জরাথুস্ট্র

প্রাচীন পারস্যের এক মহান আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক ও দার্শনিক ছিলেন জরাথুস্ট্র (Zarathustra), যিনি জোরোস্টার নামেও পরিচিত। তিনি জোরোস্ট্রিয়ান ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, যা বিশ্বের প্রাচীনতম মজবুত ধর্মীয় বিশ্বাসগুলির মধ্যে একটি। জরাথুস্ট্র “আহুরা মজদা” বা এক ঈশ্বরের ধারণা প্রচার করেন এবং নৈতিকতা, সত্য ও আলোকে জীবনধারণের শিক্ষা দেন। তাঁর মূল শিক্ষা ছিল শুভ চিন্তা, শুভ কথা এবং শুভ কর্ম। তাঁর জীবন ও দর্শন “আভেস্তা” নামে পবিত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ।

জরাথুস্ট্র

ঐতিহাসিক মনীষীজরাথুস্ট্র
জন্মআনুমানিক ১৫০০-১০০০ খ্রি. পূ.
জন্মস্থানপ্রাচীন পারস্য (বর্তমান ইরানের কোনো অঞ্চল)
ধর্মজেরোস্ট্রিয়ানিজম
দর্শনএকেশ্বরবাদ (আহুর মাজদা), শুভ চিন্তা, শুভ কথা, শুভ কর্ম
মূল শিক্ষানৈতিকতা, সত্যবাদিতা, দায়িত্বশীল জীবন ও অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর জয়
প্রভাবপারস্য সভ্যতা ও পরবর্তীকালের বিভিন্ন ধর্ম
পবিত্র গ্রন্থজেন্দ আবেস্তা

জরাথুস্ট্র

ভূমিকা :- পৃথিবীর ধর্মপ্রবর্তকদের মধ্যে মহাপুরুষ জরাথুস্ট্র অন্যতম। সৎচিন্তা, সৎবাক্য, সৎকর্মভিত্তিক যে ধর্মমত তিনি প্রচার করেছিলেন আসলে তা ছিল এক প্রাচীনতর ধর্মবিশ্বাসের সংস্কৃত রূপ। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন একজন মহান ধর্মসংস্কারক, কবি ও দার্শনিক।

জরাথুস্ট্রের আবির্ভাব

খ্রিস্টের জন্মের প্রায় আটশ বছর পূর্বে আবির্ভূত হয়েছিলেন জরাথুস্ট্র। এই হিসাবে আমাদের বুদ্ধদেব-এরও কিছুকাল আগে তিনি জন্মেছিলেন।

মনীষী জরাথুস্ট্রের পরিবার

তাঁর জীবনকাহিনী ও বংশ পরিচয় সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে অনেকেই মনে করেন বর্তমান ইরানের এক রাজবংশে জরাথুস্ট্র জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম পৌরুশসপ এবং মাতার নাম দুঘধোবা দেবী।

জরাথুস্ট্রের জন্ম সম্পর্কে দিব্যকাহিনী

প্রাচীন ধর্মগুরুদের অনেকেরই জন্মের সঙ্গে অলৌকিক কাহিনী জড়িত থাকতে দেখা যায়। জরাথুস্ট্রের জন্ম সম্বন্ধেও অনেক দিব্যকাহিনী শোনা যায়। তাঁর আবির্ভাবকালে সমগ্র দেশে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে মূলে সজ্জিত হয়েছিল চতুর্দিক। দেশত্যাগ করে পাপাত্মারা পলায়ন করেছিল। সেই আনন্দময় পরিবেশে দিব্যবিভামন্ডিত স্বর্ণকান্তি শিশু জরাথুস্ট্র আবির্ভূত হয়েছিলেন।

মনীষী জরাথুস্ট্রের নামকরণ

স্বর্ণময় কান্তি ছিল বলেই তাঁর নাম হয়েছিল জরাথুস্ট্র। এই শব্দটির এক অর্থ স্বর্ণকান্তি। অপর অর্থ সত্যনিষ্ঠ। বস্তুতঃ নামকরণের মধ্যেই তাঁর পরিচয়ের প্রকাশ ঘটেছিল, উভয় অর্থেই তিনি ছিলেন সার্থকনামা।

