বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ব্যবসা বাণিজ্য প্রসঙ্গে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, ফুলের চাহিদা, বণিক ও বণিক সংঘের প্রাধান্য, বাণিজ্য কেন্দ্র ও বন্দর, রাস্তাঘাট, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক দ্রব্য, বৈদেশিক বাণিজ্যের রপ্তানি দ্রব্য, আমদানি দ্রব্য ও সমুদ্র পথে বাণিজ্য সম্পর্কে জানবো।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ব্যবসা বাণিজ্য
বিষয় | বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ব্যবসা বাণিজ্য |
সাম্রাজ্য | বিজয়নগর সাম্রাজ্য |
সময়কাল | ১৩৩৬-১৬৪৬ খ্রি |
প্রতিষ্ঠাতা | হরিহর ও বুক্ক |
শ্রেষ্ঠ রাজা | কৃষ্ণদেব রায় |
শেষ রাজা | তৃতীয় রঙ্গ |
ভূমিকা :- বিজয়নগর দাক্ষিণাত্যে উত্তর ভারতের পুরীর মতো মন্দির-নগরী নামে খ্যাত ছিল। বিজয়নগর নগর হিসাবে যে গড়ে উঠেছিল তার পশ্চাতে ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের সমুন্নতি ও মন্দির নির্মাণ শিল্পে মূলধন নিয়োগের ফলে মন্দিরকে কেন্দ্র করে দাক্ষিণাত্যে এই যুগে অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নগরায়ণের সূচনা হয়।
বাণিজ্য ও মন্দির নির্মাণের কেন্দ্র
- (১) নাড়ুগুলি প্রাথমিক প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এই নাড়ুগুলি এক একটি বাণিজ্য কেন্দ্র ও মন্দির নির্মাণের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ফলে দক্ষিণে লোক-সমাগমের ফলে বাণিজ্য ও মন্দির নির্মাণের কেন্দ্রগুলিকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও নগরায়ণের সূচনা হয়।
- (২) এক একটি মন্দিরের উৎসস্থল নতুন নতুন নগরের সূচনা করে এবং এই মন্দির নগরগুলি দাক্ষিণাত্যে বণিকশ্রেণীর বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের ফলেই নগরায়ণের সূচনা হয়েছিল। নগরগুলি বাণিজ্যিক লেনদেনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
বণিক ও কারিগরদের মর্যাদা
বিজয়নগরে বণিক ও কারিগর এই যুগে সমাজে মর্যাদার অধিকারী ছিল তা বিভিন্ন বৈদেশিক বিবরণ ও অন্যান্য তথ্যেও পাওয়া যায়। এই শহরগুলি বণিকদের পণ্য সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বিজয়নগর যে পণ্য সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল ছিল তা বিভিন্ন তথ্যে পাওয়া যায়।
বাণিজ্যের সম্প্রসারণ
- (১) বিজয়নগর সম্পর্কে বৈদেশিক বিবরণী থেকে এই রাজ্যের অভূতপূর্ব যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা জানা যায় তার পশ্চাতে ছিল বৈদেশিক বাণিজ্যে বিজয়নগরের চূড়ান্ত সম্প্রসারণ।
- (২) যদিও বিজয়নগরের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল কৃষি। কিন্তু সেচব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় কৃষির উন্নতি ঘটলেও তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছিল কিন্তু অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের হাত ধরে।
ফুলের চাহিদা
- (১) বিজয়নগরে গোলাপ ফুলের ব্যবসায়ীর সংখ্যা লক্ষ করে রাজ্জাকের মনে হয়েছিল, বিজয়নগরে খাদ্যশস্যের আর গোলাপের প্রয়োজন ও চাহিদা একই ছিল। অর্থাৎ একদিকে যেমন খাদ্যশস্যের প্রয়োজনীয়তা ছিল, অপরদিকে তেমনি সুকুমার রুচি শিল্প ফুলের গুরুত্ব ছিল।
