির্বাসন জীবন

  • (১) বন্দি অবস্থাতেই তিনি লিখলেন নিজের জীবনের ছায়ায় A Little Hero নামে একটি ছোট গল্প। চার মাস আটক থাকার পর শুরু হল বন্দীদের বিচারপর্ব। নানা ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের পর বিচারে বন্দীদের দেওয়া হল মৃত্যুদন্ড। কিন্তু সম্রাট নিকোলাস দয়া পরায়ন হয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ রোধ করে সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দিলেন।
  • (২) দস্তয়েভস্কির জন্য ঘোষিত হল সাইবেরিয়ায় চার বছর নির্বাসন তারপর চার বছর সৈনিক হিসাবে কাজ করার আদেশ। বিচারের প্রহসন শেষ হল ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২২শে ডিসেম্বর। নতুন বছরের শুরুতেই পায়ে আট পাউন্ড ওজনের লোহার বেড়ি পরিয়ে তাঁকে চালান করা হল সাইবেরিয়ার নির্বাসন শিবিরে।
  • (৩) দেশের যত খুনী বদমাশদের সঙ্গে নরকতুল্য পরিবেশে শুরু হল দস্তয়েভস্কির নির্বাসন জীবন। ছোট্ট কুঠুরিতে শীতের দিনে ভোগ করতে হত হিমেল হাওয়ার কনকনে ঠান্ডা। পা ফেটে বেরুত রক্ত। গ্রীষ্মের দিনে সেদ্ধ হতে হত বিনা আগুনে।
  • (৪) নির্বাসন জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণার এখানেই শেষ ছিল না। দিনের বেলা খাটতে হত হাড়ডাঙ্গা খাটুনি। সেই খাটুনির পরিশ্রম সইতে না পেরে দস্তয়েভস্কি প্রায়ই জ্ঞান হারাতেন। তার জন্য প্রহরীর চাবুক পড়ত পিঠে। খুনী কয়েদিরা ছুঁড়ে দিত বিদ্রূপ।
  • (৫) এই পরিবেশে থেকে তাঁর পুরনো মৃগী রোগের প্রকোপ আরো বেড়ে যেতে লাগল। নির্বাসন জীবনের এই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা সারা জীবনে ভুলতে পারেন নি দস্তয়েভস্কি। এই অভিজ্ঞতা নিয়েই পরবর্তী জীবনে লিখেছিলেন House of the Dead উপন্যাস।

সাহিত্যিক দস্তয়েভস্কির সৈনিক জীবন

১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ দীর্ঘ চার বছর সাইবেরিয়ার বন্দিনিবাসে কাটিয়ে শাস্তির প্রথম পর্যায় থেকে মুক্ত হলেন দস্তয়েভস্কি। এবারে শুরু হবে চার বছরের সৈনিক জীবন। এ-ও বন্দিজীবন তবে এবারে কিছুটা স্বাধীনতা ছিল। তাঁকে পাঠানো হল সেমিপলতিনস্ক শহরের সেনা ছাউনিতে। সামরিক জীবনের নিয়মবদ্ধ কুচকাওয়াজ গোড়ার দিকে দস্তয়েভস্কির অনভ্যস্থ অসুস্থ শরীরকে কিছুটা দুর্বল করে ফেললেও অসম্ভব মানসিক শক্তির বলে তিনি সামলেও উঠলেন। কেবল তাই নয়, নিজের কর্মদক্ষতা দেখিয়ে উঁচু পদে স্থান পেলেন।

সেনা নায়কের বাড়িতে দস্তয়েভস্কি

সহসা ভাগ্যের প্রসন্ন দৃষ্টিপাত ঘটল দস্তয়েভস্কির প্রতি। শহরের সেনা নায়কের বাড়িতে তাঁর তলব পড়ল।ভদ্রলোক শুনেছিলেন, তাঁর সৈন্যদলের মধ্যে একজন শিক্ষিত লোক আছে। তাই খোঁজ খবর নিয়ে তিনি ডেকে পাঠালেন দস্তয়েভস্কিকে। দুজনের পরিচয় হল এবং সেইদিন থেকে দস্তয়েভস্কিকে সেই অফিসারের বাড়ি গিয়ে তাকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাতে হত।

