ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের অন্দরমহল প্রসঙ্গে বাবরের অন্দরমহলের পত্নী ও রক্ষিতা, বাবরের অন্দরমহলের নিয়ম কানুন, বাবরের অন্দরমহলের জাঁকজমক ও বাবরের অন্দরমহলের ইতিহাস সম্পর্কে জানব।
মোঘল সম্রাট বাবরের অন্দরমহল
ঐতিহাসিক বিষয় | মোঘল সম্রাট বাবরের অন্দরমহল |
বাবর-এর পরিচিতি | ভারত-এর মোঘল সম্রাট |
সাম্রাজ্য | মোঘল সাম্রাজ্য |
রাজত্বকাল | ১৫২৬-১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ |
বসবাস যোগ্য পৃথিবীর এক প্রান্তসীমার একটি ছোট রাজ্য – ফরগনার অধিপতি ওমর শেখ মির্জা। দারুণ উচ্চাকাঙক্ষা তার। আর দারুণ দুঃসাহসিক। তাই একসময় তার রাজ্যের সীমানার মধ্যে ঢুকে গেল পাশের রাজ্য সমরখন্দের অনেকখানা৷ ছোট রাজ্য বড় হল। তার ছোট সংসারও ধীরে ধীরে বড়ো হয়েছে ৷ স্ত্রী আর রক্ষিতা মিলিয়ে অন্ততঃ পাঁচজন নারী তার অন্দরমহল ভরিয়ে রেখেছেন। এঁদের গর্ভে তার তিনটি পুত্র আর পাঁচটি কন্যার জন্ম হয়েছে। মোঙ্গল য়ুনুস খাঁর মেয়ে কুতলগ নিগার খানুমের গর্ভে জন্মেছিলেন কন্যা খানজাদা বেগম (জন্ম ১৪৭৮ খৃঃ) আর পুত্র জহীর-উদ্-দীন। মোঙ্গলললনা ফাতিম সুলতানের গর্ভে জন্মেছিলেন একটি পুত্র জহাঙ্গীর মির্জা (১৪৮৫ খৃঃ) দুই কন্যা মিহর্বানু বেগম (জন্ম ১৪৭৮ খৃঃ) আর শেহরবানু বেগম (জন্ম ১৪৯১ খৃঃ) এবং একটি পুত্র নাসির মির্জার (জন্ম ১৪৮৭ খৃঃ) জন্ম দিয়েছিলেন অন্দিজানের এক উপপত্নী উমেদ অগাচহা। দুই রক্ষিতা অঘা সুলতান আর সুলতান মখদুম জন্ম দিয়েছিলেন দুই কন্যা সন্তানের। তাদের নাম যথাক্ৰমে ইয়াদগার সুলতান বেগম ও রুকিয়া সুলতান বেগম। এরা দুজনেই জন্মেছিলেন ১৪৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁদের পিতার মৃত্যুর পর।
এঁদের মধ্যে জহীর-উদ্-দীন নামটি নিরক্ষর মোঙ্গলেরা ঠিক উচ্চারণ করে উঠতে পারতো না৷ এর জন্ম হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসের চোদ্দ তারিখে, বছরটা ছিল ১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দ। উচ্চারণ পরিবর্তনে এই শিশুপুত্রের নামকরণ হয়ে গিয়েছিল বাবর ৷ ইতিহাসে তিনি এই নামেই পরিচিত।
তখনও বাবরের বয়স পাঁচ পুর্ণ হয়ে ছ’য়ে পড়েনি তিনি বেড়াতে এলেন মা-বাবার সঙ্গে ফরঘানা থেকে সমরখন্দে। সেখানে চলছে এক দারুণ বিয়ের বিশাল উৎসব। সেই উৎসবে এসেছেন শিশুকন্যা, আয়শাকে নিয়ে তার পিতা সুলতান আহমদ। ছোট ফুটফুটে মেয়েটিকে দেখে ওমরশেখ মির্জা আর তার প্রধানা বেগম কুতলগ নিগার খানুমের দারুণ পছন্দ হয়ে গেল। অমনি ঠিক হয়ে গেল আয়শাই হবেন বাবরের ভাবী পত্নী। বাগদত্তা বধূ হিসেবে নিৰ্বাচিত হয়ে রইলেন তিনি ভবিষ্যৎ মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান বাবরের সঙ্গে পরিনীতা হবার জন্য।
সাম্রাজ্যের সীমা যাদের লক্ষ্য হয়, জীবনে তাদের দুর্বিপাক আর বিপদ আসে পদে পদে। এরই মধ্যে বেছে নিতে হয় জীবনের অবকাশ, খুঁজে নিতে হয় জীবনের সঙ্গী। খোজেন্দের সমরক্ষেত্রের দুখময় দিনগুলির মধ্যে সান্তনা পেতেই বুঝি বাবর তার জীবনের সঙ্গিনী হিসেবে প্রথম বরণ করে নিলেন তার বাগদত্তা বধু আয়শাকে।
বাবর এখন পূর্ণ সতেরো বছরের টগবগে তরুণ। প্রথমা মহিষী আয়শা গর্ভবতী হয়ে আছেন সমরখন্দে। শেষে সেখানেই তিনি জন্ম দিলেন বাবরের প্রথম সন্তান, একটি কন্যা সন্তান ফখরুন্নিসা৷ ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস-মেয়েটিকে পেয়ে বাবরের আনন্দ ধরে না। কিন্তু এই সুখ কয়েকদিনের জন্য। আয়শার ভাগ্যে কি এতো সুখ অপেক্ষা করে আছে। একটা মাস কোনোক্রমে পার হয়েছে, চল্লিশ দিনও পুরো হয়নি – তার বুকের দুলালী ফখরুন্নিসা চলে গেল তাকে ছেড়ে। শুধু কি কন্যাটিই তাকে ছেড়ে চলে গেল? বাবরও কি তার থেকে ধীরে ধীরে দূরবর্তী হয়ে যাচ্ছেন না? পাঁচটা বছর যেতে না যেতেই বাবর বিয়ে করে বসেছেন আরও একজনকে ৷ সে আবার পর নয়, তাঁরই ছোট বোন মাসুম।
বাবর তখন হেরাতে শ্যালক-শ্যালিকাদের সঙ্গে দারুণ স্ফূর্তি করে, জীবনের ছাবিবশটি একটানা আরামের দিন কাটাচ্ছেন। একেবারে ছোট্ট শ্যালিকা, দেখতেও দারুণ সুন্দর আর চটকদার মাসুম গভীরভাবে বাবরের প্রেমে পড়ে গেলেন। মাসুম দিন রাত ভুলে গেলেন, ভুলে গেলেন তার সকল বাধা নিষেধ। দিদির গর্জনতর্জন, কান্নাকাটি সব ব্যর্থ হল। মাসুম হয়ে গেলেন বাবরের ঘরণী। অথচ আয়শা একটি বছরের মধ্যে বাবরকে তো কখনও স্ত্রীলোকের ব্যাপারে এমন আগ্রহী দেখেন নি।
আসলে আয়শা বুঝতেই পারেন নি যে বাবর তাকে ভালবাসতেনই না। কর্তব্যের খাতিরে, সত্যরক্ষার খাতিরে বিয়ে করেছিলেন মাত্র। কিন্তু আয়শা কি সহ্য করতে পারেন, তারই চোখের সামনে দিয়ে, তারই ছোট বোন তারই স্বামীকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে? তিনি যেন রাধার মতই বলে উঠতে চেয়েছিলেন –
‘আমারই বঁধুয়া আনবাড়ি যায় আমারি আঙ্গিনা দিয়া’।
কিন্তু কি করতে পারেন তিনি একাকিনী নারী। বাবর তরুণ, উদ্দাম আর উচ্চাভিলাষী ৷ রক্তের নোনা স্বাদ যেন তার যৌবন আবেগকে আরও ঘনীভূত করেছে। আয়শার কাছে যা পাননি, তা পেয়েছেন মাসুমের কাছে। প্রেমের উপলব্ধি ঘটছে নতুন করে। মাসুম জানে ভালবাসতে, কাছে পেতে, আকর্ষণ করতে। অতএব বিদায় নিতে হল আয়শাকে। হেরে গেলেন তিনি – মায়ের পেটের ছোট বোনটার কাছে। অন্দরমহলের এক কোণে দাসীবাঁদীদের মতই তাকে থাকতে হল। মির্জা হিন্দালের, বাবরের এক সন্তানের বিয়ের ভোজের বিশাল উৎসবে তাই তাকে আমরা যখন দেখেছিলাম অন্যান্য বেগম আর নারীদের সঙ্গে বসে থাকতে, বড় করুণ দেখাচ্ছিল তাকে।
কিন্ত শুধুই কি তার চোখে কারুণ্য ঝরে পড়েছিল? ঠোঁটের পাশে এক ঝিলিক বিদ্রুপের হাসি দেখা দেয় নি? দেয়নি প্রতিহিংসা পালনের এক পরিতৃপ্তির ঝিলিক? তখনও কি তিনি ঐ উৎসবের বিশাল আয়োজনের মাঝে বসে বসে ভাবছিলেন না – পারলো কি মাসুম আমাকে শেষ অবধি হারিয়ে দিতে ? পারলো কি মাসুমের গৰ্ভজাত কোনো পুত্ৰ বাবরের সাম্রাজ্যের অধিকারী হতে? পারলো কি তার কোনো পুত্ৰ-কন্যা মোগল সাম্রাজ্যের বিশাল বিস্তারের মধ্যে কোথাও ঠাঁই নিতে?
ভাবতে গিয়ে চোখের কোণে কি জল এসে গিয়েছিল তার? নাঃ ওটা বুঝি মনের ভুল। ছোট বোনটাকে কি কম ভালবাসতেন আয়শা ? আহা রে বেচারা ভালবেসেই মরে গেল। ভালবাসল বটে, ভোগ করতে পারল না। যথাসময়ে মাসুমের ঘর আলো করে একটা ফুলের মতো মেয়ে জন্মালো। আয়শারও তো একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছিল। না, আয়শা পারে নি তাকে বুকের বাঁধন দিয়ে বেঁধে রাখতে। পেরেছিল মাসুম, কিন্তু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে নি বাবরের প্রিয়তমা মহিষী মাসুম। কন্যা সন্তানকে জন্ম দিয়ে সে বিদায় নিয়েছিল পৃথিবী থেকে। আয়শার কি একবারও মনে হয় নি – অপরের অধিকারে নাক গলাতে গেলে তারও অমনি পরিণতি হয়! কে জানে?
