মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্ৰহণ প্রসঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে মধ্যবিত্ত রামমোহন রায়ের ভূমিকা, বিদ্যাসাগরের ভূমিকা, ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ ও মধ্যবিত্তদের পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্ৰহণের তাৎপর্য সম্পর্কে জানবো।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্ৰহণ
ঐতিহাসিক বিষয় | মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণ |
হিন্দু কলেজ | ১৮১৭ খ্রি |
আর্মহাস্ট কে চিঠি | রামমোহন রায় |
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় | ১৮৫৭ খ্রি |
হান্টার কমিশন | ১৮৮২ খ্রি |
ভূমিকা :- ঔপনিবেশিক আমলে ভারত-এ মধ্যবিত্ত শ্রেণি সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে এগিয়ে আসে। এদেশে প্রথম পর্বে খ্রিস্টান মিশনারি ও অন্যান্য বিদেশিদের উদ্যোগে পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং শহুরে বিভিন্ন প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা এই শিক্ষাগ্রহণে এগিয়ে আসে। পরবর্তীকালে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিভিন্ন মহানুভব ব্যক্তি পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে মধ্যবিত্ত রামমোহন রায়ের ভূমিকা
ভারতবাসীর মধ্যে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি মধ্যবিত্ত বাঙালি বুদ্ধিজীবী তথা অন্যতম যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল সংস্কারক রামমোহন রায়ের আন্তরিক অনুরাগ ছিল। এক্ষেত্রে তার ভূমিকা হল –
(১) হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা
রামমোহন কলকাতায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডেভিড হেয়ারকে যথেষ্ট সহায়তা করেন। অবশ্য ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় রামমোহনের কোনো ভূমিকা ছিল না বলেই মত প্রকাশ করেন।
(২) রামমোহনের চিঠি
১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে গঠিত কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’ বা ‘জনশিক্ষা কমিটি’র সদস্যরা কলকাতায় একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে রামমোহন রায় তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টকে একটি চিঠি লিখে সংস্কৃত শিক্ষার পরিবর্তে ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানান। রামমোহন রায়ের এই চিঠি ভারতের নবজাগরণ-এর ইতিহাসে একটি মূল্যবান দলিল।
পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে মধ্যবিত্ত বিদ্যাসাগরের ভূমিকা
ভারতীয়দের চিন্তার জন্য ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিদ্যাসাগর আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালে তিনি এই কলেজে ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করেন। তিনি সেখানকার পাঠক্রমে মিলের তর্কশাস্ত্র, পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদ এবং পাশ্চাত্যের গণিত শাস্ত্র প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করেন। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে তিনি বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।
অন্যান্য মধ্যবিত্তদের উদ্যোগ
বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি ইংরেজি সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। ডেভিড হেয়ার ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে বাঙালি বুদ্ধিজীবী বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, রামকমল সেন, রাধাকান্ত দেব প্রমুখ রক্ষণশীল বাঙালিরাও ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছিলেন। রামকমল সেন সংস্কৃত চর্চার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। নারীদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে রাধাকান্ত দেব যথেষ্ট উদ্যোগ নেন।
ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা
- (১) মধ্যবিত্তদের ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে মধ্যবিত্তদের মধ্যে পাশ্চাত্য ও ইংরেজি শিক্ষার আরও প্রসারের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
- (২) কিন্তু ইতিমধ্যে মধ্যবিত্তদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী পাশ্চাত্য ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও সেই হারে সরকারি চাকরি পায় নি। পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের উচ্চশিক্ষিতরা শিল্প, বাণিজ্য এবং দেশীয় রাজাদের কাজে নিযুক্ত হলেও পূর্ব ভারতে সে সুযোগ ছিল খুব কম।
- (৩) এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে হান্টার কমিশনের সুপারিশ অনুসারে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি অনুদান কমিয়ে দেয়। কিন্তু মধ্যবিত্তদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার বিপুল চাহিদা থাকায় বেসরকারি উদ্যোগে সারা ভারতে একাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ
ব্রিটিশ শাসনকালে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতে একটি স্বতন্ত্র সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দেশের মোট জনসংখ্যার বিচারে তারা অতি সামান্য অংশ হলেও প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার অধিকারী এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে খুবই তৎপর হয়ে ওঠে। যেমন –
(ক) পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ
- (১) ভারতে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশরা এদেশে আইন-আদালত ও অন্যান্য প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে শুরু করে। ইংরেজ বণিকরাও দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন করে। ব্রিটিশদের অফিস-আদালত, বাণিজ্য ঘাঁটি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি জানা বহু কর্মচারীর প্রয়োজন ছিল।