- (২) মন্দির নগরী বিজয়নগরের দেব-দেবীর শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের প্রয়োজনে ফুলের ব্যাপক চাহিদা ছিল। তা এই বিবরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়। ফুলের চাষ এই চাহিদাকে পূরণ করতে পেরেছিল।
- (৩) পরবর্তীকালে মুঘল যুগেও এই ধারা অনুসরণ করা হয়। এমনকি ঐতিহাসিক তথ্যে পাওয়া যায় যে মুঘল রাজদরবারে বসরা থেকে গোলাপ আমদানি হত।
বণিক ও বণিক সংঘের প্রাধান্য
- (১) সাধারণত অধিকাংশ শিল্পোৎপাদনের উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় বাজারের পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ অব্যাহত রাখা। কিন্তু ভ্ৰাম্যমাণ বণিক ও বণিক সংঘগুলির প্রাধান্য থাকায় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল।
- (২) বিজয়নগরের খনি, ধাতুশিল্প ও গন্ধদ্রব্য শিল্পের খ্যাতি ছিল। বিজয়নগরের প্রধান শিল্পগুলির মধ্যে সূতাকাটা ও বস্ত্রবয়ন শিল্প অন্যতম প্রধান শিল্প ছিল। তন্তুবায় সংঘ স্থানীয় বাণিজ্যে আন্তরিকতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করত।
বাণিজ্য কেন্দ্র ও বন্দর
বিজয়নগর রাজ্যে অন্তত আশিটি বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল এবং ৩০০টি বন্দর ছিল বলে আবদুর রাজ্জাক বলেছেন। রাজ্যের বিভিন্ন বন্দর থেকে নানা ধরনের সূক্ষ্মবস্ত্রের রপ্তানির কথা সমকালীন তথ্য ও লিপি থেকে জানা যায়। প্রধান বন্দরগুলি থেকে বৈদেশিক বাণিজ্য চলত। বিজয়নগরকে কেন্দ্র করে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য চলত।
কারিগর ও বণিক সংঘ
- (১) ধাতুশিল্প ও অলঙ্কারের নির্মাণশৈলী চরম উৎকর্ষে পৌঁছেছিল। লৌহশিল্প অস্ত্রনির্মাণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। লবণ সরকারি নিয়ন্ত্রণে উৎপাদন হত। বস্ত্রশিল্প, খনিজশিল্প ও ধাতুশিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত ক্ষুদ্র শিল্পগুলির মধ্যে সুগন্ধ শিল্পের খুবই গুরুত্ব ছিল এবং অনেক কারখানা গড়ে উঠেছিল।
- (২) কর্মকার, ছুতার প্রভৃতির কাজও লোকে করত। শিল্প ও কারিগরি কার্যকলাপ জাতি ও বর্ণের এবং সংঘের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল এবং সমবায়ের মাধ্যমে কাজ চলত। ফলে কারিগর ও বণিক সংঘগুলি অর্থনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
রাস্তাঘাট
বিজয়নগরের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যবস্থার বিস্তারিত পরিচয় না পাওয়া গেলেও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে জলপথের ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায় না। সড়কগুলি চওড়া না হওয়ায় যানবাহন চলাচলের অসুবিধা ঘটত। রাস্তাঘাট নিরাপদ ছিল না। অনেক সময়েই রাহাজানি ও ডাকাতি হত।
রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা বজায়
বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্যে সুলতানি শাসনকালে তাঁরা যে কঠোর হাতে শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপন করেছিলেন তা পর্তুগিজ ও অন্যান্য বৈদেশিক তথ্য থেকে জানা যায়। এই তথ্যগুলি সবই ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর আলোকসম্পাত করে। শাসকগোষ্ঠী বণিক ও বাণিজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা করত।
আভ্যন্তরীন বাণিজ্যের দ্রব্য
অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের মধ্যে প্রধান উৎপন্ন পণ্য ছিল খাদ্যশস্য, সবজি, লবণ, ফল, চিনি, তৈলবীজ, তুলো, সুতো, বস্ত্র, চট ও নানা ধরনের ধাতব দ্রব্য।
বৈদেশিক বাণিজ্যের রপ্তানি দ্রব্য
বিজয়নগরের বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রধান রপ্তানি দ্রব্য ছিল কাপড়, বহু ধরনের বস্ত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল Tzinde, Patta, Katuynen, Dragon, Sallalo, Bastan, Kassa, Kreyakam Kanteky এবং আরও নানা ধরনের বস্ত্র, চাল, লোহা, গন্ধক, চিনি, মশলা প্রভৃতি।
আমদানি দ্রব্য
- (১) বাণিজ্যের ফলেই বিজয়নগরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যে ঘটেছিল তা সব বৈদেশিক তথ্য থেকেই পাওয়া যায়। আরবি ঘোড়া, প্রবাল, মুক্তা, তামা, পলা, পারদ, চীনা রেশম ও ভেলভেট, মূল্যবান ধাতু, বিভিন্ন উৎপাদিত দ্রব্য এবং লাক্সারি দ্রব্যের বিজয়নগরে চাহিদা ছিল ব্যাপক।
- (২) মূল্যবান ধাতুর মধ্যে সব থেকে প্রয়োজন ছিল সোনা ও রূপার। কারণ মুদ্রা প্রস্তুত করার কাজে এই অষ্ট ধাতু ব্যবহৃত হত। সোনা ও রূপা আসত প্রধানত আফ্রিকার উপকূল ও চীন থেকে। মশলা ও ঔষধপত্র আসত মালাক্কা, বর্নিও, সুমাত্রা ও সিংহল থেকে। আফিং আসত চীন থেকে।
- (৩) বিজয়নগরে আমদানিকৃত প্রাণীর মধ্যে হাতি আসত সিংহল ও পেগু থেকে এবং ঘোড়া আহত আরব ও অরমুজ থেকে। লাক্সারি দ্রব্যের মধ্যে মূল্যবান পাথর আসত সিংহল, পেগু ও অরমুজ থেকে।
সমুদ্রপথে বাণিজ্য
দক্ষিণ ভারতে বৈদেশিক দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যে সমৃদ্ধি ঘটেছিল এবং এই বাণিজ্য একমাত্র সমুদ্রপথে চলত। প্রত্যক্ষভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যে কোনো স্থলপথ ছিল না। অভ্যন্তরীণ উপকূলবর্তী ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ফলে বিজয়নগরের সঙ্গে বঙ্গদেশের লেনদেন ছিল।
পোতাশ্রয়
সমুদ্রপথে মালাবার উপকূলে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর-শহর ছিল কালিকট। আফ্রিকা ও আরব দেশগুলির পক্ষে এটি ছিল নিরাপদ পোতাশ্রয়। আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পোতাশ্রয়ের নাম পাওয়া যায়। যথা – মিরজান, হোনাভার, ভাতকল, বারকর, ম্যাঙ্গালোর এবং কুম্বলা।
বাণিজ্যিক সম্পর্ক
বিজয়নগরের অধীনে ভারত মহাসাগরের দ্বীপসমূহ, মালয় দ্বীপপুঞ্জ, ব্রহ্মদেশ, চীন, আরবদেশ, পারস্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, আবিসিনিয়া ও পর্তুগাল প্রভৃতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।
পণ্য পরিবহন
- (১) সাধারণত অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গোরুর গাড়িতে, মাথা মুটে, পশুদের পিঠে পণ্য চলাচলের রীতি ছিল। উপকূলবর্তী বাণিজ্য বা সমুদ্রপারের দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক পণ্যের জাহাজে লেনদেন করা হত। বারবোসা লিখেছেন, দক্ষিণ ভারতের জন্য মালদ্বীপে জাহাজ নির্মাণের ব্যবস্থা ছিল।
- (২) বিজয়নগরের রাজারা যে বিশাল নৌবহর রাখতেন তা সমকালীন লিপি থেকে প্রমাণিত হয়। এই রাজ্যের অধিবাসীরা পর্তুগিজদের আগমনের পূর্বে জাহাজ নির্মাণে দক্ষ ছিল। তবে বিজয়নগরের অধিবাসী কীভাবে সামুদ্রিক পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা করত সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।
গোয়া বাণিজ্য কেন্দ্র
- (১) বারবোসা লিখেছেন তিনি যখন গোয়া গিয়েছিলেন তখন সেখানে অধিকাংশ অধিবাসী ছিলেন মুর সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা অধিকাংশ বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছিল। তখন গোয়া বিদরের শাসক বারিদ শাহের অধীন ছিল। গোয়া যখন পর্তুগিজদের অধীনস্থ হয় তখন থেকে এটি বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়।
- (২) বারবোসার মতে পোতাশ্রয় হিসাবেও গোয়া ছিল খুবই ভালো। গোয়ার এই বাণিজ্য থেকে শাসকবর্গ অনেক রাজস্ব পেত। গোয়া শহরটি ছিল সাজানো। গোয়াতে সবজি ও ফলের বাগান, সুন্দর গাছ ও মিষ্টি জলের পুকুর ছিল।
- (৩) ভালো জাতের আরবি ঘোড়া গোয়ার মাধ্যমেই বিজয়নগরে আমদানি করা হত। অরমুজ থেকে প্রতি বছর অনেক জাহাজে করে গোয়ায় ঘোড়া আসত এবং এগুলি বিজয়নগরের ও দক্ষিণের অন্যান্য বণিকগণ ক্রয় করতেন।
- (৪) আবার গোয়া থেকে এই জাহাজগুলি অরমুজে ফিরে যাওয়ার সময় প্রচুর পরিমাণ চাল, চিনি, লোহা, গোলমরিচ, আদা, বিভিন্ন ধরনের মশলা ও ঔষধপত্র বহন করে নিয়ে যেত। মক্কা ও এডেন থেকেও জাহাজ গোয়ায় আসত। গোয়ার উপকূল বাণিজ্যে মালাবার, চাউল, দাভোল এবং ক্যাম্বে থেকে জাহাজ আসত এবং পণ্য লেনদেনের কাজ করত।
মিরজান বন্দর
মিরজান ছিল প্রথম বন্দর এবং এটি মিরজান নদীর তীরে অবস্থিত ছিল বারবোসা একে Tolinate বলেছেন। মালাবার থেকে ‘জাঙ্গুকুয়ো’ নামে এক শ্রেণীর নৌকা করে নারকেল, নারকেল তেল ও গুড় প্রচুর পরিমাণে আসত এবং ফিরে যাওয়ার সময় নিয়ে যেত চাল।
হোনাভার বন্দর
হোনাভার শব্দের অর্থ ‘a golden village’ বা একটি সোনার গ্রাম। সরাবতী নদীর তীরে এই শহর অবস্থিত। হোনাভার বন্দর মালাবারের সঙ্গে ব্যবসা করত নারকেল, নারকেল তেল, তালরসের চিনি এবং তালরস থেকে উৎপন্ন মদ বা তাড়ি এবং ব্লাক রাইস-এর লেনদেন করত।
ভাতকল বন্দর শহর
- (১) ভাতকল (Bhatkal) ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর। বার্থেনা এটিকে ‘Bathacala’ বলে উল্লেখ করেছেন। এটিকে বলেছেন ভারতের ‘noble city’। এই শহরটি ছিল অত্যন্ত সুন্দর এবং সমুদ্র হতে এক মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। রাজা নরসিংহের অধীন ছিল।
- (২) কিন্তু আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের সময় এই বন্দরের খ্যাতি ও গৌরব ম্লান হয়ে গিয়েছিল। ভাতকল-এর শেষ দশা দেখেও হ্যামিলটন লিখেছেন এই শহর ছিল উন্মুক্ত ও বৃহৎ।
- (৩) পর্যটকরা যখন এই শহর পরিদর্শন করতেন তারা দেখেছিলেন অতীতের গৌরবের কিছুই নেই, শুধুমাত্র দশ-এগারোটি ছোটো মন্দির তামা ও পাথরে মোড়া আছে।
বাসরুর
- (১) বিজয়নগরে আর একটি শহর গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছিল সেটি হল বাসরুর। এই শহরটি অবস্থিত ছিল অতীতের কুন্দপুর নদীর তীরে। মিশর ও আরবের সঙ্গে যারা ব্যবসা চালাত সেই বণিকগণ এই বন্দর শহরটিতে অবস্থান করত।
- (২) এখানে ডাচরা একটা কারখানা তৈরি করেছিল মালাবার উপকূলে চাল জোগানের উদ্দেশ্যে। বাসরুর শহরটি দুভাগে বিভক্ত ছিল – আপার বাসরুর ও লোয়ার বাসরুর। শহরটি সুন্দর এবং সোজা বড়ো চওড়া রাস্তা এবং রাস্তার দুইধারে সারিবদ্ধ গাছ দাঁড়িয়ে আছে।
- (৩) বাসরুর শহর থেকে উচ্চমানের পরিষ্কার তৈরি চাল ব্যাপক পরিমাণে মালাবার, অরমুজ, এডেন, ক্যালানোর এবং কালিকটে রপ্তানি করা হত এবং তামা, নারকেল ও গুড় আমদানি করা হত।