দস্তয়েভস্কির প্রেম

  • (১) এই সময়েই তিনি পরিচিত হন আলেকজান্ডার ইসায়েভ নামের এক সরকারী কর্মচারীর সুন্দরী তরুণী স্ত্রীর সঙ্গে। মারিয়া ভিমিট্রিয়েভনা তাঁর নাম। অকর্মন্য অসুস্থ মদ্যপ স্বামী-সম্পর্কে এক পুত্র সন্তানের জননী মারিয়া ছিলেন অবহেলিতা। প্রথম পরিচয়েই তিনি আকৃষ্ট হন দস্তয়েভস্কির প্রতি। দুজনেরই জীবন দুঃখময়। তাই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে সময় লাগে না।
  • (২) দস্তয়েভস্কির দুঃখময় নির্বাসিত জীবনে মারিয়ার প্রেম দেখা দিল এক আনন্দময় নতুন জীবনের আহ্বান হয়ে। মারিয়া ছিলেন বহুচারিণী। দস্তয়েভস্কিকে পাশে রেখেই আলেকজান্ডার ওয়ানগেল নামে এক তরুণ আইনজীবীর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা শুরু করলেন। তবে এই নতুন সম্পর্ক গাঢ়তর হয়ে ওঠার আগেই মারিয়ার স্বামী বদলি হয়ে গেলেন দূরের এক শহরে।
  • (৩) মারিয়া দূরে চলে যেতে মানসিক বিপর্যয়ে ভুগলেন কিছুদিন দস্তয়েভস্কি। কয়েকমাস পরে মারিয়ার অসুস্থ স্বামী মারা গেলেন। দস্তয়েভস্কি ওয়ানগেলের কাছ থেকে ধার করে টাকা পাঠাতে লাগলেন মারিয়াকে। এভাবে বছরখানেক কাটল।
  • (৪) একদিন দস্তয়েভস্কি গেলেন মারিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তখন এক স্কুল শিক্ষকের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন। দেখেশুনে মুষড়ে পড়লেন দস্তয়েভস্কি। কিন্তু পিছু হটলেন না। জীবনে প্রথম প্রেমের স্বাদ পেয়েছেন তিনি মারিয়ার কাছ থেকে।

সাহিত্যিক দস্তয়েভস্কির বিবাহ ও সংসার জীবন

বহু সাধ্য সাধনায় মারিয়ার মনের পরিবর্তন ঘটিয়ে দুজনে বিয়ে করলেন ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে। বিয়ের দু বছরের মাথায় সাইবেরিয়ায় নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হল। দস্তয়েভস্কি সামরিক বিভাগের চাকরি ছেড়ে স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে চলে এলেন ছোট্ট টিভর শহরে। অদূরেই মস্কো শহর। এতদিন ছিলেন একা। এবার দস্তয়েভস্কির কাঁধে সংসারের চাপ। অর্থের সংস্থানের জন্য আবার কলম নিয়ে বসলেন। নির্বাসিত জীবনের অভিজ্ঞতা অবলম্বনে লিখলেন The House of the Dead.

দস্তয়েভস্কির পত্রিকা প্রকাশ

সাহিত্যের জগতে অখ্যাত লেখকের লেখা প্রকাশের ঝুঁকি নিতে চাইল না কোনো প্রকাশক। ভাই মাইকেলের সঙ্গে পরামর্শ করে দুজনে মিলে প্রকাশ করলেন Time নামে একটি পত্রিকা। এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হতে লাগল লেখাটি। সাইবেরিয়ার নির্মম বন্দিজীবনের ওপর ইতিপূর্বে কোনও লেখকই তেমনভাবে আলোকপাত করেন নি। দস্তয়েভস্কির লেখায় ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতার মূর্ত ছবি। তাই এই লেখা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক মহলে সাড়া তুলল। লেখার জনপ্রিয়তা লেখকের জীবনে আনল খ্যাতি, অর্থ।

লেখক দস্তয়েভস্কির সংসারে অশান্তি

গৃহিণী হিসেবে মারিয়া ছিলেন চরম অমিতব্যয়ী ও বিশৃঙ্খল। বিলাস-ব্যসনেই টান বেশি। ফলে স্ত্রীর চাহিদা মতো অর্থের জোগান দিতে ব্যর্থ হলেন দস্তয়েভস্কি। সংসারে দেখা দিল অশান্তি, মনোমালিন্য। সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মারিয়া ক্রমশই বোঝাস্বরূপ হয়ে উঠতে লাগলেন। মানসিক বিষাদ ভুলে থাকার জন্য দস্তয়েভস্কি বেশি করে মনোযোগ দিলেন লেখায়।

ফ্রান্সে এলেন দস্তয়েভস্কি

এই সময়ে পলিনা নামে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এক সুন্দরী তরুণীর প্রতি আকৃষ্ট হলেন দস্তয়েভস্কি। দুজনে স্থির করলেন, ফ্রান্স-এ গিয়ে এক সঙ্গে থাকবেন। প্রকাশকের কাছ ৩০০০ রুবল ধার করলেন দস্তয়েভস্কি। বিনিময়ে শর্ত থাকল, এক বছরের মধ্যে একটি উপন্যাস লিখে দেবেন এবং তাঁর রচনাবলী প্রকাশক প্রকাশ করবেন তিন খণ্ডে। ধারের টাকা সম্বল করে পলিনাকে নিয়ে ফ্রান্সে গেলেন দস্তয়েভস্কি। কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই অন্য পুরুষে আসক্ত হলেন পলিনা। পরিত্যক্ত হলেন দস্তয়েভস্কি।

দস্তয়েভস্কির স্ত্রী ও ভাইয়ের মৃত্যু

হাতে যৎসামান্য অর্থ তখন অবশিষ্ট। তাই সম্বল করে জুয়ার আসরে যাতায়াত শুরু করলেন তিনি। তাঁর এই জুয়াড়ি জীবনের অভিজ্ঞতা পরে তাঁর সাহিত্যের মধ্যেও চিত্রায়িত হয়েছে। স্ত্রী মারিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর চিকিৎসা ও সেবা যত্নের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন দস্তয়েভস্কি। সবই ব্যর্থ হয়। তিনি মারা গেলেন ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে। মাস তিনেক পরেই মারা গেলেন দস্তয়েভস্কির জীবনের অন্যতম অবলম্বন বড়ভাই মাইকেল। তাঁর মৃত্যুতে মনের দিক থেকে অসহায় হয়ে পড়লেন তিনি।

বিশ্বসাহিত্যের অনীতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস Crime and Punishment

এই মানসিক অবস্থাতেই তিনি লিখলেন Crime and Punishment উপন্যাস। এই উপন্যাসে তিনি জগতের মানুষের সামনে উচ্চারণ করেছেন দুঃখজয়ী মানবাত্মার স্তুতি। নিজের জীবনের দুঃখের মধ্য দিয়ে মানবজীবনের চরম সত্য উপলব্ধিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি। তাঁর Crime and Panishment বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির অন্যতম।

দস্তয়েভস্কি কর্তৃক স্টেনোগ্রাফার নিয়োগ

এই উপন্যাস লেখা শেষ হবার আগেই প্রকাশককে নতুন উপন্যাস দেবার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে এল। দু’মাস মাত্র আর সময় হাতে। দুর্ভাবনায় অস্থির হয়ে শেষ পর্যন্ত এক বন্ধুর পরামর্শে অ্যানা নামের এক তরুণী স্টেনোগ্রাফার নিযুক্ত করলেন লেখার কাজে সাহায্য করার জন্য। বছর কুড়ি বয়সের অ্যানাকে সঙ্গে নিয়ে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ অক্টোবর একটি নতুন লেখা শুরু করলেন। পড়ার ঘরে মুখোমুখি বসে তিনি বলে যান, সঙ্গে সঙ্গে তা খাতায় ঢুকে নেন অ্যানা। এভাবে এক মাসের মধ্যেই দস্তয়েভস্কি লেখা শেষ করলেন তাঁর নতুন উপন্যাস-এক জুয়াড়ির গল্প। প্রকাশকের ঘরে উপন্যাস জমা দেবার শেষ তারিখ ছিল ১ নভেম্বর। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে দেখা গেল প্রকাশকের ঘর বন্ধ। দস্তয়েভস্কি তাঁর পান্ডুলিপি থানায় জমা দিয়ে আসেন।