- (২) প্রথম পর্বে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং পরবর্তীকালে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মধ্যবিত্তরা চাকরি লাভের আশায় ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ব্রিটিশ সরকার ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করেন যে, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি জানা ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ফলে ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণের প্রতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির আগ্রহ যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
- (৩) ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সারা ভারতে ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়দের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫০ হাজার। সুমিত সরকার দেখিয়েছেন যে, ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ইংরেজি শিক্ষিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লক্ষ ৯৮ হাজার।
(খ) ব্রিটিশ সহযোগী
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রথমদিকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে সদর্থক দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় প্রমুখ। তারা কার্যক্ষেত্রে ব্রিটিশদের ‘সহযোগী’ শ্রেণি বা ‘collaborator’-এ পরিণত হয়। বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা নীলকরদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুললেও নীল বিদ্রোহকে কখনও সরকার-বিরোধী আন্দোলন হিসেবে দেখতে চান নি।
(গ) সামাজিক পরিবর্তন
পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে ব্রিটিশদের সঙ্গে বহু মধ্যবিত্তের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। এর মাধ্যমে বহু মধ্যবিত্তের সামাজিক উন্নতি ঘটেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, দ্বারকানাথ ঠাকুরের পরিবার নিম্নশ্রেণির ব্রাহ্মণ হওয়ায় সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এইসব পরিবার ব্রিটিশদের সঙ্গে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেছিল।
(ঘ) সরকারের কুনজর
- (১) ব্রিটিশ সরকার নিজেদের প্রশাসনিক কাজকর্মের স্বার্থেই ভারতীয় মধ্যবিত্তদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে। কিন্তু পরবর্তীকালে সরকার নিজেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সহ্য করতে পারত না। লর্ড কর্নওয়ালিশ মনে করতেন যে, প্রতিটি ভারতীয়ই দুর্নীতিগ্রস্ত।
- (২) বাঙালি মধ্যবিত্তদের প্রতি সরকারের কুনজর বেশি ছিল বলে তপন রায়চৌধুরী উল্লেখ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে করণিক পদে নিয়োগের জন্য দেওয়া বিজ্ঞাপনে বলা হয় যে, ‘বাঙালি বাবুরা আবেদন করবেন না।” মধ্যবিত্তদের প্রতি ঈর্ষা থেকে সরকার সরকারি উচ্চপদগুলি থেকে ভারতীয়দের দূরে সরিয়ে রাখে।
মধ্যবিত্তদের পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের তাৎপর্য
ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে আসার ফলাফল ও তাৎপর্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –
(১) পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রসার
মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণ করে পাশ্চাত্য সভ্যতা, জ্ঞানবিজ্ঞান, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবতাবাদ প্রভৃতি ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়। তাদের মাধ্যমে ভারতে এসব আদর্শের বিকাশ ঘটতে শুরু করে।
(২) যোগাযোগ ও ঐক্য স্থাপন
ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিকাশের ফলে এই ভাষার মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে যোগাযোগ ও ঐক্য গড়ে ওঠে। এর ফলে ইন্ডিয়ান লিগ এবং ভারত সভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের মতো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।
(৩) যুক্তিবাদী আন্দোলন
মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠলে তাদের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চেতনার বিকাশ ঘটে। এর ফলে বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তিবাদী সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
(৪) ভারতীয় নবজাগরণ
ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রভাবে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে ভারতীয়দের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটে। এই ঘটনাকে অনেকে ভারতীয় নবজাগরণ বলে অভিহিত করেছেন। এই নবজাগরণের সর্বাধিক প্রভাব পড়েছিল বাংলায়।
(৫) জাতীয়তাবাদী সাহিত্য
পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুরাগী মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাত ধরে বাংলা তথা ভারতে সাহিত্যের যথেষ্ট বিকাশ ঘটে এবং সাহিত্যে জাতীয়তার প্লাবন দেখা দেয়।।
(৬) জাতীয় আন্দোলন
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ক্রমে জাতীয়তাবাদের চেতনা শক্তিশালী হলে তারা ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জোয়ার আনে। এই উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী সভাসমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এ. আর. দেশাই এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আধুনিক ভারত গঠনের স্রষ্টা বলে অভিহিত করেছেন।
উপসংহার :- অবশ্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল ভারতের সমগ্র জনসংখ্যার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। ভারতে ইংরাজি ভাষা ও পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষা ব্রিটিশ শাসনকালে কখনোই গণশিক্ষায় পরিণত হয় নি।
(FAQ) মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্ৰহণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায়।
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে।