বিজয়নগর সাম্রাজ্যের তুলুভ বংশ প্রসঙ্গে বীর নরসিংহ, কৃষ্ণদেব রায়, অচ্যুত রায়, বেঙ্কট, সদাশিব রায় মন্ত্রী রামরায় ও ফিরিস্তার বর্ণনা সম্পর্কে জানবো।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের তুলুভ বংশ
বিষয় | বিজয়নগর রাজ্যের তুলুভ বংশ |
সময়কাল | ১৫০৩-১৫৭০ খ্রি |
প্রতিষ্ঠাতা | বীর নরসিংহ সালুভ |
পূর্ববর্তী বংশ | সালুভ বংশ |
পরবর্তী বংশ | আরবিডু বংশ |
ভূমিকা :- ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে নরস নায়কের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর নরসিংহ শালুভ নিজ বংশের দাবি অগ্রাহ্য করে সিংহাসনে আরোহণ করে বিজয়নগর সাম্রাজ্য-এ এক নূতন রাজবংশের সূচনা করেন। তাঁর বংশ তুলুভ বংশ নামে পরিচিত।
তুলুভ বংশের রাজা বীর নরসিংহ
বীর নরসিংহ ‘অনধিকারী’ ছিলেন বলে চারদিকে বিদ্রোহ দেখা দেয়। বীর নরসিংহের স্বল্প রাজত্বকাল যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যেই কেটে যায়, তবে তিনি সেনাবিভাগের সংস্কার করে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছিলেন। বীর নরসিংহ একজন ধর্মপ্রাণ রাজা ছিলেন বলেও জানা যায়।
তুলুভ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণদেব রায়
- (১) ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে বীর নরসিংহের মৃত্যু হলে তাঁর সৎ ভাই কৃষ্ণদেব রায় বিজয়নগরের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি বিজয়নগরের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে বিজয়নগর সাম্রাজ্য গৌরব ও সমৃদ্ধির চরম শিখরে আরোহণ করেছিল বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন।
- (২) যোদ্ধা হিসাবেও তিনি ছিলেন চূড়ান্ত সফল বিজয়নগরের গৌরব তিনিই ফিরিয়ে আনেন। বিজয়নগরের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বাহমনি রাজ্য-এর বিরুদ্ধে এবং উড়িষ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তিনি বহু অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন। পর্তুগিজদেরও তিনি দমন করেন। তাঁর শাসনকালে প্রজারা সুখে-শান্তিতে বাস করত।
- (৩) পর্তুগিজ পর্যটক পায়েস তাঁর রাজসভায় দীর্ঘদিন অবস্থান করেছিলেন। তিনি কৃষ্ণদেবের রাজত্বকাল সম্পর্কে এক মনোজ্ঞ বিবরণ রেখে গেছেন। তিনি কৃষ্ণদেবকে একজন মহান শাসক বলে বর্ণনা করেছেন। কৃষ্ণদেব রায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। তাঁর জীবিতাবস্থাতেই বিজয়নগর সাম্রাজ্যে চরম অশান্তি দেখা দেয়।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের তুলুভ বংশের রাজা অচ্যুত রায়
- (১) ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণদেব রায় মৃত্যুর পূর্বেই তাঁর জ্ঞাতিভাই অচ্যুত রায়কে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। তিনি শাসক হিসাবে খুব অযোগ্য ছিলেন না। অচ্যুত রায় রাজ্যশাসনের দায়িত্ব অর্পণ করেন তাঁর দুই শ্যালকের হতে।
- (২) এই ঘটনায় রাজ্যমধ্যে এক প্রতিপক্ষ দলের সৃষ্টি হয়। এই প্রতিপক্ষ দলের নেতৃত্ব দেন আরবিডু বংশীয় তিন ভ্রাতা রাম, তিরুমল ও বেঙ্কট। তবে এই গোষ্ঠীর প্রধান ব্যক্তি ছিলেন রামরাজা।
- (৩) রাজ্যমধ্যে এই অভ্যন্তরীণ দলাদলি ও বিরোধ বিজয়নগর রাজ্যের শেষ দিন পর্যন্ত বর্তমান ছিল এবং এই বিরোধই বিজয়নগর রাজ্যকে ধ্বংসের মধ্যে ঠেলে দেয়।
তুলুভ বংশের রাজা বেঙ্কট
বিজয়নগর রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে এই সময় এক চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এই বিশৃঙ্খল অবস্থাতেই অচ্যুত রায় মারা যান এবং তাঁর পুত্র বেঙ্কট সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি মাত্র ছ’মাস রাজত্ব করেন।
