হুমায়ুনের অন্দরমহল

ভরতের মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের অন্দরমহল প্রসঙ্গে হুমায়ুনের অন্দরমহল বা হারেমের পত্নী-উপপত্নী, হুমায়ুনের অন্দরমহলের রক্ষিতা, হুমায়ুনের অন্দরমহলের পরিচারিকা ও হুমায়ুনের অন্দরমহলের ইতিহাস সম্পর্কে জানব।

মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের অন্দরমহল

ঐতিহাসিক বিষয়হুমায়ুনের অন্দরমহল
সাম্রাজ্যমোঘল সাম্রাজ্য
মোঘল সম্রাটহুমায়ুন
প্রিয়তমা পত্নীহামিদবানু বেগম
পুত্রআকবর

জহীরউদ্দীন মহম্মদ বাবরের প্রিয়তমা পত্নী মাহমের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন নসীরউদ্দীন মহম্মদ বলে যে ভাগ্যবান সন্তানটি তিনি তার পরিচিত হুমায়ুন উপনামেই বিখ্যাত ৷ ঘটনাক্রমে কিশোর বয়সেই তিনি তার পিতার সিংহাসনে আরোহণ করার দুৰ্লভ সুযোগ পান I আর বিশ বছরের মধ্যেই তার বিয়ে হয়ে গিয়ে প্রথম সন্তানের জন্মও হয়েছিল।

প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছে। গর্বিত পিতা হুমায়ুন চিঠি লিখে নবজাতকের ঠাকুরদা সম্রাট বাবরকে সে সংবাদ জানিয়েছেন। ঠাকুরদাও দারুণ খুশি হয়ে নবজাতকের আবির্ভাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। হুমায়ুন আদর করে তার প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন – ‘অল-অমান’, যার অর্থ সংরক্ষা। লোকে ভূল করে উচ্চারণ করত অলামন বা ইলামন – যাঁর অর্থ যথাক্রমে ‘ডাকাত’ এবং ‘আমি অনুভব করি না’। নামকরণের এক দুর্ভাগ্যজনক পরিণাম।

আসলে হুমায়ুনের রাজনৈতিক জীবনের জন্মকুণ্ডলীতেই ছিল একটা দুর্ভাগ্যের রহস্যময়তা। তার বিবাহিত জীবনের অন্তরালেও মাঝে মাঝে এই ভাগ্যহীনতার ছায়াপাত যে ঘটেনি এমন নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে প্রেমের রহস্যময়তা, ভালবাসার হাতছানি এই দুর্ভাগ্যতাড়িত সম্রাটের অন্তরঙ্গ জীবনকে বেশ মনোরম করে তুলেছিল।

মোগল সম্রাটের অন্দরমহলে তাদের পত্নী-উপপত্নীর সংখ্যা নির্ণয় করতে যাওয়া একটা বোকামি। বাবরের পত্নী সংখ্যাকে সম্ভবত তার পুত্র অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। এর মধ্যে হিসেবে গুণে এনেছি আমরা আটজনকে – যদিও দুজন ছাড়া অন্যেরা তার জীবনে তেমন কোনো ভূমিকা গ্রহণ করে উঠতে পারেন নি। তবে অন্দরমহল গুলজার করে রাখতে পেরেছিলেন অবশ্যই।

তার প্রথম সন্তান অল-অমান- যার কথা আগেই বললাম তার গর্ভধারিণী ছিলেন বেগা বেগম। সম্ভবত ইনিই প্রথম বিবাহিত পত্নী ছিলেন হুমায়ুনের। এঁর একটা অন্য নামও ছিল – হাজী বেগম। ইনি ছিলেন হুমায়ুনের বৈমাত্রেয় ভাই কামরানের খুড় শ্বশুর (গুলরুখের নিজের কাকা ) ইয়াদগার বেগের কন্যা।

প্রথম স্ত্ৰী বলেই কিনা জানি না, বেগা বেগম স্বামীর উপর একটু কর্তৃত্ব করতে ভালবাসতেন। ভালবাসতেন, স্বামীকে তিনি কতটা ভালবাসেন বা বশে রেখেছেন লোকেদের কাছে, সতীনদের কাছে বিশেষ করে, তা দেখাতে। একটু তর্ক করতেন ভালবাসতেন, ভালবাসতেন একটু জেদ প্রকাশ করতেও। হুমায়ুন এমনিতে তাকে একটু প্রশ্রয় দিতেন ৷ তার ছেনালীতে বুঝি একটুখানি মজাও পেতেন ৷ কিন্তু সম্রাট বলে কথা৷ বেগমের আচল ধরা হয়ে থাকতে হুমায়ুনের আদৌ ইচ্ছে ছিল না। আর মোগল-সম্ৰাটদের অন্দর মহলে একটিমাত্র বেগমেরই তো অধিকার ছিল না ৷ যদিও একজনই শেষ অবধি সবচেয়ে প্রিয়পাত্রী হয়ে জীবনটাকে ব্যাপ্ত করে, অধিকার করে থাকতেন।

কিন্ত বেগা বেগম সেই প্রিয়পাত্রী ছিলেন না। হতে পারতেন, কিন্তু বোধকরি মুখরা বলেই হয়ে উঠতে পারেন নি। তবে শাশুড়ীর ভালবাসা সম্ভবত পেয়েছিলেন। আর সে ভালবাসা পাবার ইতিহাসটি বেশ মুখরোচক। ছেলের বিয়ে হয়েছে, নাতির মুখ দেখবার জন্য বাবর-পত্নী মাহম একেবারে পাগল হয়ে উঠতেন। সেজন্য চোখে কোনো সুন্দরী, শ্রীযুক্ত মেয়ে দেখলেই তার গর্ভে হুমায়ুনের সন্তান প্রার্থনা করে বসতেন। পাঠিয়ে দিতেন হুমায়ুনের কাছে। হুমায়ুনের সেবা করতে গিয়ে তারা অন্দরমহলে স্থান পেয়ে যেতেন। এমনি এক মেয়ে মাহমের নজর কেড়ে নিলেন। তার নাম মেওয়া-জান। দারুণ দেখতে – টানা টানা চোখ আর টিকলো নাক। মনে ধরে গেল মহিষী মাহমের। আসলে সে ছিল এক সামান্য রাজকীয় কর্মচারী খদঙ্গ-এর মেয়ে। ওসব কিছুই গণ্য করলেন না সম্রাট জননী। তখন বাবরের মৃত্যু হয়ে গেছে। একদিন মাহম সোজা গিয়ে পুত্রকে ডেকে বলেই বসলেন – ‘দেখ হুমায়ুন, মেওয়া-জানকে তোমার কেমন লাগে ? ও মেয়েটাতো দেখতে শুনতে মন্দ নয়। তবে কেন তুমি ওকে তোমার হারেমের অন্তৰ্ভুক্ত করছ না’।

হুমায়ুন আর কি করেন। মায়ের আদেশ। তদুপরি সুন্দরী ললনা। সেই রাতেই হুমায়ুন মেওয়া-জানকে শয্যাসঙ্গিনী করে নিলেন। অন্দরমহলে ভর্তি হয়ে গেলেন মেওয়াজান। বেগা বেগম তখন কাবুলে আর মধ্যে আগ্রায় এলেন তার সপত্নী ৷ জানতেও পারলেন না তিনি।