ভারি মুষড়ে পড়েছিলেন বাবর। কাবুল জয়ের অপরিমিত আনন্দে ভাটা পড়ে গেছিল। মায়ের স্মৃতিকে চিরজাগরূক করে রাখতেই মেয়ের নামও রেখেছিলেন মায়ের নামেই মাসুম। মাসুম সুলতান বেগমের মেয়েও মাসুম। অনেক পরে ঐ হেরাতেরই সুলতান হুসেনের নাতি মহম্মদ জামান মির্জার সঙ্গে এই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
না, কেউ পারল না বাবরের মহিষী হয়ে থাকতে – না আয়শা, না মাসুম। তাই বলে যদি ভেবে বসি বাবর আর বিয়ে করলেন না মাসুমের শোকে – ভূল করবো। মোগল অন্দরমহল কখনও নীরব থাকে নি। বাবরের অন্দরমহলেও
ছিল তার বিবাহিতা এবং রক্ষিতার দল। ছিলেন হিসারের সুলতান মাহমুদের কন্যা জয়নাব, ছিলেন দিলদার আগাচহা – সুখ্যাত হিন্দালের আর গুলবদনের গর্ভধারিণী, ছিলেন রায়কা, ছিলেন ইউসুফজায় প্রধানের কন্যা মুবারিকা৷ আরও ছিলেন হেরাতের সুলতান হুসেনের পরিবারের ললনা মাহম বেগম – তার প্রধানা মহিষী এবং তার প্রিয়তম পুত্র হুমায়ুন-এর গর্ভধারিণী জননী এবং কামরানের মা গুলরুখ।
বাবরের জীবনে জয়নাবের যে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল তা মনেই হয় না। কাবুল জয়ের সময় তিনি একে বিয়ে করেছিলেন। তারপর প্রায় সাধারণ স্ত্রীর মতোই অন্দরমহলে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। রায়কাও তাই।
সেদিক থেকে বাবরের আফগানী স্ত্রী মুবারিকার ভূমিকা নগণ্য ছিল না জীবনে শুধু নয়, মরণের পরেও বাবর তার ভালবাসার আস্বাদ যেন গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। বর্তমানে যেখানে তাজমহল, তার ঠিক উল্টো দিকে, যমুনা নদীর অন্য তীরটিতে আরাম বাগে (রামবাঁগ নামেই সুপরিচিত) একটি সমাধি নির্মাণ করে বাবরের যে মরদেহ প্রথম সমাহিত করা হয়। পরে সেই সমাধিস্থল থেকে কাবুলে তাকে স্থানান্তরিত করা হয় একটি দারুণ সুন্দর সমাধিক্ষেত্রে। বাবরের অনেক আত্মীয়স্বজন সেখানে সমাহিত ছিলেন আগে থেকেই ৷ এই স্থানান্তরীকরণ ঘটিয়ে
ছিলেন বাবরের এই আফগানী স্ত্রী মুবারিকা |
সত্যি কথা বলতে কি বাবরের সমস্ত স্ত্রীদের মধ্যে গণনীয় হয়ে উঠেছিলেন তার তিন স্ত্রী গুলরুখ, দিলদার আর প্রধানা মহিষী মাহম। প্রথমা পত্নী আয়শার গৰ্ভজাত কন্যাটি যখন মারা গেল, বাবরের স্নেহ বুুভুক্ষু পিতৃহৃদয় যখন সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য লালায়িত – তখনই তার এই তিন স্ত্রী তাকে উপহার দিয়েছেন পর পর পনেরটি সন্তান।
এর মধ্যে গুলরুখ বেগমের কোল জুড়ে এসেছিল পাঁচটি সন্তান – চার পুত্র এবং এক কন্যা ৷ পুত্র চারটি হলেন কামরান মীর্জা, আসকরী মীর্জা, শাহরুখ মীর্জা ও সুলতান আহমদ মীর্জা ৷ কন্যার নাম গুলবার। অবশ্য এর একটা অন্য নামও ছিল গুল-ই-জার বেগম। গুলরুখ ছিলেন বাবরের দ্বিতীয় স্ত্রী – আয়শার পরই তাকে বিয়ে করে ছিলেন। যদিও বাবর তার এই স্ত্রীকে কাবুল প্রদেশ দান করে গিয়েছিলেন, তবুও গুলরুখ কি পেরেছিলেন বাবরের অন্তরের সিংহভাগ কেড়ে নিতে ?