জরাথুস্ট্রের শিক্ষা

তাঁর শৈশবের তথ্য সম্বন্ধে জানা যায়, সাত বছর বয়স হলে তাঁর পিতা তাঁকে একজন সুযোগ্য শিক্ষকের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। জরাথুস্ট্র ছিলেন অসাধারণ মেধাবী ও জ্ঞানপিপাসু। সুযোগ্য শিক্ষকের শিক্ষায় ও নিজের মেধা ও নিষ্ঠার বলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি নানা বিষয়ে জ্ঞানলাভ করতে সমর্থ হন। পনের বছর বয়সে তাঁর উপনয়ন সম্পন্ন হয়।

মনীষী জরাথুস্ট্রের কৈশোরের গুণ

কৈশোরকালেই জরাথুস্ট্রের মধ্যে কতগুলি বিশেষ গুণ প্রকাশ পায়। রাজবংশে জন্মেও ভোগৈশ্বর্যের প্রতি ছিল তাঁর সহজাত বিরাগ। ধর্মের প্রতি ছিল প্রবল অনুরাগ তেমনি সকলের প্রতি, এমন কি মনুষ্যেতর পশুপাখির প্রতিও তাঁর ছিল গভীর মমত্ববোধ। অনেক সময়েই দেখা যেত, নিজের খাবার তিনি উপবাসী মানুষের সঙ্গে ভাগ করে খাচ্ছেন। সত্যের প্রতি ছিল তাঁর অন্তরের গভীর আকর্ষণ। যা সত্য বলে জানতেন, তা বলতে বা করতে কখনও দ্বিধা বোধ করতেন না।

ব্যথিত কিশোর জরাথুস্ট্র

তাঁর সময়ে ইরানের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা ছিল কুসংস্কার ও নানা অনাচারে পূর্ণ। ধর্মের নামে অনুষ্ঠিত হত বহু অসৎকর্ম। দরিদ্র দুঃখী মানুষের জন্য সমাজের অর্থশালী ও সম্ভ্রান্ত মানুষদের সহানুভূতি ও বেদনাবোধ ছিল না। দুর্বল নিপীড়িত হত সবলের হাতে। সমাজের এই সকল দুর্নীতিও দুরবস্থা দেখে ব্যথিত হতেন কিশোর জরাথুস্ট্র। মানুষের দুঃখ দূর করার উপায় চিন্তা করে তিনি অধীর হয়ে উঠতেন।

ধর্ম প্রবর্তক জরাথুস্ট্রের সংসার বন্ধন

জানা যায়, তিরিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি সংসার বন্ধনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে নিজের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল হবোরি। স্ত্রীর গর্ভে তিনটি পুত্র ও তিনটি কন্যা লাভ করেছিলেন তিনি।

মনীষী জরাথুস্ট্রের গৃহত্যাগ

জগৎ ও জীবনের রহস্য জানার তীর আগ্রহে ক্রমশই তাঁর মধ্যে ঈশ্বর চিন্তা গভীর হয়ে উঠতে থাকে। ত্রিশ বৎসর বয়সে ঈশ্বর লাভের জন্য তিনি গৃহত্যাগ করে সাবাতন নামে পর্বতের গুহায় আশ্রয় নিলেন।

জরাথুস্ট্রের কঠোর তপস্যা

এই সময় দিন রাত্রি তিনি গভীর ধ্যানে অতিবাহিত করতেন। আহার করতেন গাছের ফল, কন্দ। এই ভাবে দিন মাস বছর অতিক্রান্ত হয়ে চলল। ধীরে ধীরে তিনি স্বীয় হৃদয়ে এক পরম শক্তির উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করলেন। দীর্ঘ দশ বছরের কঠোর তপস্যার পরে এক দিব্য ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি পরম শক্তির দর্শন লাভ করলেন।

দিব্যমূর্তি দর্শন লাভে সক্ষম জরাথুস্ট্র

একদিন, পাহাড়ের গুহায় ধ্যানভঙ্গ হলে এক দিব্য জ্যোতির প্রভায় চারদিক উদ্ভাসিত দেখতে পেলেন। সেই উজ্জ্বল প্রভার মধ্যে পরমেশ্বর আহুর মাজদার দিব্যমূর্তি দর্শন করে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। অতঃপর এক নতুন চেতনার উপলব্ধির মধ্যে তাঁর জ্ঞান ফিরে এল। অন্তরে অনুভব করলেন, মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করে সত্য ও ন্যায়ের পথে নিয়ে যাবার ঐকান্তিক প্রেরণা। এরপর তিনি আরও বহুবার আহুর মাজদার দর্শন লাভ করেছেন। লাভ করেছেন ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ-সত্যধর্ম প্রচারের দ্বারা লোকের কল্যাণসাধনের জন্যই তিনি নির্দিষ্ট।

লোকালয়ে জরাথুস্ট্র

প্রত্যাদেশ লাভের পর পর্বতের গুহা ত্যাগ করে তিনি নেমে এলেন লোকালয়ে। প্রথমে গেলেন আজারবাইজান। সেখান থেকে ভারতবর্ষ। পরমেশ্বর আহুর মাজদার কথা, ন্যায় ও সত্যের বাণী শোনাতে লাগলেন মানুষকে। কিন্তু কোনও জায়গাতেই মানুষ তাঁর কথা শুনতে চাইল না। উপহাস বিদ্রূপে জর্জরিত হতে হল তাঁকে। করুণাময় ঈশ্বরের প্রেরণা ও শক্তিতে উদ্বুদ্ধ জরাথুস্ট্র তাঁর এই পরাজয়ে নিরাশ হলেন না। তিনি একের পর এক দেশ পর্যটন করতে লাগলেন সত্যধর্মের বাণী নিয়ে।

ফরগনা রাজ্যে জরাথুস্ট্র

এক সময় তিনি উপস্থিত হলেন ফরগনা রাজ্যে। রাজা তাঁর সত্যধর্মের বাণী শুনলেন। কিন্তু পুরোহিতের পরামর্শে বিভ্রান্ত হলেন। জরাথুস্ট্রকে গোপনে হত্যার ষড়যন্ত্র হতে লাগল। কিন্তু ঈশ্বরের অনুগ্রহে এক অলৌকিক উপায়ে রক্ষা পেয়ে গেলেন তিনি। ফরগনা রাজ্য ত্যাগ করে আবার নামলেন পথে।

জরাথুস্ট্রের ব্যথিত হৃদয়

বহু ছোট বড় রাজ্য নগর অতিক্রম করলেন তিনি। কিন্তু অজ্ঞান মানুষ তাঁর উপদেশে কোথাও কর্ণপাত তো করলই না, কোথাও কোথাও নির্মম ভাবে লাঞ্ছিত হলেন। সকল লাঞ্ছনা নির্যাতন, ব্যর্থতাকে করুণাময় আহুর মাজদার পরীক্ষা বলেই মনে করলেন তিনি। মানুষের অজ্ঞতা দেখে তাদের প্রতি করুণায় ব্যথিত হল তাঁর হৃদয়।

পারস্যের সীমান্তে জরাথুস্ট্র

অবশেষে পারস্যের (ইরানের) সীমান্তে উপনীত হলেন জরাথুস্ট্র। সামনেই বিস্তীর্ণ নদী। নদী পার হবার জন্য কিছু মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। তিনি সকলকে ডেকে বললেন, আমার সঙ্গে এসো, আমি তোমাদের পরপারে পৌঁছে দেব। জরাথুস্ট্র নদীতে নামলেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুব্ধ স্রোত থমকে গেল। জল নেমে এলো হাঁটুর নিচে। স্বচ্ছন্দে নদী অতিক্রম করে ওপারে পৌঁছলেন তিনি, তাঁর সঙ্গে অন্য সকলে। অপরিচিত এই পুরুষের অলৌকিক শক্তির পরিচয় পেয়ে সকলে অভিভূত হল। বুঝতে পারল তিনি একজন ঐশীশক্তিসম্পন্ন সাধক। ভয়ে ভক্তিতে অনেকেই তাঁর অনুসরণ করে চলল।

জরাথুস্ট্রের প্রথম শিষ্য

দীর্ঘ দশ বছর নানা দেশ পরিভ্রমণ করে তিনি উপস্থিত হলেন ইরানের সীমান্তে এক জনহীন অরণ্যসঙ্কুল স্থানে। সেখানে সত্যলাভের উদ্দেশ্যে সাধনায় লিপ্ত ছিলেন তাঁর খুড়তুত ভাই মেধিওলা। তাঁর সেবায় নিয়োজিত ছিল অনুগামী ভক্তের দল। জরাথুস্ট্রের সত্য ধর্মের বাণী শুনে উদ্বুদ্ধ হলেন মেধিওলা। উপলব্ধি করলেন ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভে ধনা হয়েছেন জরাথুস্ট্র। তিনি দীক্ষা গ্রহণ করলেন তাঁর কাছে। মেধিওলাই হলেন জরাথুস্ট্রের প্রথম দীক্ষিত শিষ্য।

ইরানের রাজার কাছে জরাথুস্ট্র

সেই কালের ইরান ছিল পৌত্তলিক ধর্মের অনুগামী। জরাথুস্ট্র তাদের মধ্যে একেশ্বরবাদের কথা প্রচার করতে লাগলেন। সেই সময়ে ইরানে রাজত্ব করছিলেন গুস্তাস্প নামে এক রাজা। জরাথুস্ট্রের এক-ঈশ্বর ভিত্তিক সৎধর্মের বাণী তাঁকে আকৃষ্ট করল। ধর্ম বিষয়ে নানা প্রশ্নের উত্তরে জরাথুস্ট্রের দিব্যজ্ঞানের পরিচয় পেয়ে তিনি আকৃষ্ট হলেন।

বন্দী জরাথুস্ট্র

ইরানের রাজার পুরোহিত জাক নিজের প্রতিপত্তি হারাবার আশঙ্কায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। রাজাকে তিনি বোঝালেন, জরাথুস্ট্র একজন যাদুকর মাত্র। যাদুশক্তির প্রভাবে সে রাজাকে হত্যা করে রাজ্য দখল করতে চায়। পুরোহিতের প্ররোচনায় রাজা জরাথুস্ট্রকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই ঘটল এমন এক ঘটনা যার ফলে পুরোহিত জাকের সমস্ত ষড়যন্ত্রই বানচাল হয়ে গেল।

রাজার সামনে জরাথুস্ট্র

ইরানের রাজার প্রিয় ঘোড়া বেহজাদ সহসা একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ল। কী এক জটিল রোগে রাতারাতি তার পেছনের পা দুটি তলপেটের সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে লেগে গেছে। পশুশালার চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেও রোগ নির্ণয় করতে পারল না। প্রিয় ঘোড়াটি মরতে বসেছে বুঝতে পেরে রাজা খুবই বিচলিত ও দুঃখিত হলেন। এই সময় প্রহরী এসে তাঁকে সংবাদ দিল, বন্দি জরাথুস্ট্র একবার অসুস্থ ঘোড়াটাকে দেখতে চান। আশান্বিত হয়ে রাজা জরাথুস্ট্রকে তাঁর কাছে উপস্থিত করতে আদেশ দিলেন।

ইরানের রাজার নিকট জরাথুস্ট্রের শর্ত

রাজার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে জরাথুস্ট্র বললেন, মহারাজ, আমার চারটি শর্ত যদি আপনি পালন করেন তবে আমি আপনার ঘোড়াকে সুস্থ করে তুলব। রাজা শর্তগুলি জানতে চাইলে জরাথুস্ট্র বলেন, পুতুলপূজা ত্যাগ করে আপনাকে আমার ধর্মমত গ্রহণ করতে হবে। রাণীকেও এই ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়ত, খুব শীঘ্রই একটি যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে সেনাপতি হবে আপনার পুত্র আসফানদিয়ার। চতুর্থ শর্ত হল, আপনার অসাধু পরামর্শদাতাদের বিচার করে শাস্তি দিতে হবে।

সত্য পথের পথিক জরাথুস্ট্র

রাজা জরাথুস্ট্রের শর্ত স্বীকার করে নিলেন। তখন ঘোড়াটিকে সুস্থ করে তুলবার জন্য জরাথুস্ট্র সর্বশক্তিমান আহুর মাজদার নিকট প্রার্থনা জানালেন। তাঁর প্রার্থনা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই অসুস্থ ঘোড়াটি সুস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াল। অভিভূত রাজা গুস্তাস্প ও উপস্থিত সকলে অনুভব করলেন, জরাথুস্ট্র তাঁর দেবতা আহুর মাজদার শক্তিতে শক্তিমান এক মহান পুরুষ। তিনি যথার্থই সত্য পথের পথিক।

জরাথুস্ট্রের প্রচারিত মাজদা ধর্ম

এর পর রাজা ও রানী জরাথুস্ট্রের ধর্মমত গ্রহণ করলেন। রাজার প্রভাবে অল্পদিনের মধ্যেই একেশ্বরবাদী নতুন ধর্মমতের কথা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। দলে দলে লোক প্রচলিত পৌত্তলিক ধর্ম ত্যাগ করে জরাথুস্ট্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে লাগল। জরাথুস্ট্রের প্রচারিত ধর্মমতের নাম হল মাজদায়ামনি। সংক্ষেপে বলা হয় মাজদা ধর্ম। মাজদা শব্দের অর্থ হল এক ঈশ্বর। আর জরাথুস্ট্রের নির্দেশ হল আহুর মাজদাই হলেন একমাত্র ঈশ্বর। তিনি ছাড়া অন্য কোনো দেবতা উপাস্য নাই। তিনি সকলের সৃষ্টি ও রক্ষাকর্তা। একমাত্র মাজদার উপাসনাই মানুষের কর্তব্য।

জেন্দ আবেস্তা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ জরাথুস্ট্রের বাণী

  • (১) মহাত্মা জরাথ্রুস্ট অমরবাণী লিপিবদ্ধ হয়েছে জেন্দ আবেস্তা গ্রন্থে। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য ও সৎ কার্যের দ্বারা মানুষ চারিত্রিক শুচিতা লাভ করতে পারে। ক্রোধ ও প্রতিহিংসা আত্মার সৌন্দর্যকে কলুষিত করে। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর প্রতিও অন্যায় আচরণ করতে নেই।
  • (২) যারা অপরকে ভালবাসে, অপরের দুঃখ দূর করার চেষ্টা করে, তারা আছর মাজদার আশীর্বাদ লাভ করে। তাঁর কাছে সর্বদা সৎপথে চালিত করার জন্য প্রার্থনা করা উচিত। যারা নিয়মিত প্রার্থনা করে তারাই প্রকৃত উপাসক। ধনী দরিদ্র, ছোট বড় সকলের প্রতিই আমাদের কর্তব্য সমান ভাবে পালন করা উচিত।
  • (৩) এই মহৎ গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে, চন্দ্র, সূর্য, সমুদ্র, বায়ু-প্রভৃতির মধ্যে আহুর মাজদার মহিমার প্রকাশ। অগ্নি তাঁর জ্ঞান, জ্যোতি ও পবিত্রতার প্রতীক। তাই অগ্নির মাধ্যমে তাঁর উপাসনাই প্রশস্ত। কিন্তু অগ্নি নিজে উপাস্য নয়। মাজদা ধর্মের অনুসারী পার্সীগণ এই কারণে অগ্নির মাধ্যমেই জগৎপ্রভু সর্বশক্তিমান আহুর মাজদার উপাসনা করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে তারা অগ্নি উপাসক নন।
  • (৪) সমস্ত আবেস্তা গ্রন্থ জুড়ে রয়েছে জরাথুস্ট্রের বহু মূল্যবান উপদেশ ও আহুর মাজদার প্রশস্তি। আবেস্তা গ্রন্থে যে সকল ধর্মীয় স্তোত্র রয়েছে তার মধ্যে প্রথম পাঁচটি সংকলন করেছেন জরাথুস্ট্র নিজে। অবশিষ্টগুলি সংকলিত হয়েছে তাঁর শিষ্যদের দ্বারা।

রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা

ইরানের রাজা একেশ্বরবাদী মাজদা ধর্মে দীক্ষিত হবার ফলে একদিকে যেমন জনসাধারণ এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল তেমনি পৌত্তলিক জনসাধারণের একটা অংশ রাজার বিরোধী হয়ে উঠেছিল। এই বিরোধী গোষ্ঠীর প্ররোচনায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি বিরোধী হয়ে উঠল এবং কিছুদিনের মধ্যেই তারা যুদ্ধ ঘোষণা করে বসল।

তুরানের রাজার পলায়ন

শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে সাহস পেলেন না রাজা গুস্তাস্প। বিশেষ করে শক্তিশালী তুরানের রাজার প্রতাপ তাঁকে ভীত করে তুলেছিল। জরাথুস্ট্র রাজাকে সাহস দিয়ে বললেন, আহুর মাজদা স্বয়ং তাকে রক্ষা করবেন। তুরানের রাজা নিশ্চয় পরাজিত হবেন। রাজা গুস্তাস্প পূর্ব শর্ত মতো তাঁর পুত্রকে সেনাপতি করে যুদ্ধে পাঠালেন। রাজকুমারের বীরত্বে পর্যুদস্ত হল শত্রুবাহিনী। তুরানের রাজা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেল।

জরাথুস্ট্রের প্রতি মানুষের বিশ্বাস

কিছুদিন পরেই শক্তিসংগ্রহ করে তুরানের রাজা যুদ্ধ ঘোষণা করল। কিন্তু এবার গুস্তাস্পের বীর পুত্রের হাতে তাকে প্রাণ হারাতে হল। অন্য রাজারা যুদ্ধ করতে সাহস পেল না। এই ঘটনার পর জরাথুস্ট্রের প্রতি মানুষের বিশ্বাস বেড়ে গেল। তারা তাঁর উপদেশ শোনার জন্য ভিড় করতে লাগল।

দেশে দেশে ঘুরে জরাথুস্ট্রের ধর্মমত প্রচার

জরাথুস্ট্র দেশে দেশে ঘুরে তাঁর ধর্মমত প্রচার করতে লাগলেন। সেই কালে রাজাদের অধিকাংশই ছিলেন অত্যাচারী ও স্বার্থপর। সাধারণ মানুষের জীবন ছিল দুঃখ-কষ্টে ভরা। জরাথুস্ট্র তাদের শোনাতে লাগলেন কল্যাণের বাণী, জীবনে সুখী হবার উপায়। মানুষের কাছে গিয়ে তিনি বলতেন, সৎভাবে জীবন যাপন কর, অপরকে ভালবাসো। যারা অসৎকর্ম পরিত্যাগ করে সৎ আচরণ করে মৃত্যুর পর তারা অনন্ত সুখ লাভ করে।