এর মধ্যে একদিন তিনি এসেও গেলেন কাবুল থেকে আগ্রায়। ঠিক মেওয়াজানকে বিয়ে করার তিন দিনের মাথায়। অন্দরমহলের দুটি বধু এসে শাশুড়িকে শুভ সংবাদ জানালেন। দুজনেই সন্তান-সম্ভবা, গর্ভবতী। দারুণ খুশি হয়ে উঠলেন মহিষী মাহম। ঘোরেন-ফেরেন আর বলেন – দু দুটো বউ গর্ভবতী, কারও না কারও ছেলে হবেই। বেগা বেগমের প্রথম সন্তান বেশিদিন বাঁচেনি। তাই মহিষীর আশা এবারেও হয়তো আবার ছেলে হবে। মেওয়া জানকেও ভালবাসতেন খুব। তিনিই তো তাঁকে পছন্দ করেছিলেন। ভাবছেন তার গর্ভেও পুত্র সন্তান হবে। নাতির মুখ দেখবেন বলে দু প্রস্থ অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করিয়ে বসলেন। যার ছেলে হবে তাকেই আমি ভাল ভাল অস্ত্র উপহার দেবো। এই বলে খুব যত্ন-আত্তি করে দু প্রস্থ অস্ত্র ভালকরে বেঁধে গুছিয়ে রেখে দিলেন ৷

আর গড়ালেন সোনা আর রূপো দিয়ে আখরোট বাদাম। মোগল সেনাপতিদের উপযুক্ত অস্ত্ৰশস্ত্ৰও খুঁজে পেতে সংগ্রহ করে রাখলেন তিনি । তার পর দিন গুনতে লাগলেন। তর সইছে না যেন তার। কিন্তু হা হতোস্মি। বেগা বেগম এ কি প্রসব করলেন ৷ কন্যাসন্তান ? দারুণ মুসড়ে পড়লেন মাহম। যতই আদর করে মেয়ের নাম রাখা হোক অকীকা – মাহমের একটুও ভাল লাগল না।

এবার একমাত্র ভরসা ঐ মেওয়া জান। কিন্তু সবুরেও তো মেওয়া ফলল না। দশ মাস পার হয়ে এগারো মাস এল।মেওয়াজান শাশুড়িকে বলেন – ভাবছেন কেন আম্মা আমার স্বর্গত শ্বশুরের জ্যেঠা মশায় উলুঘ বেগের হারেমে ছিলেন আমার এক মাসী। সে মাসির ছেলে হয়েছিল পাকা বারো মাস পার হয়ে। আমি হলাম সেই মাসির বোনঝি।

কথায় বলে লোকে আশায় ঘর বাঁধে। মাহমও তৈরি করালেন আতুড় ঘরের জন্য তাবু। ছোট্ট বাচ্চার কথা ভেবে তৈরি করানো হল মখমলের বালিশ তিসি ভরতি করে। কিন্তু এবারেও সেই হা হতোস্মি। বারো মাস পার হয়ে গেল। মেওয়া ফলল না। শেষ অবধি জানা গেল — সব মিথ্যে। বেগা বেগমের তো একটা মেয়ে অন্তত হয়েছে ৷ মেওয়া জানটা বড্ড মিথ্যেবাদী। বড্ড ঠক আর প্রবঞ্চক। শাশুড়ির আদর পাবে বলে এতোদিনে মিথ্য়ের জাল বুনে এসেছে। তার গর্ভ-সঞ্চারই হয় নি। অনুমান করতে পারি বাঁদীটাকে অনাদরে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন হুমায়ুন। এ যেন বেঁচে থাকুক চূড়া বাঁশি, রাই হেন কতো মিলবে দাসী ৷ কোনোক্রমে অন্দরমহলে মেওয়া জানের দিন কাটতে
লাগল ৷

কাজেই কন্যা সন্তান হলেও বেগা বেগমের আদর বেড়েই গেল। এমনিতেই গরবিনী ছিলেন। আবার সম্রাটের কন্যার জননীও। অহঙ্কার বাড়ল বৈকি। শাশুড়ির নেক নজরে আছেন। হুমায়ুন তখন সবাইকে নিয়ে গোয়ালিয়রে বেড়াতে যাচ্ছেন। বেগা বেগম তার মেয়েকে নিয়ে আগ্রাতেই আছেন। শাশুড়ির মন খুব খারাপ আদরের বৌটিকে না হলে তার বেড়ানোই সার্থক হবে না। ছেলের কাছে গিয়ে বললেন – দেখ বাবু, এ আমার ভাল লাগছে না। বাড়ির বড় বৌ, বড় মেয়ে সঙ্গে যাবে না-তা কি হয়। ওরাও একটু ঘুরবে, দেখবে-তবেই না আমার ভাল লাগবে। তুমি বাবু, ওদের আনিয়ে নাও। নইলে খুব বিশ্রী লাগছে। ওদের নিয়ে আসার জন্য মাহম নিজেই পাঠিয়েছিলেন নৌকর আর খওয়াজা কবীরকে। এসে গেলেন ওর৷ পুরো দুটো মাস আনন্দে কাটালেন সবাই মিলে গোয়ালিয়রে ৷

এমন বেগমের যদি গর্ব না হয়, তো কী হবে। এর মধ্যে মাহম মারা গিয়ে তার একটু অসুবিধে হল। তবুও গরবে তিনি টলমল করতে লাগলেন। তখন হিন্দালের বিয়ে হয়ে গেছে। সেই উপলক্ষে বিশাল আড়ম্বর-জাঁকজমক হয়ে গেল। নতুন ছাউনি বসেছে জর আফশান বাগে। দিলদার বেগম, মাসুম সুলতান বেগম, গুলরঙ বেগম, গুলবার্গ বেগম, বেগা বেগম সবার আলাদা আলাদা ছাউনি ৷ হুমায়ুন নিজে যেতেন সেই সব ছাউনি তৈরি করা পরিদর্শন করতে। তারই ফাঁকে দেখা করতেন বেগম আর বোনেদের সঙ্গে।

একদিন এলেন গুলবদনের ছাউনিতে। অনেক রাত অবধি সবার সঙ্গে গল্পগুজব খানাপিনা করে সম্রাট হুমায়ুন বোনদের আর বেগমদের কাছেই একত্রে মাথায় তাকিয়া দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন ৷

খুব ভোরেই রোজ ঘুম ভাঙে বেগা বেগমের। প্রতিদিনই তিনি সম্ৰাটকে জাগিয়ে দিয়ে ভোরের নমাজ পড়তে পাঠিয়ে দিতেন। সেদিনও তিনি সবাইকে ডেকে জাগিয়ে দিলেন। হুমায়ুনের ঘুম ভেঙে গেছিল আগেই। বেগা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন – ওজু করার জল আমাকে এখানেই পাঠিয়ে দাও।