দিলদার আগাচহার গর্ভে বাবরের ঔরসে জন্ম নিয়েছিলেন যে পাঁচটি সন্তান তার তিনটি ছিলেন কন্যা আর দুটি পুত্ৰ। এর মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র আলওয়ার মারা গিয়েছিলেন খুব অল্প বয়সেই, বড় দাদা হিন্দালের বয়স তখন মাত্র দশ। হিন্দাল জন্মেছিলেন ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে কাবুলে। অবশ্য যে পনেরোটি সন্তানের কথা বলেছি দু জন বাদে সবাই জন্মেছিলেন কাবুলেই ৷ হিন্দালের একটা পোশাকী নাম অবশ্য ছিল – আবুল নাসির। তার দুই দিদি আর ছোট বোনের নাম ছিল যথাক্রমে গুলরং, গুলচিহরা এবং গুলবদন। গুলরং কাবুলে জন্মগ্রহণ করেন নি, করেছিলেন খোস্ত-এ।
দিলদার বেগম ছিলেন খুবই স্নেহপ্রবণ মা৷ ছোট ছেলে অলওয়ার মীর্জা ভুগে ভুগে দারুণ কাহিল। চিকিৎসকেরা অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না। বাবরের পিতৃহৃদয়ও ছিল বড় প্রশস্ত। পুত্রের এই মৃত্যু তার বুকে হানল দারুণ শেলাঘাত আর মা দিলদার বেগম পুত্রকে হারিয়ে হয়ে উঠলেন একেবারে উন্মাদ।
দিলদারকে খুবই ভালবাসতেন সম্রাট বাবর। তাঁকে ভালবেসে বুকে টেনে নিয়ে বললেন – “এই তো সংসার দিল্। দুঃখ পেও না৷ ভেবে নাও না – এই হল আল্লাহর বিধান।” তারপর সব বেগমদের ডেকে বললেন, “চল আমরা কাবুল থেকে চলে যাই, কদিন বেড়িয়ে আসি ধউলপুর (ধৌলপুর) থেকে।
এমনি করে পরে আরও একবার হুমায়ুন বাবরের প্রধানা মহিষীকে, নিজের মাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন গোয়ালিয়ারে ৷ সেদিনও তিনি বিমাতা দিলদারকে সসন্মানে নিয়ে গিয়েছিলেন। আবার দিলদারকে নিয়ে হুমায়ুন ধৌলপুরেও বেড়াতে গেছিলেন। দিলদারের তখন মনে পড়ে গিয়েছিল বাবরের স্মৃতি। দু চোখ বেয়ে জল এসেছিল।
আসলে দিলদারকে খুবই ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন সম্রাট হুমায়ুন। যেখানে গেছেন সেখানেই তাকে সসম্মানে নিয়ে গেছেন। দিলদার যে তার প্রিয় ভাই হিন্দাল এবং প্রিয় বোন গুলবদনের মা। কতদিন পবিত্র কোরাণ গ্রন্থ হাতে নিয়ে এসে দিলদারের কাছে মনের দরজা উন্মুক্ত করে বলেছেন – ‘হিন্দালই হচ্ছে আমার মনের বল-ভরসা, আমার চোখের মণি, আমার ডান হাত, আমার আদরের আর দারুণ ভালবাসার পাত্র’। তারই অনুরোধে দিলদারও নিজে গিয়ে পুত্র হিন্দালকে নিয়ে এসেছেন আলোয়ার থেকে হুমায়ুনের রাজধানীতে। দেখা হয়েছে দুই ভাইয়ে হুমায়ুনের বিপদের দিনগুলিতে।
দিলদারও হুমায়ুনকে দারুণ ভালবাসতেন ৷ আর স্বপত্নীপুত্ৰ কামরানকে দারুণ ভয় পেতেন। একবার তো কামরান দিলদারকে এমন দুখ দিয়েছিলেন যে তিনি কেঁদে একশা। কামরান চালাকি করে গুলবদনকে কিছুকাল নিজের কাছে রেখেছিলেন রাজনৈতিক স্বাৰ্থসিদ্ধির জন্য দিলদারের বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে। তখন থেকে কামরান যেন তার চোখের বিষ হয়ে উঠলেন। পরেও অনেক আশংকার সঙ্গে কামরানের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করেছেন।
অথচ হুমায়ুনের অন্যায় আবদারকেও তিনি প্রশ্রয় দেন। হমীদাবানু বেগমকে বিয়ে করার জন্য হুমায়ুন যখন পাগল তখন প্রথমে রাগ করলেও পরে দৌত্যকাৰ্যে দিলদারই এগিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়। এসব থেকে মনে হয় মোগলদের রাষ্ট্ৰনৈতিক ব্যাপারেও দিলদারের একটা অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল।
আসলে পাটরাণী বলতে যা বোঝায় তা ছিলেন মাহম বেগম। হেরাতের সুবিখ্যাত সুলতান হুসেনের পরিবারের মেয়ে তিনি। তৈমুরের সুখ্যাত ও সর্বাধিক শক্তিশালী অধস্তন পুরুষ, খোরসানের অধিপতি সুলতান হুসেন বৈকারা শেইবানীর বিরুদ্ধে তাকে সহায়তা করার জন্য বাবরকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বাবর সানন্দে এবং সাগ্রহে গিয়ে পৌছলেন হেরাতে। কুড়িটি বড়ো আনন্দময় দিন তিনি সেখানে কাটালেন। প্রতিদিন ঘোড়ায় চড়ে নতুন নতুন জায়গা ভ্রমণ করে আসেন। কোনোদিন যান কোনো গুলবাগিচায়, কোনোদিন বা কোনো সমাধিস্থলে, কোনোদিন কোনো মসজিদে, কোনোদিন বা হাসপাতালে এবং সর্বত্র ৷ দেখে তার মনে হয়েছিল সারা পৃথিবীতে এমন বাসযোগ্য স্থান বুঝি আর নেই।