তুলুভ বংশের রাজা সদাশিব রায়
শেষপর্যন্ত অচ্যুত রায়ের ভ্রাতুষ্পুত্র সদাশিব রায় বেঙ্কটকে সিংহাসনচ্যুত করে সিংহাসন দখল করেন এবং ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। সদাশিব রায় নামমাত্র রাজা ছিলেন। প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তাঁর মন্ত্রী রাম রায়। রাম রায় যোগ্য মন্ত্রী ছিলেন।
বিজয়নগরের তুলুভ বংশের রাজা মন্ত্রী রাম রায়
- (১) মন্ত্রী রাম রায় বিজয়নগরের গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় দাক্ষিণাত্যের সুলতানি রাজ্যগুলির রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেন। পর্তুগিজদের সঙ্গেও এক বাণিজ্যিক চুক্তি করেন। এই বাণিজ্যিক চুক্তির ফলে বিজাপুরের সুলতানকে পর্তুগিজরা ঘোড়া সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
- (২) রাম রায়ের উদ্দেশ্য ছিল, ঘোড়া সরবরাহ বন্ধ করে বিজাপুরের সামরিক শক্তিকে দুর্বল করা। দেখা যায়, বিজাপুরের সুলতানকে পরাস্ত করার জন্য তিনি আহম্মদনগরের বুরহান নিজাম ও গোলকুণ্ডার কুতুব শাহের সঙ্গে এক চুক্তি করেন।
- (৩) কিন্তু বিজাপুরের সুচতুর মন্ত্রী আসাদ খান এই কূটনীতির যোগ্য উত্তর দেন বুরহান শাহ ও রাম রায়ের সঙ্গে পৃথক এক চুক্তি করে। রাম রায়ের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, দাক্ষিণাত্যের শক্তিগুলির মধ্যে পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে বিরোধ লাগিয়ে রেখে, দাক্ষিণাত্যে নিজ অনুকূলে শক্তিসাম্য বজায় রাখা।
- (৪) কিন্তু এই নীতি প্রথম দিকে সাফল্যলাভ করলেও, তা বিজয়নগরের পক্ষে চরম ক্ষতিকারক হয়েছিল। ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাম রায় বিজয়নগর, গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরের মধ্যে এক সামরিক জোট সৃষ্টি করে আহম্মদনগর আক্রমণ করেন।
- (৫) বিজয়নগরের সেনাবাহিনী এই যুদ্ধে আহম্মদনগরের মুসলমানদের ওপর চরম অত্যাচার করে এবং বহু ধর্মস্থান অপবিত্র করে। রাম রায় পরাজিত আহম্মদনগরের সুলতানের প্রতি চরম অবমাননা করে নিজের এবং বিজয়নগর সাম্রাজ্যের চরম সর্বনাশ ডেকে আনেন।
- (৬) এর ফলে বেরার ছাড়া সমগ্র দাক্ষিণাত্যের নরপতিগণ একত্রিত হয়ে বিজয়নগরের বিরুদ্ধে ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে তালিকোটার রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। এই যুদ্ধ ভারত-ইতিহাসে এক সীমা-মীমাংসক যুদ্ধ হিসাবে পরিচিত। ভয়ঙ্কর এই যুদ্ধে এক লক্ষ সৈন্য নিহত হয়েছিল এবং রাম রায়ের মস্তক হোসেন নিজাম শাহ নিজহাতে দেহচ্যুত করেন।
পর্যটক ফিরিস্তার বর্ণনা
ফিরিস্তার লেখা থেকে জানা যায়, এক বিশাল পরিমাণ সম্পদ লুঠতরাজ করে, প্রতিটি সৈনিক মাথায় করে নিয়ে যান।
উপসংহার :- Sewell তালিকোটার যুদ্ধের ভয়াবহতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁর A Forgotten Empire গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “Never perhaps in the history of the world has such havoc been wrought so suddenly, on so splendid a city.” সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে একটি দীপ্তিময় নগরের উপর এরকম হঠাৎ ব্যাপক ধ্বংস কখনও ঘটে নি।
(FAQ) বিজয়নগর সাম্রাজ্যের তুলুভ বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৫০৩-১৫৭০ খ্রিস্টাব্দ।
বীর নরসিংহ সালুভ।
কৃষ্ণদেব রায়।
সদাশিব রায়।
সদাশিব রায়।