ঈশ্বর সম্পর্কে জরাথুস্ট্রের মতামত

জরাথুস্ট্র কোনো দেবদেবী উপাসনার কথা বলেন নি। তাঁর মতে ঈশ্বর সমস্ত রূপের আধার, তাঁর কোন রূপ নেই। তিনি বলতেন, আহুর মাজদাকেই ঈশ্বর রূপে উপাসনা করবে। তাহলে সমস্ত বিপদ ও অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাবে। অগ্নি হচ্ছে প্রাণের প্রতীক। সমস্ত শক্তির উৎস। জরাথুস্ট্রের সাধনকালে অগ্নিই সর্বপ্রথম তাঁর সামনে আবির্ভূত হয়েছিল। তাই অগ্নিকে তিনি বলেছেন আহুর মাজদার পুত্র। কিন্তু অগ্নি উপাস্য নয়। তাঁর অনুগামীরা অগ্নিকে উপাসনার একটি মাধ্যম রূপে পবিত্র স্থানে প্রজ্জ্বলিত করে রাখে।

মানুষের কল্যাণে জরাথুস্ট্রের অবদান

কথিত আছে, জরাথুস্ট্র তাঁর তপস্যালব্ধ শক্তিবলে অসংখ্য মানুষের কল্যাণ সাধন করেছেন। বহু রোগক্লিষ্ট রোগারোগ্য লাভ করেছে, অন্ধ ব্যক্তি ফিরে পেয়েছে দৃষ্টিশক্তি। অনেক দুর্বিপাক থেকে দেশকে রক্ষা করেছেন তিনি। তাঁর শক্তিবলে গুস্তাস্প ক্রমশ ইরানের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নেন। সেই সঙ্গে নতুন নতুন অঞ্চলে জরাথুস্ট্র ধর্মমতও প্রচারিত হতে থাকে। ক্রমে সুদূর গ্রিস থেকে পূর্বভারতের প্রান্ত পর্যন্ত তাঁর ধর্মমত ছড়িয়ে পড়ে।

জরাথুস্ট্রের অনুগামী

জরাথুস্ট্রের অনুগামীদের বলা হয় পার্সী। বর্তমানে পার্সীদের সংখ্যা কমে এসেছে। কিছু সীমাবদ্ধ অঞ্চলে তারা বাস করে। ভারতবর্ষেও বহু পার্সি বসবাস করে।

জেন্দ আবেস্তা গ্রন্থের বাণী

  • (১) মহাত্মা জরাথুস্ট্রের অমরবাণী লিপিবদ্ধ হয়েছে যে পবিত্র গ্রন্থে তার নাম জেন্দ আবেস্তা। এই গ্রন্থে বহু অমূল্য উপদেশ রয়েছে। এই গ্রন্থ বলে, ক্রোধ ও প্রতিহিংসা আত্মাকে কলুষিত করে। পরের দুঃখ দূর করার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত শান্তি ও কল্যাণ।
  • (২) যে ব্যক্তি পরের দুঃখ দূর করে, সেই আহুর মাজদার প্রকৃত উপাসক। আত্মপ্রশংসা বিষবৎ পরিত্যজ্য। অন্যের নিকট আমরা যেরূপ ব্যবহার আশা করব, অন্যের প্রতি আমাদের ব্যবহারও সেই রকম করা উচিত। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও প্রতিবেশীদের সুশিক্ষাদান অবশ্য কর্তব্য।
  • (৩) এই গ্রন্থ আরও বলেছে, জগৎপিতা আহুর মাজদার মহিমা প্রকাশ করে সমুদ্র, চন্দ্র, সূর্য। এরা হল তাঁর উপাসনার প্রশস্ত মাধ্যম। অগ্নির মাধ্যমেও তিনি উপাস্য। পার্সী সমাজে হিন্দুদের মতো উপনয়ন-প্রথা প্রচলিত। নারী-পুরুষ উভয়েই উপনয়ন ধারণ করতে পারে।
  • (৪) মৃতদেহ সৎকার সম্বন্ধেও নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র সকলেরই সমান ব্যবস্থা। পার্সীরা মৃতদেহ পাহাড়ের ওপর অনাবৃত অবস্থায় রেখে দেয়। শকুনি প্রভৃতি মাংসভুক পাখি ওই মৃতদেহ খেয়ে নেয়। কোনো রূপ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের বিধান আবেস্তা সমর্থন করে নি।