কিন্তু বাবর সাহায্য করতে এলেও হেরাত হাতছাড়া হয়ে গেল। সুলতানের কাছ থেকে চলে গেল শেইবানীর অধিকারে। পালিয়ে গেলেন সুলতান হুসেনের ছেলেরা। বাবর তখন কান্দাহারের দিকে এগিয়ে গেলেন বিলাসব্যসন ছেড়ে৷ গুলবাগিচায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি দেখা পেয়েছিলেন মাহমের – সুন্দরী মাহমের। এই কুড়িদিনের স্বর্ণমুহূর্তের কতক্ষণই না বন্দী হয়ে গিয়েছিল মাহম-বাবরের প্রণয় গুঞ্জনে। বাবর জানলেন মাহমকেও পালিয়ে যেতে হয়েছে পরিবারের অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে। অমনি তিনিও সসৈন্যে এগোলেন ৷ কান্দাহারের পথে যেতে যেতে তার দেখা হয়ে গেল প্রহৃত সৈন্যদলের সঙ্গে। আর দেখা হল সুলতান পরিবারের মহিলাদের সঙ্গে। সেখানে রয়েছেন মাহম। তার তখনকার যৌবনের স্বপ্ন, তার প্রিয়তমা মাহম। কর্তব্য আর প্রেমের দ্বন্দ্বে তখন কৰ্তব্য প্রধান স্থান পেল বটে, মন পড়ে রইল মাহমের কাছেই। গুলরুখের কথা হয়তো একবার মনে এসেছিল, কিন্তু মাহমই তখন কেড়ে নিয়েছে তার দিনের কাজ, রাতের ঘুম। কর্তব্য পালনের আগেই তাই মাহমকে তিনি বিবাহ করলেন। সেটা ১৫০৬ খ্রিষ্টাব্দ, বাবর তখন ২১ বছরের টগবগে তরুণ।
বিয়ের কিছুদিন পরেই বাবর-মাহমের সন্তানেরা একে একে জন্মগ্ৰহণ করতে লাগল। প্রথমা পত্নী আয়শার কন্যাসন্তান জন্মেই কিছুদিন পর মারা গেছে। এরপর জন্ম হল মাহমের গর্ভে সুলতান বাবরের প্রথম পুত্ৰ সন্তান হুমায়ুনের। হুমায়ুন মাহমের একমাত্র জীবিত সন্তান। অনেকগুলো ছেলে মরে তবে হুমায়ুন | সেজন্য মায়ের নয়নের নিধি। তার কোল আলো করে এসেছিল আরও চারটি সন্তান ৷ এলো বারবুল মীর্জা, এলো মিহর-জান বেগম, এলো ইসান দৌলত বেগম আর ফারুক মীর্জা। সবাই বড়ো স্বল্পায়ু। ফারুক মীর্জা পুরো দুটো বছরও বাঁচে নি। তাঁকে তো তার পিতা দেখার সুযোগ পৰ্যন্ত পান নি ৷
সবশেষে কেবল বেঁচে রইলেন হুমায়ুন। তার জন্ম হয়েছিল কাবুল দুর্গে । সেদিন ছিল মঙ্গলবার, রাত্রি ৯১৩ হিজরী সনের ৪ ঠা জূল-কেদা, ইংরেজি ৬ মাৰ্চ ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দ৷ সূর্য তখন মীন রাশিতে। এই হুমায়ুন, ‘সৌভাগ্য’-কে নিয়েই মাহমের বাকী জীবন কেটেছে। তা বলে তার সপত্নী পুত্র-কন্যারা তার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হন নি কেউ। হিন্দালকে তো তিনি পোষ্যপুত্র হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। গুলবদনও ছিলেন তার পালিতা কন্যা। অনেক বড়ো হয়েই তারা আপন মা দিলদারকে কাছে পেয়েছিলেন। কিন্তু ছোটবেলায় তারা কোনোদিনই বুঝতে পারেন নি মাহম তাদের গর্ভধারিণী মা নন।
সংসারে দেখা যায়, যারা ভাল তারাই বেশি দুঃখ পাঁন। মাহম বাবরের প্রিয়তমা মহিষী হলেও দুঃখী ছিলেন। পাঁচ সন্তানের জননী হয়েও চার চারটি সন্তানকে তিনি হারিয়ে ছিলেন অকালে। একটি মাত্র নিধি যিনি মোগল বংশের দ্বিতীয় সম্রাটরূপে অভিষিক্ত তাঁকে নিয়েও তার গর্ব করার, আনন্দ করার দিনগুলোও বুঝি নির্দিষ্ট হয়ে গেছিল। মীর্জা হুমায়ুন শাসনভার গ্রহণের জন্য বদকশান গেছেন। মা মাহমও সঙ্গে গেছেন রক্ষাকবচ হয়ে। তেরো বছরের কিশোরটিকে একলা ছেড়ে দিতে তিনি একেবারেই নারাজ। তা বলে স্বামীর দিকে তার নজর কম ছিল ভাবাই যায় না। একটু বেশিই ছিল বুঝি, আর তাই নিয়ে স্বামীর কাছে বকুনিও খেয়েছেন।
তখন বাবর প্রায় চার বছর ধরে আগ্রায় রয়েছেন। একদিন প্রখর গ্রীষ্মে একটা মজার ব্যাপার ঘটল। বাবর প্রতি শুক্রবারই হিসেব করে নিজের পিসিদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। একদিন খুব গরম বাতাস বইছে। তাই দেখে মাহম স্বামীকে ডেকে বললেন – “আজ প্রিয়তম, বাইরে যেতে দিতে ভরসা পাচ্ছি না। বাইরে একদম লু
বইছে। নাই বা গেলে তোমার পিসিদের সঙ্গে এই শুক্রবার দেখা করতে। বেগমরা নিশ্চয়ই তাতে কিছু মনে করবেন না ৷”
প্রিয়তমা পত্নীর কথা শুনে বাবর দুঃখ পেলেন। বললেন, ‘প্রিয়তমা, তুমি কি করে এমন কথা বলতে পারলে আশ্চর্য! আবু সঈদ মীৰ্জার মেয়েরা আজ পিতৃহারা, ভাই হারা। আমি ছাড়া আর তাদের কে আছে যে তাদের মুখে
হাসি ফোটাবে ?’