সুযোগ পেয়ে গেলেন বেগা বেগম। সেই সাতসকালেই গরবিনী বেগম ভালবাসার নাকে-কান্না জুড়ে দিলেন। বলতে লাগলেন – ‘ক’দিন ধরেই তো এই বাগে আসছ তুমি। কিন্ত একবারও আমাদের ওখানে তোমার ছায়া পড়ল না কেন? আমাদের ওখানে যাবার পথে তো আর কাঁটা পোতা নেই। একদিন আমাদের ছাউনিতেও তুমি যাবে, সেখানেও এমন গল্প-গুজব, আমোদ-আহ্লাদ, খানাপিনা, মজলিস হবে, এ আশা তো আমরাও করতে পারি, সে সাধ আমাদের মনেও জাগে। এ হতভাগিনীদের দিকে কত দিন আর এমন মুখ ফিরিয়ে থাকবে? আমাদের তো, মন বলে একটা পদার্থ আছে। অন্যদের ওখানে এর মধ্যে অন্তত তিনবার করে গেছ তুমি, এক জায়গায় গল্প-গুজব, আমোদ-আহ্লাদ করে পুরো দিন আর রাত্তির কাটালে, অথচ আমাদের বেলায় -‘

কান মাথা লাল হয়ে উঠল সম্রাটের ৷ এমন সুন্দর সকাল বেলাটা একেবারে তেতো হয়ে উঠল ৷ তর্কবিতর্কে কোনো অভিরুচি হল না৷ তার, নমাজ পড়বার সময় হয়ে গেছে। কোনো উত্তর না দিয়ে সম্রাট ধীরে ধীরে নমাজ পড়তে এগিয়ে গেলেন। নমাজ পড়া শেষ করেছেন হুমায়ুন। এক প্রহর বেলা হয়েছে। একে একে ডেকে পাঠালেন সব ছাউনি থেকে বিমাতা দিলদার বেগম, আফগানী অগাচহা, গুলনার অগাচহা, মেওয়া-জান বেগম, আঘা-জান, এমন কি ধাইমা, দুধ-মাদের ।

পরস্পরের মুখ চাইতে চাইতে সবাই এসে হাজির। বেগা বেগমও এসেছেন ৷ সম্ৰাট হুমায়ুনের মুখ থমথমে ৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভেতরটা তাঁর গজরাচ্ছে। সকলের দিকে একবার করে তাকিয়ে দেখলেন বেগা বেগম কোথায় বসেছেন। তারপরে কোনো ভণিতা না করে বেগা বেগমের চোখে স্থির নিষ্পলক দৃষ্টি রেখে বললেন – ‘বিবি! তোমার প্রতি বিরূপ ব্যবহারের এ কেমন ধারা অভিযোগ আজ সকালে আনলে তুমি? আর যেখানে বসে অভিযোগ করলে সেটা কি তার মানানসই জায়গা ? তোমরা সকলেই জানো, যারা সম্পর্কে আমার এবং তোমাদের সকলেরই গুরুজন, তাদের সঙ্গেই এ যাবৎ দেখা করার জন্য গেছি। তাদের সুখী করার দায়িত্ব আমার ওপর বর্তেছে বলেই তা করা আমার দিক থেকে একান্ত কর্তব্য। বরং আমি লজ্জিত যে তাঁদের কাছে আরো ঘন ঘন যাওয়া আমার পক্ষে হয়ে ওঠে না। অনেকদিন থেকেই এজন্য আমি ভাবছি এ ব্যাপারে প্রত্যেককে একটি সই করা ঘোষণা লিখে দেওয়ার অনুরোধ জানাবো। আজ শেষ পর্যন্ত সেই পদক্ষেপ নেওয়ার পরিস্থিতিতেই আমাকে টেনে নিয়ে এলে। সকলেই জানো, আমি একটা আফিংখোর মানুষ। যদি কারো কাছে যেতে-আসতে আমার বিলম্ব হয় সে জন্য কেউ তোমরা রাগ করো না যেন। বরং আমার কাছে এরকম একটি পত্র লিখ – ‘আসো কি না আসো সে তোমার খুশি। তুমি যা করবে তাতেই আমরা তৃপ্ত ও তোমার প্রতি, কৃতজ্ঞ থাকবো।’

সমস্ত ঘরটা হুমায়ুনের গম্ভীর গলার আওয়াজে গভীর হয়ে উঠে নিস্তব্ধ হল৷ বেগা বেগম ছাড়া সবাই হাতজোড়। অন্য বেগমরা সঙ্গে সঙ্গে হুমায়ুনের প্রস্তাবে সায় দিয়ে উঠলেন। গুলবার্গ বেগম তো তাড়াতাড়ি কলমদানি আনিয়ে সম্রাটের বয়ান মতো একটি চিঠি লিখে হুমায়ুনের পায়ের কাছে নামিয়ে কুর্নিশ করে বসলেন।

কিন্তু সারাক্ষণ তুর্কি ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বসে রইলেন বেগা বেগম। তারপর তার মধ্যে সেই তার্কিক মানুষটা আবার জেগে উঠল। বললেন – ‘ত্রুটির চেয়ে তার কারণ হিসাবে এ রকম একটা কৈফিয়ৎ আরো বেশি নিন্দার। আমাদের প্রতি অনুগ্রহ দেখিয়ে জাঁহাপনা যাতে আমাদের মাথা উচু করে তোলেন সেজন্যই আমরা এ রকম অনুযোগ করেছি। জাঁহাপনা নিজেই ব্যাপারটিকে টেনেটুনে এখানে এনে দাঁড় করালেন। এরপর আমাদের আর কি করার থাকতে পারে। আপনিই সৰ্বেসৰ্বা সম্রাট।’ এই বলে নিতান্ত অনিচ্ছায় যেন তিনিও সম্ৰাটকে তার বয়ান মতো একটা চিঠি লিখে দিলেন। আগুনে জল পড়ল ৷ হুমায়ুন শান্ত হলেন। তখনকার মতো ব্যাপারটির সেখানেই ইতি ঘটল। এর পরেও কিন্তু বেগা বেগমের হাঁকডাক কমে গেছিল, তা মনে করার কারণ নেই। কিন্তু একটা অবাঞ্ছিত অসম্মান যেন তার জন্য অপেক্ষা করে বসেছিল।

শেরশাহ-এর তাড়নায় হুমায়ুন বেগম আর আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এক যুদ্ধক্ষেত্রের পর অন্যত্ৰ। একবার তো নিজে পালাতে গিয়ে ঘোড়াসুদ্ধ যমুনা নদীতে ডুবে মরেই যাচ্ছিলেন। এক মশক-ভিস্তিওয়ালার জন্য প্রাণে গেলেন বেঁচে। আর সে সময়েই একটা সরু সেতু পার হতে গিয়ে ভার সইতে না পেরে সেটা ভেঙে যেতেই পরিবারের লোকজনেরা পড়ে গেলেন ভরা যমুনা নদীতে। কেউ কেউ মারা গেলেন ডুবে। কেউ বা বন্দী হলেন শত্রুর হাতে।

ডুবে গিয়ে অদৃশ্য হলেন চিরতরে সুলতান হুসেন মির্জার কন্যা আয়েসা সুলতান বেগম, বাচকা নামে বাবরের এক খলিফা (পরিচারিকা), বেগাজান কুকা, কন্যা অকীকা বেগম, চাঁদ বিবি আর শাদ বিবি। আট বছরের মেয়েকে হারিয়ে বেগা বেগম কাঁদতে পর্যন্ত পেলেন না। কারণ, তিনি নিজেই হলেন শক্রহস্তে বন্দিনী। অবশ্য শত্রুরা বহু মান্য করে তাঁকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু খুব কি আর হুমায়ূনের সঙ্গে সংলগ্ন থাকতে পারলেন তিনি ? কিন্ত আত্ম-গরবিনী মেয়েরা সহজে নিজেদের ভুলে যায় না। অন্দরমহলে নতুন বেগম এসেছেন হামীদা বানু। বেগা বেগমেরও দিন গেছে কি? বোধহয় যায় নি তখনও। নিজের সাজগোজ নিয়েই মশগুল থাকতেন তিনি। তাতেই সুখ।