সাহিত্যিক দস্তয়েভস্কির দ্বিতীয় বিবাহ

  • (১) তরুণী অ্যানা ছিলেন মমতাময়ী। সাংসারিক জ্ঞানহীন, অস্থির চরিত্র দস্তয়েভস্কির জীবনের অসহায়তা তাঁর হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। তাই লেখার কাজের সঙ্গে সংসারের জরুরী কাজকর্মও তিনি যত্নের সঙ্গে করে দিতেন। এর আগে মারিয়া, পলিনা এসেছিল দস্তয়েভস্কির জীবনে। কিন্তু তাঁরা তাঁকে সংসারের সুখ দিতে পারেন নি।
  • (২) অ্যানাকে কাছে থেকে দেখে তাঁর মনে হল, এই মেয়ে তাঁর অপূর্ণ জীবনে পূর্ণতা আনতে পারবে। একদিন নিজেই বিবাহের প্রস্তাব করলেন অ্যানার কাছে। তাঁর তখন বয়স পঁয়তাল্লিশ। তবুও অ্যানা সানন্দে সম্মতি জানাল।
  • (৩) দস্তয়েভস্কির পরিবারের লোকজন, বড়ভাই মাইকেলের বিধবা, পালিতপুত্র নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে এ বিয়েতে বিরোধিতা করল। সব কিছু অগ্রাহ্য করে দস্তয়েভস্কি অ্যানাকে বিয়ে করলেন। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই বুদ্ধিমতী অ্যানা উপলব্ধি করতে পারলেন তাঁদের দুজনকে ঘিরে পড়ছে হিংসা আর বিদ্বেষের বিষ নিঃশ্বাস।
  • (৪) দস্তয়েভস্কি তখন রিক্ত হস্ত। তবুও নিজের চেষ্টায়, ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করে তিনি স্বামীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ঘর ছেড়ে। ঘুরতে লাগলেন ইউরোপ-এর দেশে দেশে। প্রকাশকদের কাছ থেকে মাঝে মাঝে টাকা পান দস্তয়েভস্কি। তার বেশিরভাগটাই তিনি উড়িয়ে আসেন জুয়ার টেবিলে। সংসার খরচ চালাতে চোখে অন্ধকার দেখেন অ্যানা।

দস্তয়েভস্কির The Ediot উপন্যাস

এই সময় এমনও দিন গেছে, খাবার কেনার জন্য দস্তয়েভস্কিকে গায়ের পোশাক বন্ধক দিতে হয়েছে। অবস্থা সামাল দিতে নতুন উপন্যাস দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রকাশকদের কাছ থেকে টাকা ধার করেন। ধার শোধ করতে লেখা নিয়ে বসেন। এইভাবে জন্ম নিল The Ediot উপন্যাস। প্রেমের দ্বন্দ্বে ক্ষত বিক্ষত ঈশ্বর বিশ্বাসী, সরল ও পবিত্র এক বাস্তববুদ্ধিশূন্য মানুষের করুণ পরিণতি হল এই কাহিনীর উপজীব্য।

সাহিত্যিক দস্তয়েভস্কির যাযাবর জীবন

উপন্যাস শেষ করে এক দেশ থেকে আর এক দেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন দস্তয়েভস্কি। যাযাবর জীবনের সঙ্গী হয়ে রইল নিত্য দারিদ্র্য। এই অবস্থাতেই লিখলেন The Eternal Husband The Possessed! এভাবে ঘুরে ঘুরে চার বছর গত হল। দস্তয়েভস্কির মন স্থির নেই। এর মধ্যে একটি সন্তানের মৃত্যু হয়েছে তিন মাস বয়সে। দ্বিতীয় সন্তান দেড় বছরের মেয়ে অ্যানার কোলে। এই অবস্থায় সে আবার সন্তান সম্ভবা। দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে দস্তয়েভস্কির মন। কিন্তু হাতে টাকা নেই। শেষ সম্বলটুকু নিয়ে একদিন বসলেন জুয়ার টেবিলে। সর্বস্বান্ত হলেন। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন দস্তয়ভস্কি। এই সঙ্কট সময়ে এক সহৃদয় বন্ধু অর্থ সাহায্য করলেন।

ফিওদর দস্তয়েভস্কির সংসারে সুখের আগমন

দীর্ঘ চার বছর পরে স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে পিটসবার্গের বাড়িতে ফিরে এলেন তিনি। সময়টা ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ। একমাস পরেই সংসারে এল পুত্র সন্তান। বুদ্ধিমতি অ্যানা হাতে সামান্য টাকা থাকতে থাকতেই সচেতন হলেন। বিশৃঙ্খল স্বভাবের অস্থিরচিত্ত স্বামীর ওপরে আর ভরসা করলেন না। পাওনাদারের উৎপাত বন্ধ করলেন ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করে। প্রকাশকরা খুব সামান্য অর্থই দিত। অ্যানা তাই দস্তয়েভস্কির সমস্ত বই প্রকাশের দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। তাঁর আন্তরিক চেষ্টায় ও যত্নে অল্প দিনের মধ্যেই সংসারের দৈন্যদশা ঘুচল। জীবনে সুখ শান্তির প্রত্যাশায় শেষ যৌবনে তরুণী অ্যানাকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিলেন দস্তয়েভস্কি। তাঁর সে আশা অপূর্ণ রাখেন নি অ্যানা। তিনি তাঁর দেহ মন উজাড় করে দিয়েছিলেন দস্তয়েভস্কিকে। তাই জীবনের প্রৌঢ় বেলায় তৃপ্তি আর সুখের আস্বাদ পেলেন দস্তয়েভস্কি।

জাতির প্রবক্তা দস্তয়েভস্কি

দুঃখ দুর্দশার ভার কিছুটা শিথিল হতে দস্তয়েভস্কি মহৎ সৃষ্টির প্রেরণা লাভ করলেন। তুর্গেনিভ, তলস্তয়-এর সাহিত্যকীর্তি তাঁকে উদ্বুদ্ধ করল। দীর্ঘ চার বছরের নিবিষ্ট সাধনায় তিনি রচনা করলেন, The Brothers Karamasov উপন্যাস। এক মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিতে দস্তয়েভস্কি গ্রথিত করেছেন এই উপন্যাসের দীর্ঘ কাহিনী। বৈশিষ্ট্যে ও গভীরতায় জীবন্ত রূপ পেয়েছে প্রতিটি চরিত্র। এই উপন্যাস তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি। রাশিয়ার সাহিত্যে স্বমহীমায় ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তিমান হলেন দস্তয়েভস্কি। বিশ্বমানবের আত্মীক বন্ধনে বিশ্বাসী, মানবতার একনিষ্ঠ প্রচারক দস্তয়েভস্কিকে রাশিয়ার মানুষ শ্রদ্ধা ভালবাসায় অভিষিক্ত করল। তিনি হয়ে উঠলেন জাতির প্রবক্তা।

দস্তয়েভস্কির মৃত্যু

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর ভেঙ্গে পড়ছিল তাঁর। ক্রমে এগিয়ে এল ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারী। শয্যাশায়ী দস্তয়েভস্কি। সাইবেরিয়ার নির্বাসনে যাবার সময় এক মহিলা তাঁকে একটি বাইবেল উপহার দিয়েছিলেন। সযত্নে রক্ষিত আছে সে বই। অ্যানাকে ডেকে চেয়ে নিলেন বাইবেলটি। পড়তে পড়তে একসময় বলে উঠলেন, “সময় হয়েছে, এবার আমায় যেতে হবে।” দিনটা কাটল। সন্ধ্যায় বিদায় নিলেন জীবনপথের চির পথিক দস্তয়েভস্কি।