না, তা বলে বাবর রাগ করে থাকতে পারেন নি কোনদিন। মাহমকে তিনি ভালবাসতেন নিজের চেয়েও বুঝি বেশি। একবার মাহম আসছেন কাবুল থেকে হিন্দুস্তানে। মাহম যখন আলিগড়ে ( কুল-জলালী ) পৌছলেন তখন তিনজন অশ্বারোহী এল দুটি চতুর্দোল নিয়ে। সম্রাট বাবর স্ত্রীর আগমনকে স্বচ্ছন্দ করার জন্যই চৌদোলা পাঠিয়ে
দিয়েছিলেন। মাহম ধীরে ধীরে আসছেন, সম্ৰাট যেন ধৈৰ্য ধরতে রাজী নন। দ্রুতগতিতে চৌদোলা চড়ে মহিষী এগিয়ে আসছেন। বাবরের ইচ্ছা তিনিও আলিগড় পৰ্যন্ত এগিয়ে গিয়ে মিলিত হবেন তার প্রিয়তমা ভাৰ্যার সঙ্গে। তার আগেই খবর পেলেন মাহম এসে গেছেন মাইল চারেক দূরত্বের মধ্যে।
বাবরের আর প্রার্থনা সারা হল না। ঘোড়া আনানোর সময়টুকু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তার উন্মুখ মন নারাজ। পায়ে হেঁটেই বেরিয়ে পড়লেন তিনি। পথে রাত হলে যে শিবিরে নামবার কথা তার একটু আগেই সম্রাট দেখতে পেলেন তার মাহমের চৌদোলা আসছে। মহিষী তাকে দেখতে পেয়েই দোলা থামিয়ে তা থেকে নেমে আসার উদ্যোগ করতে লাগলেন ৷ বাবরের তখন তুঙ্গ অবস্থা। প্রেম-কামনার আবেগে তিনি ভিতরে ভিতরে কাঁপছেন থর থর করে। সৌজন্য-শিষ্টাচার গেলেন ভুলে৷ ভুলে গেলেন পরিবেশ এবং বাহকদের কথা৷ অধীর আগ্রহে
তিনি নিজেই দোলা থামিয়ে তার মধ্যে প্রবেশ করলেন। আদরে আদরে প্রিয়তমা বেগমকে পূৰ্ণ করে ভরিয়ে দিয়ে নেমে এলেন দুজনে। তারপর বাকী পথ দুজনে পায়ে হেঁটে হাতে হাত ধরে এগিয়ে গেলেন সম্ৰাট মহলের দিকে।
কখনও বা বেড়াতে গেছেন স্বামীর সঙ্গে ধৌলপুরের বাগানে। এখানের এক অখণ্ড পাথর খুঁড়ে দশ গজ লম্বা-চওড়া একটা ছোট পুকুর বানিয়ে রেখেছেন বাবর। তার পাড়ে বসে মাহমের সঙ্গে রচনা করেন সুখ-দুঃখের ভবিষ্যৎ।
কিন্তু এসব সুখ মাহমের জীবনে শুধুমাত্র নিশার স্বপনের মতই এসেছিল। অচিরেই এসে গিয়েছিল দুঃখের অনাকাঙক্ষাহিত বেদনাদায়ক মুহূর্ত গুলি। সম্রাট বেগমদের নিয়ে এগিয়ে চলেছেন ধৌলপুরের দিকে নৌকাযোগে৷ হঠাৎ দিল্লী থেকে মৌলানা মহম্মদ ফরঘরীর চিঠি এল – মীর্জা হুমায়ুন প্রবল অসুস্থ, অবস্থা সঙ্কটজনক। মহামান্য বেগম যেন অবিলম্বে দিল্লী চলে আসেন ৷ হুমায়ুন মীর্জা দারুণ ভেঙে পড়েছেন।
মাহম ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠলেন। পাগলের মতো দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি করতে লাগলেন। হলেনই বা সম্রাটের বেগম ৷ তিনি যে মা, অনেক ছেলে মরা এক সন্তানের মা। আর্তের মতো ছুটে গেলেন তিনি দিল্লীর দিকে। পথে মথুরাতেই দেখা হয়ে গেল হুমায়ুনের সঙ্গে। বাবর জলপথে হুমায়ুনকে দিল্লী থেকে আগ্রায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছেন ৷
ছেলেকে দেখেই মা বুঝতে পারলেন হুমায়ুন খুবই রোগা আর কাহিল হয়ে পড়েছেন। চিঠিতে যা লেখা হয়েছে তার চেয়ে হুমায়ুন আরও প্রবল অসুস্থ। বুকের ডানায় আগলে শাবকের মতো হুমায়ুনকে নিয়ে এলেন আগ্রায়। তারপর চলতে লাগল বিনিদ্র সেবা। সেবা আর প্রার্থনা। তবুও হুমায়ুন প্রতিদিনই যেন ক্ষয় হয়ে যেতে লাগলেন।
প্রতিদিনই আরও বলহীন। কখনও চেতনা পান, কখনো চেতনা হারান। মাহম উন্মাদপ্রায়।
সম্রাট বাবর পুত্রকে দেখতে এসে পত্নীকে দেখে উদাস। এই সংসার ! এই ভালবাসা ! এমনি করেই তার সাজানো বাগান শুকিয়ে যাবে! মুখে হা-হুতাশ নেই। কিন্তু অন্তরটা শূন্য, শুষ্ক। তার চোখ দুটিকে ক্রমে গ্রাস করল বিষন্নতা, মুখশ্রীকে আচ্ছন্ন করল প্রবল কারুণ্য। মহিষী একবার পুত্রের দিকে তাকান আর একবার স্বামীর দিকে। দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে আসে ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
একদিন মাহম বাবরের হাত দুটোকে জড়িয়ে ধরে বললেন ‘কেন, কেন তুমি এতো ভেঙে পড়েছো৷ তুমি তো রাজা, তুমি তো সম্ৰাট। তুমি কেন এত দুঃখ পাবে ? আর তোমার তো এই একটি মাত্র ছেলে নয়, তোমার তো আরও ছেলে আছে ৷ যদি বল আমি কাঁদছি কেন? আমি তো কাঁদবই ৷ এই একটি মাত্র অন্ধের নড়ি আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছেন। এ চলে গেলে আমি কাকে নিয়ে বাঁচব’I
বাবরের স্বর গভীর হয়ে উঠল৷ মাহমকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন – ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ মাহম। আমার আরও অনেক সন্তান আছে। কিন্ত তাঁরা কি কেউ আমার হুমায়ুনের চেয়ে বেশি প্রিয় ? তাকেই যে আমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসি ৷ এমন কি আমার প্রাণের চেয়েও। আমার সব নিয়ে ও বেঁচে থাকুক – এই আমার প্রার্থনা। আমি চাই ও-ই আমার রাজ্যের পরবর্তী অধিকারী হোক। ওর মতে৷ সন্তান, কি গুণে, কি প্রতিভায় আমার একটি সন্তানও নয়।
একটা গভীর বিষাদ বাবরের অন্তরকে বেশ কিছুদিন ধরেই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। হুমায়ুনের অসুস্থতার আগেই একদিন বাগ-ই-বার আফশানে এক প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন করেছিলেন সম্রাট বাবর। বাগানের মধ্যে ছিল একটি চৌবাচ্চার মতো জায়গা – নমাজের আগে হাতমুখ ধোবার জন্য। সেটির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে আপন মনেই বলে উঠেছিলেন – ‘মহিষী আর যেন পারছি না। রাজত্ব আর শাসন কাৰ্য পরিচালনা করে বড় অবসন্ন হয়ে পড়েছি বেগম। এখন কেবল ইচ্ছে হচ্ছে জীবনের সব কাজ থেকে অবসর নিয়ে শুধু এই বাগানটাতে একা একা থাকি। পরিচারক হিসেবে শুধু আমার কাছে থাকবে আমার জলপাত্র বাহক তাহির ৷ রাজ্যের ভার তুলে দেব পুত্র হুমায়ুনের হাতে ৷’
শুনে চোখে জল এসে গিয়েছিল দুঃখী মাহমের। তার ভালবাসার মধ্যেও কি তবে সম্ৰাটের কোনো সুখ নেই। দেহ শুধু কাছে এসে তার হৃদয়কে ক্লান্ত করছে? এক চোখ জল নিয়ে মাহম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন – আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘকাল সুখে শান্তিতে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত রাখুন। আর আপনার সেই দীর্ঘ পরমায়ুর অধিকারী হয় যেন আপনার সব পুত্ৰই।
হুমায়ুন অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই একই অবসাদ সম্রাটের মধ্যে এলেও পুত্রপ্রেমে সমৃদ্ধ পিতা বাবর যেন আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠলেন। তাকে ঘিরে গড়ে উঠল ইতিহাসের সেই প্রখ্যাত কিংবদন্তি। এর পর বাবর হুমায়ুনের শয্যার পাশে তিনবার ঘুরে নিজের পরমায়ুর পরিবর্তে পুত্রের পরমায়ু প্রার্থনা করলেন এবং নিজে অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
অসুস্থতার মধ্যেও সম্রাট মাহমকে কাছে ডেকে বলেন – মহিষী আমার দিন শেষ হয়ে গেছে। গুলরঙ-আর গুল-চিহর তো তোমারই মেয়ে। গুলবদনটা খুবই ছোট ৷ ওর কথা এখন ভাবি নে। তুমি বড় দুটোর সাদীর যাহোক ব্যবস্থা কর। ওদের পিসি, আমার দিদি (খানজাদা বেগম ) এলে তাঁকে বলো যে ইসান তৈমুর সুলতানদের (ইসান হলেন বাবরের মৃত ছোট মামা আহমদ খানের পুত্র ) সঙ্গে গুলরঙের এবং তূখ-তা-বুখার সঙ্গে গুলচিহরার বিয়ে দিতে আমার খুব ইচ্ছে। সে যেন এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়।