যেদিন রীওয়াজ ফুল কেমন করে ফোটে দেখার জন্য বায়না ধরে বেগমরা কোহ গেলেন, সেদিন তো বেগা বেগমের সাজ করা আর ফুরোয়ই না। কমলা বাগিচায় সম্রাটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেও তার সমান সাজগোজ। এমনি করে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে থাকতে এই রূপ-গরবিনীর বয়স বাড়ল। হজ করে ফিরে এসেছেন গুলবদন আর হামীদা বানুরা। বয়স বেড়ে বেগা বেগম তখন সত্তর পার হয়ে গেছেন হুমায়ুন যখন চলে গেছেন তখন তার বয়স কতই বা, বড়জোর পঁয়তাল্লিশ। তারপর থেকে শুধু হারেমে থাকার সুখ, স্বামী-সোহাগিনীর সুখ নেই। এমনি করেই স্বামীর মৃত্যুর প্রায় পঁচিশ বছর বাদে বেগা বেগমও চলে গিয়েছিলেন। বেঁচে থেকে তাঁর সুখই কি বা। একটা ছেলে একটা মেয়ে সবাই তো তাকে সেই কোন সকালে ছেড়ে চলে গেছে! দিল্লীতে তাই একমনে স্বামীর সমাধি রচনা করে গেছেন মৃত্যুর আগে (১৫৬৯)। তবে বাঁচার একটা আশ্রয়ও তিনি পেয়েছিলেন হুমায়ুনের অপর স্ত্রী হামীদা বেগমের পুত্র আকবরকে ভালবেসে। এতো ভালবাসতেন এই পুত্রটিকে পুত্রহারা জননী, যে ঐতিহাসিকেরা তাকে আকবরের নিজের মা বলেও গুলিয়ে ফেলেছেন।

বেগা বেগমের দারুণ প্রতিপত্তির মধ্যে হারিয়ে গেছে গুলমার্গ, চাঁদবিবি, বখশি বানু, খানীশ আঘা গুলওয়ার বিবিদের দল। কেউ শুধু জন্ম দিয়েছে একটি পুত্র অথবা একটি কন্যাকে। ব্যস, তারপরে লেগেছেন কচিৎ সম্রাটের শয্যা সঙ্গিনীর সামান্য উপকরণ হিসেবে। অন্দরমহলের বাইরে তাদের জীবন আর এতটুকুও বিকশিত হতে পারেনি।

তবুও মাহচূচক হতে পেরেছিলেন হুমায়ুনের দলের একাংশের অধিকারিণী। বদকশানে থাকার সময় মাহচূচক হুমায়ুনকে একটি কন্যা সন্তানও উপহার দেন। হুমায়ুন সে সময় একটি স্বপ্ন দেখেন এবং সেই স্বপ্ন অনুসারে এই কন্যার নামকরণ করেন বখত নিশা। এই নামকরণের ব্যাপারটি সম্রাট হুমায়ুনের ভাষায় এমনি করেই ঘটেছিল – ‘আমার যামা (ধাত্রীমাতা) ফখর-উন্নিসা ও দৌলত বখত দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলেন, এটা ওটা কি যেন নিয়ে এলেন, তারপর আমাকে একা ফেলে রেখে চলে গেলেন’। এই স্বপ্ন থেকেই তিনি ঠিক করলেন এ দুজনের নাম মিলিয়েই তিনি কন্যার নামকরণ করবেন। একজনের থেকে নিলেন বখত, অন্যজনের থেকে নিশা। তাই নিয়ে নবজাতিকার নাম রাখলেন বখত-নিশা৷

স্বভাবতই গৌরবান্বীতা হয়েছিলেন মাহচুচক বেগম ৷ তার গৰ্ভে কাবুলে জন্মগ্রহণ করেছিল তার এক পুত্রসন্তানও। আগ্রায় সেই খবর নিয়ে এসেছিলেন এক দূত শাহওয়ালী। দারুণ খুশি হয়েছিলেন সম্ৰাট। দূতকে খুশি হয়ে সুলতান উপাধি দিয়ে বসেছিলেন আর নবজাতকের নাম রেখেছিলেন ফারুক-ফাল। মাহচূচক হয়েছিলেন শাকিনা বানু, অমীনা বানু আর মহম্মদ হকীমেরও গর্ভধারিনী। তাই নিয়েই তিনি খুশী ছিলেন। পাটরাণী হবার স্বপ্ন দেখেন নি।

পাটরাণী হবার স্বপ্ন দেখেন নি হামীদা বানু বেগমও। কিন্তু তার নসীবে তাই লেখা ছিল। নইলে যে সম্রাটকে একদা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যৌবনের মদমত্ততায়, তারই প্রিয়তমা মহিষী হয়ে উঠতে পারলেন ঘটনা চক্রে? সে এক রোমাঞ্চকর প্রেমের পরম উপাখ্যান। মোগল অন্দর মহলের সে এক মনোমুগ্ধকর কাহিনী।

হুমায়ুনের তখন ভাগ্যবিপর্যয় চলছে। শোনা গেল ভাই হিন্দালও তার প্রতি বিমুখ হয়ে মীর্জা কামরানের রাজ্যের অন্তৰ্ভুক্ত কান্দাহারে একটা শিবির করে নাকি বসবাস করছেন। হুমায়ুনের নামে নানা অপবাদ শুনে তিনি তিতিবিরক্ত। হুমায়ুন ব্যাপারটিকে সরেজমিনে জানবার জন্য ঠিক করলেন হিন্দালের কাছে যাবেন। ভক্করের কাছে সিন্ধুনদ পার হয়ে চলে গেলেন হিন্দাল। হুমায়ুন ভক্কর অধিকার করে আছেন। হুমায়ুন খোঁজ নিয়ে জানলেন সিন্ধুনদ থেকে প্রায় একশো মাইল দূরে পতর বলে একটি গ্রামে হিন্দাল ছাউনি ফেলে আছেন, কান্দাহারে যান নি। যাবেনও না। এটা একটা মিথ্যা প্রচার মাত্র।

খুশি হয়ে হুমায়ুন তার সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে তার কাছে গেলেন। হিন্দাল খুব জাঁকজমকের সঙ্গে সম্রাট ভাইকে সম্বর্ধনা জানালেন। তাতে মীর্জা হিন্দালের অনুগামী ছাড়াও তার হারেমের মহিলারাও সম্রাটকে অভিবাদন জানালেন। হারেমের অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে এসেছিলেন একটি চতুর্দশী কিশোরীও। অপরূপ রূপলাবণ্যবতী এই তন্বীকে সম্রাট আগে কোনোদিন দেখেন নি। দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন এবং প্রথম দর্শনেই প্রেমাহত হয়ে সম্রাট প্রেম নিবেদনের জন্য উন্মুখ হয়ে পড়লেন। কোনো ভূমিকা না করেই সম্ৰাট জিজ্ঞাসা করলেন – এ কে? উত্তর এল – মীর বাবা দোস্ত-এর মেয়ে। মেয়েটির বৈমাত্রেয় ভ্রাতা খওয়াজা মুয়জ্জন কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, সম্রাটও আমাদের বংশের লোক আর মেয়েটিও আমার আত্মীয়।