বিবাহ ও ভিক্ষাবৃত্তি সম্পর্কে জরাথুস্ট্রের মত

জরাথ্রুস্ট নিজেই বিবাহ করেছিলেন। তাঁর মতে বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন। কিন্তু তিনি বহুবিবাহের নিন্দা করেছেন। পার্সী সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি হল অভিশাপ। ফলে এই সমাজ পরিনির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত।

মৃত্যু সম্পর্কে জরাথুস্ট্রের মত

জরাথুস্ট্রের মতে মৃত্যুতেই জীবনের শেষ নয়। মৃত্যুর পরেও আত্মার অস্তিত্ব থাকে। সৎ বা অসৎ কর্ম অনুসারেই মানুষের গতি হয়।

মনীষী জরাথুস্ট্রের মৃত্যু

প্রায় ৭৭ বছর বয়স পর্যন্ত পারস্যের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে তাঁর সত্য ধর্মমত প্রচারের পর এক পর্বতগুহায় জরাথুস্ট্র চিরসমাধি লাভ করেন।

উপসংহার :- পবিত্র জেন্দ আবেস্তা গ্রন্থে পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব লাভের সকল উপাদানই রয়েছে। পরবর্তী যুগের বহু ধর্মগুরু জরাথুস্ট্রের পথই অনুসরণ করেছেন। মধ্যযুগে মুসলমানদের আক্রমণে ও ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রসারের ফলে জরাথুস্ট্রের ধর্মের প্রভাব অনেক হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু কবি হাফিজ প্রমুখ বহু মুসলিম মনীষী জরাথুস্ট্রের ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে উচ্চ প্রশংসা করেছেন। ইউরোপ-এও বহু মনীষী জরাথুস্ট্র ও তাঁর মহান আদর্শের প্রভূত প্রশংসা করেছেন। মহান দার্শনিক প্লেটো জরাথুস্ট্রকে বলেছেন পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী মানুষ।

(FAQ) ধর্মগুরু জরাথুস্ট্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১। জরাথুস্ট্র কে ছিলেন?

জরাথুস্ট্র ছিলেন প্রাচীন পারস্যের আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক এবং জোরোস্ট্রিয়ান ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা।

২। জরাথুস্ট্রের ধর্মের মূল শিক্ষা কী?

জরাথুস্ট্রের ধর্মের মূল শিক্ষা হলো শুভ চিন্তা (Good Thoughts), শুভ কথা (Good Words), শুভ কর্ম (Good Deeds)।

৩। আহুরা মজদা কী?

আহুরা মজদা জোরোস্ট্রিয়ান ধর্মে প্রধান দেবতা, যিনি জ্ঞানের এবং সৃষ্টির ঈশ্বর।

৪। জরাথুস্ট্রের শিক্ষার প্রভাব কীভাবে দেখা যায়?

জরাথুস্ট্রের শিক্ষা পারস্য সভ্যতার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং পরবর্তীকালে ইহুদিধর্ম, খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম ধর্মের ওপরেও প্রভাব ফেলে।

৫। জেন্দ আবেস্তা কী?

জেন্দ আবেস্তা হলো জোরোস্ট্রিয়ান ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ, যেখানে ধর্মীয় আচার, প্রার্থনা ও দর্শন লিপিবদ্ধ আছে।

৬। জরাথুস্ট্রের জীবন সম্পর্কে কেন এত কম তথ্য পাওয়া যায়?

তাঁর জীবনের সময়কাল অত্যন্ত প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক নথি সংরক্ষণের অভাবের কারণে তাঁর জীবন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া কঠিন।

৭। জোরোস্ট্রিয়ানিজম আজ কোথায় প্রচলিত?

বর্তমানে জোরোস্ট্রিয়ান ধর্মের অনুসারীরা প্রধানত ইরান ও ভারতের পার্সি সম্প্রদায়ে বসবাস করেন। এছাড়াও, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছোট ছোট সম্প্রদায় হিসেবে তারা ছড়িয়ে আছে।

Leave a Comment