ম্যাঙ্গালোর
আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের মতে ম্যাঙ্গালোর ছিল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহত্তম বাণিজ্যকেন্দ্র। যদিও সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে তার বাণিজ্যিক গুরুত্ব হারিয়েছিল। আবদুর রাজ্জাক দেখেছেন ম্যাঙ্গালোরে ছিল একটি সেনাঘাঁটি। ম্যাঙ্গালোর থেকে এডেন ও মালাবার উপকূলে প্রধান রপ্তানি দ্রব্য ছিল ‘ব্ল্যাক রাইস’ ও গোলমরিচ।
মালাবার গোষ্ঠী
- (১) মালাবার গোষ্ঠীতে সব থেকে বেশি সংখ্যায় বন্দর শহর ছিল। এই বন্দরগুলি দিয়েই সব থেকে বেশি পণ্যদ্রব্য আমদানি-রপ্তানি হত। মালাবার গোষ্ঠীর প্রধান বন্দর ছিল কোচিন। আফ্রিকা, ইউরোপ, আরব, পারস্য, সিংহল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মত এই ছটি বিদেশি বাজারের সঙ্গে বাণিজ্য চলত।
- (২) মালাবার গোষ্ঠীর প্রধান বন্দরগুলি ছিল ক্যাননানোর, ধর্মপত্তনম, কালিকট, কোচিন, ক্যোঙ্কলাম (Kayamkulam) এবং কুইলন। ক্যাননানোর বা কাননানুর অথবা কানন্দর ছিল গুরুত্বপূর্ণ বন্দর।
- (৩) এই বন্দরের বণিকরা ছিল ধনী ও নিজেদের জাহাজ ছিল। তারা দাভোল, চাউল, গোয়া, করমণ্ডল উপকূল, সিংহল, মালদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ, বান্দা প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করত।
কালিকট বন্দর
- (১) দক্ষিণে সবথেকে বিখ্যাত বন্দর ছিল কালিকট। ভাস্কো-দা-গামার নেতৃত্বে পর্তুগিজরা প্রথম এই কালিকটেই এসেছিল। জামোরিন ছিলেন তখন কালিকট রাজ্যের শাসক। চীন, জাভা, সিংহল, মালদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ এবং ইয়েমেন থেকে জাহাজ আসত।
- (২) প্রত্যেক বছর কালিকটের বণিকরা লোহিত সাগরের উপর দিয়ে এডেন, মক্কা এবং জিদ্দায় দশ-পনেরোটি জাহাজে করে গোলমরিচ, আদা, দারুচিনি, এলাচ, হরীতকী, তেঁতুল, বিভিন্ন রকমের মূল্যবান পাথর, সুগন্ধী দ্রব্য, তিমি মাছের অন্ত্রজাত সুগন্ধী দ্রব্য, রেউচিনি গাছ, ঘৃতকুমারী ও পোর্সেলিন রপ্তানি করত।
- (৩) বণিকগণ এই দ্রব্যগুলির মধ্যে থেকে কিছু দ্রব্য টরো, কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া এবং ভেনিস-এর মাধ্যমে ইউরোপের বাজারে নিয়ে যেত। আবার যখন কালিকটের জাহাজগুলি ফিরে আসত তখন তামা, সোনা, রূপা, সিঁদুর, গোলাপজল, রঙিন ভেলভেট, ছুরি, জাফরাং এবং আরও অন্যান্য বহু দ্রব্য নিয়ে আসত।
বারবোসার উক্তি
বারবোসা বলেছেন এই বৈদেশিক বাণিজ্য বণিকদের অত্যন্ত ধনাঢ্য করেছিল। বৈদেশিক বণিকগণও এইসব জাহাজ যখন ভারতে প্রত্যাবর্তন করত তাদের সঙ্গী হত এবং তারা ভারতে এসে জাহাজ নির্মাণের কাজে এবং বাণিজ্যের জন্য এখানে বসবাস করত। এদেশের রাজা তাদের নিরাপত্তার জন্য দেহরক্ষী নিযুক্ত করতেন এবং হিসাবপত্র রক্ষার জন্য করণিক নিযুক্ত করতেন।
নিকোলো কন্টির উক্তি
নিকোলো কন্টি ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে বলেছেন যে কালিকট বন্দর ছিল “a noble emporium for all India and abounded in pepper. ginger, cinnamon. myrobalans and zedoary “
রাজ্জাকের মন্তব্য
আবদুর রাজ্জাক বলেছেন যে বিভিন্ন দেশের বণিকগণ কালিকটে প্রায়ই সমবেত হতেন। এই বিদেশি বণিকদের নিকট হতে ২.৫% বাণিজ্য শুল্ক আদায় করা হত। নিকিতিন বলেছেন যে “Calicot (Calicut) was a port for the whole Indian sea.”