আসলে এই ইরাণী রূপসী কিশোরী প্রায়ই হিন্দালের অন্দর মহলে আসতেন। হুমায়ুনও মাঝে মাঝে দিলদার বেগমের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন অন্দর মহলে। একদিন স্পষ্টতই বিমাতার কাছে প্রস্তাবই করে বসলেন – মীর বাবা দোস্ত যেহেতু আমাদের আপনার লোক, তখন আপনি যদি তার মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করেন, তাহলে ব্যাপারটা শোভনই হবে। (একটা কথা এখানে স্পষ্ট করা দরকার গুলবদন বলেছেন কিশোরীটি মীর বাবা দোস্ত-এর কন্যা। জৌহর বলেছেন তিনি হিন্দালের ‘অখুন্দে’র মেয়ে। মীর মাসুম বলেছেন তিনি হলেন শেখ আলী আকবর জামীর কন্যা। মনে হয় মীর বাবা দোস্ত এই আলী সাহেবেরই অন্য নাম)

প্রস্তাব শুনে হিন্দাল রেগে আগুন। এমন একটা অশোভন প্রস্তাব কি করে হুমায়ুন দিলেন। মীর বাবা তার উপদেষ্টা, তার শিক্ষক। তার মেয়েকে হিন্দাল নিজের বোনের মতো, এমনকি নিজের মেয়ের মতো মনে করে আর বড় ভাই হয়ে হুমায়ুন কিনা তাকে বিয়ে করতে চায়? আল্লা করুণ, ব্যাপাটার এখানেই শেষ হোক, বিয়েটা যেন না ঘটে।

দুজনের মধ্যে একটা দারুণ কলহ প্রায় ভেঙে পড়ে দেখে হুমায়ুন রেগে পতর থেকে একেবারে চলে এলেন ভক্করে। তারপর দিলদার বেগম একটা চিঠি লিখলেন হুমাযুনকে – পুত্র, তুমি বাপু একটুতেই রেগে যাও। হিন্দালটা আমার পাগল ছেলে, তুমিও পাগল ব্যাটা। তোমরা তো জান না, তুমি বলবার আগেই মেয়েটির মা আমাকে প্রস্তাব
দিয়েছিল যাতে তোমার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়। আশ্চর্য, তুমি রেগে চলে গেলে কি হবে বলো তো!

হুমায়ুন দারুণ খুশি। তিনিও লিখে পাঠালেন – যা লিখেছেন তা যদি সত্যি হয় মা, দারুন খুশি আমি। আপনি যা হয় একটা করুন। আপনি যা বলবেন আমি সুবোধ বালকের মতো মাথা নিচু করে মেনে নেবো। আর পণাপুণি নিয়ে যে কথা তারা তুলেছে, সে নিয়ে কোনই অসুবিধা হবে না। সে তারা যা বলবেন, তাই মেনে নেবো আমি। এখন শুভকাজের জন্য আমি পথ চেয়ে রইলাম ৷

চিঠি পেয়ে দিলদার বেগম নিজেই ভক্করে গিয়ে পুত্র হুমায়ুনকে নিয়ে এলেন ৷ একটা বড় মিলন সমাবেশ হল। হুমায়ুন সরেজমিনে সব শুনে, খুশি ৷ কিন্তু কাজ এগোচ্ছে কই? আবার একদিন এলেন তিনি বিমাতার কাছে। এসেই বললেন – আর কতো অপেক্ষা করা যায়। আপনি একবার হুমীদা বানুকে ডেকে আনার ব্যবস্থা করুন।

সম্রাট ডেকে পাঠিয়েছেন। কিশোরী হামীদা আসবেন এটা প্রত্যাশিত। কিন্তু যা প্রত্যাশা করা যায়, জীবনে তা কি সর্বদা ঘটে! হামীদা এলেন না। তুর্কি বেবাগা ঘোড়ার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে উল্টে জবাব দিল – কেন, কি জন্য যাবো। শ্ৰদ্ধা নিবেদনের জন্য? সে তো তাঁকে আগেই জানিয়ে নিজেকে ধন্য করেছি। বার বার কেন ? আবার যাবো কেন?

– আসবে না? এতো গরব! ডেকে পাঠালেন হুমায়ুন সুভান কুলীকে। বললেন – যাও মীর্জা হিন্দালকে গিয়ে বল, সে যেন এখনই বেগম হামীদা বানুকে পাঠিয়ে দেয়। হিন্দাল বলে পাঠালেন – অসম্ভব। আমি হাজার বার বললেও সে
কিছুতেই যাবে না। বরং সুভান সাহেব তুমি নিজে গিয়ে হামীদাকে বল।

সুভান আর কি করেন, সম্ৰাট রেগে যাবেন। অতএব হামীদার কাছে গিয়ে অশেষ সৌজন্য দেখিয়ে হুমায়ুনের ইচ্ছাটুকু সবিনয়ে নিবেদন করলেন। হামীদা আবার জলে উঠলেন ৷ কিন্তু দারুণ বাক্‌চাতুৰ্যের সঙ্গে
বললেন আপনি সম্ৰাটকে গিয়ে বলুন রাজদর্শন একবারই নিয়মমাত্র, দ্বিতীয়বার নিষেধ। অতএব আমার তো যাওয়া চলে না।

সুভান নতমস্তকে এসে সে কথা নিবেদন করতেই হুমায়ুনও জ্বলে উঠলেন। বললেন দাঁতে দাঁত চেপে – ও, তাই নাকি? আচ্ছা দেখা যাক – আমিও পুরুষ মানুষ! সে নাকি রাজবধু হতে নারাজ! আমি তাকে সম্ৰাটবধূ বানিয়ে তবে ছাড়ব। ঠিক আছে।

আপত্তি করার কারণ ছিল বইকি হামীদার। সে তো সবে মাত্ৰ চোদ্দ পুর্ণ করেছে। সম্রাট তার বয়সের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। হুমায়ুনের বয়স তখন সাড়ে তেত্রিশ। তার জন্ম ৬ই মার্চ ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দ।

তাছাড়া হামীদাই তো হুমায়ুনের একমাত্র পত্নী হবেন না! তার হারেম এমনিতেই তো বিবাহিত-অবিবাহিত পত্নীতে পরিপূর্ণ ৷ দু’দিন থাকবে নেশা, তারপর যখন নেশা টুটে যাবে হামীদা কোথায় পড়ে থাকবে। আর সত্যি কথা বলতে কি, হুমায়ুন সম্রাট বটে তবে এমন ভাগ্যবিড়ম্বিত সম্রাট যে তাকে কেবল পালিয়ে বেড়াতে হয়। এমন লোকের সঙ্গে কি কেউ সাধ করে নিজের ভাগ্যকে জড়িয়ে নেয়।

কিন্ত মানুষ যা ইচ্ছে করে, তা-ই কি হয় ! পাক্কা চল্লিশটা দিন ধরে প্রেমের টানাপোড়েনের খেলা চলতে লাগল। টানার ঘর শুন্য, পোড়েনের মাকু কেবল এঘর ওঘর করতে লাগল। দিলদার শেষ অবধি একদিন হামীদাকে ডেকে বোঝাতে বসলেন – দেখ মা, তোমার বয়স হয়েছে, বিয়ে তো তুমি একদিন করবেই। আর তা যদি করতে হয়, তবে
বল তো মা, রাজার চেয়ে সেরা বর আর কে হতে পারে?

হামীদার কি জেদ ! – হ্যা, ঠিকই বলেছেন আপনি। বিয়ে আমাকে একদিন করতে হবে, সে ঠিক কথাই। কিন্তু আমি এমন পুরুষকে বিয়ে করতে চাই যার কাঁধ ইচ্ছে করলে আমি হাত দিয়ে ছুঁতে পারি। হাত বাড়িয়ে যার জামার কোনাটুকুও ছুঁতে পারবো না তাকে কখনই নয়। অর্থাৎ হামীদা বোঝাতে চাইলেন – যাকে তিনি নিজের নাগালের মধ্যে ভাববেন তাঁকেই তিনি স্বামী হিসেবে পেতে চান – অন্যকে নয়।

তবুও দিলদার থেমে থাকতে পারেন না। বিবাহার্থী পুরুষ শুধু তার পুত্রসম নন, স্বয়ং সম্রাটও। একটা যুদ্ধও হয়তো
ঘটে যেতে পারে। একবার তার মনে হল, এ তার ছেলের এক আশ্চৰ্য পাগলামি। শক্রর তাড়নায় ছুটে ছুটে পালাতে হচ্ছে। বৈমাত্রেয় ভাই কামরান তো বিদ্রোহীই, হিন্দাল পর্যন্ত রেগেছে। শেরশাহ সর্বদা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তবুও কি আশ্চর্য এই প্রেমের নেশা।

শেষে ধৈর্যের ফল ফলল। হামীদা মত দিলেন। শক্ত ও শক্তিমান পুরুষকে মেয়েরা বুঝি ভাল না বেসে পারে না। শেষে ঐ পতরেই বিয়ের বাসর বসল – হিজরী ৯৪৮ অব্দের জুমাদ-উল-অওয়াল মাসের এক সোমবারের দুপুরে (১৫ আগস্ট ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দ) হুমাযুন-হামীদার বিয়ে হয়ে গেল এক শুভলগ্নে। হুমায়ুন নিজেই পঞ্জিকা দেখে শুভদিন স্থির করলেন। কন্যার পিতার হাতে তুলে দিলেন নগদ দু’লাখ টাকা। মীর আবুল বকা-কে ডেকে পাঠানো হল। তিনি এসে দুজনকে বিবাহ-বন্ধনে বেঁধে দিলেন।

বিয়ের পর তিনটি দিন যুগলে কাটালেন ঐ পতেরই। তারপর দুজনে রওনা হলেন ভক্করের নৌকোয় চড়ে। হামীদা বানু বেগমের জীবনে সেই দুৰ্গতি আর সন্মানের সঙ্গে তার গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেল। মাসখানেক ভক্করে থাকলেন দুজনে। হিন্দাল তাদের সঙ্গ ত্যাগ করলেন। নববিবাহিত বেগমকে নিয়ে হুমায়ুন রওনা হলেন সিহওয়ানের পথে। কিন্ত সে পথ নিদারুণ কণ্টকিত – শক্রসৈন্যে বিমর্দিত হলেন কতবার সম্রাট। শাহ হুসেন করলেন বিশ্বাসঘাতকতা, মালদেবের সঙ্গে বাধল সংঘর্ষ। কোথাও এগোন, কোথাও পিছিয়ে যান ৷

এবার চলেছেন অমরকোটের দিকে। ঠিক যাবার আগেই দুজন গুপ্তচরের আক্রমণে সম্রাটের ঘোড়াটির মৃত্যু হল৷ হামীদা বানু গর্ভবতী। তাঁর জন্য প্রয়োজন একটি ঘোড়ার। তারদী বেগের কাছে চাইলেন একটি ঘোড়া। তিনি নারাজ। শেষে বদনা-বাহক জৌহরের, উটটিতে চড়ার উদ্যোগ করছেন, এমন সময় আকবরের ভবিষ্যৎ ধাত্রী মাহম অনগের স্বামী নদীম বেগ নিজের ঘোড়াটি এনে দিলেন সম্রাটকে।

রাজস্থানের পথে চলেছে সম্রাটের অনুগামী দল। তার অন্দরমহলও এখন পথে বেরিয়ে পড়েছে। হায় হতভাগ্য সম্ৰাট! কি দুৰ্গম সেই মরুময় পথ ! অর্থের অভাব, অভাব যানবাহনেরও। সঙ্গের লোকের সংখ্যাও ক্রমক্ষীয়মান। হামীদা স্বামীর সঙ্গে চলেছেন ভারী শরীরটি নিয়ে। ধূ ধূ মরুভূমি, উত্তপ্ত বালুকা তারই মধ্যে যেতে হচ্ছে। ক্ষুৎপিপাসায় সকলেই অবসন্ন। তারই মধ্যে খবর আসে শক্রসৈন্য আসছে। চমকে চমকে ওঠেন হামীদা, স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ভয় মোচন করেন।

জল, জল, জল। চারিদিকে জলের জন্য হাহাকার। একটুর সন্ধান যেই পাওয়া গেল, অমনি শোনা গেল সাবধান,
আবার আসছে মালদেব। পালাও, পালাও। আবার চলা। একটা কুয়ো সামনে। তাঁর সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল অনেকে। মরে গেল দড়ি ছি’ড়ে কুয়োয় পড়ে কেউ কেউ। বড় জলাধারে জল খেয়ে কত উট-ঘোড়া মারা গেল তার হিসেব নেই। দুর্ভাগ্য, দুর্ভোগ বেড়েই চলে। শেষে সুন্দরী অমরকোটে পৌছলেন হামীদা। একেবারে অবসন্ন।

অপূর্ব সৌজন্য দেখালেন সেখানের রাণা। পরম সমাদরে নিয়ে গেলেন। সকলের জন্য দিলেন মনোরম আসন আর আহার্য। স্বস্তি পেলেন হামীদা আর বুঝি যুঝতে পারেন না এই আসন্নপ্রসবা বালিকা বধুটি। রাণা মহাসম্মানে তাকে তার দুর্গটি খালি করে দিলেন অশেষ সৌজন্যে। হামীদা যেন প্রাণে বাঁচলেন।

হুমায়ুন ইতিমধ্যে রাণার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করেছেন তার ইতিকর্তব্য। সেইমতো প্রায় সাত সপ্তাহ আরামে কাটিয়ে হুমায়ুন ভক্করের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঠিক চারদিন পর ১৫ অক্টোবর ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে হামীদা একটি সন্তান প্রসব করলেন ঐ রাণার আতিথ্যে দু মাস থাকার পর। এই সন্তানই মোগল বংশের শ্রেষ্ঠ কীর্তিমান পুরুষ মহামতি আকবর।

দিনটি ছিল শুভকর নানাদিক থেকে। চন্দ্র প্রবেশ করেছে সিংহ রাশিতে। আবুল ফজল বলেছেন এমন শুভলগ্ন হাজার বছরে হয়তো এক বার ঘটে। এর আগেই নাকি সম্রাট অপুর্ব এক স্বপ্ন দেখেছিলেন ১০ জুলাই ১৫৪০-এর রাতে। হামীদার ভ্রুযুগলকে নাকি দর্পণের মতো উজ্জল দেখতে লাগতো সেই সময়ে। কিন্তু এক ভীষণদর্শন ধাত্রীকে সন্তান প্রসব করাতে দেখে হামীদা নাকি দারুণ বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন।

হুমায়ুন তখন অমরকোট থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে এক বিশাল পুকুরের তীরের বাগানে ছাউনি পেতেছেন জুন যাবার পথে। সেলনের সেই দর্পন বাগে শুভ খবর নিয়ে গেলেন তারদী বেগ। তারদী বেগের সমস্ত পুরনো অপরাধ মাপ হয়ে গেল। আর সেই পুরনো স্বপ্নানুসারে পুত্রের নাম রাখলেন আকবর। কিছু সম্বল নেই ৷ সম্বল বলতে আছে
মাত্র ২০০টি রূপোর শাহরুখ। আর ছিল এক পাত্র মৃগনাভি কস্তুরী। একটি পিরিচের উপর রেখে সেটি ভেঙে সঙ্গীদের সকলের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন। আর বললেন – “আমার পুত্রের জন্মদিনে এর বেশি কিছু আর দিতে পারলাম না । শুধু বলুন আমার পুত্রের যশসৌরভ যেন এই কন্তুরীর মতোই দিকে দিকে পরিব্যাপ্ত হয়।

প্রসবের পর হামীদা অবসাদগ্রস্থ। শুধু ভাবেন, মোগল বংশের পরবর্তী সম্রাটের তিনি জন্ম দিলেন ৷ কিন্তু সেই গর্বিত মাতাকে আদর জানাবার জন্য তার স্বামী এলেন কই!

হুমায়ুন এদিকে এগিয়ে চলেছেন থাট্টা থেকে জুনের দিকে সেই সন্ধ্যার পর থেকেই ৷ এদিকে নবজাতক জালাল-উদ-দীন মহম্মদ আকবরকে বুকে নিয়ে হামীদা বানু বেগম আরও ছত্রিশ দিন রাণার আশ্রয়ে থেকে এগোতে লাগলেন স্বামীর উদ্দেশ্যে ২০ নভেম্বর তারিখে। আকবর তখন মাত্র পাঁচ সপ্তাহের শিশু। পঞ্চান্নদিন যখন তার বয়স, সেদিন ৮ ডিসেম্বর ১৫৪২ তারিখে আকবর মায়ের সঙ্গে বাবার কাছে এসে পৌঁছায়৷ সঙ্গে এলেন অনেকগুলি ধাত্রীমাতা ৷

প্রায় ন’ মাস জুনে থাকার পর হুমায়ুন শিবিরপথে কান্দাহারের দিকে এগোলেন ৷ খবর পেয়ে ধেয়ে এলেন বৈমাত্রের ভাই অস্করী (গুলরুখের সন্তান)। হুমায়ুনও খবর পেয়ে ঘোড়ায় চেপে মক্কার পথে সিয়েস্তানের দিকে রওনা হলেন। ফারলং খানেক এগিয়ে হামীদাকেও আনতে পাঠালেন। একটাও বাড়তি ঘোড়া নেই। তারদী বেগ সুযোগ বুঝে বললেন নিজের ঘোড়া দিতে পারবেন না। কিন্তু হুমায়ুনকে পালাতে হবেই। হামীদাকে সামনে বসিয়ে নিজের ঘোড়াটিতেই পিছনে বসে ছোটালেন ঘোড়া। শিশুপুত্র আকবরকে নেবার সময় পৰ্যন্ত হল না। আশ্চর্য জনক-জননী। এ কি দৈহিক ভালবাসার মাত্র আকর্ষণ, নিজের জীবনের জন্য পুত্রকে বিৰ্সজন।

হায় রে, একবছরের অসহায় শিশুপুত্র আকবর জানলেন না পর্যন্ত তাঁর বাবা-মা কি নিষ্ঠুরতম ব্যবহারটাই না করে গেলেন। সেদিন ১৫ অক্টোবর ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দ আকররের জন্মদিন। দ্বিতীয় জন্মোৎসব পালিত হল মাতা-পিতার পরিত্যাগের মধ্যে। শুধু কয়েকটি ভূত্যের তত্বাবধানে তিনি পড়ে রইলেন শিবিরে।

শত্ৰু অস্করীকে শত ধন্যবাদ। তিনি এসে দেখলেন পাখী উড়ে গেছে। শুধু ধাত্রী মাহম অনগ, জীজী অনগ আর আতকা খানের তত্ত্বাবধানে পড়ে আছে শিশুপুত্র আকবর। আশ্চৰ্য ঔদার্যে ভ্ৰাতুষ্পুত্ৰটিকে নিয়ে তিনি কান্দাহারের প্রাসাদে এনে নিজের স্ত্রী সুলতানম্‌ বেগমের হাতে দিলেন। কি পরম উদারতায় আর মাতৃস্নেহে এই নারী আকবরকে স্তন্যদানে পূৰ্ণ করেছেন। হামীদা যা পারেন নি গর্ভধারিণী হয়ে, সুলতানম্‌ বেগম তাই পারলেন। অনেকদিন পর, আকবরের বয়স তখন ৩ বছর ২ মাস ৮ দিন – হুমায়ুনের সঙ্গে পুত্রের মিলন ঘটল।

আর মায়ের সঙ্গে আকবরের? সে এক চমৎকার আখ্যান। সবাই মিলে পরীক্ষা করতে চাইলেন এক বছর বয়সে যে শিশুটি মায়ের কাছছাড়া, কোলছাড়া হয়েছিল, সে তার মাকে চিনতে পারে কি না তা দেখা যাক। হুমায়ুনের হারেমে অন্যসব মেয়েদের মাঝে গিয়ে বসেছেন হামীদা। খুব সাধাসিধে পোশাকে, যাতে তাকে আলাদা করে না চেনা যায়। আবুল ফজল লিখেছেনএকটুও ইতস্ততঃ না করে, একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে বা ভুল না করে শিশু আকবর আস্তে আস্তে গিয়ে মায়ের কোলে বসলেন। আর হামীদার মাতৃস্নেহ উথলে পড়ছিল – একেবারে পুত্রকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন। সে এক চোখে জল আসা অভূতপূর্ব মিলন দৃশ্য। আবেগে, আক্ষেপে, অনুশোচনায়, আনন্দে হামীদা তখন পাগলপ্রায়।

হামীদা বানুর একটি কন্যা সন্তানও জন্মেছিল যখন তারা সবজওয়ারে ছিলেন (১৫৪৪)। কিন্তু হামীদার সব ভালবাসা তখন আকবরের প্রতিই ধাবিত। এই পুত্ৰই তার জীবনের সূচনায় এবং অন্তিম পর্বে স্বপ্ন হয়েছিল। তখন তার বেশ বয়স হয়েছে। ১৫৭৮ খ্রিষ্টাব্দ, আকবর বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মা হামীদা খবর পেয়েছেন। এখন তিনি মাকে দিয়েছেন সম্মানের উপাধি। হামীদা এখন মোগল সাম্রাজ্যে মরিয়ম মাকানী নামেই পরিচিত। মা হামীদা পুত্রের অসুস্থতার সংবাদ পেয়েই সেই বয়সে ফতেপুরসিক্রির প্রাসাদ ছেড়ে পুত্রের কাছে ভেরা শিবিরে এসে দেখা করেছেন ৷ কোমল হাতে পুত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে রোগমুক্ত করেছেন। আবার ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরের দারুণ শীতে পুত্র আকবর বলনাথ পর্বতে যোগীদের কাছে তীর্থভ্রমণে যাচ্ছেন শুনে সেই বয়সেই রাজধানী থেকে রোহটাস-এ পুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে তীর্ঘভ্রমণে গেছেন।