উপসংহার :- ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি মানব প্রকৃতি, নৈতিকতা, এবং অস্তিত্ববাদ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেছেন। তার রচনায় তিনি মানুষের মানসিক এবং নৈতিক দ্বন্দ্ব, নৈতিক সংকট, এবং সমাজের অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই নিয়ে আলোচনা করেছেন। দস্তয়েভস্কির লেখাগুলোতে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক দ্বন্দ্বের গভীরতা তুলে ধরা হয়েছে। তার রচনা জীবনের গভীর দার্শনিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়, যেখানে ধর্ম, নৈতিকতা, এবং মানব প্রকৃতি নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দস্তয়েভস্কির কাজ সমাজে অপরাধ, দারিদ্র্য, এবং মনস্তাত্ত্বিক সংকটকে যেমন তুলে ধরে, তেমনি মানুষের আত্মার মুক্তি ও নৈতিক পরিশুদ্ধির জন্যও প্রস্তাবনা দেয়।

(FAQ) ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ফিওদর দস্তয়েভস্কির সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস কোনটি?

দস্তয়েভস্কির সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে Crime and Punishment, The Brothers Karamazov, এবং The Idiot অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে Crime and Punishment তাঁকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়।

২. দস্তয়েভস্কি কোন ধরণের বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতেন?

দস্তয়েভস্কি তাঁর রচনায় মানব প্রকৃতি, নৈতিক দ্বন্দ্ব, পাপ, শাস্তি, ধর্ম এবং অস্তিত্ব নিয়ে গভীর দার্শনিক অনুসন্ধান করেছেন। তাঁর রচনায় মানুষের মানসিক এবং নৈতিক সংকটের বিশ্লেষণ লক্ষণীয়।

৩. দস্তয়েভস্কির সাহিত্যিক ধারা কী ছিল?

দস্তয়েভস্কির সাহিত্যিক ধারা প্রধানত রাশিয়ান বাস্তববাদ এবং অস্তিত্ববাদী চিন্তাভাবনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তিনি মানব অভিজ্ঞতা এবং সমাজের গভীর সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করতেন।

৪. দস্তয়েভস্কির ব্যক্তিগত জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কি তাঁর লেখায় প্রভাব ফেলেছিল?

হ্যাঁ, দস্তয়েভস্কির ব্যক্তিগত জীবনে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন, অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং তার নিজস্ব নৈতিক ও ধর্মীয় অনুসন্ধান তাঁর লেখায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষত, তাঁর সাইবেরিয়ার জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর চিন্তাধারার বিকাশে সহায়ক হয়।

৫. দস্তয়েভস্কি কি ধরনের চরিত্র সৃষ্টি করেছেন?

দস্তয়েভস্কির চরিত্রগুলো সাধারণত মানসিক দ্বন্দ্বপূর্ণ, নৈতিক সংকটে থাকা এবং আত্মপর্যালোচনায় নিমগ্ন থাকে। তাঁর অনেক চরিত্রই পাপ, শাস্তি, এবং ক্ষমা নিয়ে অভ্যন্তরীণ সংগ্রামে লিপ্ত থাকে।

৬. দস্তয়েভস্কির রচনায় ধর্ম কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

দস্তয়েভস্কির রচনায় ধর্ম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি নৈতিকতা, বিশ্বাস, পাপ, এবং মানুষের আত্মিক মুক্তি নিয়ে গভীর আলোচনা করেছেন, যা তাঁর রচনায় মূল থিম হিসেবে উপস্থিত।

৭. দস্তয়েভস্কি কি অস্তিত্ববাদী লেখক ছিলেন?

দস্তয়েভস্কিকে অস্তিত্ববাদী চিন্তাভাবনার পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও তিনি সরাসরি অস্তিত্ববাদী লেখক নন, তাঁর রচনায় মানব অস্তিত্বের অর্থ, নৈতিক সংকট, এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ে আলোচনা অস্তিত্ববাদী দর্শনের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ।

Leave a Comment