তারপর ডিসেম্বর ২৬, ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ সোমবার বাবর চলে গেলেন চিরদিনের জন্য। মাহম কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কিন্ত তাকে শান্ত হতে হল। ভবিষ্যৎ সম্রাটের তিনি মা। বাবর যে গেলেন তাকে কত ভালবাসতেন তার একটা প্রমাণও পেয়ে গেলেন তিনি তীর মৃত্যুর পরেও। নতুন সম্ৰাট হিসেবে হুমায়ুনের অভিষেকের পর যিনি তার তত্বাবধায়ক রূপে নির্বাচিত হলেন তিনি হুমায়ুনের মাতুল এবং মাহম বেগমের ভাই মহম্মদ আলী অসজ ৷
বাবর, তার প্রিয়তম স্বামী চলে গেছেন। প্রতিদিন সমাধিসৌধে চলে প্রার্থনা ৷ মাহম নিজে দৈনিক দুবার ভোজন ব্যবস্থার নিমিত্ত প্রয়োজনীয় খরচখরচা দিতে লাগলেন। আমৃত্যু এই ব্রত তিনি স্বামীর আত্মার শান্তির জন্য পালন করে গেছেন।
গুলচিহরা আর গুল-রঙের বিয়ে হয়ে গেছে। বাবর থাকতেই হুমায়ুনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। হুমায়ুনের পুত্রও হয়েছিল৷ পুত্রের আরও সন্তানের জন্য তিনি উন্মুখ থাকতেন। এমনকি এর জন্য পুত্রের শষ্যাসঙ্গিনী নির্বাচনেও উদগ্রীব থাকতেন ৷ সামান্য এক পরিচারিকা মেওয়া-জান দেখতে সুন্দর ছিল ৷ মায়ের আদেশে হুমায়ুন তাঁকে বিয়ে করলেন। কোনো বধু গর্ভবতী জানলে দারুণ খুশি হতেন মাহম। তার স্নেহপ্রস্রবণ সর্বদা স্নেহপাত্রের দিকে ছিল সদাধাবমান ৷ হুমায়ুনকে ঘিরেই তখন তার স্বপ্নজাল বিস্তৃত। পুত্রের আরোগ্যে তিনি সুখী। পুত্রের গৌরবে গর্বীত ৷ হুমায়ুন চুনার থেকে নিরাপদে সুস্থ শরীরে ফিরে এসেছেন। অমনি মাহম বেগম বিরাট ভোজের আয়োজন করে বসলেন। চারিদিক সাজসজ্জার আদেশ দিলেন। অমন আলোকসজ্জা আগ্রায় এর আগে দেখা যায় নি।
পুত্রের জন্য তৈরি করিয়েছেন রত্নখচিত সিংহাসন। তার মাথার ওপরে সোনার সুতোর সুক্ষ্ম কারুকার্য সমন্বিত চন্দ্রাতপ। এমনকি গদি বালিশগুলোতে পর্যন্ত সোনার সুতোর কাজ | এছাড়া তৈরি করিয়েছিলেন গুজরাটি সোনার কাপড় দিয়ে আরও একটি চন্দ্ৰাতপ। তৈরি করিয়েছিলেন একটি করে কন্নৎ ও সর-কন্নৎ। গড়িয়েছিলেন গোলাপজলের ঝারি। গড়িয়েছিলেন দীপাধার। সবই সোনার তৈরি আর মণিমুক্তোহীরেজহরৎ বসানো।
কিন্তু হুমায়ুনের জীবনে স্বস্তি ছিল না। তাই একদিন মাকে এসে বললেন মাগো আর ভালো লাগে না এই যুদ্ধ আর পালিয়ে বেড়ানো ৷ চল না ক’দিন বেড়িয়ে আসি গোয়ালিয়র থেকে। তাই যাওয়া হল। অনেককে নিয়ে মাহম গেলেন সেখানে। বেগা বেগম আর আকীকা কাছে ছিলেন না বলে তাদের জন্য মন খারাপ করতে লাগলেন। আনিয়ে নিলেন তাদের ৷ বিশাল উদার হৃদয় তার, তাই বিশ্বজোড়া ভালবাসা ৷ দু মাস ধরে সবাই একসঙ্গে গোয়ালিয়র থেকে ফিরলেন এবার আগ্রায়। সেটা ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাস। হিজরী ৯৩৯ সনের শবান মাস।
এর পরেই শওয়াল মাসে একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়লেন মাহম। স্বামীর মতই পেটের গোলমাল দেখা দিল। আর বেশিদিন ভুগতে হল না এই দুঃখী আর গর্বিতা সম্ৰাজ্ঞীকে। ১৩ শওয়াল ৯৩৯ হিজরী, ৮ মে ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি চিরবিদায় নিলেন। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত বাবরের অন্দর মহলের সবচেয়ে উজ্জল চিরাগটি নিভে গেল। শুধু শোকের জন্য রইলেন বাবরের সন্তানেরা। বিশেষ করে কেঁদে কেঁদে সারা হয়ে গেলেন তার পালিতা কন্যা গুলবদন মাহমের অন্দরমহলে থেকেই ৷ হারানোর ব্যথা কি সহজে ভোলা যায়!
(FAQ) বাবরের অন্দরমহল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য
১। বাবর কে ছিলেন? ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাবর।
২। বাবরের অন্দরমহল ভরিয়ে রেখেছিল কতজন নারী? স্ত্রী আর রক্ষিতা মিলিয়ে অন্ততঃ পাঁচজন নারী।
৩। সম্রাট বাবরের প্রথমা মহিষী কে ছিলেন? আয়শা বেগম।
৪। বাবরের প্রিয়তমা পত্নী কে ছিলেন? মাহম বেগম।
৫। মাহম বেগমের গর্ভজাত বাবরের পুত্রের নাম কী? হুমায়ুন