আসলে হামীদার মধ্যে একটা সাধুচিত্ত বাস করত। তীর্থভ্রমণে পরম আগ্রহ ছিল তার। সেজন্য গুলবদন বেগম যখন মক্কা যাত্রা করলেন, তিনিও পুত্রের বিশেষ অনুমতি নিয়ে অনেক দুখভোগ করে বহুপ্রার্থিত তীর্থ মক্কা দর্শন করে এসেছিলেন। অথচ অন্য ধর্মের প্রতি তার প্রবল অসহিষ্ণুতা দেখে আমরা বিস্মিত হই। খ্রিষ্টানদের সম্পৰ্কে বিশেষ করে তার একটা জাতক্ৰোধ ছিল যেন। পুত্ৰ আকবরকে এ নিয়ে কম অশান্তি ভোগ করতে হয় নি।

পুত্ৰ ছাড়া তার জীবনে স্বামী এবং পৌত্র সেলিমের (জাহাঙ্গীর) স্থান ছিল উল্লেখনীয়। স্বামীর সমস্ত সুখ দুখের অংশভাগিনী হামীদার জীবন বাস্তবিকই আদর্শের৷ হুমায়ুন একবার অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন, হামীদা আদর করে বেদানার রস স্বামীর মুখে একটু একটু করে ঢেলে দিতেই তিনি ফিরে পেয়েছেন পূর্ণ চেতনা৷ ইরানের শাহ-এর কাছে বেড়াতে গিয়ে স্বামীর পাশে পাশে থেকে কখনও দেখেছেন মৃগয়া। আবার পরম চাতুর্যে ভৃত্য কূকের চৌর্যকার্যের আদ্যোপান্ত রহস্য করেছেন উন্মোচিত। কখনো গেছেন স্বামীর সঙ্গে রীওয়াজ ফুল ফোটার পরম মুহূর্ত গুলি দর্শনে, কখনো গেছেন কমলা বাগিচাগুলোতে বেড়াতে স্বামীর সঙ্গে। পরম আদরে স্বামীর সোহাগিনী হয়ে দিনগুলো তার কেটেছে।

নাতিটিকে দারুণ ভালবাসতেন হামীদা। পিতা-পুত্রে তখন দারুণ মনান্তর। সেলিম বিদ্রোহী। আকবর ঠিক করেছেন এই বিদ্রোহী পুত্রকে চরম শাস্তি দেবেন৷ ঠাকুমা কি তাই সহ্য করতে পারেন৷ মধ্যস্থতা করে সব মিটিয়ে দিলেন। তারই কথায় সেলিম গিয়ে পিতার কাছে আত্মসমৰ্পণ করে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। অথচ এই সেলিমই একদিন এই মরিয়ম মাকানীকে একটু ভদ্রতা পৰ্যন্ত দেখালেন না। তিনি তখন আগ্রায়। কি নিদারুণ দুঃখই না পেয়েছিলেন সেদিন। নাতি কাছে এসেছে শুনে দেখা করতে গেলেন। আর সেই নাতিই নাকি মৃগয়া ছেড়ে ঠাকুমা আসছেন শুনে নৌকো করে পালিয়ে গেল !

এখন মনে হয়, হামীদা যে নিজের ভাগ্যকে মোগল রাজবংশের সঙ্গে জড়াতে চান নি, তা-ই হয়তো ভাল হত। বুকে সমস্ত ভালবাসা নিয়ে স্বামী-পুত্র-পৌত্র, আত্মীয়-স্বজন সকলকেই কাছে পেতে চেয়েছেন। পরিবর্তে ভালবাসা-সম্মান যে পান নি তা নয়, কিন্তু দুখ পেয়েছেন তুলনামূলকভাবে বেশি।

স্বামী সেই কবে ছেড়ে চলে গেছেন। পুত্র মাথায় রেখেছেন বটে, কিন্তু অমান্যও কম বার করেন নি। আকবর চাইতেন মা যেন কোনো প্রকারেই রাষ্ট্রনৈতিক ব্যাপারে নাক না গলান। একবার পোর্তুগিজদের একটা দল একটা কোরানকে কুকুরের গলায় বেঁধে অপমান করায় হামীদা পুত্রকে বলেছেন একটা বাইবেলকে গাধার গলায় বেঁধে দিতে। আকবর না শুনে ভান করেছিলেন হয়তো, এমনকি লাহোরের দরবার না তুলে দিয়েও হয়তো ঠিক করেছিলেন। কিন্তু দুঃখিত মনে হামীদা ঘর-সংসারে মন দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে আকবর যখন দারুণভাবে দুর্ঘটনায় পড়েন, হামীদা বলে পাঠালেন তুমি কিছুদিন বিশ্রাম নাও পুত্র। আকবর উদ্ধতভাবে বলেছিলেন আমি আরামে থাকব আর বিশ্ব কষ্ট পাবে তা হয় না। বড় দুঃখ পেয়েছিলেন সম্ৰাট-মাতা।

তবে সবচেয়ে দুঃখ পেলেন যখন তিনি পুত্রকে পৌত্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে নিষেধ করলেন। আকবর যখন এই অনুরোধ অমান্য করে এগোতে লাগলেন তখন যেন এই বৃদ্ধার বুকে শেলাঘাত হল। তিনি দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। খবর শুনে আকবর আগ্রাতে ফিরে এলেন। হামীদা তখন মৃত্যু শয্যায়। তার বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। স্বামীর মৃত্যুর চল্লিশ বছর পরে সাতাত্তর বছর বয়সে দুঃখ পেতে পেতে হামীদা চলে গেলেন।

যাবার পরেই এল যে সম্মান, সন্মানিতের কাঁধে চড়ে আগ্রা থেকে মৃতদেহের দিল্লী আগমন – তাও বুঝি আপাত। হামীদা চেয়েছিলেন তার সমস্ত সম্পদ সবার মধ্যে সমান করে ভাগ করে দেওয়া হোক। আকবর – লোভী আকবর একাই সবকিছু আত্মসাৎ করে হামিদার শেষ ইচ্ছাটুকুও পূর্ণ করলেন না। মোগল-হারেমের সবটুকুই বিলাসিতা, প্রমোদ আর নিরাবিল জীবনের ইতিহাস নয়। হামীদার জীবন তার উজ্জল দৃষ্টান্ত।

(FAQ) মোঘল সম্রাট হুমাযুনের অন্দরমহল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য

১। হুমায়ুন কে ছিলেন? ভারতের মোঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজা ছিলেন হুমায়ুন।

২। হুমায়ুন কথার অর্থ কী? ভাগ্যবান

৩। হুমায়ুনের প্রিয়তমা রানী কে ছিলেন? হামিদাবানু বেগম।

৪। হামিদাবানু বেগমের গর্ভজাত হুমায়ুনের পুত্রের নাম কী? আকবর

৫। হুমায়ুনের প্রথম বিবাহিত পত্নী কে ছিলেন? বেগ বেগম


Leave a Comment