কোচিন
- (১) এরপরই বন্দর হিসাবে গুরুত্ব অর্জন করেছিল কোচিন। মা-হুয়ানের বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি যে চীনের সঙ্গে সিল্কের বাণিজ্যে কোচিন অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়েছিল। পর্তুগিজদের কোচিনে একটি সুন্দর দুর্গ ছিল এবং এখানে জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত হত।
- (২) এখানে প্রচুর গোলমরিচ ও অন্যান্য মশলা উৎপাদন হত এবং ঔষধপত্র মালাক্কা হতে এখানে পৌঁছাত। সেগুলি পর্তুগিজরা জাহাজে করে প্রতি বছর পর্তুগালে পাঠাত।
কুরআন
- (১) মালাবার অঞ্চলে কুইলন ছিল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বন্দর। এখান থেকে চীনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য চলত। এই বন্দর চীনা দ্রব্যের আমদানি-রপ্তানির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। চীনা বণিকগণ তাদের দ্রব্য সম্ভার পশ্চিমে নিয়ে যাওয়ার সময় কুইলনকে তাদের বিশ্রামস্থল হিসাবে ব্যবহার করত।
- (২) এখানকার মুর ও হিন্দু অধিবাসীরা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ব্যবসায়ী ছিল এবং তাদের নিজেদের যান ছিল। তারা বিভিন্ন ধরনের দ্রব্য সিংহল, করমণ্ডল উপকূল, বেঙ্গালা, মালাক্কা, সুমাত্রা ও পেগুতে রপ্তানি করত কিন্তু ক্যাম্বেতে নয়। গোলমরিচ ছিল এই বাণিজ্যের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য এবং কুইলন ছিল বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র।
মালাবার অঞ্চলের বন্দর
- (১) মালাবার অঞ্চলে বা করমণ্ডল উপকূলে আরও কয়েকটি বন্দর ছিল। যথা – কয়াল, নেগাপতম, মৈলাপুর এবং পুলিকট। এই বন্দরগুলির প্রধান বিদেশি বাজার ছিল সিংহল, পেগু, মালাক্কা, সুমাত্রা এবং চীন।
- (২) কয়াল এই সময়ে বিজয়নগরের অধীন ছিল না। বারবোসার তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র মৈলপুর ও পুলিকট বিজয়নগর রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল। মৈলপুর আদিমধ্য যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল। পুলিকট শুধুমাত্র সমুদ্র বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল না, স্থলপথে বহু বণিক পুলিকটের বাজারে আসতেন।
- (৩) পেগু থেকে বিরাট পরিমাণ রুপো, মৃগনাভি ও সুগন্ধী দ্রব্য পুলিকটে রপ্তানি করা হত এবং এগুলি এখানে খুবই সস্তা ছিল। পুলিকটে প্রচুর পরিমাণ ছাপা কাপড় উৎপাদন হত এবং মালাক্কা, পেগু, সুমাত্রা, মালাবার এবং গুজরাটে রপ্তানি করা হত।
মোতুপল্লি ও মসুলিপত্তম
তেলেঙ্গানা অঞ্চলে মোতুপল্লি এবং মসুলি পত্তনম এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল। মোতুপল্লির রাজা বণিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল। ১২৪৫ খ্রিস্টাব্দে কাকতীয়রাজ গণপতিদেব এবং অন্নপোতা রেড্ডি ‘abhaya-sasana’ নামে এক সনদে সামুদ্রিক বণিকদের নিরাপত্তা ও তাদের প্রতি সহানুভূতির আশ্বাস মঞ্জুর করেছিলেন। মোতুপল্লি এবং মসুলিপত্তম বন্দর দুটি বিখ্যাত ছিল হিরের জন্য এবং বড়ো আকারের মণি মুক্তার জন্য।
দক্ষিণ ভারতের প্রাণকেন্দ্র বিজয়নগর
স্বভাবতই দেখা যায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে বিজয়নগর দক্ষিণ ভারতের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। বিজয়নগরের যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও গৌরবের কাহিনি বিভিন্ন বিদেশি পর্যটকদের বিবরণে পাওয়া যায় তা এই অনুকূল বৈদেশিক বাণিজ্যই সমৃদ্ধ করেছিল।
উপসংহার :- বিজয়নগর তার অতীত যুগে রোম-ভারত বাণিজ্যেও অংশগ্রহণ করেছিল এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক গৌরবময় শিখরে আরোহণ করেছিল। বিজয়নগরের বাণিজ্যিক ধারা সমগ্র বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল।
(FAQ) বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বিজয়নগর সাম্রাজ্য।
কালিকট।
কালিকট।
জামোরিন।